একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধদিনের কথা মনে হলে এই পড়ন্ত বয়সেও স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। ফিরে যাই আজ থেকে ৫৪ বয়স আগে। যৌবনের সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা মনে হতেই শিহরণ জাগে। দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করতে সেদিন জীবন উৎসর্গ করতেও যেন কোনো দ্বিধা ছিল না। ‘হয় বিজয় নয়তো মরণ’-এর মাঝামাঝি আর কিছুই যেন ওই সময় চিন্তা করতে পারতাম না।
২৫ মার্চ সন্ধ্যা থেকে অসহযোগ আন্দোলনে জড়িত ছাত্র, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ দলে দলে সাধারণ মানুষ জাতীয় পরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট আলী আজম ভূঁইয়া এবং প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট লুৎফুল হাই সাচ্চুর বাসভবনে জড়ো হতে থাকেন। সবাই দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চান। নেতৃবৃন্দের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। এদিকে নেতৃবৃন্দ টেলিফোনে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করতে থাকেন। যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছিল না। অ্যাডভোকেট লুৎফুল হাই সাচ্চু ঢাকা থেকে তাঁর এক আত্মীয়ের ফোনের মাধ্যমে ঢাকায় গণহত্যা শুরু হয়ে যাওয়ার খবর পান। তিনি ঢাকায় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এরই মধ্যে খবর চাউর হতে থাকে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পূর্বপরিকল্পিতভাবে ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর ও কুমিল্লা সেনানিবাস দখল করে নেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাসে, বিভিন্ন পুলিশ, ইপিআর ও আনসার ক্যাম্পগুলোয় আক্রমণ চালিয়ে বাঙালিদের হত্যা করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও পাকিস্তানি বাহিনী অনুরূপ আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু এলাকার সংগ্রামী জনতা প্রাথমিক পর্যায়ে তাদের সে উদ্দেশ্য নস্যাৎ করে দেয়। প্রসঙ্গত, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরিকল্পনামাফিক কথিত ভারতীয় বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করার অজুহাতে ১ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে মেজর শাফায়াত জামিল ও মেজর সাদেক নেওয়াজের (পাকিস্তানি) নেতৃত্বে দুটি কোম্পানি ব্রাহ্মণবাড়িয়া ওয়াপদা রেস্টহাউসে অবস্থান করছিল। পরে পরিকল্পনার অংশ হিসেবে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক খিজির হায়াত খান (অবাঙালি) ব্যাটালিয়নের বাকি সৈনিকদের নিয়ে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চলে আসেন।
পরদিন ২৬ মার্চ সকাল থেকেই সেনাবাহিনীবোঝাই ট্রাক রাস্তায় নেমে আসে। ট্রাক থেকে শহরে কারফিউ জারির ঘোষণা দেওয়া হয়। জনতাকে বাড়িঘরে ফিরে যেতে বলা হয়। না হলে দেখামাত্র গুলি করা হবে বলে ঘোষণা করা হয়। এ ঘোষণায় প্রাথমিকভাবে ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হলেও জনতা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে আলী আজম ভূঁইয়া ও লুৎফুল হাই সাচ্চুর বাসভবনে সমবেত হতে থাকে। এদিকে অ্যাডভোকেট লুৎফুল হাই সাচ্চু কয়েকজন ছাত্রনেতাসহ একটি জিপগাড়ি নিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। তাঁর হাতে একটি হ্যান্ডমাইক। সারাশহরে তিনি কারফিউর বিরুদ্ধে পাল্টা ঘোষণা দিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের উদ্ধৃতি দিয়ে যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানান। এরই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা লাঠিসোটা, কাঠের টুকরা, বাঁশ, রামদা, বল্লমসহ নানা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রসহ মিছিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মিছিলের পদভারে আর স্লোগানে স্লোগানে সারাশহর প্রকম্পিত হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া তখন প্রতিবাদের আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ২৭ মার্চ সকালে নাশতার টেবিলে বসার সময় পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা অধিনায়ক খিজির হায়াত খান, মেজর সাদেক নেওয়াজসহ তিন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাকে বাঙালি সেনা কর্মকর্তা মেজর শাফায়েত জামিলের নেতৃত্বে অন্যান্য বাঙালি সেনা কর্মকর্তা গ্রেপ্তার করে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এ সংবাদ শুনে ওখানে অবস্থানরত বাঙালি সদস্যরা জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে তারাও বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এদিকে বিদ্রোহের খবর পেয়ে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে আসা পাকিস্তানি সেনাদের কনভয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছামাত্র দুই কিলোমিটার দূর থেকে আবার কুমিল্লা ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিল। তাদের আসার লক্ষ্য ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে বাঙালি জওয়ানদের অস্ত্র সমর্পণ করানো। খবর পেয়ে সংগ্রামী জনতা মিছিল নিয়ে গিয়ে বিদ্রোহী সেনাবাহিনীকে অভিনন্দন জানায়। এরই মধ্যে মেজর খালেদ মোশাররফ সিলেটের শমশেরনগর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে পৌঁছান। এসেই তিনি প্রথমে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার ও জওয়ানদের নিয়ে এক জরুরি সভায় মিলিত হন। ওই সভায় মেজর খালেদ মোশাররফকে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং উপ-অধিনায়ক করা হয় মেজর শাফায়াত জামিলকে। এখান থেকেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আশপাশ এলাকা শত্রুমুক্ত রাখার নানা পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
এদিকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তবর্তী তৎকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা পাকিস্তানি বাহিনী দখল করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। স্থলপথে সুবিধা করতে না পেরে তারা বিমান হামলা শুরু করে। ২ এপ্রিল থেকে তারা উপর্যুপরি বিমান হামলা শুরু করে। বিমান হামলার মধ্যে তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পশ্চিমাংশের বিভিন্ন জায়গায় হেলিকপ্টারযোগে সৈন্য নামিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর দখলে চেষ্টা চালায়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৫ থেকে ১৭ এপ্রিল উপর্যুপরি বিমান হামলা চালিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর দখলে নেয় পাকিস্তানি সেনারা। পর্যায়ক্রমে ১৯ এপ্রিল আখাউড়া, ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনারা সীমান্তবর্তী আজমপুর এলাকাসহ পুরো ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমাই দখলে নেয়।
পাকিস্তানি সৈন্যদের বিমান হামলায় টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন। প্রশিক্ষণ শেষে জুন মাসের দিকে কুমিল্লা দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে হোমনা, বাঞ্ছারামপুর ও নবীনগর হয়ে সরাইল-আশুগঞ্জ এলাকায় আসি। যুদ্ধকালীন সরাইলের প্রত্যন্ত অরুয়াইল, পাকমিল, আশুগঞ্জের পাকশিমুল এলাকায় অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অভিযানে অংশ নিয়েছি। ৯ মাসে দেশ স্বাধীন হবে, কল্পনাও করেনি। তখন পণ করেছিলাম– ‘হয় বিজয় নয়তো মরণ’। এর মাঝে আর কিছুই নেই। ৮ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর মুক্ত হওয়ার সময় আমি ও সহযোদ্ধা হাবিব (কামাউড়া) শহরতলির ঘাটুরা দিয়ে মেড্ডা হয়ে শহরে প্রবেশ করি। ওই দিনই মিত্র বাহিনীর ট্যাঙ্কের ওপর বসে আশুগঞ্জের দিকে রওনা দিই। ৮ ডিসেম্বর যৌথ বাহিনী পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে কুলিয়ে উঠতে পারছিল না। মেঘনার অপর পার ভৈরবে পাকিস্তান বাহিনীর শক্ত অবস্থান এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে পাকিস্তানি সেনারা আশুগঞ্জে জড়ো হলে তাদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় হয়।
ভৈরব ও আশুগঞ্জ থেকে তাদের কামানের গোলার আঘাতে যৌথ বাহিনী সামনের দিকে এগোতে পারছিল না। ৯ ডিসেম্বর বিকেলে যৌথ বাহিনীর ট্যাঙ্কগুলো লক্ষ্য করে ভারী মেশিনগান, কামান ও বিমান বিধ্বংসী কামান দিয়ে গোলাবর্ষণ করতে থাকে পাকিস্তান বাহিনী। ওই সময় আমি ছিলাম ট্যাঙ্কের ওপরে। এক পর্যায়ে ট্যাঙ্কের ওপর থেকে লাফ দিয়ে রাস্তার খাদে পড়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করি। পরক্ষণেই দেখি, ট্যাঙ্কটি বিধ্বস্ত হয়। পরে ওখান থেকে দীর্ঘ পথ ক্রলিং করে জীবন রক্ষা করি। ব্যাপক হতাহতের পর পাকিস্তান বাহিনী পিছু হটে ভৈরব গিয়ে আশ্রয় নিলে ১০ ডিসেম্বর আশুগঞ্জ মুক্ত হয়।
অনুলিখন
আবদুন নূর
নিজস্ব প্রতিবেদক ব্রাহ্মণবাড়িয়া
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব র হ মণব ড় য় কর মকর ত ড স ম বর অবস থ ন র কল প
এছাড়াও পড়ুন:
ছয় কোটি শ্রমিক রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার বাইরে
দেশের মোট শ্রমিকের ৮৪ দশমিক ১ শতাংশের কোনো দায়দায়িত্ব নেয় না রাষ্ট্র । শ্রমিক হিসেবে তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। কোনো রকম আইনি ও সামাজিক সুরক্ষা নেই। কর্মস্থলের পরিচয়পত্র নেই। কাজের ক্ষেত্রে অন্যায়ের শিকার হলে তাদের শ্রম আদালতে মামলা করার সুযোগও নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, অপ্রাতিষ্ঠানিক এই শ্রমিকের সংখ্যা ৫ কোটি ৯৬ লাখ ৮০ হাজার।
বিশালসংখ্যক শ্রমিকের প্রতি রাষ্ট্রের এ রকম অবহেলার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সরকারের গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গত ২১ এপ্রিল পেশ করা কমিশনের ২৫ সুপারিশের মধ্যে প্রথমে প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সব শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা ও স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
দেশের শ্রম খাতের দুর্বলতা চিহ্নিত করা এবং শ্রমিকের অধিকার ও জীবনমান উন্নয়নে সুপারিশ প্রণয়নের উদ্দেশ্যে গঠিত ১৯ সদস্যের কমিশনপ্রধান ছিলেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ। জানতে চাইলে গতকাল তিনি সমকালকে বলেন, ‘আমরা সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছি। শ্রম আইনে অন্য সব শ্রমিকের মতো একই অধিকার এবং সুযোগসুবিধা পাওয়ার পাশাপাশি ক্ষেত্রবিশেষে তাদের বাড়তি সুবিধা দেওয়ার কথা বলেছি। সামাজিক সুরক্ষার আওতায় তাদের জন্য ভাতার কথা বলেছি। প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকের জন্য এ সুবিধার সুপারিশ করা হয়নি। কারণ, তারা চাকরি শেষে কমবেশি কিছু আর্থিক সুবিধা পান।’
কমিশনের এ সব সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে নিয়মিত নজরদারি রাখার কথাও জানান তিনি।
এ বাস্তবতায় আজ বৃহস্পতিবার মহান শ্রমিক দিবস পালন করা হচ্ছে। আজ সরকারি ছুটি থাকবে। এ দিনও কাজ করতে হবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দিবসটি পালনের বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘শ্রমিক মালিক এক হয়ে, গড়ব এ দেশ নতুন করে’।
বিবিএসের গত নভেম্বরে প্রকাশিত সর্বশেষ জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যা ১২ কোটি ৬ লাখ ২০ হাজার। তাদের মধ্যে শ্রমশক্তি ৭ কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার। মোট শ্রমশক্তির ৮৪ দশমিক ১ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে।
দেশে শ্রমশক্তি বলতে ১৫ বছরের বেশি বয়সের মানুষের মধ্যে যারা কর্মে নিয়োজিত এবং বেকার জনগোষ্ঠীর সমষ্টিকে বোঝায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা–আইএলওর মানদণ্ড অনুযায়ী, যারা সাত দিনে কমপক্ষে ১ ঘণ্টার বেতন, মজুরি বা মুনাফার বিনিময় অথবা পরিবারের নিজস্ব ভোগের জন্য পণ্য উৎপাদনের কাজ করেছেন জরিপে তাদের কর্মে নিয়োজিত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আবার যারা কর্মক্ষম কিন্তু কোনো কাজে নিয়োজিত নন, নির্দিষ্ট সময়ে কাজ খুঁজে বেড়ান এবং ওই সময়ে কাজের সুযোগ পেলে সে কাজ করতে প্রস্তুত তাদের বেকার বলা হয়েছে। এ হিসাবে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৪ লাখ ৬০ হাজার।
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক কারা
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা–আইএলওর আন্তর্জাতিক শ্রম পরিসংখ্যানবিদের সম্মেলন ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অব লেবার স্ট্যাটিসিয়ান্স–আইসিএলসির সংজ্ঞা অনুযায়ী, বেসরকারি অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি বা খানামালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান, যেগুলোর আইনি সত্তা নেই, পরিপূর্ণ হিসাব নেই, উৎপাদনের হিসাব দিতে হয় না এবং বেসরকারি ও অনিবন্ধিত–এরকম খাতকে অনানুষ্ঠানিক খাত এবং এ খাতের শ্রমিকদের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক বলা হয়।
মূলত কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক বেশি। কৃষিতে ৯৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক। শিল্প খাতে ৮২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের বড় অংশই গ্রামে থাকেন।
বিবিএস বলছে, গ্রামের মোট শ্রমিকের ৮৭ দশমিক ৪ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। সংখ্যায় তারা ৪ কোটি ৬১ লাখ ১০ হাজার। শহরের শ্রমিকদের এ হার কিছুটা কম। ৭৪ দশমিক ৫ শতাংশ। সংখ্যায় এক কোটি ৩৫ লাখ ৭০ হাজার। নারী শ্রমিকদের ৯৫ দশমিক ৭ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে থাকেন।
শ্রম আইনে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকেও অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ কমিশনের
শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক, কৃষি, গৃহশ্রমিক, অভিবাসী, স্বনিয়োজিত শ্রমিকসহ সব শ্রমিকের জন্য শ্রম আইনে সুরক্ষা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে শ্রমিকদের কাজের স্বীকৃতি, পরিচয়পত্র, নিরবচ্ছিন্ন কাজ এবং আয়ের নিশ্চয়তা, মর্যাদাকর শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়। এতে আরও বলা হয়, এসব শ্রমিকের জন্য রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা হিসেবে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সব অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় থেকে প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আলাদা অফিস অথবা ডেস্ক স্থাপন করতে হবে। শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা এবং কল্যাণে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের সব ধরনের তথ্য নিয়ে তথ্যভান্ডার করা, পরিচয়পত্র দেওয়া এবং অবসর ভাতা চালুসহ বেশ কিছু সুপারিশ করে কমিশন।
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের প্রবীণ শ্রমিকদের জন্য অসরকালীন ভাতার সুপারিশ
রাষ্ট্রের নিম্নতম মজুরি বোর্ডের আওতায় বিভিন্ন সুবিধা পেয়ে থাকেন প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা। অবসরের পরও কিছু সুবিধা পান তারা। তবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা সারা জীবন খাটুনির পর প্রবীণ বয়সে আরও কষ্টে থাকেন। কারণ সামান্যতম কোনো সুবিধা পান না তারা। এ বিবেচনা থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য অসরকালীন ভাতা বা তাদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনার সুপারিশ করেছে কমিশন। তাদের অবসরের বয়সসীমা ৬০ বছর নির্ধারণের কথা বলা হয় এতে। দরিদ্র বেকার শ্রমিকদের বয়স্কভাতা এবং তাদের প্রতিদিনের খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা ও অন্যান্য চাহিদা বিবেচনায় বয়স্কভাতার পরিমাণ নির্ধারণের কথা বলেছে কমিশন। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের পেশা ও খাত অনুযায়ী সংগঠিত হওয়া, প্রতিনিধিত্ব করা ও নিয়োগকারী, তাদের সমিতি করার সুযোগ দেওয়ার কথাও বলা হয় কমিশনের সুপারিশে।
প্রাতিষ্ঠানিকের ৫৫ খাতেও ন্যূনতম মজুরি নেই
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের চেয়ে কিছুটা ভালো হলেও প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের অবস্থাও খুব বেশি ভালো নয়। এখনও অনেক শিল্প খাতকে ন্যূনতম মজুরি কাঠামোর আওতায় আনা হয়নি। মালিকপক্ষ যা দেয়, তা মেনে নিয়ে কাজ করেন শ্রমিকরা। এরকম অন্তত ৫৫টি খাতে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হয়নি।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশের স্বীকৃত শিল্প আছে ১০২টি।
টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পের মজুরি বোর্ড হয় সর্বশেষ ১৯৮৩ সালে। অর্থাৎ, গত তিন যুগ ধরে একই মজুরি চলছে এ খাতে। জানতে চাইলে সরকারের নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সচিব রাইসা ইসলাম গতকাল সমকালকে বলেন, ন্যূনতম মজুরি কাঠামোতে বর্তমানে ৪৭টি শিল্প রয়েছে। নতুন করে দুটি শিল্পকে ন্যূনতম মজুরির আওতায় আনা হবে। আরও ২০ শিল্পকে এর আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে। তিনি জানান, পেট্রোল পাম্পের শ্রমিকদের মজুরি পুনঃনির্ধারণে বোর্ড গঠন হয়েছে। মালিক পক্ষ এ-সংক্রান্ত সভায় আসছে না। এ অবস্থায় করণীয় জানতে শ্রম মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ চেয়েছে মজুরি বোর্ড।
টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পে তিন যুগ ধরে একই মজুরির বিষয়ে জানতে চাইলে রাইসা ইসলাম বলেন, টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পের আর অস্তিত্ব নেই। খাতটি হয়তো বিলুপ্ত ঘোষণা করা হবে।