মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যাঁরা দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে রণাঙ্গনে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন এবং যাঁরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন, শুধু তাঁরাই ‘বীর মুক্তিযোদ্ধার’ স্বীকৃতি পাবেন। এর বাইরে যাঁরা দেশে-বিদেশে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন, বিশ্বজনমত তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন, তাঁরা হবেন ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’।

জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) আইন সংশোধন করে নতুন যে অধ্যাদেশ হতে যাচ্ছে, তাতে বীর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় এ পরিবর্তন আনা হচ্ছে। ইতিমধ্যে এই অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। এর আগে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হয়েছিল ২০২২ সালে। সর্বশেষ সংজ্ঞায় মুক্তিযুদ্ধের সময় যাঁরা যুদ্ধ করেছিলেন এবং যাঁরা বিশেষ অবদান রেখেছিলেন, তাঁদের সবাইকে বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞা পরিবর্তন আনার দাবি উঠে বিভিন্ন মহল থেকে। এরপর বিষয়টি নিয়ে তাঁরা খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক এবং বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে কথা বলেছেন। প্রায় সবাই বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন আর যাঁরা বিভিন্ন উপায়ে অবদান রেখেছেন, তাঁরা একই কাতারে থাকতে পারেন না। যে কারণে সবার মতামত নিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা পরিবর্তন করা হচ্ছে।

তবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক একাধিক গবেষক প্রথম আলোকে বলছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন সময়ে বীর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় পরিবর্তন করেছিল। এখন আবার নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী শ্রেণি করাও ঠিক হচ্ছে না। এটি সম্মানজনক হবে না। ভবিষ্যতে এ নিয়ে সংকট ও তিক্ততা আরও বাড়বে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক আফসান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞা, মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক ছিল। কখনো রাজনৈতিক কারণে, কখনো সুবিধার কারণে এসব পরিবর্তন হয়। মুক্তিযুদ্ধে নানা ধরনের মানুষ অংশগ্রহণ করেছিলেন, বিভিন্নভাবে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তবে রাজনৈতিক কারণে সব সরকারই মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞায় পরিবর্তন এনেছে। এটি এখন আবার হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা কারা হবেন

খসড়া অধ্যাদেশে নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যাঁরা দেশের ভেতরে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগী রাজাকার, আল–বদর, আল শামস, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন, এ রূপ সব বেসামরিক নাগরিক (ওই সময়ে যাঁদের বয়স সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন বয়সের মধ্যে ছিল) বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাবেন। এর পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী, মুক্তিবাহিনী, বিএলএফ ও অন্যান্য স্বীকৃত বাহিনী, পুলিশ বাহিনী, ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্ট (ইপিআর), নৌ কমান্ডো, কিলো ফোর্স ও আনসার সদস্যরাও বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হবেন।

সংজ্ঞায় বেসামরিক নাগরিক বলতে তিনটি শ্রেণির কথা বলা হয়েছে। প্রথমত, যেসব ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে তাঁদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীর মাধ্যমে নির্যাতিত সব নারী (বীরাঙ্গনা)। তৃতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধের সময় আহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী ফিল্ড হাসপাতালের সব চিকিৎসক, নার্স ও চিকিৎসা সহকারী। এই তিন শ্রেণির সবাই বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাবেন।

কারা হবেন মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী

খসড়া অধ্যাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী নামে নতুন একটি ধারা যুক্ত করা হচ্ছে। সহযোগীদের সম্পর্কে বলা আছে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যাঁরা দেশের ভেতরে বা প্রবাসে অবস্থান করে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দীপ্ত করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করতে সংগঠকের ভূমিকা পালন, বিশ্বজনমত গঠন, কূটনৈতিক সমর্থন অর্জন এবং মনস্তাত্ত্বিক শক্তি অর্জনে বাংলাদেশের যেসব নাগরিক প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা করেছিলেন, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীর মর্যাদা পাবেন।

সহযোগীদের জন্য পাঁচটি শ্রেণি ঠিক করা হয়েছে। প্রথমত, যেসব বাংলাদেশি পেশাজীবী মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশে অবস্থানকালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন এবং যেসব বাংলাদেশি নাগরিক বিশ্বজনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, যেসব ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) অধীন কর্মকর্তা বা কর্মচারী বা দূত, মুজিবনগর সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তৃতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) সঙ্গে সম্পৃক্ত সব এমএনএ (জাতীয় পরিষদের সদস্য) বা এমপিএ (প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য), যাঁরা পরবর্তী সময়ে গণপরিষদের সদস্য হিসেবে গণ্য হয়েছিলেন। চতুর্থত, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের সব শিল্পী ও কলাকুশলী এবং দেশ ও দেশের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে দায়িত্ব পালনকারী সব বাংলাদেশি সাংবাদিক। পঞ্চমত, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।

যদিও এই পাঁচ শ্রেণির ব্যক্তিরা বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে আসছেন। জামুকা আইনের সংশোধিত অধ্যাদেশ জারি হলে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী হবেন।

বিদ্যমান জামুকা আইনে যেসব জায়গায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লেখা রয়েছে, অধ্যাদেশে তা বাদ দেওয়া হচ্ছে। বিদ্যমান আইনে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ শব্দের পরিবর্তে ‘লক্ষ্য’ শব্দটি যুক্ত করা হচ্ছে।

মুক্তিযুদ্ধ বলতে জামুকা আইনে এখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণায় সাড়া দেওয়ার বিষয়টি রয়েছে। নতুন অধ্যাদেশে এই লাইনসহ কিছু শব্দ বাদ পড়ছে। এর পরিবর্তে লেখা হয়েছে, ‘১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষায় হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাদের সহযোগী রাজাকার, আল–বদর, আল–শামস, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ।’

মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১১ বার বীর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও মানদণ্ড বদলানো হয়েছে। এর মধ্যে শুধু সংজ্ঞা বদলানো হয়েছে পাঁচবার। অধ্যাদেশ জারি হলে বীর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও মানদণ্ড বদলাবে ১২ বার। অন্যদিকে এখন পর্যন্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে সাতবার।

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা, ভাতা প্রদানসহ অন্যান্য তথ্য ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) নামের একটি সফটওয়্যারে হালনাগাদ করে থাকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এমআইএসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ লাখ ৯৭ হাজার ৮০০। এর মধ্যে মাসিক ভাতা পান ১ লাখ ৯৬ হাজার ৪৫৪ জন। তবে নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী করা হলে স্বাভাবিকভাবেই বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কমে যাবে। সেটি কমে কত হবে, তা নিশ্চিত করতে পারেনি মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক–ই–আজম ২৩ মার্চ তাঁর দপ্তরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূলত যাঁরা রণাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, কেবল তাঁরাই বীর মু্ক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাবেন। যাঁরা নানা আঙিকে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, কেউ কূটনৈতিক সহযোগিতা করেছেন, কেউ গান গেয়েছেন, তাঁরা হবেন মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী।’

ফারুক–ই–আজম বলেন, জামুকার সংশোধিত অধ্যাদেশ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছিল। তারা কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছে, সেগুলো সংশোধন করা হচ্ছে।

এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা ফারুক–ই–আজম বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত বাংলাদেশ সরকারে (মুজিবনগর সরকার) যাঁরা ছিলেন, তাঁদের বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। খসড়া অধ্যাদেশে প্রথমে তাঁদের মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী করার চিন্তা ছিল। এখন এটি সংশোধন করা হচ্ছে।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

খসড়া অধ্যাদেশে নতুন একটি ধারা (১৪) যুক্ত করা হয়েছে। এতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়টি রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ অর্থ ‘১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের পক্ষে মুজিবনগর সরকার কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লেখিত বাংলাদেশের জনগণের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিতকল্পে যে চেতনা’।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্লার্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক মোহাম্মদ সাজ্জাদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধের পর কোনো বিতর্কের বিষয় ছিল না। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞার আদি রূপে ফেরার একটা প্রয়াস দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার পরিধি যেভাবে বাড়িয়েছিল, তাতে প্রবাসীরাও মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট পাওয়া শুরু করেছিলেন। এর রাশ টেনে ধরতে চাইছে এই সরকার।

গবেষক সাজ্জাদুর রহমান বলেন, রাজনৈতিক নেতাদের যেভাবে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত আগের সরকার নিয়েছিল, তা অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু এবার যেভাবে তাঁদের সহযোগীর কাতারে নামিয়ে আনা হচ্ছে, তাতে বিতর্ক আরও বাড়বে। যেহেতু মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধ বলা হয়, তাই নানা ধরনের সহযোগীদের আলাদা করে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার বিষয়টা সুবিবেচনা প্রসূত হবে না।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম ক ত য দ ধ র সহয গ ম ক ত য দ ধ র সময় দখলদ র প ক স ত ন অবদ ন র খ ছ প রথম আল ক ১৯৭১ স ল র য দ ধ কর ছ কর ছ ল ন র জন ত ক স ব ধ নত র ব ষয়ট র সরক র সরক র র র রহম ন র সদস য ক ত কর কর ছ ন য সব ব হয় ছ ল মন ত র ইসল ম

এছাড়াও পড়ুন:

সকালের সবচেয়ে বরকতময় সময় ব্যবহারের ৭ কৌশল

সকাল মানুষের জীবনের একটি মূল্যবান সময়, যা দিনের বাকি অংশের জন্য সুর নির্ধারণ করে। সকাল আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার, শরীর ও মনকে প্রস্তুত করার এবং দিনের লক্ষ্য অর্জনের একটি সুবর্ণ সুযোগ।

সামাজিক মাধ্যম, কাজের চাপ এবং পারিবারিক দায়িত্ব আমাদের অনেক সময় কেড়ে নেয়, তাই সকালকে সঠিকভাবে ব্যবহার করে আমরা জীবনকে আরও উৎপাদনশীল করতে পারি।

১. আল্লাহর সঙ্গে দিনের শুরু

ফজরের নামাজের ১৫-২০ মিনিট আগে উঠে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া এবং দোয়া করা জীবনকে আমূল বদলে দিতে পারে। এই সময়টি শান্ত ও পবিত্র, যখন আল্লাহর সঙ্গে কোনো বাধা থাকে না।

কে আছে আমাকে ডাকার, আমি সাড়া দেব? কে আছে আমার কাছে চাওয়ার, আমি দান করব? কে আছে ক্ষমা প্রার্থনা করার, আমি ক্ষমা করব?সহিহ বুখারি, হাদিস: ১,১৪৫

নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘প্রতি রাতে, যখন রাতের শেষ তৃতীয়াংশ বাকি থাকে, তখন আমাদের রব নিকটতম আসমানে নেমে আসেন এবং বলেন, ‘কে আছে আমাকে ডাকার, আমি সাড়া দেব? কে আছে আমার কাছে চাওয়ার, আমি দান করব? কে আছে ক্ষমা প্রার্থনা করার, আমি ক্ষমা করব?”’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১,১৪৫)।

তাহাজ্জুদের সময় আপনার হৃদয়ের কথা আল্লাহর কাছে প্রকাশ করুন। এতে মানসিক শান্তি বাড়বে এবং দিনের জন্য ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হবে। যদি আপনি নতুন হন, সপ্তাহে এক দিন থেকে শুরু করুন এবং ধীরে ধীরে এটি অভ্যাসে পরিণত করুন।

ফজরের আগে অবশিষ্ট সময়ে কোরআন তিলাওয়াত করুন, কারণ কোরআনে বলা হয়েছে, ‘ভোরে কোরআন পড়া (ফেরেশতাদের) দ্বারা প্রত্যক্ষ করা হয়।’ (সুরা ইসরা. আয়াত: ৭৮)।

আরও পড়ুনইশরাকের নামাজ: সকালের আলোয় আল্লাহর নৈকট্য ০৪ জুলাই ২০২৫২. ফজরের পর ঘুম থেকে দূরে থাকুন

ফজরের নামাজের পর ঘুমিয়ে পড়া অনেকের অভ্যাস, কিন্তু এটি সকালের বরকতময় সময় নষ্ট করে। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ আমার উম্মতের জন্য সকালের সময়কে বরকতময় করেছেন।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ২৬,৪৮১)।

এই সময়ে বড় বড় কাজ সহজে সম্পন্ন করা যায়, কারণ এতে আল্লাহর বিশেষ বরকত রয়েছে।

আল্লাহ আমার উম্মতের জন্য সকালের সময়কে বরকতময় করেছেন। মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ২৬,৪৮১

ফজরের পর ঘুমের প্রলোভন এড়াতে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। এই সময়ে পড়াশোনা, কোরআন মুখস্থ করা বা কোনো ব্যক্তিগত প্রকল্পে কাজ করা যায়। এটি দিনের বাকি সময়ে অবসরের জন্য সময় বাঁচায় এবং আগামী দিনে আরও তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস তৈরি করে।

বিশ্বের সফল ব্যক্তিরাও ভোর চারটা বা পাঁচটায় উঠে কাজ শুরু করার কথা বলেন, যা তাদের সাফল্যের একটি রহস্য।

৩. করণীয় তালিকা তৈরি করুন

একটি করণীয় তালিকা তৈরি করা দিনের পরিকল্পনাকে সুসংগঠিত করে। আমরা প্রায়ই মনে মনে কাজের পরিকল্পনা করি, কিন্তু মস্তিষ্কের ধারণক্ষমতা সীমিত। একটি ডায়েরি বা ফোনের নোট অ্যাপে কাজের তালিকা লিখে রাখলে সময় ও শক্তি সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়। সম্পন্ন হওয়া কাজগুলো তালিকা থেকে কেটে দেওয়ার একটা আলাদা আনন্দ আছে।

এই তালিকায় দৈনন্দিন কাজের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যও অন্তর্ভুক্ত করুন। যেমন কোরআনের একটি নির্দিষ্ট অংশ মুখস্থ করা বা একটি নতুন দক্ষতা শেখার পরিকল্পনা। এটি আপনাকে দিনের শুরুতে ফোকাসড রাখবে এবং উৎপাদনশীলতা বাড়াবে।

আরও পড়ুনযে ৪টি পরীক্ষা নবীজি (সা.)–এর জীবনকে দৃঢ়তা দিয়েছে২২ জুলাই ২০২৫বিশ্বের সফল ব্যক্তিরাও ভোর চারটা বা পাঁচটায় উঠে কাজ শুরু করার কথা বলেন, যা তাদের সাফল্যের একটি রহস্য।৪. সকালে স্ক্রিন থেকে দূরে থাকুন

সকালের মূল্যবান সময় সামাজিক মাধ্যমে বা ফোনে অযথা স্ক্রল করে নষ্ট করা উচিত নয়। অনেকে সকালে ফোন হাতে নিয়ে ‘শুধু একটু দেখে নিই’ ভেবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হারিয়ে ফেলেন। এটি মানসিক চাপ বাড়ায় এবং সকালের শান্তি নষ্ট করে।

নিয়ম করুন, সকালের নাশতা বা কিছু কাজ শুরু না করা পর্যন্ত ফোন বা সামাজিক মাধ্যমে যাবেন না। সকালে খবর পড়া এড়িয়ে চলুন। কারণ, এটি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করতে পারে। যখন ফোন ব্যবহার করবেন, তখন ইতিবাচক ও প্রেরণাদায়ক কনটেন্ট দেখুন, যা আপনার দিনকে উজ্জ্বল করবে।

৫. শরীরচর্চা করুন

শরীরচর্চার উপকারিতা আমরা সবাই জানি। বিশেষ করে এই সময়ে, যখন অনেকে বাড়ি থেকে কাজ করছেন, শরীরচর্চা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। বাড়িতে কাজ করার ফলে ঘাড়ে ও পিঠে ব্যথা, পেশির সমস্যা বাড়ছে।

সকালে মাত্র ৩০ মিনিট শরীরচর্চা, যেমন যোগ, পাইলেটস, হাই-ইনটেনসিটি ইন্টারভাল ট্রেনিং বা ব্রিস্ক ওয়াক, আপনার শরীরে রক্ত সঞ্চালন বাড়াবে এবং মনকে সতেজ করবে।

ইউটিউবে হাজারো ধরনের ব্যায়ামের ভিডিও পাওয়া যায়, যা বাড়িতে সামান্য জায়গায় করা যায়। যদি বাইরে যাওয়ার সুযোগ থাকে, তবে সকালে ৩০ মিনিট হাঁটুন। লক্ষ্য হলো শরীরকে সচল রাখা এবং শক্তি বৃদ্ধি করা।

আরও পড়ুনসুস্থ জীবন যাপনে মহানবী (সা.)-এর ৯ অভ্যাস২৪ জুলাই ২০২৫সকালে মাত্র ৩০ মিনিট শরীরচর্চা, যেমন যোগ, পাইলেটস, হাই-ইনটেনসিটি ইন্টারভাল ট্রেনিং বা ব্রিস্ক ওয়াক, আপনার শরীরে রক্ত সঞ্চালন বাড়াবে এবং মনকে সতেজ করবে।৬. পুষ্টিকর নাশতা গ্রহণ

ব্যস্ততার কারণে অনেকে সকালের নাশতা বাদ দেন, কিন্তু গবেষণা বলছে, পুষ্টিকর নাশতা দিনভর মনোযোগ বাড়ায়, অপ্রয়োজনীয় চিনির লোভ কমায় এবং শক্তি জোগায়। নাশতায় উচ্চ ফাইবারযুক্ত খাবার, যেমন ওটস বা মাল্টিগ্রেইন রুটি, স্বাস্থ্যকর চর্বি যেমন অ্যাভোকাডো বা বাদাম, গ্রিক ইয়োগার্ট এবং ফল অন্তর্ভুক্ত করুন।

সময় কম থাকলে একটি স্মুদি তৈরি করুন—পালংশাক, আপেল এবং হিমায়িত কলা ব্লেন্ড করে সুস্বাদু ও পুষ্টিকর নাশতা তৈরি করা যায়। এটি দিনের শুরুতে সবুজ শাকসবজি গ্রহণের একটি সহজ উপায়।

৭. নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন

বাড়ি থেকে কাজ করার সময় অনেকে ক্যাজুয়াল পোশাকে থাকেন। বরং সকালে সুন্দর পোশাক পরুন, যা আপনার মেজাজ উজ্জ্বল করবে। একটু পছন্দের সুগন্ধি ব্যবহার করলে আত্মবিশ্বাস বাড়বে।

আল্লাহ সুন্দর এবং তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন।সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯১

নবীজি (সা) বলেছেন, ‘আল্লাহ সুন্দর এবং তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯১)। নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা শুধু বাহ্যিক নয়, বরং এটি আপনার মানসিক প্রস্তুতি ও দিনের জন্য উৎসাহ বাড়ায়।

সকাল আমাদের দিনের ভিত্তি। ইসলাম আমাদের শেখায় যে সকাল আল্লাহর বরকত নিয়ে আসে। তাহাজ্জুদ, ফজরের পর জাগ্রত থাকা, করণীয় তালিকা তৈরি, স্ক্রিন থেকে দূরে থাকা, শরীরচর্চা, পুষ্টিকর নাশতা এবং নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন—এই সাতটি অভ্যাস আমাদের সকালকে উৎপাদনশীল করবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

সূত্র: দ্য মুসলিম ভাইব ডট কম

আরও পড়ুনরহমতের দুয়ারে হাজিরা১৫ জুন ২০২৪

সম্পর্কিত নিবন্ধ