মহান মুক্তিযুদ্ধে চালানো গণহত্যার দুর্লভ সব সংগ্রহ নিয়ে খুলনা নগরীর সাউথ সেন্ট্রাল রোডে গড়ে ওঠে দেশের একমাত্র গণহত্যা জাদুঘর। ভেতরে মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যার অসংখ্য নিদর্শন, নথি, বইপত্র থাকলেও তা দেখার সুযোগ পাচ্ছে না মানুষ। ৮ মাস ধরে বন্ধ জাদুঘরের প্রধান ফটক। স্বল্প পরিসরে আর্কাইভ অংশ চালু থাকলেও পরিচালন বরাদ্দ না থাকায় সেই কাজও ব্যাহত হচ্ছে।
জাদুঘর সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ২০ জুলাই সংস্কারের কারণে জাদুঘর বন্ধ করা হয়। আন্দোলনের পর সেটি আর চালু হয়নি। এর মধ্যে ৪ আগস্ট গুলিবিদ্ধ কয়েকজনকে চিকিৎসা না দেওয়ায় জাদুঘরের সামনের হাসপাতালে ভাঙচুর চালায় বিক্ষুব্ধ 
ছাত্ররা। ওই সময় জাদুঘরের প্রধান ফটকও ভাঙচুর করা হয়। এতে অরক্ষিত হয়ে পড়ে জাদুঘর। 
এর পর ফটক মেরামতের জন্য কয়েকবার গণপূর্ত বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও সাড়া মেলেনি। জাদুঘর ও আর্কাইভ পরিচালনার জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে অনুদান পাওয়ার কথা ছিল, তবে সেই টাকাও ছাড় হয়নি। এতে আর্থিক সংকটে নিজেরাও ফটক মেরামত করতে পারছে না। তহবিল না থাকায় জাদুঘর ও আর্কাইভের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। ছাঁটাই করা হয়েছে ৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে।
১৯৭১ সালের ইতিহাসের সবচেয়ে নারকীয় গণহত্যার তথ্য নতুন প্রজন্মসহ বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে ২০১৪ সালে খুলনায় গড়ে তোলা হয় ‘১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’। অধ্যাপক ড.

মুনতাসীর মামুন ছিলেন এ জাদুঘরের প্রধান উদ্যোক্তা। ১১ বছর ধরে গণহত্যা-নির্যাতনের নিদর্শন সংরক্ষণ, বধ্যভূমি ও গণকবর-সংক্রান্ত তথ্যভান্ডার গড়ে তোলা এবং গবেষণা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন তারা। শুধু বাংলাদেশই নয়, এশিয়ায় এ ধরনের জাদুঘর এটাই প্রথম।
শুরুতে নগরীর শেরেবাংলা রোডের একটি ভাড়া বাড়িতে আর্কাইভ ও জাদুঘরের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৫ সালে জাদুঘর কর্তৃপক্ষকে নগরীর ২৬ সাউথ সেন্ট্রাল রোডে জমিসহ একটি বাড়ি বরাদ্দ দেয় সরকার। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের তত্ত্বাবধানে সেখানে প্রায় ৩২ কোটি ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে ৬ তলা নতুন ভবন নির্মাণ হয়েছে। খুলনার দৃষ্টিনন্দন স্থাপনাগুলোর মধ্যে এটি দ্বিতীয়। গত মে মাসে ভবনটি চালু হয়।
এখন জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা, শহীদদের চিঠিসহ ১৯২ ধরনের নিদর্শন রয়েছে। আছে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সাড়ে তিন শতাধিক ছবি। আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে ১০ হাজারের বেশি ছবি, দুই হাজারের মতো ভিডিও ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক অসংখ্য দুষ্প্রাপ্য নথি।
জাদুঘরে গিয়ে দেখা গেছে, প্রবেশমুখেই দাঁড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের নৃশংস গণহত্যার সাক্ষী প্লাটিনাম জুট মিলের বয়লার। এই বয়লারে ফেলে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে অসংখ্য মুক্তিকামী মানুষকে। জাদুঘরের প্রবেশপথটি টিন ও বাঁশ দিয়ে স্থায়ীভাবে বন্ধ। ফটকের পাশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-সংবলিত টেরাকোটা অযত্নে পড়ে আছে। 
জাদুঘরের ডেপুটি কিউরেটর মো. রোকনুজ্জামান বাবুল বলেন, প্রধান ফটকটি মেরামত না করে জাদুঘর চালু করা যাচ্ছে না। এ জন্য কয়েকবার গণপূর্ত বিভাগে চিঠি দেওয়া হয়েছে।’
আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্টি বোর্ডের এক সদস্য জানান, ফটক মেরামতের জন্য ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা প্রয়োজন। জাদুঘরের নিজস্ব তহবিলে এত টাকা নেই। জাদুঘর পরিচালনায় যে অনুদান পাওয়ার কথা, সেটিও পাওয়া যায়নি। বিদ্যুৎ বিল, স্টাফ বেতনসহ আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে বছরে ৬০ থেকে ৬৫ লাখ টাকা লাগে। বর্তমানে তহবিল সংকটে কার্যক্রম সীমিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, নিরাপত্তাও বড় বিষয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ছাড়া জাদুঘরটি চালু করা ঝুঁকিপূর্ণ। 
গণপূর্ত বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী কামরুল হাসান বলেন, ওই ভবন মেরামতের জন্য আমাদের তহবিলে বরাদ্দ নেই। মন্ত্রণালয় থেকে যদি তহবিল দেয়, তাহলে আমরা মেরামত করে দিতে পারব। 
মুক্তিযোদ্ধা সংসদের খুলনা মহানগর কমান্ডার মনিরুজ্জামান মনি বলেন, জাদুঘরটি চালুর জন্য জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যার ইতিহাস তুলে ধরতে দ্রুত জাদুঘরটি খুলে দেওয়া প্রয়োজন। 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গণহত য জ দ ঘর র প গণহত য র য় জ দ ঘর ম র মত র জন য তহব ল

এছাড়াও পড়ুন:

যে ‘ধর্মীয় অনুপ্রেরণায়’ ইরানে এই হামলা চালাল ইসরায়েল

ইসরায়েল আবারও ইরানে বড় রকমের হামলা করেছে। হামলায় ইরানের বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণুবিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। হামলা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি ও আবাসিক এলাকায়। একদিন পর পাল্টা হামলা চালায় ইরান। এতে কয়েকজন ইসরায়েলি নিহত হয়। ধ্বংস হয় তেলআবিবের কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।

ইসরায়েল তার ইরানবিরোধী এ হামলার নাম দিয়েছে ‘রাইজিং লায়ন’। এ নাম রাখা হয়েছে হিব্রু বাইবেলের একটি চরণ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। যে নাম ইসরায়েলের একটি শক্তিশালী ও বিজয়দীপ্ত ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি দেয়।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বৃহস্পতিবার ইহুদিদের সবচেয়ে পবিত্র উপাসনাস্থল জেরুজালেমের ওয়েস্টার্ন ওয়ালের একটি ফাটলে হাতে লেখা একটি চিরকুট রেখে আসার সময় ছবি তোলেন। এটি ছিল মূলত ইরানে ইসরায়েলের হামলার ইঙ্গিত।

শুক্রবার তার অফিস থেকে সেই চিরকুটে একটি ছবি প্রকাশ করা হয়। সেখানে লেখা ছিল: ‘জনগণ সিংহের মতো উঠে দাঁড়াবে।’

এই বাক্যাংশটি হিব্রু বাইবেলের গ্রন্থ বুক অব নাম্বারস (গণনা পুস্তক) ২৩:২৪ পদ থেকে এসেছে। যেখানে বলা হয়েছে: ‘দেখো, এই জাতি একটি মহান সিংহের মতো উঠে দাঁড়াবে এবং একটি তরুণ সিংহের মতো নিজেকে উদ্দীপ্ত করবে; সে শিকার না খাওয়া পর্যন্ত বিশ্রাম নেবে না এবং নিহতদের রক্ত না পান করা পর্যন্ত থামবে না।’

এই চরণটি হিব্রু বাইবেলের অ-ইসরায়েলীয় একজন নবী ও ভবিষ্যদ্বক্তা বালামের প্রথম ভবিষ্যদ্বাণীর অংশ। সেখানে তিনি ইসরায়েলের শক্তি ও ক্ষমতার কথা বলেন। তাদের এমন এক সিংহের সঙ্গে তুলনা করেন যে নিজের ক্ষুধা না মেটানো পর্যন্ত বিশ্রামে যায় না।

অনেকেই মনে করেন, এই অভিযানের নাম ইরানের শেষ শাহ-এর পুত্রের প্রতি ইঙ্গিত হতে পারে। কারণ পারস্য রাজপরিবারের প্রতীক হিসেবেও সিংহ ব্যবহৃত হতো।

ইসরায়েলের ঐশ্বরিক অধিকারের দাবি

ইসরায়েল প্রায়শই তার সামরিক অভিযানের নাম হিব্রু বাইবেল বা ওল্ড টেস্টেমেন্ট থেকে নেয় বা ধর্মীয় অনুপ্রেরণা থেকে গ্রহণ করে। ফিলিস্তিনি ভূমির উপর ইহুদিদের তথাকথিত ঐশ্বরিক অধিকারের দাবি এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের যুদ্ধকে ন্যায্যতা দিতে ইসরায়েল এসব ধর্মীয় বিষয় ব্যবহৃত করে বলে অনেকে মনে করে থাকেন।

উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সিরিয়ার সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে চালানো এক অভিযানের নাম দিয়েছিল, ‘অ্যারো অব বাশান।’ ‘বাশান’ শব্দটি ইসরায়েলিদের ধর্মগ্রন্থ ওল্ড টেস্টামেন্টে ব্যবহৃত হয়েছে। এটি দিয়ে মূলত সিরিয়ার দক্ষিণ ও জর্ডান নদীর পূর্বে অবস্থিত একটি অঞ্চলকে নির্দেশ করা হয়। বাশানের রাজাকে পরাজিত করে ইসরায়েলিরা সেই অঞ্চলকে দখল করেছিল।

গাজা উপত্যকার ওপর হামলা চালাতেও অস্ত্র ও অভিযানের জন্য হিব্রু বাইবেলীয় প্রতীক বা অনুষঙ্গ ব্যবহার করছে ইসরায়েল। নেতানিয়াহু অন্তত তিনবার গাজায় আক্রমণের জন্য হিব্রু বাইবেলীয় আমালেক কাহিনি ব্যবহার করেছেন।

২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর এক বিবৃতিতে নেতানিয়াহু হিব্রু বাইবেল ও ওল্ড টেস্টামেন্টের গ্রন্থ ‘বুক অব ডিউটেরনমি’(২৫:১৭) এর থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন:

‘আমালেক তোমার সঙ্গে যা করেছিল তা মনে রেখো, আমরা মনে রাখি এবং আমরা যুদ্ধ করি।’

এর মধ্য দিয়ে গাজাবাসীদের উপর পূর্ণাঙ্গ হামলা করা উচিত বলে নেতানিয়াহু ইঙ্গিত করেন। কারণ ডিউটেরনমির এই উদ্ধৃতি বাইবেলের স্যামুয়েল গ্রন্থে বর্ণিত আমালেকীয়দের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ ধ্বংসের আহ্বান হিসেবে বিবেচিত হয়।

বাইবেলের এ কাহিনিতে ইসরায়েলিদের ওপর আক্রমণকারীদের সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার আহ্বান জানানো হয়েছে। গাজার গোটা জনসংখ্যাকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দিতে বাইবেলের এ কাহিনিকে হাজির করেছেন নেতানিয়াহু।

গণহত্যার মামলায় নেতানিয়াহুর বক্তব্য

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার দায়ের করা গণহত্যার মামলায় আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) প্রথম শুনানিতে দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষের আইনজীবী হিব্রু বাইবেলের উদ্ধৃতির মাধ্যমে নেতানিয়াহুর এই বক্তব্যকে গাজার জনগণের বিরুদ্ধে গণহত্যায় প্ররোচনা হিসেবে তুলে ধরেন।

আইনজীবী আরও জানান, নেতানিয়াহু ৩ নভেম্বর সেনাদের উদ্দেশ্যে লেখা আরেকটি চিঠিতে একই আমালেকীয় গল্প পুনরাবৃত্তি করেন।

ধর্মীয় নাম ব্যবহার করে সামরিক প্রযুক্তি

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি গাজায় বোমাবর্ষণে সহায়তা করছে, তাদের নাম ‘ল্যাভেন্ডার’ এবং ‘দ্য গসপেল’, যা উভয়ই হিব্রু বাইবেলীয় ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে।

টিআরটি ওয়ার্ল্ডের বিশ্লেষক রাভালে মহিদিনের মতে, প্রায়ই ধর্মীয় ধর্মগ্রন্থ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ইসরায়েলের অস্ত্রের নামকরণ করা হয়। যেমন, স্যামসন রিমোট কন্ট্রোলড ওয়েপন স্টেশন।

জেরিকো ব্যালিস্টিক মিসাইল-এর নাম রাখা হয়েছে জেরিকো শহরের নামে। হিব্রু বাইবেল ও ওল্ড টেস্টামেন্টের একটি গ্রন্থ ‘বুক অব যশুয়া’ অনুসারে ইসরায়েলিরা এই শহর ফিলিস্তিনিদের কাছ দখল করেছিল।

ডেভিড’স স্লিং নামক আরেকটি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার নাম রাখা হয়েছে বাইবেলের মেষপালক ডেভিড ও বিশাল যোদ্ধা গোলিয়াথের মধ্যকার বিখ্যাত সেই লড়াইয়ের স্মরণে, যেখানে ডেভিডের বিজয় হয়েছিল। এই কাহিনী আছে হিব্রু বাইবেল ও ওল্ট টেস্টামেন্টের একটি গ্রন্থ ‘বুক অব স্যামুয়েল’-এ।

*দ্য নিউ আরব, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা বিষয়ক লন্ডনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম। টিআরটি ওয়ার্ল্ডের বিশ্লেষক ও হার্ভার্ডের গবেষক রাভালে মহিদিনের একটি লেখার অবলম্বনে দ্য নিউ আরব এ বিশ্লেষণটি প্রকাশ করেছে। অনুবাদ করেছেন: রাফসান গালিব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, ভালো উদ্যোগ নিলেও বিরোধিতা আসে
  • যে ‘ধর্মীয় অনুপ্রেরণায়’ ইরানে এই হামলা চালাল ইসরায়েল
  • তেহরানে ইসরায়েলের বিমান হামলার নিন্দা জানিয়েছে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল