রাইসুল ইসলাম (৫০) ও সোলায়মান আলী (৪৫) পেশায় ছাগল ব্যবসায়ী। বাড়ি দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার ভিয়াইল এলাকায়। রোববার সকালে একটি মোটরসাইকেলে দিনাজপুর শহরের বড়বন্দর হাটে ছাগল কিনতে যাচ্ছিলেন। পথে মহারাজার মোড়ে তাঁদের মোটরসাইকেলের গতিরোধ করে হেলমেট না পরার কারণ জানতে চান দুই সেনাসদস্য। উত্তরে রাইসুল বলেন, ‘স্যার হারা শহরত ঢুকি না। গ্রামোত ঘুরি ঘুরি ছাগল কিনি। আইজ পয়লাবার শহরের হাটত আইসিনো। স্যার হামাক এংনা ছাড়ি দেও।’
রাইসুলের মোটরসাইকেলটি পুরোনো। পেছনে দেখার আয়না নেই, নেই নির্দেশক (ইন্ডিকেটর) বাতি। এমনকি চাবি ছাড়াই মোটরসাইকেলটি চালু করা যায়। সেনাসদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেল, মোটরসাইকেলের নিবন্ধন নেই, নেই ইনস্যুরেন্স। সঙ্গে রাইসুলের ব্যক্তিগত লাইসেন্সও নেই। এত সব নেই দেখে ট্রাফিক পুলিশের কাছে তিন হাজার টাকা জরিমানাসহ একটি মামলা খেলেন রাইসুল। পুলিশের জেরার মুখে ততক্ষণে গাল বেয়ে ঘাম ঝরছে তাঁর।
রোববার সকাল সাড়ে নয়টা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত রাইসুলের মতো অনেকেই পুলিশ ও সেনাসদস্যদের জেরার মুখে পড়েছেন। শহরের মহারাজা মোড় এলাকায় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যৌথ উদ্যোগে চেকপোস্ট বসানো হয়। মূলত চিরিরবন্দর উপজেলা থেকে শহরে ঢোকার প্রবেশমুখ মহারাজার মোড়। মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহনের বৈধ কাগজপত্র, চালকের নিবন্ধন, মোটরসাইকেলচালকদের হেলমেট আছে কি না এসব খতিয়ে দেখেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। যাঁরা ঠিকঠাক কাগজপত্র দেখাচ্ছেন, তাঁরা ছাড় পাচ্ছেন। অন্যরা বিভিন্ন ধারায় মামলা খাচ্ছেন, জরিমানা গুনছেন।
দিনাজপুর সেনা ক্যাম্পের কমান্ডার সাজিবুর রহমান বলেন, সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে। মূলত মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত ও দুষ্কৃতকারীদের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণে যৌথ বাহিনী চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি কার্যক্রম চালায়। এটি চলমান কর্মসূচি। ঈদ–পরবর্তী সময়ে তাঁরা কার্যক্রমে বেশি জোর দিয়েছেন।
পুলিশের জেরার মুখে পড়েছেন সুমন চন্দ্র রায় (৪২)। মাথায় হেলমেট নেই। গাড়ির নিবন্ধন নেই। সুমন চন্দ্র বলেন, ‘কয়েক দিন হলো গাড়ি কিনেছি। হেলমেট আছে, গতকালকে অফিসে রেখে আসছি।’ পুলিশ কথা শোনেনি। জরিমানা করেছেন দুই হাজার টাকা। খানিকটা উত্তেজিত হলেন তিনি। পরে ওই পুলিশ সদস্য গাড়ি থানায় নেওয়ার হুমকি দিলে অগত্যা জরিমানার স্লিপ নিয়ে দ্রুত প্রস্থান করেন।
মাথায় হেলমেট নেই কেন প্রশ্নের জবাবে আব্দুস সালাম নামের মধ্যবয়সী একজন পুলিশকে উত্তরে বলেন, ‘খুব গরম বা। হেলমেটটা মাথাত রাখা যাওছে না। গাড়িত ঝুলে রাখেছি।’
পালসার মোটরসাইকেল নিয়ে মহারাজা মোড় গলির মুখে আসতেই গাড়ি ঘোরানোর চেষ্টা করলেন সাব্বির হোসেন (২৮)। তাঁর মাথায়ও হেলমেট নেই। সাব্বিরের উত্তর ‘এইখানেই বাড়ি, একটু কাজে বের হয়েছি। তাই হেলমেট নেওয়া হয়নি।’ কথা বলতে বলতেই মুঠোফোনে কাকে যেন ফোন করার চেষ্টা। পুলিশ তাঁকে জানায়, ফোন করে লাভ নেই। নিজের ভালোমন্দটা বোঝার চেষ্টা করেন। পরে অবশ্য পুলিশ তাঁকে ছেড়েও দেয়।
জেলা ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) ইকরাম চৌধুরী বলেন, কমবেশি প্রতিদিনই তাঁরা সচেতনতামূলক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে লিফলেট বিতরণ, মাইকে প্রচারণা ও চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি করেন। বিশেষ করে শহরের প্রবেশমুখ মহারাজা মোড়, কলেজ মোড়, বালুয়াডাঙ্গা, পুলহাট, ফুলবাড়ী বাসস্ট্যান্ড, মেডিকেল কলেজ এলাকায় নিয়মিত তল্লাশিচৌকি বসানো হয়। গত এক মাসে ট্রাফিক আইনে বিভিন্ন মামলায় প্রায় ২৮ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
জমিজমার বিরোধে থানায় সালিসে গিয়ে ‘রাজনৈতিক মামলায়’ গ্রেপ্তার যুবক
জমিজমা–সংক্রান্ত বিরোধে ময়মনসিংহ কোতোয়ালি মডেল থানায় সালিসে আসা এক যুবককে ‘রাজনৈতিক মামলায়’ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আজ দুপুরে ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে ওই যুবকের মা আনারা বেগম এ কথা জানান।
গ্রেপ্তার ওই যুবকের নাম আল-আমিন (৩২)। তাঁর বাড়ি নগরের বলাশপুর এলাকায়। মায়ের দাবি, আল-আমিন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। সালিসে জমিজমার কাগজ ঠিক থাকায় সাদা কাগজে স্বাক্ষর করতে রাজি না হলে রাজনৈতিক মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।
তবে পুলিশ বলছে, ওই যুবক যুবলীগের সমর্থক। তাঁকে গ্রেপ্তারে কয়েকবার বাড়িতে অভিযানও চালিয়েছে পুলিশ। থানায় তাঁকে পেয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যদিও গ্রেপ্তারের পর আদালতে পাঠানো প্রতিবেদনে তাঁকে নগরের কেওয়াটখালী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
আজ মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে আল-আমিনের মা আনারা বেগম বলেন, ২০২১ সালে বলাশপুর এলাকায় স্বামীর পেনশনের ১৭ লাখ টাকায় ৩ দশমিক ৬০ শতাংশ জমি কেনেন তাঁরা। এর আগে ২০০৮ সালে একই দাগে ৪ শতাংশ জমি কেনার দাবি করে ২০২২ সালে জোরপূর্বক সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করেন এক ব্যক্তি। এ নিয়ে স্থানীয়ভাবে সালিস হলেও কোনো সুরাহা হয়নি। ৫ আগস্টের পর সরকার পরিবর্তন হলে নিজের কেনা জমিতে বাড়ি করার উদ্যোগ নিলে বাধা হয়ে দাঁড়ান ওই ব্যক্তি ও তাঁর পক্ষের লোকজন।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বিষয়টি সমাধানের লক্ষ্যে কোতোয়ালি মডেল থানায় উভয় পক্ষকে ডাকা হয়। গত শনিবার রাত আটটায় থানায় সালিস শুরু হয়। চলে রাত ১২টা পর্যন্ত। সালিসে শেষ পর্যায়ে যখন জমির কাগজপত্র তাঁদের ঠিক পান সালিসকারীরা, তখন ওসি আল-আমিনকে তাঁর কক্ষে নিয়ে পিটিয়ে হাড়গোড় ভেঙে ফেলার হুমকি দেন। পেছনে পেছনে তিনি গিয়ে প্রতিবাদ করলে তাঁর সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার করা হয়। এরপর আল-আমিনকে গারদে ঢুকিয়ে সাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করার জন্য চাপ দেওয়া হয়। রাজি না হওয়ায় সাজানো রাজনৈতিক মামলায় তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়।
আনারা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে কোনো রাজনীতি করে না। আমার ছেলে ব্যবসা করে। তাকে রাজনৈতিক মামলায় পুলিশ কারাগারে পাঠিয়েছে।’
২৭ জুলাই আল-আমিনকে আদালতে পাঠানোর প্রতিবেদনে পুলিশ উল্লেখ করে, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রাত ১টা ৩৫ মিনিটে পুলিশের টহল দল নগরের আকুয়া ভাঙ্গাপুল এলাকায় অবস্থানকালে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারে যে সদরের উত্তর দাপুনিয়ার সরকারি পুকুরপাড় সেলফি নামের স্থানে পাকা রাস্তার ওপর একদল সন্ত্রাসী জনতাবদ্ধ হয়ে রাস্তা বন্ধ করে গাড়ি ভাঙচুর ও দাঙ্গাহাঙ্গামা সৃষ্টি করে। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে ৫টি মশাল, ২০টি লাঠি, ৩০টি ইটের টুকরা, ২৫টি কাচের টুকরা জব্দ করা হয়। এ ঘটনার পরদিন পুলিশ কোতোয়ালি মডেল থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় আল-আমিনকে সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে ২৬ জুলাই রাত ১১টা ৪০ মিনিটে নগরের কেওয়াটখালী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। প্রতিবেদনে পুলিশ আল-আমিনকে যুবলীগের সমর্থক হিসেবে উল্লেখ করে।
থানার ওই সালিসে থাকা মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি মো. বাবু বলেন, থানা চত্বরের একটি ঘরে এসআই সজীব কোচের উপস্থিতিতে দুই পক্ষের কাগজপত্র বোঝেন, এমন লোকজন নিয়ে সালিস শুরু হয়। একপর্যায়ে আল-আমিনকে ‘ফ্যাসিস্ট’ আখ্যায়িত করে গ্রেপ্তারের দাবি জানান প্রতিপক্ষের লোকজন। পরে তাঁকে থানা থেকেই গ্রেপ্তার করা হয়।
জানতে চাইলে কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ শিবিরুল ইসলাম বলেন, ‘১০ দিন আগে থেকে দারোগারা তাঁকে (আল-আমিন) ধরার জন্য খুঁজতেছে। ডেভিল হান্টের আসামি সে। আমাদের দুই দারোগা ছয় থেকে সাতবার তাঁর বাড়িতে রেড দিছে। সে যুবলীগের ফ্যাসিস্ট। মামলার ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তদন্তে প্রাপ্ত আসামি।’ ওসি বলেন, কোনো কাগজপত্র দিয়ে নোটিশ করে তাঁকে থানায় ডাকা হয়নি। বিচারক যদি মনে করে আমরা তাঁকে ইলিগ্যাল অ্যারেস্ট করেছি, তাহলে আদালত ফাইন্ডিংস দেবেন। আসামিকে থানা থেকে গ্রেপ্তার করা কী নিষেধ আছে?’ আদালতের প্রতিবেদনে ভিন্ন স্থান দেখানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘জজ এটার বিচার করবে। যদি এমন কইরা থাকে, সমস্যা কী?’