লাল সালাম: বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়
Published: 11th, April 2025 GMT
বাংলাদেশে বামপন্থী রাজনীতির মধ্যে নানা মত-পথ, শাখা-প্রশাখা রয়েছে। তরুণ প্রজন্মের বেশির ভাগের কাছেই সব কটি বামপন্থী দল ও এর ছাত্রসংগঠনগুলোর নাম মনে রাখা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। মূল আদর্শগত পাটাতন একই হওয়ার পরও কেন এত ভাগ—এমন প্রশ্নে বাম রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কহীন যে কারও মাথায় ঘোরে। যদিও পদ্ধতিগত ও কৌশলগত ভিন্নতার কারণেই এত ভাগ, কিন্তু এর ফলে বাংলাদেশে ভোটের রাজনীতিতে বাম দলগুলোর যেটুকুই শক্তি আছে, তা-ও বিভক্ত হয়ে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বুঝতে আগ্রহী যে কারও জন্যই এ দেশের বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর ইতিহাস জানা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের সম্প্রতি প্রকাশিত ‘লাল সালাম: বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি’ বইটি আগ্রহী পাঠকের এ–বিষয়ক জিজ্ঞাসার অনেক উত্তর দিতে সক্ষম।
ভলতেয়ার (১৬৪১-১৭৭৮), টমাস পেইন (১৭৩২-১৮০৯), জেরেমি বেনথাম (১৭৪৮-১৮৩৪), কার্ল মার্ক্স (১৮১৮-১৮৮৩) প্রমুখ দার্শনিক ও চিন্তকেরা আধুনিক বাম ভাবাদর্শিক রাজনীতির প্রবক্তা। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে প্রথম কোনো কমিউনিস্ট পার্টি রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে। তবে ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টির সূচনা ঘটে ১৯২০ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীন বর্তমান উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে।
মানবেন্দ্রনাথ রায়ের নেতৃত্বে কিছু প্রবাসী ভারতীয় এই উদ্যোগ গ্রহণ করলেও তা বিরোধিতার মুখে পড়ে। পরবর্তী সময়ে ১৯২৫ সালের ২৫-২৮ ডিসেম্বরে উত্তর প্রদেশের কানপুরে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এই সালকেই তাদের প্রতিষ্ঠা সাল হিসেবে পালন করে থাকে।
সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পাকিস্তানে প্রথম বামপন্থী রাজনৈতিক দল ছিল পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি। ১৯৪৮ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে পাকিস্তানের পার্টির জন্য ৯ সদস্যের একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৪৮ সালের ৬ মার্চ।
পাকিস্তান গঠনের শুরুতে কমিউনিস্ট পার্টি সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করতে সম্মত হলেও সেই সন্ধি বেশি দিন টেকেনি। ১৯৪৮-৫০ সময়ে পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের নেতৃত্বে বেশ কিছু কৃষক বিদ্রোহ ও লাগাতার কৃষক আন্দোলন পরিচালিত হয়। পার্টির অনেক নেতা–কর্মী এসব ঘটনায় নিহত ও কারারুদ্ধ হন। পার্টির সদস্যরা আত্মগোপনে যাওয়ায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। অতিবিপ্লবী লাইনের নানামুখী সমালোচনার ফলে ১৯৫১ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেওয় হয় যে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য থেকে কমিউনিস্ট পার্টি নিজেদের সংগঠিত করবে।
সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেসের পর আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিভক্তির সূচনা ঘটে। ষাটের দশকের শুরু থেকে এর ফলে ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট পার্টিও সোভিয়েত-চীন লাইনে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর এসব বিভক্তি আরও ডালপালা মেলে এ দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলোও নানা মত-পথে ছড়িয়ে পড়ে। সে হিসাবে বর্তমানে বিদ্যমান বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিই আমাদের দেশে প্রথম কমিউনিস্ট পার্টি।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস নিয়ে বেশ কিছু গবেষণামূলক বই ইতিমধ্যে রয়েছে। এ ছাড়া এই পার্টির সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত প্রথিতযশা ব্যক্তিদের কিছু আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ও স্মৃতিচারণাও রয়েছে। সেসব থেকে কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু বেশ কিছু কারণে সম্প্রতি প্রকাশিত ‘লাল সালাম: বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি’ গ্রন্থটি অনন্য হয়ে উঠেছে।
প্রথম কারণ কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে বইয়ের লেখক মতিউর রহমানের ৩০ বছরের পথচলা এবং একটা বড় সময় দলটির নানামুখী প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ততা। দীর্ঘকাল তিনি কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র সাপ্তাহিক একতার সম্পাদক ছিলেন। এ ছাড়া তিনি শিখা, মুক্তির দিগন্ত, গণসাহিত্য ও মুক্তিযুদ্ধ নামের পার্টির অন্যান্য পত্রিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। এর ফলে সহজেই তিনি পার্টির দলিলপত্র ও অনেক লিখিত ইতিহাসের সংস্পর্শে আসতে পেরেছিলেন, যেগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগও তাঁর মধ্যে ছিল।
বইয়ের লেখক মতিউর রহমান বইটি লেখার দীর্ঘ যাত্রাপথের কাহিনি ও অনুপ্রেরণার উৎস সম্পর্কে ভূমিকায় লিখেছেন। নিজ পরিবারে কমিউনিস্ট রাজনীতির আবহ থাকায় এবং ছোটকাল থেকেই এ ঘরানার পত্রপত্রিকা ও প্রকাশনার সংস্পর্শে আসায় বামপন্থার প্রতি তিনি ঝুঁকে পড়েন। তিনি ছাত্র ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট পার্টিসহ নানামুখী বামপন্থী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন।
ভূমিকার অংশ পড়ে জানা যায়, তিনি দেশ–বিদেশের বহু বামপন্থী রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তির সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত ছিলেন। লেখক স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করেছেন, দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার পর বইটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বহু নেতা–কর্মীর প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকারের একটি উপলক্ষ তিনি পেয়েছেন।
এই বইয়ের একটি বিশেষ দিক হলো ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন। বহু বইপত্র ও লেখাজোকা থেকে সেই নির্বাচন সম্পর্কে জানা যায়। সেই নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির বেশ কয়েকজন প্রার্থী জয়লাভ করেছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টি, স্বতন্ত্র ও যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হয়ে তাঁরা লড়েছিলেন। পাকিস্তান সরকারের দমন-পীড়ন ও বাধাবিপত্তির মুখেও এটা ছিল কমিউনিস্টদের একটা উল্লেখযোগ্য সাফল্য। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির ঠিক কতজন প্রার্থী সে নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য কোথাও পাওয়া যায় না। বিভিন্ন লেখায় নানা ধরনের সংখ্যার উল্লেখ পাওয়া যায়।
তবে এই বইয়ে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের ১৯৭৭ সালে প্রণীত প্রতিবেদন এবং তৎকালীন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সূত্র ব্যবহার করে কমিউনিস্ট পার্টির মোট কতজন প্রার্থীর মধ্যে কতজন জয়ী হয়েছিলেন, তার একটা সুনির্দিষ্ট তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এ ছাড়া বহু জানা ঘটনারই বেশ কিছু অজানা দিক উঠে এসেছে এই বইয়ে।
সে সময়ে নানা উদ্যোগের মধ্যে কমিউনিস্টদের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল যুবলীগ গঠন (বর্তমানের যুবলীগ নয়)। এটি ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম প্রগতিশীল যুবসংগঠন। এ ছাড়া ভাষা আন্দোলন, ছাত্র ইউনিয়ন গঠন, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে নানা উদ্যোগ, শান্তি পরিষদ গঠন ইত্যাদি বিষয়ে কমিউনিস্টদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা রয়েছে এই বইয়ে। সে সময়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল গণতন্ত্রী দল গঠন। পাকিস্তান সরকারের নিপীড়নের কারণে তখন প্রকাশ্যে কমিউনিস্ট পরিচয়ে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। তাই গণতন্ত্রী দল গঠনের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট রাজনীতি এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এর পেছনে উদ্যোগ, গঠন এবং এর পরিণতি সম্পর্কে বইয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
দমন–পীড়ন এড়াতে সে সময় কমিউনিস্টরা অন্য দলের ভেতর কাজ করা শুরু করেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তাঁরা যুক্তফ্রন্ট গঠনেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের পরপরই কমিউনিস্টদের গ্রেপ্তার ও আটক করা শুরু হয় এবং শেষ পর্যন্ত পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয়। পাকিস্তান সরকার এবং মার্কিন প্রশাসনের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল। এসব বিষয়ে বেশ কিছু অজানা দিক উঠে এসেছে এই বইয়ে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি ও সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সম্পর্কের নানা দিক নিয়েও আলোচনা রয়েছে এখানে। দেশ-বিদেশের কমিউনিস্ট নেতাদের সঙ্গে লেখক মতিউর রহমানের ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও অভিজ্ঞতার বর্ণনা বইটিকে অনেক বেশি ঋদ্ধ করেছে।
বইয়ের দ্বিতীয় ভাগের শিরোনাম ‘গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম’। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করার পর থেকে দেশ স্বৈরশাসনের কবলে পড়ে। এর পর থেকেই কমিউনিস্টরা নানা ধরনের আন্দোলন–সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকেন। মতিউর রহমানের সংগ্রহে থাকা দলিলপত্রের বরাতে ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত নানামুখী গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগ্রামের চিত্র উঠে এসেছে বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ে। এ অধ্যায়ে সংযুক্ত দলিলপত্রের মধ্যে রয়েছে কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেসে গৃহীত কেন্দ্রীয় কমিটির রাজনৈতিক রিপোর্ট, রাজনৈতিক কর্মসূচি এবং রাজনৈতিক প্রস্তাব। এসব দলিলপত্রে দেখা যায়, ১৯৬৮ সালেই কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেসে স্বাধীন বাংলার প্রশ্ন বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল।
১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা সম্পর্কে বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ে আলোকপাত করা হয়েছে। লেখকের কাছে থাকা বেশ কিছু দুর্লভ প্রচারপত্র, রাজনৈতিক প্রস্তাব, সার্কুলার, মূল্যায়ন পুস্তিকা ইত্যাদি দলিলের বরাতে সে সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকার একটি চিত্রায়ণ করা হয়েছে। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন হয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বিস্তৃত এই অধ্যায়ের সময়কাল।
বইয়ে ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু পরিশিষ্ট যুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ১৯৪৮ সালের কমিউনিস্ট পার্টির সশস্ত্র বিপ্লবের প্রচারপত্র, পূর্ববঙ্গে কমিউনিস্ট বিরোধিতায় ১৯৫০ সালের মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মসূচি, কমিউনিস্ট পার্টির ১৯৫৩ সালের খসড়া রাজনৈতিক কর্মসূচি, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে কমিউনিস্ট ও বামপন্থী প্রার্থীদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, ১৯৫৫-৫৬ সময়ে মুক্তিপ্রাপ্ত রাজবন্দীদের নামের তালিকা এবং ১৯৬৯ সালে মস্কোয় অনুষ্ঠিত ৭৫টি কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে অনিল মুখার্জির বক্তৃতা।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের শুরুর দিকে দলটি বহু বাধাবিপত্তি ও সংগ্রামের মুখে পড়েছিল। পুস্তকের বর্ণনার মতো ছিল না এর গঠনপর্ব। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পুরো ২৪ বছরের নানামুখী রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির উজ্জ্বল ভূমিকা দেখা যায়। তাই বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস ছাড়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এ বিবেচনায় সম্প্রতি প্রকাশিত ‘লাল সালাম: বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি’ বইটি একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
খলিলউল্লাহ্ প্রথম আলোর জলবায়ু প্রকল্প ব্যবস্থাপক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র র জন ত ক র জন ত র অন ষ ঠ ত ব মপন থ প রথম ক উল ল খ বইয় র সরক র রপত র র একট
এছাড়াও পড়ুন:
প্রতিদিন কেন মৃত্যুকে স্মরণ করতে হবে
মৃত্যু জীবনের একটি অবশ্যম্ভাবী সত্য, যা প্রত্যেকটি মানুষের জন্য নির্ধারিত। ইসলামে মৃত্যুকে ভয়ের বিষয় হিসেবে নয়; বরং আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়ার একটি স্বাভাবিক ধাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘প্রত্যেক প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৮৫)
মৃত্যুর স্মরণ মুসলিমদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক অনুশীলন, যা জীবনের উদ্দেশ্যকে স্মরণ করিয়ে দেয় এবং আমাদের পার্থিব লোভ-লালসা থেকে দূরে রাখে।
মৃত্যু: মুমিনের জন্য স্বস্তিপৃথিবী একটি পরীক্ষার ক্ষেত্র, যেখানে মানুষ নানা দুঃখ-কষ্ট, অভাব, প্রিয়জনের মৃত্যু, দারিদ্র্য ও অন্যান্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। মুসলিমদের জন্য এ পরীক্ষা হলো আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলার মাধ্যমে জীবন যাপন করা।
কোরআনে বলা হয়েছে, ‘(আল্লাহ) যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন, যাতে তিনি তোমাদের পরীক্ষা করেন, তোমাদের মধ্যে কে উত্তম কাজ করে।’ (সুরা মুলক, আয়াত: ২)
আনন্দের ধ্বংসকারীকে (মৃত্যুকে) বেশি বেশি স্মরণ করো। তিরমিজি, হাদিস: ২৩০৭মৃত্যু মুমিনের জন্য একটি স্বস্তি। এটি পার্থিব পরীক্ষা ও কষ্ট থেকে মুক্তি দেয় এবং আল্লাহর রহমতের আলিঙ্গনে নিয়ে যায়। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘মুমিন মৃত্যুর মাধ্যমে স্বস্তি পায়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৫০৭)।
এমনকি নবীজি (সা.)-এর জীবনেও এ সত্য প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর সময় মৃত্যুর ফেরেশতা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁকে মৃত্যু বিলম্বিত করার সুযোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়ার পথ বেছে নিয়েছিলেন।
আরও পড়ুনমৃত্যু থেকে পালানোর পথ নেই১৮ মার্চ ২০২৫মৃত্যুকে স্মরণ করার গুরুত্বমৃত্যু স্মরণ একটি গভীর আধ্যাত্মিক অনুশীলন। যখন আমরা কোনো প্রিয়জনের মৃত্যু দেখি, তখন পার্থিব বিষয়গুলো তুচ্ছ মনে হয়। আমরা আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে পুনর্বিবেচনা করি।
নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘হৃদয় মরিচার মতো মলিন হয়।’ লোকেরা জিজ্ঞাসা করল, ‘কীভাবে তা পরিষ্কার করা যায়?’ তিনি বললেন, ‘মৃত্যু স্মরণ ও কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে।’ (নাহজুল ফাসাহা)।
এ ছাড়া তিনি বলেছেন, ‘আনন্দের ধ্বংসকারীকে (মৃত্যুকে) বেশি বেশি স্মরণ করো।’ (তিরমিজি, হাদিস: ২৩০৭)
হজরত আলী (রা) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি প্রায়ই মৃত্যুকে স্মরণ করে, সে অল্প সম্পদেও সন্তুষ্ট থাকে। সে কখনো লোভী বা কৃপণ হয় না।’ (বিহারুল আনওয়ার)
মৃত্যুর জন্য কী কামনা করা যায়ইসলামে আত্মহত্যা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। তাই কোনো বিপদ বা কষ্টের কারণে মৃত্যুর জন্য প্রার্থনা করা অনুমোদিত নয়। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যেন বিপদের কারণে মৃত্যু কামনা না করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৩৫১)।
তবে শহীদ হওয়ার জন্য দোয়া করা, অর্থাৎ আল্লাহর পথে মৃত্যুবরণের জন্য প্রার্থনা করা ইসলামে অনুমোদিত।
ইসলামের দৃষ্টিকোণে মৃত্যু জীবনের সমাপ্তি নয়; বরং এটি পার্থিব জীবন থেকে চিরস্থায়ী জীবনের দিকে একটি সেতু। মৃত্যু মুমিনের জন্য এটি আল্লাহর সঙ্গে মিলিত হওয়ার একটি সুযোগ।মৃত্যুই শেষ কথা নয়ইসলামের দৃষ্টিকোণে মৃত্যু জীবনের সমাপ্তি নয়; বরং এটি পার্থিব জীবন থেকে চিরস্থায়ী জীবনের দিকে একটি সেতু। এটি ভয় বা দুঃখের বিষয় হলেও মুমিনের জন্য এটি আল্লাহর সঙ্গে মিলিত হওয়ার একটি সুযোগ। মৃত্যু স্মরণ ও এর জন্য প্রস্তুতি আমাদের জীবনকে আরও অর্থবহ করে।
বিপদে পড়লে মৃত্যু স্মরণের দোয়া আমাদের ধৈর্য ধরতে এবং আল্লাহর ওপর ভরসা রাখতে সাহায্য করে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যারা বিপদে পড়ে বলে, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন (আমরা আল্লাহর জন্য এবং তাঁর দিকেই ফিরে যাব।)’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৬)
এ আয়াত মৃত্যুর সংবাদ শোনার সময়ও পাঠ করা হয়। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে বিপদ আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে এবং তিনি আমাদের সামর্থ্যের বাইরে পরীক্ষা দেন না। (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৮৬)।
প্রতিটি বিপদের মধ্যে আমাদের জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এ বিপদ ক্ষণস্থায়ী। কারণ, আমরা আল্লাহর কাছে ফিরে যাব।
আরও পড়ুনসন্তান জন্মের আগে মৃত্যু কামনা করেন নবীর মা৩১ মে ২০২৫কয়েকটি দোয়ামৃত্যু ভাবাপন্ন বিপদ হলে: কঠিন বিপদের সময় পাঠ করা যায়, তা হলো নবীজি (সা.)-এর শেখানো: ‘হে আল্লাহ, যতক্ষণ জীবন আমার জন্য কল্যাণকর, ততক্ষণ আমাকে জীবিত রাখো এবং যখন মৃত্যু আমার জন্য উত্তম, তখন আমাকে মৃত্যু দাও।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৩৫১)
মৃত্যু নিকটবর্তী হলে: মৃত্যুর সময় শুধু আল্লাহই জানেন। তবে আমরা বা আমাদের প্রিয়জন মৃত্যুর কাছাকাছি থাকি এবং ভয় বা উদ্বেগ অনুভব করি, তবে এই দোয়া পাঠ করা যায়: ‘হে আল্লাহ, মৃত্যুর যন্ত্রণা ও কষ্ট থেকে আমাকে সাহায্য করো।’ (তিরমিজি, হাদিস: ৯৭৮)।
নবীজি (সা.) নিজেও তাঁর মৃত্যুর সময় এই দোয়া পাঠ করেছিলেন।
হে আল্লাহ, যতক্ষণ জীবন আমার জন্য কল্যাণকর, ততক্ষণ আমাকে জীবিত রাখো এবং যখন মৃত্যু আমার জন্য উত্তম, তখন আমাকে মৃত্যু দাও।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৩৫১সহজ মৃত্যুর জন্য দোয়া: নবীজি (সা.) একটি দীর্ঘ দোয়ার শেষে বলেছেন, ‘এবং আমার মৃত্যুকে আমার জন্য স্বস্তির উৎস করো, যা আমাকে সব অনিষ্ট থেকে রক্ষা করবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৬৮৮)
এখানে সহজ মৃত্যু বলতে পার্থিব অর্থে আরামদায়ক মৃত্যু (যেমন ঘুমের মধ্যে মৃত্যু) বোঝায় না; বরং এটি বোঝায় মৃত্যুর ফেরেশতার আগমন থেকে শুরু করে পরকালে স্থানান্তর পর্যন্ত একটি সহজ প্রক্রিয়া।
মৃত্যুর কঠিন পরীক্ষা থেকে আশ্রয়: একটি দোয়ায় নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে অলসতা, বার্ধক্য, কাপুরুষতা, অক্ষমতা এবং জীবন ও মৃত্যুর পরীক্ষা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি।’ (সুনানে নাসাঈ, হাদিস: ৫৪৯১)
মৃত্যুর সময় শয়তান থেকে বাঁচতে: নবীজি (সা.) এ–সময় দোয়া করেছেন, ‘আমি তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি যেন শয়তান আমার মৃত্যুর সময় আমাকে ক্ষতি করতে না পারে।’ (আবু দাউদ, হাদিস: ১৫৫২)
ইসলামে মৃত্যুকে ভয়ের বিষয় হিসেবে নয়; বরং আল্লাহর সঙ্গে পুনর্মিলনের একটি সুযোগ হিসেবে দেখা হয়। নিয়মিত মৃত্যু স্মরণ আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়, লোভ-লালসা থেকে দূরে রাখে এবং আমাদের ভালো কাজের পথে রাখে।
আরও পড়ুনমৃত্যু কি শেষ, মৃত্যু আসলে কী৩১ জুলাই ২০২৩