হার্ট অ্যাটাক জানান দিয়ে আসে না। অফিসে, যানবাহনে, ঘুমের মধ্যে, বক্তৃতার মঞ্চে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা বিরল নয়। এমনকি খেলার মাঠে, খেলাধুলার সময়ও হতে পারে হার্ট অ্যাটাক। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হলে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট বা হঠাৎ হৃৎপিণ্ড বন্ধ হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারলে বন্ধ হয়ে যাওয়া হৃৎপিণ্ডকে আবার সক্রিয় করা যায়। জীবন বাঁচানোর এই প্রাথমিক চিকিৎসাকে বলে কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন বা সিপিআর।

ক্রিকেটার তামিম ইকবালের ক্ষেত্রে এই জীবন রক্ষাকারী সিপিআর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আর তারপর দ্রুততম সময়ে করা এনজিওগ্রাফি ও স্টেন্টিং হার্টের ব্লক দ্রুত খুলে দিয়ে তাঁর জীবন বাঁচিয়েছে। কিন্তু দুই দিন ধরে অনেকেরই মনে প্রশ্ন জেগেছে, যাঁরা নিয়মিত খেলাধুলা করেন, স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করেন, যাঁদের আমরা ‘ফিটেস্ট পারসন’ বলেই জানি, তাঁরা কেন কম বয়সে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হন?

তামিম ইকবালের উদাহরণটি তো আছেই; ২০২১ সালের জানুয়ারিতে মৃদু হার্ট অ্যাটাক হয় ভারতীয় ক্রিকেট তারকা সৌরভ গাঙ্গুলীর। একই বছরের এপ্রিলে হার্টে ব্লক ধরা পরে লঙ্কান স্পিন কিংবদন্তি মুত্তিয়া মুরালিধরনের।

নিয়মিত ব্যায়াম বা কায়িক পরিশ্রমই শেষ কথা নয়

হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধে আমরা নিয়মিত ব্যায়াম বা কায়িক পরিশ্রমের কথা বলি বটে, কিন্তু এটা হার্ট অ্যাটাকের একটা ঝুঁকি মোকাবিলার উপায় মাত্র। হার্ট অ্যাটাকের আরও অনেক ঝুঁকি আছে। সময়মতো গুরুত্বের সঙ্গে সেসবও নির্ণয় করে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। আমরা যদি ভাবি, নিয়মিত ব্যায়াম, খেলাধুলা তো করিই, সে কারণে আমি যথেষ্ট ফিট; আদতে তা সত্য নয়। জানতে হবে শরীরে হৃদ্‌রোগের অন্য ঝুঁকিগুলোর অবস্থা কেমন।

আজকাল অপেক্ষাকৃত কম বয়সেও যে এমন হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে, বংশগতির প্রভাব এখানে উল্লেখযোগ্য একটা ঝুঁকি। বংশগতির প্রভাব বলতে বোঝায়, কারও মা–বাবা, ভাইবোন বা রক্তের সম্পর্কের ৫৫ বছরের কম বয়সী পুরুষ বা ৬৫ বছরের কম বয়সী নারীদের মধ্যে হৃদ্‌রোগ, হার্ট অ্যাটাক বা হঠাৎ মৃত্যুর ইতিহাস থাকলে তাঁরও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি থাকে। আমরা জেনেছি, তামিম ইকবালের বাবাও অল্প বয়সে আকস্মিকভাবে মারা যান। সম্প্রতি তাঁর ভাই নাফিস ইকবালও স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছিলেন।

আরও পড়ুনবয়স ত্রিশের পর গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা নাকি হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ০৭ আগস্ট ২০২৪হার্ট অ্যাটাক ও কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কি এক জিনিস

হার্ট অ্যাটাক ও কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট এক জিনিস নয়। কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলো হঠাৎ হার্টের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া, যা হৃদ্‌যন্ত্রের অন্য কিছু রোগেও হতে পারে। বিশেষ করে অ্যারিদমিয়া বা অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন এ ক্ষেত্রে একটি বড় কারণ। হার্ট অ্যাটাক হলে তাৎক্ষণিকভাবে হৃৎস্পন্দনও অনিয়মিত হতে পারে, যা থেকে মুহূর্তেই হার্টের অ্যারেস্ট হতে পারে। অন্যান্য ঝুঁকির মধ্যে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে উচ্চমাত্রার খারাপ কোলেস্টেরল ও স্থূলতা তো আছেই; ধূমপান, মদ্যপান, বিভিন্ন মাদক সেবন, অত্যধিক মানসিক চাপ, পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়। যত দিন যাচ্ছে, হার্ট অ্যাটাকের নতুন নতুন ঝুঁকি খোঁজার গবেষণা চলছে। রক্তের লাইপোপ্রোটিন ও বায়ুদূষণের কথা এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে। সুতরাং শুধু খেলাধুলা, ব্যায়াম, পরিশ্রম করলেই যে কেউ হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি থেকে মুক্ত বা শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ ফিট থাকবেন, এ কথা হলফ করে বলা যাবে না।

খেলাধুলার সময় কেন হয়

হার্ট অ্যাটাকে হার্টের পেশিতে রক্ত সরবরাহকারী রক্তনালি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। রক্তনালির ভেতরের দেয়ালে দীর্ঘদিন ধরে চর্বি জমতে জমতে এমনটা হয়। যার পরিণতিতে একসময় হয় হার্ট অ্যাটাক। খুব ভারী কাজ, দৌড় কিংবা খেলাধুলার সময় হার্টকে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি শক্তি নিয়ে কাজ করতে হয়। এ জন্য আগে থেকে বা নিয়মিত হার্টের ফিটনেস পরীক্ষা করা না থাকলে খেলাধুলাকালীন হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। এ অবস্থায় অনেক সময় হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিক দ্রুত বা অনিয়মিত হতে পারে। কোনো কিছু বোঝার আগেই হার্ট অ্যাটাক থেকে এভাবে হার্টের অ্যারেস্ট বা অজ্ঞান হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটতে পারে।

আরও পড়ুনহার্ট অ্যাটাকের আগেই কি শরীর বিশেষ কিছু জানান দেয়২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫জরুরি অবস্থায় করণীয়

হঠাৎ অজ্ঞান হলে: হৃদ্‌রোগে হঠাৎ কেউ অজ্ঞান হলে ওই মুহূর্তে যাঁরা কাছে আছেন, তাঁদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। রোগীর সাড়াশব্দ না পাওয়া, নাড়ির স্পন্দন না পাওয়া, শ্বাস–প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাগুলো হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে হার্টের অ্যারেস্ট হওয়ার লক্ষণ। এমন অবস্থায় হার্টকে সবার আগে সচল করতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে সিপিআর দিতে হবে। তিনটি ছন্দোবদ্ধ কাজ হলো সিপিআর। কাজ তিনটি হলো জোরে জোরে বুকের মাঝখানে চাপ দেওয়া, শ্বাসনালি খোলা রাখা এবং মুখে মুখ লাগিয়ে অথবা মাস্কের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর আক্রান্ত ব্যক্তিকে শ্বাস দেওয়া। আক্রান্ত ব্যক্তিকে শক্ত কিছুর ওপর চিত করে শোয়াতে হবে। হাঁটু গেড়ে বসে এক হাতের ওপর আরেক হাতের তালু রেখে দুই হাত দিয়ে বুকের মাঝখানে প্রতি মিনিটে ১০০ বারের মতো চাপ দিতে হবে। প্রতি ৩০ বার চাপ দেওয়ার পর দুইবার আক্রান্ত ব্যক্তির মুখে নিজের মুখ লাগিয়ে শ্বাস দিতে হবে। এক সেকেন্ডে দুইবার শ্বাস দিতে হবে। এ রকম ছন্দোবদ্ধ বুকে চাপ এবং শ্বাস দেওয়ার কাজ টানা দুই মিনিট করার পর নাড়ির গতি এবং শ্বাস–প্রশ্বাস আবার পরীক্ষা করে দেখতে হবে। শ্বাস–প্রশ্বাস ও নাড়ির গতি ফিরে না আসা পর্যন্ত কাজটি করে যেতে হবে। দ্রুত আক্রান্ত ব্যক্তিকে সিপিআর দেওয়া অবস্থায়ই হাসপাতালে নিতে হবে।

হঠাৎ বুকে ব্যথায়: হঠাৎ বুকের মাঝখানে ব্যথা, যা কোনোভাবেই যাচ্ছে না; সঙ্গে শরীরে ঘাম, বমি বা বমির ভাব, বুক ধড়ফড়, শ্বাসকষ্ট হওয়া হার্ট অ্যাটাকের উপসর্গ। এ অবস্থায় দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে যেতে হবে। হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসায় সময়ের হিসাব করা হয় মিনিটের সঙ্গে। রোগী হাসপাতালে পৌঁছালে ইসিজি, টপ্রোনিন আইসহ দু–একটি জরুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে হার্ট অ্যাটাক নিশ্চিত হওয়া যায় এবং দ্রুত চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়। হার্ট অ্যাটাকে বুকে ব্যথা শুরুর প্রথম ১২ ঘণ্টার মধ্যে রোগীকে এনজিওগ্রাম করে স্টেন্টিং বা রিং লাগিয়ে চিকিৎসা করতে পারলে রোগীর জন্য তা সবচেয়ে ফলপ্রসূ হয়। বিশ্বব্যাপী এটাই স্বীকৃত এবং আদর্শ চিকিৎসাপদ্ধতি। তবে হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসার সুবিধা সব হাসপাতালে একরকম নয়। সুতরাং রোগীর অবস্থাভেদে এবং হাসপাতালের সক্ষমতা অনুযায়ী রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। কখনো হার্ট অ্যাটাকের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রোগীকে উচ্চমানের হাসপাতালে পাঠানো হয়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রোগীকে সুযোগ–সুবিধাসংবলিত হাসপাতালে নেওয়া গেলে, জীবনরক্ষাকারী ধমনির জমাটবাঁধা রক্ত তরল করার ওষুধ ব্যবহার করেও চিকিৎসা করা যায়।

সচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ: যাঁরা অ্যাথলেট, খেলোয়াড় কিংবা ব্যায়ামবিদ, তাঁদের অধিকতর সচেতন হতে হবে। নিজের হার্ট খেলাধুলা বা অন্য কোনো ভারী পরিশ্রমের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর মতো যথেষ্ট উপযুক্ত কি না, তা কার্ডিওপালমোনারি এক্সারসাইজ টেস্ট করে দেখতে হবে। প্রয়োজনে একজন হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শে নিয়মিত রুটিন করে হার্টের ফিটনেস টেস্ট (ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাফি এবং এক্সারসাইজ টলারেন্স টেস্ট বা ট্রেড মিল টেস্ট) করে দেখতে হবে। ৩০ বছর বয়সের পর প্রতিবছর একবার এটা করা উচিত। অনেক সময় দীর্ঘদিন ভারী কাজ, পরিশ্রম বা খেলাধুলা করা ব্যক্তি যখন এসব বন্ধ করে দেন, তখন তাঁর ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, মুটিয়ে যাওয়া এবং রক্তের খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। এসবও বছর বছর চেক করে দেখতে হবে।

ডা.

শরদিন্দু শেখর রায়, সহকারী অধ্যাপক, হৃদ্‌রোগ বিভাগ, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা

আরও পড়ুনহার্ট অ্যাটাকের ৬টি লক্ষণ এবং হার্ট অ‍্যাটাক হলে সঙ্গে সঙ্গে যা করবেন২৪ মার্চ ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ত ম ম ইকব ল অবস থ য় স প আর হওয় র

এছাড়াও পড়ুন:

বিদ্যুৎ খাতে সংঘবদ্ধ দুর্নীতি হয়েছে: পর্যালোচনা কমিটি

বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির নামে বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো সরকারের কাছ থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া বাবদ অর্থ নিয়েছে, যেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহের চেয়ে দুর্নীতিই মুখ্য ছিল বলে অভিমত দিয়েছে সরকার গঠিত চুক্তি পর্যালোচনা কমিটি। তারা বলেছে, চুক্তিতে ব‍্যবসায়ীদের কোনো ঝুঁকি নেই, সব ঝুঁকি সরকারের। এটি সরকারের অদক্ষতাজনিত ব‍্যর্থতা নয়, দুর্নীতি জড়িত। তাই চুক্তি বাতিল করা সম্ভব।

বিদ্যুৎ খাতের চুক্তি পর্যালোচনা কমিটির তিন সদস্যের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তাঁরা বলেছেন, গত সরকারের দেড় দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে চার গুণ, খরচ বেড়েছে ১১ গুণ। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইনটি করাই হয়েছে দুর্নীতির জন্য। এখানে সংঘবদ্ধ দুর্নীতি হয়েছে। বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিগুলো ভাড়া আদায়ের নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে কাজ করেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো জ্বালানি আমদানি করেছে নিজেরা। এতেও দুর্নীতি হয়েছে।

তবে এখন এসব চুক্তি বাতিল করতে হলে অনুসন্ধান করে দুর্নীতির প্রমাণ খুঁজে বের করতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন পর্যালোচনা কমিটির সদস্যরা। তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের প্রতিবেদন নিয়ে সরকারের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করতে পারে। গত সরকারের সময় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একের পর এক একতরফা চুক্তি করা হয়েছে। চুক্তিতে সব সুবিধা দেওয়া হয়েছে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে, রাষ্ট্রের কথা চিন্তা করা হয়নি। একটি চুক্তি যেন আরেকটির প্রতিলিপি। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ সংস্থাগুলো এতে জড়িত ছিল। গ্যাস পাওয়া যাবে না, চুক্তি করা হোক—এমন সুপারিশও দেখা গেছে মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে।

পর্যালোচনা কমিটির তিনজন সদস্যের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেন, শুধু চুক্তি নয়, চুক্তির আগের পুরো প্রক্রিয়া যাচাই করে দেখা হয়েছে। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপের নমুনা পাওয়া গেছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বেও ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। সাবেক দুই বিদ্যুৎসচিব, যাঁরা পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব হয়েছিলেন; তাঁদের সংশ্লিষ্টতা আছে সংঘবদ্ধ দুর্নীতিতে। এই দুজন হলেন আবুল কালাম আজাদ ও আহমদ কায়কাউস।

# চুক্তি পর্যালোচনা কমিটির অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন
# দেড় দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে চার গুণ, খরচ বেড়েছে ১১ গুণ
# ব্যবসায়ী, আমলা, সরকারের শীর্ষ পর্যায় মিলে সংঘবদ্ধ দুর্নীতি
# চুক্তি বাতিল সম্ভব, দুদকের তদন্ত করতে হবে
# আদানির চুক্তিতে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে

দায়মুক্তি আইন হিসেবে পরিচিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনটি বাতিল করা হয় গত বছরের নভেম্বরে। এর আগেই এ আইনের অধীনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে গত সরকারের করা চুক্তিগুলো পর্যালোচনায় গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।

কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে আছেন হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী। কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও সহ-উপাচার্য আবদুল হাসিব চৌধুরী, কেপিএমজি বাংলাদেশের সাবেক প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) আলী আশফাক, বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ফ্যাকাল্টি অব ল অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সের অর্থনীতির অধ্যাপক মোশতাক হোসেন খান ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক।

জানুয়ারিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন

আজ রোববার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দিয়েছে চুক্তি পর্যালোচনা কমিটি। আগামী জানুয়ারির মাঝামাঝি চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেবে তারা। এ ছাড়া ভারতের আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে করা চুক্তির অনিয়ম নিয়েও একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তারা। প্রতিবেদন জমার পর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে একটি সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন কমিটির সদস্যরা।

সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, কারণ ছাড়া চুক্তি বাতিল করলে তার ক্ষতিপূরণের বিষয়টি চুক্তিতেই বলা আছে। তবে প্রতিটি চুক্তিতেই স্বীকারোক্তি থাকে যে এই চুক্তিতে কোনো দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়নি। এটা যদি লঙ্ঘিত হয়, তাহলে চুক্তি বাতিল করা যায়। কিন্তু মুখের কথা তো আদালত মানতে চাইবেন না, সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দিতে হবে আদালতে। কমিটির সহায়তায় চুক্তির অনিয়ম খুঁজে দেখা হচ্ছে। কারণ, খুঁজে পাওয়া গেলে চুক্তি বাতিলে দ্বিধা করা হবে না।

কমিটির আহ্বায়ক মঈনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, চুক্তি কতটা বাতিল করা যাবে, তা ভবিষ্যৎ বলে দেবে। বিদ্যুৎ খাতের চুক্তিগুলো পুরোপুরি কারিগরি, তাই সময় লেগেছে পর্যালোচনায়। এতে ব্যাপক দুর্নীতি পাওয়া গেছে। আগামী জানুয়ারির মাঝামাঝি চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে কমিটির সদস্য জাহিদ হোসেন বলেন, চুক্তি–সম্পর্কিত নথি দেখা হয়েছে। পিডিবি থেকে পরিশোধ করা বিলের তথ্য নেওয়া হয়েছে। এগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা হয়েছে, কী কী ধরনের অনিয়ম হয়েছে। ক্ষমতার কেন্দ্রীয়করণ ছিল, মন্ত্রণালয় সব সময় প্রধানমন্ত্রীর হাতে ছিল। বিদ্যুৎ খাতে যে পরিমাণ বিল পরিশোধ করা হয়েছে এবং এর বিপরীতে যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে, এর হিসাব আইনস্টাইনও মেলাতে পারবেন না।

চুক্তি বাতিল করলে ক্ষতিপূরণের বিষয়ে জানতে চাইলে কমিটির সদস্য শাহদীন মালিক বলেন, যাঁরা ক্ষতিপূরণ দাবি করবেন, তাঁরা তাঁদের ক্ষতির হিসাব দেবেন। তাই ক্ষতিপূরণের বিষয়টা তো এ কমিটি বলতে পারবে না।

দুর্নীতির কারণে বেড়েছে বিদ্যুতের দাম

সংবাদ সম্মেলনে কমিটির সদস্য মোশতাক হোসেন খান বলেন, ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। দুর্নীতির কারণে বিদ্যুতের দাম ২৫ শতাংশ বেশি হয়ে গেছে। ভর্তুকি না থাকলে ৪০ শতাংশ বেড়ে যেত। এ দামে ব্যবসা-বাণিজ্য টিকতে পারবে না। এটা কমাতে হবে। যারা টাকা নিয়ে চলে গেছে, তাদের বোঝাতে হবে, তারা পার পাবে না। তাড়াতাড়ি করলে ভুল হতে পারে, তাই সময় লেগেছে। তবে রাষ্ট্রের সঙ্গে কোম্পানির চুক্তিগুলো সার্বভৌম চুক্তি। চাইলেই এটা বাতিল করা যায় না। বড় জরিমানা দিতে হতে পারে।

আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে মোশতাক হোসেন বলেন, আদানির চুক্তির অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে আদালতে রিট হয়েছে। আদালত প্রতিবেদন চেয়েছেন। মাসখানেকের মধ্যে শক্ত প্রমাণ সামনে আসবে। এসব প্রমাণ নিয়ে দেশে-বিদেশে আইনি প্রক্রিয়া নেওয়া যাবে।

পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশে মূলত ভবিষ্যতে সুরক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যাতে এ ধরনের চুক্তি না করা হয়। চুক্তির আগে স্বাধীন কমিশনের মাধ্যমে যাচাই করে দেখার কথা বলা হয়েছে। পর্যালোচনা কমিটির পরামর্শে গত ২১ জানুয়ারি করা হয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ট্যারিফ (বিদ্যুতের দাম) পর্যালোচনা কমিটি। এ কমিটির কাজ চলমান।

চুক্তি অনুসারে প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনে নেয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম নির্ধারণে একটি সূত্র দেওয়া আছে চুক্তিতে। এ সূত্র অনুসারে দাম নির্ধারিত হয়। একেক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে একেক দাম। সমঝোতার মাধ্যমে কাউকে কাউকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। দরপত্র ছাড়া বিশেষ বিধান আইনে এভাবে চুক্তি করার সুযোগ নিয়েছে গত আওয়ামী লীগ সরকার।

বিশেষ বিধান আইনটি করা হয় ২০১০ সালে। এরপর দফায় দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়। এই আইনের অধীনে নেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। এর কারণে এটি দায়মুক্তি আইন হিসেবে পরিচিত। এ আইনের অধীনে দরপত্র ছাড়া একটার পর একটা চুক্তি করেছিল গত সরকার।

সম্পর্কিত নিবন্ধ