গুলেন ব্যারি সিনড্রোম কেন হয়, চিকিৎসা কী
Published: 14th, April 2025 GMT
গুলেন ব্যারি সিনড্রোম বা সংক্ষেপে জিবিএস নামটি একটু অপরিচিত হলেও রোগটির প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশে নেহাত কম নয়। যেকোনো বয়সের মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। প্রকৃতপক্ষে জীবাণু–প্রতিরোধী ইমিউন সিস্টেমের অস্বাভাবিক আচরণের ফলে এ রোগের উৎপত্তি হয়।
‘ক্যাম্পাইলো ব্যাকটর জেজুনি’ নামের জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত ডায়রিয়ার রোগী বা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত সর্দি-জ্বরের রোগীরা ইমিউন সিস্টেমের জটিলতার কারণে পরবর্তী সময়ে এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।
কীভাবে বুঝবেন
ডায়রিয়া বা ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বরের প্রায় দুই সপ্তাহ পর রোগী হঠাৎ দুই পায়ে দুর্বলতা বোধ করেন। এ দুর্বলতা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং একপর্যায়ে ওপরের দিকে বিস্তার লাভ করে মেরুদণ্ড, দুই হাত, বুকের মাংসপেশি, এমনকি মুখের মাংসপেশিতে ছড়িয়ে পড়ে। কখনো কখনো দুবলর্তা এত বেশি হয় যে রোগী হাত–পায়ের আঙুলও সামান্য পরিমাণ নাড়াতে পারেন না।
বুকের মাংসপেশির দুবর্লতার কারণে শ্বাসকষ্ট হলে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালের আইসিইউ, অর্থাৎ নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে স্থানান্তর করতে হয়। না হলে রোগীর মৃত্যুও ঘটতে পারে। জিবিএস রোগীর এত দুর্বলতা সত্ত্বেও সাধারণ অনুভূতি, স্মৃতিশক্তি, পায়খানা-প্রস্রাবের অবশ্য কোনো সমস্যা হয় না এবং রোগী কখনোই চেতনা হারান না।
চিকিৎসা কী
এ ধরনের রোগীকে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দিতে হবে। নিউরোলজিস্ট বা স্নায়রোগবিশেষজ্ঞ রোগের উপসর্গ, শারীরিক পরীক্ষা, এনসিএস নামের স্নায়ুর পরীক্ষা ও মস্তিষ্কের রস বিশ্লেষণ করে রোগটি নির্ণয় করেন।
রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাস, নাড়ির গতি, রক্তচাপ ইত্যাদি সব সময় লক্ষ্য রাখতে হয়। যদি শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, তবে তাৎক্ষণিক রোগীকে আইসিইউতে স্থানান্তর করতে হয়। নিয়মিত হাত-পায়ের ব্যায়াম, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা, রোগীকে দ্রুত সেরে উঠতে সাহায্য করে।
এ রোগের নির্দিষ্ট চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। প্লাজমাফেরোসিস বা আইভি ইমিউনো গ্লোবিন দিয়ে এ রোগের চিকিৎসা করা হয়। কোনো কোনো রোগীর পুরোপুরি আরোগ্য পেতে প্রায় এক বছর লেগে যায়। উপসর্গ শুরুর দুই সপ্তাহের মধ্যে চিকিৎসা শুরু করতে হবে। এরপর ইমিউনোগ্লোবিনের কর্যকারিতা থাকে না।
জিবিএসের ক্ষেত্রে সাধারণত প্রায় ৮০ শতাংশ রোগী সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য লাভ করেন। আর ৫-১০ শতাংশ রোগীর মধ্যে কিছু না কিছু শারীরিক দুর্বলতা স্থায়ীভাবে থেকে যায়। মৃত্যুর হার ৫-৬ শতাংশ। মনে রাখবেন, সাধারণত কোনো সংক্রমণ যেমন ডায়রিয়া বা শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের দু–তিন সপ্তাহ পর জিবিএসএর লক্ষণগুলো দেখা দেয়। কখনো কখনো টিকা দেওয়ার পরও এ রোগ হতে পারে।
আরও পড়ুনমস্তিষ্কের জটিল রোগ মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস কেন হয়, উপসর্গ ও চিকিৎসা কী২৭ মার্চ ২০২৫.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
কণ্ঠস্বরকে সুস্থ রাখতে চাই সচেতনতা
ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে কণ্ঠের ওঠানামা গুরুত্বপূর্ণ। আপনার কথা কী প্রভাব সৃষ্টি করবে, তার ৩৮ শতাংশ নির্ভর করে কণ্ঠের ওঠানামার ওপর। পেশাগত কণ্ঠ ব্যবহারকারী মানুষ যেমন গায়ক, অভিনেতা, শিক্ষক, উকিল, ধারাভাষ্যকার, বিক্রয়কর্মী, কলসেন্টারের কর্মী, কণ্ঠশিল্পীদের জন্য কণ্ঠই সবকিছু।
কণ্ঠনালির প্রদাহএ প্রদাহ দুই ধরনের। সাময়িক ও দীর্ঘমেয়াদি ল্যারিনজাইটিস। ভাইরাস, আবহাওয়া পরিবর্তন, পরিবেশদূষণেও কণ্ঠনালির প্রদাহ হতে পারে। পাকস্থলীর অ্যাসিড রিফ্লাক্সের জন্য কণ্ঠনালির দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ হতে পারে। ধূমপান, অতিরিক্ত চা বা পানীয় পান করলে, হাঁপানির জন্য ইনহেলার ব্যবহার করলে বা যাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম, তাদের দীর্ঘমেয়াদি ল্যারিনজাইটিস হতে পারে।
কণ্ঠস্বরের অতিব্যবহারঅতিরিক্ত চিৎকারের কারণে যেমন স্বর ভেঙে যায়, তেমনি আবার মৌসুম বদলের সময়ও এমন সমস্যায় ভুগতে দেখা যায়। তাপমাত্রার তারতম্যের সময় কণ্ঠনালি বা টনসিলের প্রদাহের উপসর্গ হিসেবে স্বর ভেঙে যেতে পারে। এসব ক্ষেত্রে সপ্তাহখানেকের মধ্যেই রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন।
তবে কিছু ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে রোগী স্বর ভেঙে যাওয়ার সমস্যায় ভোগেন: কণ্ঠস্বরের ওপর যাঁদের খুব বেশি চাপ পড়ে (যেমন গায়ক, আবৃত্তিকার, শিশুদের শিক্ষক)। তাঁদের স্বরতন্ত্রীতে ছোট ছোট গোটা হতে পারে (নডিউল)। এ রকম হলে স্বর অস্বাভাবিক রয়ে যায় দীর্ঘদিন। স্বর ভাঙার অন্যান্য কারণ হলো থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি, ফুসফুস বা শ্বাসতন্ত্রের ক্যানসার, স্টেরয়েড ইনহেলার ব্যবহার ইত্যাদি।
মৌসুমের কারণে কণ্ঠনালির প্রদাহ হলে গলাব্যথা, জ্বর, কাশি ও সর্দির মতো উপসর্গ থাকে।
থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতিতে ওজন বৃদ্ধি, শীতপ্রবণতা, দুর্বলতা, বিষণ্নতা, চিন্তায় ও কাজে ধীরতা, চুল পড়া প্রভৃতি সমস্যা দেখা দেয়।
ফুসফুস বা শ্বাসতন্ত্রের ক্যানসারে ওজন হ্রাস, বুকে ব্যথা বা শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
কণ্ঠস্বরের যত্নে যা করতে হবে● কণ্ঠস্বরের সমস্যা তিন সপ্তাহের বেশি থাকলে নাক–কান–গলা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
● আর্দ্রতা কণ্ঠের সুস্থতার জন্য অত্যন্ত জরুরি, তাই প্রতিদিন অন্তত দুই লিটার পানি পান করতে হবে।
● কণ্ঠ ব্যবহারে সাবধানী হোন। অতিউচ্চ বা পরিবর্তিত স্বরে কথা বলবেন না।
● ধূমপান, অ্যালকোহল, তামাক, গাঁজা ও অন্যান্য নেশা সম্পূর্ণ পরিহার করুন।
● ঘুমাতে যাওয়ার কমপক্ষে দুই ঘণ্টা আগে খাওয়া শেষ করুন এবং অল্প আহার করুন।
● অতিরিক্ত টেলিফোন ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন।
● অপ্রয়োজনে বারবার গলা পরিষ্কার ও কাশি দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
● শুষ্ক আবহাওয়া কণ্ঠের জন্য ক্ষতিকর। শীতাতপ যন্ত্রের বাতাসে জলীয় বাষ্প কম থাকে, এটি কণ্ঠের আর্দ্রতা কমিয়ে দেয়। রাতে আর্দ্রতা বৃদ্ধিকারী যন্ত্র ব্যবহার করুন।
● গলা শুকনো থাকলে অথবা মিউকাস জমে থাকলে জোরে কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করার চেষ্টা করা ক্ষতিকর।
● যখন বেশি মিউকাস উৎপন্ন হয়, তখন মিউকাস তরলকারী ওষুধ ব্যবহার করতে পারেন।
আমরা একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করি প্রধানত কণ্ঠের মাধ্যমে। অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা ও খাওয়ার বদভ্যাস কণ্ঠস্বরের নানা সমস্যার জন্ম দেয়। তাই সঠিক কণ্ঠস্বর বজায় রাখতে স্বাস্থ্যকর অভ্যাস বজায় রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ।
অধ্যাপক ডা. এম আলমগীর চৌধুরী, অধ্যাপক, ইএনটি হেড নেক সার্জারি, আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ, ঢাকা