Samakal:
2025-11-02@15:18:33 GMT

৯৯ কিলোমিটারে চাঁদার ১২ ঘাট

Published: 22nd, March 2025 GMT

৯৯ কিলোমিটারে চাঁদার ১২ ঘাট

আওয়ামী লীগ আমলে প্রতি গাড়ির মাসিক টোকেন মূল্য ছিল ৭০০ টাকা। এখন তা বেড়ে ১ হাজার ৫০০ টাকা হয়েছে। ভাড়া নিয়ে এলে আগে স্ট্যান্ডপ্রতি নেওয়া হতো ১০ টাকা; এখন নিচ্ছে ২০ টাকা। এভাবে প্রতিদিন চাঁদা দিতে হচ্ছে ১২ পয়েন্টে। এ ছাড়া চালক সমিতি ও মালিক সমিতির নামে নেওয়া হচ্ছে আরও ১০ টাকা করে। এর বাইরে চাঁদা দিতে হয় হাইওয়ে ও কমিউনিটি পুলিশকেও; বকশিশ তো আছেই। সারাদিন পরিশ্রম করলেও পথে পথে চাঁদা দিয়ে দিন শেষে ঘরে নিতে পারি না আয়ের অর্ধেক। অটোরিকশাচালক খায়রুল আমিন এভাবেই তাঁর অসহায়ত্বের কথা বলেন সমকালের কাছে। তিনি গত ১০ বছর ধরে গাড়ি চালান চট্টগ্রামের অক্সিজেন-রাঙামাটি জাতীয় মহাসড়ক ও চান্দগাঁও-কাপ্তাই সড়কে। নগরীর সঙ্গে উত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য এলাকাকে সংযুক্ত করা এই দুটি সড়কের মোট দৈর্ঘ্য মাত্র ৯৯ কিলোমিটার। কিন্তু দুটি সড়কেই অন্তত ১২টি পয়েন্টে যানবাহন থেকে প্রতিদিন লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হয় বলে খবর পাওয়া গেছে। 

পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই দুই সড়কে অটোরিকশা শ্রমিক লীগের ব্যানারে চাঁদাবাজি ও টোকেন বাণিজ্য চলত। চাঁদার ভাগ পেত হাইওয়ে ও কমিউনিটি পুলিশ। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর মাস তিনেক বন্ধ ছিল চাঁদার অত্যাচার। কিন্তু এখন আবার শুরু হয়েছে চাঁদাবাজি। উল্টো বেড়েছে চাঁদার অঙ্ক। বর্তমানে নগর অটোরিকশাচালক সমিতি, রাউজান অটোরিকশাচালক সমিতি, রাঙ্গুনিয়া অটোরিকশাচালক সমিতি, লিচু বাগান অটোরিকশাচালক সমিতি, শাহ লতিফ অটোরিকশাচালক সমিতির নামে চাঁদার টোকেন বাণিজ্য হচ্ছে আন্তঃজেলা সড়কে। আলাদাভাবে চাঁদা দিতে হয় হাইওয়ে ও কমিউনিটি পুলিশকেও। ধরন ভিন্ন হলেও অটোরিকশার মতো চাঁদা গুনতে হয় বাস, ট্রাকসহ অন্যান্য যানবাহনকেও। তাদেরও মালিক এবং  চালকদের নামে রয়েছে পৃথক সমিতি।
চাঁদাবাজি বন্ধের দাবিতে বিক্ষুব্ধ অটোরিকশাচালকরা গত ৭ মার্চ কাপ্তাই সড়ক পথ অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। চাঁদাবাজদের টোকেন বাণিজ্য স্থায়ীভাবে বন্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনের কাছে দাবি জানান। পরে চাঁদাবাজি বন্ধে প্রশাসন ও  বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে আশ্বাস পেয়ে চালকরা অবরোধ তুলে নেন। কিন্তু পরদিনই ৮ মার্চ চালকদের কাছে আবার চাঁদা দাবি করে সমিতির নেতারা। তখন ফের চালকরা সড়ক অবরোধ করেন। এবারও পুলিশ এসে চাঁদাবাজদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের আশ্বাস দিলে অবরোধ তুলে নেওয়া হয়। তার পরও পরিস্থিতি পাল্টায়নি।  

চাঁদাবাজি বন্ধে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়কে অবরোধ  
চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়কটির দৈর্ঘ্য ৬৬ কিলোমিটার। এ সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে গত ১১ জানুয়ারি অবরোধ করেন অটোরিকশাচালকরা। তাদের অভিযোগ, ৫ আগস্টের পর আগের চাঁদাবাজরা পালিয়ে গেলে সড়কে মাস তিনেক চাঁদাবাজি বন্ধ ছিল। এখন আবার কমিউনিটি পুলিশ পরিচয়ে এবং অটোরিকশাচালক সংগঠনের নাম ব্যবহার করে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। এ নিয়ে চালকদের সঙ্গে চাঁদা আদায়কারীদের ধস্তাধস্তির ঘটনাও ঘটে। 

আগের চেয়ে দ্বিগুণ বেড়েছে কাপ্তাই সড়কের চাঁদা
চান্দগাঁও থেকে কাপ্তাই চন্দ্রঘোনা পর্যন্ত সড়কটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৩ কিলোমিটার। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানান, এখানে ছয়টি পয়েন্টে চাঁদা দিতে হয় বিভিন্ন ধরনের গাড়িকে। চান্দগাঁও, হাটহাজারীর নজুমিয়া হাট, রাউজানের নোয়াপাড়া, চুয়েট গেট, রাঙ্গুনিয়ার রোয়াজার হাট, লিচু বাগান স্ট্যান্ডে চাঁদা তোলা হয় মালিক ও চালক সমিতির নামে। আগে এই সমিতির নেতারা ছিলেন আওয়ামী লীগ ও শ্রমিক লীগের ছায়ায়। এখন তারা শ্রমিক দল ও বিএনপির নাম ভাঙিয়ে তৎপরতা চালাচ্ছে। এই রুটে বাস সার্ভিস কম থাকায় অটোরিকশায় চড়ে প্রতিদিন গন্তব্যে যেতে হয় মানুষকে। ব্যবহার করতে হয় চান্দগাঁওয়ের কাপ্তাই রাস্তার মাথা। কারণ চট্টগ্রাম জেলার নম্বরে নিবন্ধিত গাড়ি নগরীতে ঢোকায় বিধিনিষেধ আছে। মূলত একে অজুহাত হিসেবে সমানে এনে পুলিশ ও সমিতির নেতারা চাঁদাবাজি করছে। 

রাঙামাটি সড়কে চাঁদা দিতে হয় ছয় পয়েন্টে
চট্টগ্রাম নগর-রাঙামাটি মহাসড়কে ছয়টি স্থানে চাঁদার টোকেন বাণিজ্য চলছে। অক্সিজেন মোড়, নতুনপাড়া ট্যাক্সি স্ট্যান্ড (বিআরটিসি), হাটহাজারী ট্যাক্সি স্ট্যান্ড, জলিলনগর, রাউজান ট্যাক্সি স্ট্যান্ড ও রাঙামাটি বনরুপা ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে চলছে এই চাঁদাবাজি। অটোরিকশাচালক জানে আলম জানান, অতীতে চট্টগ্রাম জেলার নম্বরে নিবন্ধিত গাড়ি অক্সিজেন ও রাঙামাটির বনরুপা আসতে হলে মাসিক টোকেন মূল্য ছিল ৫০০ টাকা। প্রতি ভাড়ায় ১০ টাকা চাঁদা দিতে হতো আলাদাভাবে। বর্তমানে দিতে হয় মাসিক ১ হাজার ২০০ টাকা। প্রতি ভাড়ায় আবার ২০ টাকা করে দিতে হয় ছয়টি স্ট্যান্ডে। রাউজান ও হাটহাজারী পৌরসভার টোল আদায় করে ২০ টাকা করে মোট ৪০ টাকা। পাশাপাশি এ সড়কে সমিতির নামে গাড়িপ্রতি ২০ টাকা হারে চাঁদা আদায় করে জলিলনগর, হাটহাজারী ও নতুন পাড়া এলাকায়।  

চাঁদাবাজিতে জড়িত কারা 
কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকায় চাঁদাবাজির মূল হোতা রাঙ্গুনিয়া উপজেলার মোহাম্মদ হাসান নামে এক ব্যক্তি। তাঁর সঙ্গে আছে ২০ থেকে ২৫ জনের একটি গ্রুপ। অভিযোগ আছে, তাদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন স্থানীয় বিএনপি নেতারা। সড়কের রাউজান অংশের নোয়াপাড়, চুয়েট পাহাড়তলী, হাটহাজরী অংশে নজুমিয়া হাট ও রাঙ্গুনিয়া অংশে লিচু বাগান, রোয়াজার হাট এলাকায় চাঁদা আদায় করে হাসানের সহযোগীরা। কয়েকজন করে সিএনজি স্ট্যান্ডগুলোতে চাঁদা আদায় রসিদ হাতে তাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। চাঁদা আদায় প্রসঙ্গে হাসানের ফোন নম্বরে একাধিকবার কল করলেও তিনি সাড়া দেননি। অপরদিকে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়কে চাঁদা আদায় করা হয় সিএনজি চালক সমিতির নামে। এ কাজে সড়কে মাঠপর্যায়ে চাঁদা আদায় করতে দিকনির্দেশনা দিতে দেখা যায় মোহাম্মদ রফিক নামে একজনকে। তাঁর সঙ্গে আছে মেহেদী, রাজু, সালাহউদ্দিন, খোকন, বাবুল, রায়হান, রাশেদ। চাঁদা উত্তোলন প্রসঙ্গে মোহাম্মদ রফিক সমকালকে বলেন, আমারা মাসিক টোকেনে টাকা আদায় করি না। মাসিক টোকেনে চাঁদা আদায় করে হাইওয়ে পুলিশ। আমাদের সরকারি রেজিস্ট্রেশন করা চালক সমিতি রয়েছে। আমরা প্রতিদিন ১০ টাকা করে চাঁদা নিয়ে থাকি চালকদের কল্যাণে। সেই টাকা ব্যাংকে জমা হয়। মৃত্যুকালীন, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতদের পরিবারকে সহযোগিতা করা হয় এই জমাকৃত অর্থ দিয়ে। যদিও এই আপৎকালীন অর্থ সহায়তা এখন পর্যন্ত কোনো চালক পাননি বলে দাবি করেন রাউজান অটোরিকশাচালক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক তাজুল ইসলাম।

যা বলছে পুলিশ
রাউজান ও হাটহাজারী অংশের দায়িত্বরত হাইওয়ে পুলিশের এসআই ফখরুল আলম বলেন, ‘সড়কে আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিদিন গড়ে ১০-১২টি মামলা দিয়ে থাকি। হাইওয়ে পুলিশ পেশাদারিত্বকে গুরুত্ব দেয়। এখন টোকেন বাণিজ্য করার কোনো সুযোগ নেই কারও।’ 
রাউজান থানার ওসি মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, মহাসড়ক দেখভাল করে হাইওয়ে পুলিশ। চাঁদার ব্যাপারে তারাই ভালো বলতে পারবে। সড়কে চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে থানা পুলিশ কঠোর অবস্থানে রয়েছে। 
চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘৫ আগস্টের পর নতুন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি আমরা। এর পথে যারা বাধা হবে, তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। সড়ক কিংবা মহাসড়কে যারা নতুন করে চাঁদাবাজি করছে, তাদের তথ্য-উপাত্ত আমরা সংগ্রহ করেছি।’ 

 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: চ লকদ র ২০ ট ক ১০ ট ক হ ইওয় চ লকর অবর ধ ই সড়ক

এছাড়াও পড়ুন:

বিদ্যুৎ খাতে সংঘবদ্ধ দুর্নীতি হয়েছে: পর্যালোচনা কমিটি

বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির নামে বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো সরকারের কাছ থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া বাবদ অর্থ নিয়েছে, যেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহের চেয়ে দুর্নীতিই মুখ্য ছিল বলে অভিমত দিয়েছে সরকার গঠিত চুক্তি পর্যালোচনা কমিটি। তারা বলেছে, চুক্তিতে ব‍্যবসায়ীদের কোনো ঝুঁকি নেই, সব ঝুঁকি সরকারের। এটি সরকারের অদক্ষতাজনিত ব‍্যর্থতা নয়, দুর্নীতি জড়িত। তাই চুক্তি বাতিল করা সম্ভব।

বিদ্যুৎ খাতের চুক্তি পর্যালোচনা কমিটির তিন সদস্যের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তাঁরা বলেছেন, গত সরকারের দেড় দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে চার গুণ, খরচ বেড়েছে ১১ গুণ। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইনটি করাই হয়েছে দুর্নীতির জন্য। এখানে সংঘবদ্ধ দুর্নীতি হয়েছে। বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিগুলো ভাড়া আদায়ের নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে কাজ করেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো জ্বালানি আমদানি করেছে নিজেরা। এতেও দুর্নীতি হয়েছে।

তবে এখন এসব চুক্তি বাতিল করতে হলে অনুসন্ধান করে দুর্নীতির প্রমাণ খুঁজে বের করতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন পর্যালোচনা কমিটির সদস্যরা। তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের প্রতিবেদন নিয়ে সরকারের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করতে পারে। গত সরকারের সময় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একের পর এক একতরফা চুক্তি করা হয়েছে। চুক্তিতে সব সুবিধা দেওয়া হয়েছে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে, রাষ্ট্রের কথা চিন্তা করা হয়নি। একটি চুক্তি যেন আরেকটির প্রতিলিপি। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ সংস্থাগুলো এতে জড়িত ছিল। গ্যাস পাওয়া যাবে না, চুক্তি করা হোক—এমন সুপারিশও দেখা গেছে মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে।

পর্যালোচনা কমিটির তিনজন সদস্যের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেন, শুধু চুক্তি নয়, চুক্তির আগের পুরো প্রক্রিয়া যাচাই করে দেখা হয়েছে। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপের নমুনা পাওয়া গেছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বেও ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। সাবেক দুই বিদ্যুৎসচিব, যাঁরা পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব হয়েছিলেন; তাঁদের সংশ্লিষ্টতা আছে সংঘবদ্ধ দুর্নীতিতে। এই দুজন হলেন আবুল কালাম আজাদ ও আহমদ কায়কাউস।

# চুক্তি পর্যালোচনা কমিটির অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন
# দেড় দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে চার গুণ, খরচ বেড়েছে ১১ গুণ
# ব্যবসায়ী, আমলা, সরকারের শীর্ষ পর্যায় মিলে সংঘবদ্ধ দুর্নীতি
# চুক্তি বাতিল সম্ভব, দুদকের তদন্ত করতে হবে
# আদানির চুক্তিতে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে

দায়মুক্তি আইন হিসেবে পরিচিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনটি বাতিল করা হয় গত বছরের নভেম্বরে। এর আগেই এ আইনের অধীনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে গত সরকারের করা চুক্তিগুলো পর্যালোচনায় গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।

কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে আছেন হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী। কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও সহ-উপাচার্য আবদুল হাসিব চৌধুরী, কেপিএমজি বাংলাদেশের সাবেক প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) আলী আশফাক, বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ফ্যাকাল্টি অব ল অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সের অর্থনীতির অধ্যাপক মোশতাক হোসেন খান ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক।

জানুয়ারিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন

আজ রোববার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দিয়েছে চুক্তি পর্যালোচনা কমিটি। আগামী জানুয়ারির মাঝামাঝি চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেবে তারা। এ ছাড়া ভারতের আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে করা চুক্তির অনিয়ম নিয়েও একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তারা। প্রতিবেদন জমার পর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে একটি সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন কমিটির সদস্যরা।

সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, কারণ ছাড়া চুক্তি বাতিল করলে তার ক্ষতিপূরণের বিষয়টি চুক্তিতেই বলা আছে। তবে প্রতিটি চুক্তিতেই স্বীকারোক্তি থাকে যে এই চুক্তিতে কোনো দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়নি। এটা যদি লঙ্ঘিত হয়, তাহলে চুক্তি বাতিল করা যায়। কিন্তু মুখের কথা তো আদালত মানতে চাইবেন না, সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দিতে হবে আদালতে। কমিটির সহায়তায় চুক্তির অনিয়ম খুঁজে দেখা হচ্ছে। কারণ, খুঁজে পাওয়া গেলে চুক্তি বাতিলে দ্বিধা করা হবে না।

কমিটির আহ্বায়ক মঈনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, চুক্তি কতটা বাতিল করা যাবে, তা ভবিষ্যৎ বলে দেবে। বিদ্যুৎ খাতের চুক্তিগুলো পুরোপুরি কারিগরি, তাই সময় লেগেছে পর্যালোচনায়। এতে ব্যাপক দুর্নীতি পাওয়া গেছে। আগামী জানুয়ারির মাঝামাঝি চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে কমিটির সদস্য জাহিদ হোসেন বলেন, চুক্তি–সম্পর্কিত নথি দেখা হয়েছে। পিডিবি থেকে পরিশোধ করা বিলের তথ্য নেওয়া হয়েছে। এগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা হয়েছে, কী কী ধরনের অনিয়ম হয়েছে। ক্ষমতার কেন্দ্রীয়করণ ছিল, মন্ত্রণালয় সব সময় প্রধানমন্ত্রীর হাতে ছিল। বিদ্যুৎ খাতে যে পরিমাণ বিল পরিশোধ করা হয়েছে এবং এর বিপরীতে যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে, এর হিসাব আইনস্টাইনও মেলাতে পারবেন না।

চুক্তি বাতিল করলে ক্ষতিপূরণের বিষয়ে জানতে চাইলে কমিটির সদস্য শাহদীন মালিক বলেন, যাঁরা ক্ষতিপূরণ দাবি করবেন, তাঁরা তাঁদের ক্ষতির হিসাব দেবেন। তাই ক্ষতিপূরণের বিষয়টা তো এ কমিটি বলতে পারবে না।

দুর্নীতির কারণে বেড়েছে বিদ্যুতের দাম

সংবাদ সম্মেলনে কমিটির সদস্য মোশতাক হোসেন খান বলেন, ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। দুর্নীতির কারণে বিদ্যুতের দাম ২৫ শতাংশ বেশি হয়ে গেছে। ভর্তুকি না থাকলে ৪০ শতাংশ বেড়ে যেত। এ দামে ব্যবসা-বাণিজ্য টিকতে পারবে না। এটা কমাতে হবে। যারা টাকা নিয়ে চলে গেছে, তাদের বোঝাতে হবে, তারা পার পাবে না। তাড়াতাড়ি করলে ভুল হতে পারে, তাই সময় লেগেছে। তবে রাষ্ট্রের সঙ্গে কোম্পানির চুক্তিগুলো সার্বভৌম চুক্তি। চাইলেই এটা বাতিল করা যায় না। বড় জরিমানা দিতে হতে পারে।

আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে মোশতাক হোসেন বলেন, আদানির চুক্তির অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে আদালতে রিট হয়েছে। আদালত প্রতিবেদন চেয়েছেন। মাসখানেকের মধ্যে শক্ত প্রমাণ সামনে আসবে। এসব প্রমাণ নিয়ে দেশে-বিদেশে আইনি প্রক্রিয়া নেওয়া যাবে।

পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশে মূলত ভবিষ্যতে সুরক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যাতে এ ধরনের চুক্তি না করা হয়। চুক্তির আগে স্বাধীন কমিশনের মাধ্যমে যাচাই করে দেখার কথা বলা হয়েছে। পর্যালোচনা কমিটির পরামর্শে গত ২১ জানুয়ারি করা হয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ট্যারিফ (বিদ্যুতের দাম) পর্যালোচনা কমিটি। এ কমিটির কাজ চলমান।

চুক্তি অনুসারে প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনে নেয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম নির্ধারণে একটি সূত্র দেওয়া আছে চুক্তিতে। এ সূত্র অনুসারে দাম নির্ধারিত হয়। একেক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে একেক দাম। সমঝোতার মাধ্যমে কাউকে কাউকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। দরপত্র ছাড়া বিশেষ বিধান আইনে এভাবে চুক্তি করার সুযোগ নিয়েছে গত আওয়ামী লীগ সরকার।

বিশেষ বিধান আইনটি করা হয় ২০১০ সালে। এরপর দফায় দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়। এই আইনের অধীনে নেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। এর কারণে এটি দায়মুক্তি আইন হিসেবে পরিচিত। এ আইনের অধীনে দরপত্র ছাড়া একটার পর একটা চুক্তি করেছিল গত সরকার।

সম্পর্কিত নিবন্ধ