সংসদে নারীদের জন্য ১০০ আসন সংরক্ষণ এবং সেখানে সরাসরি নির্বাচনের দাবি বহুদিনের। জুলাই-পরবর্তী সময়ে বৈষম্যমূলক এই ব্যবস্থা সংস্কারে আশার আলো দেখা দিয়েছিল।

কিন্তু অচিরেই সেই আলো ক্ষীণ হতে শুরু করল। নারীদের বাদ দিয়েই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলল।

ঐকমত্য কমিশনে ‘ঐকমত্য’ হলো—সংসদে আগের মতোই তাদের জন্য ৫০টি আসন থাকবে এবং আগামী নির্বাচনে ৩০০ সাধারণ আসনে অন্তত ৫ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়নের জন্য দলগুলোকে আহ্বান জানানো হবে।

এখানে প্রশ্ন হলো, নাগরিক সমাজের দাবি এবং তিনটি সংস্কার কমিশনেরই সুপারিশ ছিল নারীর জন্য আসন সংরক্ষণ ও সরাসরি নির্বাচনের।

গবেষণাও বারবার দেখিয়েছে, বর্তমান সংরক্ষিত পদ্ধতি নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন ঘটাতে পারছে না এবং কার্যকর ফলাফল বয়ে আনতে পারছে না। নারীরা সংসদে গেলেও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং কাজের সুযোগ সীমিত থেকে যায়।

তাহলে সেখানে গবেষণার ফলাফল, জনদাবি উপেক্ষা করে পুরোনো ব্যবস্থা কেন বহাল রাখা হলো?

আরও পড়ুনসংরক্ষিত নারী আসনে নির্বাচন: ব্রিটিশ আমল ও পাকিস্তান পর্ব হয়ে বর্তমান চিত্র২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

সংবিধান সংশোধনের দোহাই দিয়ে নারীদের জন্য সরাসরি নির্বাচনের সুযোগ খারিজ করা হলো, অথচ অন্যান্য সংস্কারের ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধনের প্রসঙ্গ তো সামনে আসছে না।

যদি অন্যান্য ক্ষেত্রে সংস্কার সম্ভব হয়, তবে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনেও সংস্কার সম্ভব হওয়া উচিত।

২০২৫ সালে এসেও এই অকার্যকর পদ্ধতি বহাল রাখা যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয় না। কারণ, এর সঙ্গে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি, অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়ও জড়িত।

রাষ্ট্র প্রতিবছর ৫০টি সংরক্ষিত আসনের জন্য প্রায় ৮ কোটির বেশি টাকা ব্যয় করছে। এটি একটি বড় বিনিয়োগ। কিন্তু এই বিনিয়োগের পূর্ণ সুফল আসছে না।

সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা চালু করা গেলে এই বিনিয়োগ সমাজ ও অর্থনীতিতে বহুগুণ রিটার্ন দিতে পারে।

আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাও সেটাই প্রমাণ করেছে। যেমন মেক্সিকোতে ২০১৪ সালের পারিটি আইন কার্যকর হওয়ার পর মাতৃমৃত্যু ২০০০ সালের প্রতি লাখে ১০৭ জন থেকে ২০২৩ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ৪২ জনে (উইলসন সেন্টার, ২০২৩, রয়টার্স, ২০২৩)।

ওইসিডি দেশগুলোতে দেখা গেছে, নারী কর্মসংস্থান ১০ শতাংশ বাড়লে জিডিপি ২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায় (ওইসিডি, ২০২২)।

আরও পড়ুনসংরক্ষিত নারী আসন: তাঁরা কেন বাদ পড়লেন১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

ফ্রান্সে নারী প্রার্থী বাধ্যতামূলক করার ফলে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে এবং জিডিপিতে প্রতিবছর অতিরিক্ত ০.

৫-০.৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি যোগ হয়েছে (ইউরোপিয়ান কমিশন, ২০১৮)।

যুক্তরাজ্যে নারী-পুরুষ সমান কর্মসংস্থান হলে অর্থনীতিতে বাড়তি ১৫০ বিলিয়ন পাউন্ড যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে (ফাওসেট সোসাইটি, ২০২৪)।

গবেষণায় আরও দেখা গেছে, নারী কোটা চালুর পর উন্নয়নশীল দেশে মাতৃমৃত্যু ৮-১২ শতাংশ কমেছে, যা সরাসরি স্বাস্থ্য ব্যয় সাশ্রয় ও শ্রমশক্তির উৎপাদনশীলতা বাড়িয়েছে।

বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার এখনো প্রতি লাখে ১৫৬ জন (বিবিএস, ২০২২) যা ২০৩০ সালের মধ্যে ৭০-এ নামানোর লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে।

আরও পড়ুননারী সংসদ সদস্য: সংরক্ষিত নাকি সরাসরি ভোটে?০২ জুন ২০২৫

একইভাবে ২০২৪ সালের জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৭০ শতাংশ নারী জীবনে অন্তত একবার সহিংসতার শিকার হয়েছেন (ইউএনএফপিএ বাংলাদেশ, ২০২৪), যার ফলে পরিবার ও রাষ্ট্র উভয়কেই অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে হচ্ছে।

বর্তমান সংরক্ষিত ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে এসব ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত ফল আনতে পারছে না।

আবার সাধারণ আসনে কমিশনের ৫ শতাংশ মনোনয়নের আহ্বানে কোনো আইনগত ভিত্তি নেই, ফলে রাজনৈতিক দলগুলো সহজেই তা এড়িয়ে যেতে পারে। এতে সাধারণ আসনে নারীর মনোনয়ন আরও কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

তাই এখন সময় এসেছে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার। সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচন চালু করতে হবে, যাতে নারী এমপিরা জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে সংসদে যেতে পারেন। সাধারণ আসনে ন্যূনতম ২০ শতাংশ নারী মনোনয়ন বাধ্যতামূলক করতে হবে।

বিশ্বের অনেক দেশেই ইতিমধ্যেই দেখা গেছে, নারীর নেতৃত্ব গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে এবং অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়। বাংলাদেশ যদি এখনই পদক্ষেপ নেয়, তবে কেবল নারী নয়, গোটা দেশই এর সুফল পাবে। অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বাড়বে, মানবসম্পদ উন্নত হবে এবং গণতন্ত্রও হবে আরও টেকসই।

ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন আরপিও (রিপ্রেজেন্টেশন অব দ্য পিপল অর্ডার) সংশোধনের প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে, নারীর জন্য মনোনয়নের হার ন্যূনতম ২০ শতাংশ করে একটি ধারা সংযোজন করতে হবে।

একই সঙ্গে রাজনৈতিক দল এ নিয়ম মানতে ব্যর্থ হলে তাদের জন্য আর্থিক জরিমানার বিষয়টিও উল্লেখ থাকতে হবে। অন্যথায় নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা চ্যালেঞ্জিং হবে।

একই সঙ্গে নারীদের জন্য নিরাপদ রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে হবে, নারীদের অনলাইন–অফলাইন যে হয়রানির শিকার হতে হয়, তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে; যাতে তাঁরা হয়রানি ও সহিংসতার ভয় ছাড়াই প্রার্থী হতে বা দলে যুক্ত হতে পারেন। নারী প্রার্থীদের জন্য জনতহবিলের ব্যবস্থা করতে হবে।

বিশ্বের অনেক দেশেই ইতিমধ্যেই দেখা গেছে, নারীর নেতৃত্ব গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে এবং অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়।

বাংলাদেশ যদি এখনই পদক্ষেপ নেয়, তবে কেবল নারী নয়, গোটা দেশই এর সুফল পাবে। অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বাড়বে, মানবসম্পদ উন্নত হবে এবং গণতন্ত্রও হবে আরও টেকসই।

লিপিকা বিশ্বাস নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নবিষয়ক বিশ্লেষক

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন র দ র জন য র জন ত ক ন স রক ষ প রব দ ধ ক র যকর ব যবস থ গণতন ত র র জন নয়ন র

এছাড়াও পড়ুন:

দ্রুত নির্বাচনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করুন: আকবর খান

ঢাকা-৮ আসনে দ্রুত নির্বাচনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য আকবর খান। তিনি বলেন, “ভোটের অধিকার জনগণের পবিত্র আমানত, এটি সচেতনভাবে প্রয়োগ করতে হবে।”

বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) রাজধানীর মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা জননেতা সাইফুল হক-এর ঢাকা-৮ আসনে নির্বাচনী গণসংযোগ ও প্রচারপত্র বিতরণ কর্মসূচিতে তিনি একথা বলেন।

গণসংযোগের শুরুতে ঢাকা মহানগর কমিটির সভাপতি মীর মোফাজ্জল হোসেন মোশতাকের সভাপতিত্বে এক সংক্ষিপ্ত পথসভা হয়। 

সেখানে আকবর খান বলেন, “নির্বাচন কমিশন ও সরকারকে অবিলম্বে ভোটের গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরিতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। গত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনে—২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে—ঢাকা-৮ আসনের বহু নাগরিক ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। যে তরুণের এখন বয়স ২৫ বা ২৬, তারা কখনো ভোট দিতে পারেনি, ভোট কী তা জানে না- এটি গণতন্ত্রের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়।”

তিনি আরো বলেন, “গত ১৬-১৭ বছর ধরে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি এবং আমাদের নেতা সাইফুল হক জনগণের ভোটাধিকারের আন্দোলনে রাজপথে সংগ্রাম করে আসছেন। এর জন্য জেল-জুলুম, নির্যাতন সহ্য করেও তিনি থেমে থাকেননি। ভোটাধিকার গণমানুষের দীর্ঘ লড়াই ও ত্যাগের ফসল। এই অধিকার ভুল ব্যক্তিকে নির্বাচিত করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।”

আকবর খান বলেন, “জননেতা সাইফুল হক গণমানুষের পরীক্ষিত নেতা। আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের জনগণ যেন তাকে ভোট দিয়ে নিজেদের সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়ার কথা ও দীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাস সংসদে তুলে ধরার সুযোগ করে দেন- এটাই আমাদের আহ্বান।”

গণসংযোগ ও প্রচারপত্র বিতরণ কর্মসূচি বাংলাদেশ ব্যাংক এলাকা থেকে শুরু হয়ে মতিঝিল, কমলাপুর, ফকিরাপুল, কালভার্ট রোড হয়ে বিজয়নগরে এসে শেষ হয়। এতে শতাধিক নেতাকর্মী অংশ নেন।

কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা সিকদার হারুন মাহমুদ, মীর রেজাউল আলম, কবি জামাল সিকদার, ফাইজুর রহমান মুনির, বাবর চৌধুরী, মহানগর নেতা যুবরান আলী জুয়েল, সালাউদ্দিন, রিয়েল মাতবর, আরিফুল ইসলাম, মুজিবুল হক চুন্নু, গোলাম রাজিব, মাহমুদুল হাসান খান, ফয়েজ ইবনে জাফর, নান্টু দাস, শিবু মহন্ত ও হুমায়ুন কবির প্রমুখ।

ঢাকা/এএএম/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ৩০০ আসনে প্রার্থী বাছাই প্রায় চূড়ান্ত: তারেক রহমান
  • গণতন্ত্রের পথে সংকট দেখছেন তারেক
  • এমন তো হবার কথা ছিল না: তারেক রহমান
  • যশোরে জিআই পণ্য খেজুর গুড় তৈরির রস সংগ্রহে গাছ প্রস্তুতির উদ্বোধন
  • সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠাই এখন জাতির দাবি
  • জনগণের বৃহত্তর ঐক্য ছাড়া এই ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার পতন হবে না: সাকি
  • ১০০ কোটি টাকার পাচারের অভিযোগ, জাহাঙ্গীরের নামে মামলা
  • দ্রুত নির্বাচনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করুন: আকবর খান