মুক্তিযোদ্ধার নতুন সংজ্ঞায় কেউ হবেন মুক্তিযোদ্ধা, কেউ সহযোগী
Published: 26th, March 2025 GMT
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যাঁরা দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে রণাঙ্গনে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন এবং যাঁরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন, শুধু তাঁরাই ‘বীর মুক্তিযোদ্ধার’ স্বীকৃতি পাবেন। এর বাইরে যাঁরা দেশে-বিদেশে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন, বিশ্বজনমত তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন, তাঁরা হবেন ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’।
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) আইন সংশোধন করে নতুন যে অধ্যাদেশ হতে যাচ্ছে, তাতে বীর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় এ পরিবর্তন আনা হচ্ছে। ইতিমধ্যে এই অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। এর আগে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হয়েছিল ২০২২ সালে। সর্বশেষ সংজ্ঞায় মুক্তিযুদ্ধের সময় যাঁরা যুদ্ধ করেছিলেন এবং যাঁরা বিশেষ অবদান রেখেছিলেন, তাঁদের সবাইকে বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞা পরিবর্তন আনার দাবি উঠে বিভিন্ন মহল থেকে। এরপর বিষয়টি নিয়ে তাঁরা খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক এবং বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে কথা বলেছেন। প্রায় সবাই বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন আর যাঁরা বিভিন্ন উপায়ে অবদান রেখেছেন, তাঁরা একই কাতারে থাকতে পারেন না। যে কারণে সবার মতামত নিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা পরিবর্তন করা হচ্ছে।
তবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক একাধিক গবেষক প্রথম আলোকে বলছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন সময়ে বীর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় পরিবর্তন করেছিল। এখন আবার নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী শ্রেণি করাও ঠিক হচ্ছে না। এটি সম্মানজনক হবে না। ভবিষ্যতে এ নিয়ে সংকট ও তিক্ততা আরও বাড়বে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক আফসান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞা, মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক ছিল। কখনো রাজনৈতিক কারণে, কখনো সুবিধার কারণে এসব পরিবর্তন হয়। মুক্তিযুদ্ধে নানা ধরনের মানুষ অংশগ্রহণ করেছিলেন, বিভিন্নভাবে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তবে রাজনৈতিক কারণে সব সরকারই মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞায় পরিবর্তন এনেছে। এটি এখন আবার হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা কারা হবেনখসড়া অধ্যাদেশে নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যাঁরা দেশের ভেতরে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগী রাজাকার, আল–বদর, আল শামস, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন, এ রূপ সব বেসামরিক নাগরিক (ওই সময়ে যাঁদের বয়স সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন বয়সের মধ্যে ছিল) বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাবেন। এর পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী, মুক্তিবাহিনী, বিএলএফ ও অন্যান্য স্বীকৃত বাহিনী, পুলিশ বাহিনী, ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্ট (ইপিআর), নৌ কমান্ডো, কিলো ফোর্স ও আনসার সদস্যরাও বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হবেন।
সংজ্ঞায় বেসামরিক নাগরিক বলতে তিনটি শ্রেণির কথা বলা হয়েছে। প্রথমত, যেসব ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে তাঁদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীর মাধ্যমে নির্যাতিত সব নারী (বীরাঙ্গনা)। তৃতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধের সময় আহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী ফিল্ড হাসপাতালের সব চিকিৎসক, নার্স ও চিকিৎসা সহকারী। এই তিন শ্রেণির সবাই বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাবেন।
কারা হবেন মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীখসড়া অধ্যাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী নামে নতুন একটি ধারা যুক্ত করা হচ্ছে। সহযোগীদের সম্পর্কে বলা আছে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যাঁরা দেশের ভেতরে বা প্রবাসে অবস্থান করে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দীপ্ত করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করতে সংগঠকের ভূমিকা পালন, বিশ্বজনমত গঠন, কূটনৈতিক সমর্থন অর্জন এবং মনস্তাত্ত্বিক শক্তি অর্জনে বাংলাদেশের যেসব নাগরিক প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা করেছিলেন, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীর মর্যাদা পাবেন।
সহযোগীদের জন্য পাঁচটি শ্রেণি ঠিক করা হয়েছে। প্রথমত, যেসব বাংলাদেশি পেশাজীবী মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশে অবস্থানকালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন এবং যেসব বাংলাদেশি নাগরিক বিশ্বজনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, যেসব ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) অধীন কর্মকর্তা বা কর্মচারী বা দূত, মুজিবনগর সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তৃতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) সঙ্গে সম্পৃক্ত সব এমএনএ (জাতীয় পরিষদের সদস্য) বা এমপিএ (প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য), যাঁরা পরবর্তী সময়ে গণপরিষদের সদস্য হিসেবে গণ্য হয়েছিলেন। চতুর্থত, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের সব শিল্পী ও কলাকুশলী এবং দেশ ও দেশের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে দায়িত্ব পালনকারী সব বাংলাদেশি সাংবাদিক। পঞ্চমত, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।
যদিও এই পাঁচ শ্রেণির ব্যক্তিরা বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে আসছেন। জামুকা আইনের সংশোধিত অধ্যাদেশ জারি হলে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী হবেন।
বিদ্যমান জামুকা আইনে যেসব জায়গায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লেখা রয়েছে, অধ্যাদেশে তা বাদ দেওয়া হচ্ছে। বিদ্যমান আইনে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ শব্দের পরিবর্তে ‘লক্ষ্য’ শব্দটি যুক্ত করা হচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধ বলতে জামুকা আইনে এখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণায় সাড়া দেওয়ার বিষয়টি রয়েছে। নতুন অধ্যাদেশে এই লাইনসহ কিছু শব্দ বাদ পড়ছে। এর পরিবর্তে লেখা হয়েছে, ‘১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষায় হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাদের সহযোগী রাজাকার, আল–বদর, আল–শামস, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ।’
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১১ বার বীর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও মানদণ্ড বদলানো হয়েছে। এর মধ্যে শুধু সংজ্ঞা বদলানো হয়েছে পাঁচবার। অধ্যাদেশ জারি হলে বীর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও মানদণ্ড বদলাবে ১২ বার। অন্যদিকে এখন পর্যন্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে সাতবার।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা, ভাতা প্রদানসহ অন্যান্য তথ্য ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) নামের একটি সফটওয়্যারে হালনাগাদ করে থাকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এমআইএসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ লাখ ৯৭ হাজার ৮০০। এর মধ্যে মাসিক ভাতা পান ১ লাখ ৯৬ হাজার ৪৫৪ জন। তবে নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী করা হলে স্বাভাবিকভাবেই বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কমে যাবে। সেটি কমে কত হবে, তা নিশ্চিত করতে পারেনি মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক–ই–আজম ২৩ মার্চ তাঁর দপ্তরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূলত যাঁরা রণাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, কেবল তাঁরাই বীর মু্ক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাবেন। যাঁরা নানা আঙিকে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, কেউ কূটনৈতিক সহযোগিতা করেছেন, কেউ গান গেয়েছেন, তাঁরা হবেন মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী।’
ফারুক–ই–আজম বলেন, জামুকার সংশোধিত অধ্যাদেশ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছিল। তারা কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছে, সেগুলো সংশোধন করা হচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা ফারুক–ই–আজম বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত বাংলাদেশ সরকারে (মুজিবনগর সরকার) যাঁরা ছিলেন, তাঁদের বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। খসড়া অধ্যাদেশে প্রথমে তাঁদের মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী করার চিন্তা ছিল। এখন এটি সংশোধন করা হচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাখসড়া অধ্যাদেশে নতুন একটি ধারা (১৪) যুক্ত করা হয়েছে। এতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়টি রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ অর্থ ‘১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের পক্ষে মুজিবনগর সরকার কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লেখিত বাংলাদেশের জনগণের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিতকল্পে যে চেতনা’।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্লার্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক মোহাম্মদ সাজ্জাদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধের পর কোনো বিতর্কের বিষয় ছিল না। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞার আদি রূপে ফেরার একটা প্রয়াস দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার পরিধি যেভাবে বাড়িয়েছিল, তাতে প্রবাসীরাও মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট পাওয়া শুরু করেছিলেন। এর রাশ টেনে ধরতে চাইছে এই সরকার।
গবেষক সাজ্জাদুর রহমান বলেন, রাজনৈতিক নেতাদের যেভাবে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত আগের সরকার নিয়েছিল, তা অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু এবার যেভাবে তাঁদের সহযোগীর কাতারে নামিয়ে আনা হচ্ছে, তাতে বিতর্ক আরও বাড়বে। যেহেতু মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধ বলা হয়, তাই নানা ধরনের সহযোগীদের আলাদা করে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার বিষয়টা সুবিবেচনা প্রসূত হবে না।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম ক ত য দ ধ র সহয গ ম ক ত য দ ধ র সময় দখলদ র প ক স ত ন অবদ ন র খ ছ প রথম আল ক ১৯৭১ স ল র য দ ধ কর ছ কর ছ ল ন র জন ত ক স ব ধ নত র ব ষয়ট র সরক র সরক র র র রহম ন র সদস য ক ত কর কর ছ ন য সব ব হয় ছ ল মন ত র ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
‘মুক্তিযোদ্ধা’ সংজ্ঞার রাজনৈতিক জটিলতা কোথায়
সম্প্রতি ‘মুক্তিযোদ্ধা’র সংজ্ঞা নিয়ে যে তর্ক-বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তা কিছুটা স্তিমিত হওয়ায় এখন কিঞ্চিৎ জটিল একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য রাজনৈতিক নেতাদের নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ পড়ার সংবাদ প্রকাশ, এর ফলে সৃষ্ট তীব্র প্রতিক্রিয়া ও পরবর্তী সময় ‘মিস/ডিজইনফরমেশন’ এবং তালিকায় নাম আবিষ্কার করার মধ্য দিয়ে সেই ক্ষোভের প্রশমন—এ পুরো ঘটনাচক্র প্রমাণ করে, আওয়ামী লীগ আমাদের জন্য যে বিরাট বয়ান তৈরি করে গেছে, তার প্রতি প্রায় সবার আস্থা ও এর সংকট কতটা গভীর।
সম্ভবত সরকারপন্থী অনেকের ভয় ছিল, এই ‘বাতিল’-এর ঘটনা তাঁদের ‘মুক্তিযুদ্ধবিরোধী’ হিসেবে চিত্রিত করতে পারে। ফলে তাঁরা যখন নিশ্চিত হলেন যে মুজিব, তাজউদ্দীনসহ সবার নাম সংজ্ঞার আওতায় অন্তর্ভুক্ত, তখন তাঁরা স্বস্তি ফিরে পান। কিন্তু এ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞার রাজনীতি অনুধাবন করতে পারলেই আমরা টের পাব, কীভাবে আমরা আওয়ামী লীগের রেখে যাওয়া গর্তে আটকে আছি।
২.
এ আলোচনার শুরু ১৯৭২ সাল থেকে করা যেতে পারে। সে বছর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ছিল একেবারে স্পষ্ট। ইংরেজিতে প্রদত্ত সংজ্ঞায় বলা হয়েছিল, ‘ফ্রিডম ফাইটার মিনস অ্যানি পারসন হু হ্যাড সার্ভড অ্যাজ আ মেম্বার অব অ্যানি ফোর্স এনগেজড ইন দ্য ওয়ার অব লিবারেশন।’ অর্থাৎ যিনি মুক্তিযুদ্ধে যেকোনো একটি বাহিনীর সদস্য হিসেবে যুদ্ধ করেছেন, তিনিই মুক্তিযোদ্ধা। সেই আদেশে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ ছিল: যাঁরা প্রতিরক্ষা বাহিনী, পুলিশ বা সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত, কিংবা সরকারি পেনশনভোগী বা যাঁদের নিয়মিত আয়ের উৎস আছে, তাঁরা সম্মানী ভাতা বা সুবিধার আওতায় আসবেন না।
এ তথ্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ২০১৮ সালে যখন এ আদেশ রহিত করে ‘পরিমার্জনমূলক যুগোপযোগী’ করার বিল আনা হয়, তখন যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছিল যে বাহাত্তরের সংজ্ঞার কারণে সব মুক্তিযোদ্ধাকে ভাতা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছিল না। এ উদ্দেশ্য থেকেই স্পষ্ট হয় যে মূলত ‘সম্মানী ভাতা’ দেওয়ার সুবিধার জন্যই আইনটি পুনঃপ্রণয়ন করা হয়েছিল।
২০০২ সালে বিএনপি সরকারের সময়ে যখন জামুকা (জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল) আইন তৈরি হয়, তখনো মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা হিসেবে বাহাত্তরের সংজ্ঞাটিই মূল ভিত্তি ছিল। তখন তালিকা মূলত বয়স কমানো-বাড়ানোর মধ্য দিয়ে বৃদ্ধি বা হ্রাস পেত। প্রায় প্রতিটি সরকারই কিছু নতুন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়াত। আবার পরবর্তী সরকার এসে তার কিছু বাতিল করে নতুন নাম যুক্ত করত। কিন্তু সংজ্ঞার মূল মানদণ্ড ১৯৭২ সালের আদেশটিই ছিল।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ বিতর্ক নতুন মাত্রা পায়। ২০০৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা গণকর্মচারীদের অবসরের বয়স বাড়ানোর ঘোষণার মধ্য দিয়ে এ নতুন বিতর্কের শুরু হয়। এর রেশ ধরে ২০১৪ সালে জামুকার বৈঠকে মুক্তিযোদ্ধার সনদ পাওয়ার জন্য আটটি নতুন যোগ্যতার কথা বলা হয়। এর মধ্যে ছিল: মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে সীমান্ত অতিক্রম করে ট্রেনিং ক্যাম্পে নাম অন্তর্ভুক্ত করা, মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে ভূমিকা রাখা, বিভিন্ন মুক্তিবাহিনীর (যেমন কাদেরিয়া, হেমায়েত বাহিনী) সদস্য থাকা, প্রথমে ত্রাণশিবিরে থাকলেও পরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া, বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য হয়ে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অথবা মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত গণপরিষদের সদস্য হওয়া এবং শিল্পী, সাহিত্যিক, খেলোয়াড়, চিকিৎসক, সাংবাদিক হিসেবে বা বিদেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অবদান রাখা।
■ ২০০২ সালে বিএনপি সরকারের সময়ে যখন জামুকা (জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল) আইন তৈরি হয়, তখনো মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা হিসেবে বাহাত্তরের সংজ্ঞাই মূল ভিত্তি ছিল। ■ ‘মুক্তিযোদ্ধা’ বলতে এখন শুধু রণাঙ্গনে যুদ্ধ করাকে আর বোঝানো হচ্ছে না; বরং মুক্তিযুদ্ধে বিচিত্র ধরনের ‘অবদান’কেও এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।২০১৬ সালের নভেম্বরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও বয়স নতুন করে নির্ধারণ করা হয়। সেখানে বলা হয়, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণায় সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যে সকল ব্যক্তি বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁরাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হবেন।’
এ সংজ্ঞায় মুক্তিযোদ্ধার পরিধি অনেক ব্যাপক ছিল। সেই সংজ্ঞায় ট্রেনিং ক্যাম্পে নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়া, কোনো বাহিনীর সদস্য হিসেবে সক্রিয় অংশ নেওয়া, নির্যাতনের শিকার নারীরা (বীরাঙ্গনা) যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন বিদেশে অবদান রাখা পেশাজীবীরা, মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী, এর সঙ্গে সম্পৃক্ত এমএনএ ও এমপিএরা (গণপরিষদের সদস্য), চিকিৎসায় সহায়তাকারী, বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড় ও কালচারাল ফ্রন্টে অবদান রাখা কলাকুশলীরাও।
২০১৮ সালে যখন ১৯৭২ সালের আদেশ রহিত করে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট আইন’ এবং ২০২২ সালে যখন ২০০২ সালের জামুকা আইন রহিত করে নতুন আইন তৈরি করা হয়, তখন ২০১৬ সালের এ বর্ধিত সংজ্ঞার কাঠামোই বহাল রাখা হয়। ২০১৮ সালের আইনে আরেকটি জিনিস যুক্ত করা হয়—যুদ্ধ যাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়েছিল, অর্থাৎ ‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও জামায়াতে ইসলামী এবং তাহাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী’, তাদের নামও তখন যুক্ত করে দেওয়া হয়।
৩.
খেয়াল করে দেখুন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে মুক্তিযোদ্ধার পরিধি কেবল বয়স দিয়ে নয়, বরং প্রকারেও বেড়েছে। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধা বলতে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করাকে আর বোঝানো হচ্ছে না; বরং মুক্তিযুদ্ধে বিচিত্র ধরনের ‘অবদান’কেও এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখানে একটি মৌলিক প্রশ্ন তোলা হয়নি: রাজনৈতিক নেতৃত্বকে কেন মুক্তিযোদ্ধা বলার প্রয়োজন দেখা দিল? কেনই-বা শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন আহমদদের মতো মুক্তিযুদ্ধে প্রধান রাজনৈতিক নেতৃত্বকে মুক্তিযোদ্ধা বলতে হবে? তাঁরা নিজেরা সরকার গঠনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে অনেক উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেখানে কি তাঁরা নিজেদেরও অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন? তাঁরা নিজেরা কি কখনো মুক্তিযোদ্ধা বলে নিজেদের পরিচয় দিতে পারতেন? এই গোঁড়ার প্রশ্নটা তোলার অবকাশ কখনো হয়নি।
যখন মাঠের যুদ্ধ ছাড়াও সব ধরনের অবদানকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করা শুরু হলো, তখনই বিপত্তি ঘটল। সুযোগ-সুবিধা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কেবল বয়স দিয়ে আর তালিকা বাড়ানো যাচ্ছিল না, তখন সংজ্ঞার ‘প্রকার’ই বাড়াতে হলো। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধা বর্গটির মূল অর্থই হারিয়ে গেল। যিনি অস্ত্র হাতে শত্রুর মুখোমুখি হয়েছেন, তিনিও মুক্তিযোদ্ধা; আবার যিনি বিদেশে বসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবদান রেখেছেন, তিনিও মুক্তিযোদ্ধা। এখানে কারও অবদানকে ছোট করা হচ্ছে না। কারণ, মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ এবং এ যুদ্ধে সবারই অবদান ছিল। কিন্তু সব অবদানকে যদি মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে ফেলা হয়, তাহলে যাঁরা সরাসরি যুদ্ধ করেছেন, তাঁদের পৃথক করা যাবে কীভাবে?
সংজ্ঞার এই পরিধি বাড়ানোর সমালোচনা খোদ আওয়ামী লীগ আমলেই হয়েছিল। ২০১৬ সালেই মেজর (অব.) এ এস এম শামসুল আরেফিন বলেছিলেন, ‘…যেভাবে সহযোগী, লেখক, শিল্পীসহ নানাজন তালিকায় যুক্ত হচ্ছেন, তাতে একে আর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা বলা যাবে না। এটা এখন স্বাধীনতাসংগ্রামীদের তালিকা হয়ে যাচ্ছে।’
২০১৬ সাল থেকে জারি করা সংজ্ঞায় আরও একটি হাস্যকর বিষয় রয়েছে। একদিকে বলা হচ্ছে, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণায় সাড়া দিয়া’ যাঁরা লড়াই করেছেন, তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা। আবার অন্যদিকে সেই আহ্বানকারী নেতাকেও মুক্তিযোদ্ধা বলা হচ্ছে। অতিরিক্ত আনুগত্য প্রকাশ ও ইতিহাসে আওয়ামীকরণ ঘটাতে গিয়ে সংজ্ঞার এ অন্তর্নিহিত সংকট কারও চোখে পড়েনি।
৪.
সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার যখন ঘোষণা দিল যে তারা বাহাত্তরের সংজ্ঞায় ফিরে যাবে, তখন এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে পারত। গত কয়েক দশকে মুক্তিযোদ্ধা বর্গের যে বাজে ও অপমানজনক হালত হয়েছে, তা থেকে রেহাই পেতে এ পদক্ষেপ ভালো সমাধান হতে পারত। এমনকি খোদ আওয়ামীপন্থী বলে পরিচিত ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনও ২০১৬ সালে বলেছিলেন, ‘১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধাদের যে সংজ্ঞা হয়েছে, সেটাই মানা উচিত।’
কিন্তু এ বিষয়ে গণমাধ্যমগুলোর উপস্থাপনা বা ফ্রেমিং নিয়েও একটি কথা বলে নেওয়া দরকার। যখন প্রথম এ আলাপ শুরু হয়েছিল, তখন তারা বলতে পারত, ‘মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা বাহাত্তরের অথবা শেখ মুজিবের আমলের সংজ্ঞায় ফিরে যাচ্ছে।’ কিন্তু তা না করে তারা শিরোনাম করল রাজনৈতিক নেতাদের নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাতিল করা নিয়ে। মূল প্রশ্ন, কেন রাজনৈতিক নেতা বা অন্য পেশাজীবীদের মুক্তিযোদ্ধা বলা হবে, তা এবারও এড়িয়ে যাওয়া হলো।
এখানেই আওয়ামী লীগের তৈরি করা জটিলতার গভীরতা বোঝা যায়। প্রথমে তারা অজস্র বর্গ তৈরি করে সবাইকে মুক্তিযোদ্ধার ছাতার নিচে এনেছে; এখন যখন সেই বর্ধিত অংশ বাদ দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, তখন এমনভাবে সংবাদ পরিবেশন করা হচ্ছে, যেন তাঁদের অবদানকেই অস্বীকার করা হচ্ছে। ‘মুক্তিযুদ্ধে অবদান’ ও ‘মুক্তিযোদ্ধা’—এই দুটিকে সমার্থক করে ফেলার সংকটই এখানে প্রকট হয়ে উঠেছে। কেন রাজনৈতিক নেতাসহ সবাইকে মুক্তিযোদ্ধা বলতে হবে, এই মৌলিক প্রশ্ন প্রায় সবাই এড়িয়ে গেলেন। আওয়ামীবয়ানে আমাদের বসবাসের গভীর স্মারক হয়ে উঠল মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও এতে রাজনৈতিক নেতাদের থাকা বা না-থাকা নিয়ে সাম্প্রতিক উদ্বেগ।
সবকিছুকে কীভাবে আওয়ামীকরণ করা হয়েছিল, তার একটি ছোট নজির হতে পারে এই সংজ্ঞার পাঠ। ১৯৭২ সালের সংজ্ঞাটি ছিল নির্ভার ও মেদহীন। কিন্তু আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় এসেছে, সবকিছু শেখ মুজিবের নামে করার চেষ্টা করেছে। ১৯৯৬ সালে বলা হলো, যাঁরা বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন, তাঁরাই মুক্তিযোদ্ধা। ২০১৬ সাল থেকে প্রতিটি আইনে সংজ্ঞার শুরুতেই ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’-এর নাম যুক্ত করা হয়েছে।
২০০২ সালে বিএনপির আমলে যখন জামুকা আইন তৈরি করা হয়, তখন বলা হয়েছিল, ‘জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সমুন্নত রাখা এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিতকরণকল্পে’ এটা করা হচ্ছে; কিন্তু ২০২২ সালে সেই আইন রহিত করে যখন নতুন আইন করা হচ্ছে, তখন বলা হচ্ছে, ‘জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সমুন্নত রাখিবার এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করিবার লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গঠন করিবার স্বপ্ন বাস্তবায়নের অংশ হিসাবে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিতকল্পে।’
এটি মুক্তিযুদ্ধের ‘দলীয়করণ’ ও ‘আওয়ামীকরণ’-এর স্পষ্ট নজির। শেখ মুজিব একাত্তরে অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠেছিলেন, এটা সত্য। অন্যদিকে সবাই তাঁর আহ্বানেই যুদ্ধ করেছেন, সেটা সত্য নয়। এটা দলীয় বয়ান। যুদ্ধ ছিল বিচিত্র; তার ভাব ও ভঙ্গিমা ছিল বিচিত্র।
৫.
মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নিয়ে তৈরি হওয়া এ সমস্যার জট খোলার পরিবর্তে আমরা সম্ভবত আরেক নতুন আবর্তে পড়তে যাচ্ছি। একদিকে ‘মুজিবনগর সরকার’ নিয়ে একটা ভালো ধোঁয়াশা রেখে দেওয়া হয়েছে। সংজ্ঞায় থাকা মুজিবনগর সরকার নিয়ে যা বলা হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে, মুজিবনগর সরকার দিয়ে আসলে মুজিবনগর সরকারের কেবল মন্ত্রিসভা বা ক্যাবিনেটকেই বোঝানো হচ্ছে। অন্যদিকে ‘সহযোগী’ নামে নতুন একটি বর্গ তৈরি হলে, তার পরিধিও বাড়তে থাকবে। যদি সুযোগ-সুবিধা সমানই থাকে, যেভাবে বলা হচ্ছে, তাহলে এটি আরেকটি বিতর্কের জন্ম দেবে।
গত পঞ্চাশ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন। যাঁরা যুদ্ধে অংশ নেন, আহত বা ক্ষতিগ্রস্ত হন, রাষ্ট্র অবশ্যই তাঁদের সম্মান জানাবে ও দেখভাল করবে। কিন্তু এটা করতে গিয়ে যদি আরেকটি ‘সুবিধাভোগী’ বর্গ তৈরি হয়, যা ক্রমাগত আকারে বাড়তে থাকে, তখন জনমনে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ইতিহাসের এ শিক্ষা আমাদের অবশ্যই নেওয়া উচিত। যদিও আমরা জানি, ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না।
● সহুল আহমদ গবেষক
* মতামত লেখকের নিজস্ব