বিচারক বললেন, আদালতের অনুমতি ছাড়া মক্কেলের সঙ্গে আইনজীবীর কথা নয়
Published: 16th, April 2025 GMT
ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে আজ বুধবার বেলা ১১টার দিকে শুনানি শেষ হয়। বিচারক আদালতকক্ষ থেকে খাসকামরায় যান। তখন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের মাথায় এক পুলিশ সদস্য হেলমেট পরিয়ে দেন। আনিসুল নিজেই তাঁর দুই হাত পেছনের দিকে রাখেন। পরে এক পুলিশ সদস্য তাঁর দুই হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেন।
আনিসুলের ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। তাঁর মাথায়ও হেলমেট পরিয়ে দেওয়া হয়। তিনিও তাঁর দুই হাত পেছনের দিকে নিয়ে যান। পরে এক পুলিশ সদস্য তাঁর দুই হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেন।
এভাবে একে একে সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, কামরুল ইসলাম, প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলকদের মাথায় হেলমেট ও দুই হাত পেছনে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে দেন পুলিশ সদস্যরা। এরপর একে একে আদালতের বারান্দায় এনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় তাঁদের।
আদালত ভবনের ছয়তলায় ছিলেন আসামিরা। ভবনের সিঁড়ি দিয়ে যখন তাঁদের পাঁচতলায় আনা হয়, তখন দেখা যায়, রাশেদ খান মেননের দুই বাহু দুজন পুলিশ সদস্য ধরে রেখেছেন। তিনি সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে নিচের দিকে নামতে থাকেন। এ সময় তিনি মাথা নিচু করে ছিলেন।
একইভাবে ইনু, কামরুল, আনিসুল, সালমান, শাজাহান খান, আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, জুনাইদ আহ্মেদ পলক, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন, ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম মজুমদার প্রত্যেকের দুই বাহু দুজন করে পুলিশ সদস্য ধরে রাখেন। তাঁরা খুব সাবধানে ছয়তলার সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে থাকেন। এরপর দ্রুত নিচতলা থেকে আদালতের সামনে দিয়ে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় হাজতখানায়।
আদালতকক্ষে যাওয়ার সময় বিমর্ষসকাল সাড়ে আটটার দিকে আনিসুল, সালমান, কামরুলদের কারাগার থেকে প্রিজন ভ্যানে ঢাকার সিএমএম আদালতের হাজতখানায় এনে রাখা হয়। সকাল সাড়ে ৯টার পর পুলিশের একটা দল তাঁদের প্রত্যেকের মাথায় হেলমেট পরিয়ে দেয়। বুকে পরিয়ে দেয় বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট। আর দুই হাত পেছনে নিয়ে পরিয়ে দেয় হাতকড়া।
এরপর সকাল ৯টা ৫০ মিনিটের দিকে আসামিদের একে একে হাজতখানা থেকে বের করে আনা হয়। সারিবদ্ধভাবে আনিসুল, সালমান, মেনন, কামরুল, ইনুরা সামনের দিকে হাঁটতে থাকেন। তাঁদের হাঁটিয়ে লিফটের সামনে আনা হয়। পরে লিফটে তাঁদের আদালত ভবনের ছয়তলায় নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় তাঁদের প্রত্যেককে বিমর্ষ দেখা যায়।
‘আদালতের অনুমতি ছাড়া কথা বলা যাবে না’
সকাল ৯টা ৫৭ মিনিটে কামরুলকে যখন আদালতকক্ষের সামনে আনা হয়, তখন এক পুলিশ সদস্য তাঁর মাথা থেকে হেলমেটটি খুলে নেন। দুই হাত পেছনে নিয়ে পরিয়ে দেওয়া হাতকড়াও খুলে দেন এক পুলিশ সদস্য।
এরপর কামরুলকে এজলাস কক্ষে ঢোকার জন্য অনুরোধ করা হয়। পুলিশ সদস্যের এমন কথা শুনে বিরক্ত হন তিনি।
পুলিশ কনস্টেবলের উদ্দেশে কামরুল বলেন, ‘আমার বুকের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট খোলেন।’ তখন কনস্টেবল কামরুলকে বলেন, ‘স্যার, এই বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট খোলা যাবে না।’
পুলিশ কনস্টেবলের এ কথা শুনে রেগে এজলাস কক্ষের কাঠগড়ায় ঢোকেন কামরুল। তখন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন আনিসুল ও সালমান। কামরুল তখন সালমান ও আনিসুলের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন।
কাঠগড়ায় তখন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলেন ইনু ও মেনন। মেনন তাঁর আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। ইনুও কথা বলছিলেন তাঁর আইনজীবীর সঙ্গে।
সালমান ও আনিসুল যখন তাঁদের আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত, তখন এজলাস কক্ষে প্রবেশ করেন বিচারক। সময় তখন সকাল ১০টা ৫ মিনিট।
এজলাস কক্ষ আইনজীবীতে ঠাসা। কাঠগড়ায় গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন আনিসুলসহ অন্যরা। এর মধ্যেই বিচারক কথা বলতে শুরু করেন। আইনজীবীদের উদ্দেশে বিচারক বলেন, আদালতের অনুমতি ছাড়া কোনো আইনজীবী তাঁর মক্কেলের সঙ্গে কথা বলবেন না।
বিচারকের এমন নির্দেশনার পর আইনজীবীরা আনিসুল–সালমানদের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করেন। পরে শাজাহান খানসহ কয়েকজনের আইনজীবী আদালতের অনুমতি নিয়ে মক্কেলদের ওকালতনামায় স্বাক্ষর করান।
পরে আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের এক আইনজীবী তাঁর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন। তখন সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা জ্যাকবের আইনজীবীকে বলেন, ‘আদালতের অনুমতি ছাড়া কথা বলা যাবে না। আদালতের অনুমতি নেন, তারপর কথা বলেন।’
শুনানি শুরু হয়। যাত্রাবাড়ী থানায় দায়ের করা একটি হত্যা মামলায় আনিসুল, সালমান, শাজাহান, ইনু, মেনন ও পলককে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করা হয়। এ সময় আনিসুল ও কামরুল জানতে চান, কোন মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে।
তখন এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, তাঁদের যাত্রাবাড়ী থানার একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করা হয়েছে।
গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন মঞ্জুর করার পর বিচারক নিজেই আনিসুলদের উদ্দেশে বলতে থাকেন, ‘আপনাদের যাত্রাবাড়ী থানার হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।’
আনিসুল, সালমান, কামরুল ও পলকের হাসিমুখ
এজলাস কক্ষে প্রবেশের পরপর বিচারক বলে দিয়েছিলেন, আদালতের অনুমতি ছাড়া আইনজীবীরা তাঁদের মক্কেলদের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না।
আদালতের এমন নির্দেশনার পর আনিসুল, সালমান, পলক, কামরুল, ইনুরা আর তাঁদের আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেননি; বরং শুনানির সময় আনিসুল, সালমান, কামরুল, ইনুরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করেন।
সবচেয়ে বেশি কথা বলেন পলক। তিনি আনিসুলের সঙ্গেও কথা বলেন। আবার কথা বলেন একাত্তর টিভির সাবেক প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবুর সঙ্গে। আরও কথা বলেন একাত্তর টিভির সাবেক সাংবাদিক ফারজানা রুপার সঙ্গে। এ সময় পলককে হাসিমুখে কথা বলতে দেখা যায়। ১০ থেকে ১৫ মিনিট ধরে তিনি কথা বলেন কাঠগড়ায়।
পলক যখন রুপার সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন আনিসুল ও সালমান নিজেদের মধ্যে কথা বলতে থাকেন।
কাঠগড়ায় কিছুটা নিশ্চুপ ছিলেন মেনন। ইনু হাসিমুখে মামলার শুনানি শুনতে থাকেন। এ সময় রুপা তাঁর স্বামী শাকিল আহমেদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার কথা বলেন। মোজাম্মেল বাবুর সঙ্গেও কথা বলেন রুপা ও শাকিল।
কাঠগড়ার এক কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন দুবার সালমানের সঙ্গে কথা বলেন। আনিসুলের সঙ্গে কথা বলেন একবার। তবে তাঁর মুখে কোনো হাসি ছিল না। অন্যদিকে আনিসুলের সঙ্গে বেশ কয়েকবার কথা বলেন কামরুল। এ সময় আনিসুলের মুখে ছিল হাসি।
ঢাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ড যাত্রাবাড়ীতে
যাত্রাবাড়ী থানায় দায়ের করা শক্তি তালুকদার হত্যা মামলায় সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন ও সাবেক ওসি আবুল হাসানকে ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করা হয়।
দুজনের রিমান্ডের সপক্ষে আদালতে যুক্তি তুলে ধরেন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পিপি ওমর ফারুক ফারুকী। তিনি আদালতকে বলেন, জুলাই–আগস্টের ছাত্র–জনতার আন্দোলনের সময় ঢাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে যাত্রাবাড়ী থানা এলাকায়। এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ও যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান সরাসরি জড়িত। কেবল হত্যাকাণ্ড নয়, এই সময়ে তিন হাজার ছাত্র–জনতাকে গুলিতে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে। তাঁরা এখন মানবেতর জীবন যাপন করছেন। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে মামলা হবে। প্রতিটি মামলায় তাঁকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার আবেদন করা হবে।
এ সময় চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের আইনজীবী আদালতকে বলেন, তাঁর মক্কেল এখন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ইতিমধ্যে ৮৫ দিনের বেশি রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। ৬০ দিনের বেশি তাঁকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাঁকে যদি জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হয়, তাহলে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দেওয়া হোক।
শুনানি নিয়ে আদালত মামুনের তিন ও যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসানের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আবদ ল ল হ আল ম ম ন এক প ল শ সদস য স ব ক আইজ প ন ক ঠগড় য় র আইনজ ব আইনজ ব র ল ইসল ম মন ত র এ সময় হ তকড়
এছাড়াও পড়ুন:
তত্ত্বাবধায়ক সরকারযুক্ত সংবিধানই জনগণ চায়
ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যুক্ত হয়েছিল সংবিধানে, তা–ই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে আপিল বিভাগে এ–সংক্রান্ত শুনানিতে বলেছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল–পরবর্তী নির্বাচনগুলোর চিত্র দেখিয়ে জয়নুল আবেদীন বলেছেন, ২০১৪ সালে ভোটারবিহীন এবং ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে হয়েছে—দেশের জনগণ এমন বিতর্কিত কোনো নির্বাচন হোক, তা চায় না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলের ওপর আজ রোববার ষষ্ঠ দিনের মতো শুনানি হয়। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বেঞ্চে বিএনপি মহাসচিবের আপিল–সংক্রান্ত শুনানি করেন জয়নুল আবেদীন।
সকাল ৯টা ২০ মিনিটে শুনানি শুরু হয়। বেলা ১১টা থেকে মাঝে বিরতি দিয়ে ১টা পর্যন্ত শুনানি চলে। পরবর্তী শুনানির জন্য মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) দিন রাখা হয়েছে। এদিন বিরতির পর শুনানি শুরুর আগে প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের অপর বিচারপতিদের সঙ্গে এজলাসে আসেন বাংলাদেশে সফররত নেপালের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ মান সিং রাউত। বিচারপতিদের সঙ্গে এজলাসে বসে এই শুনানি পর্যবেক্ষণ করেন তিনি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেই একটি আলোচিত বিষয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের মুখে তৎকালীন বিএনপি সরকার সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকারব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে যুক্ত করেছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার দুই বছর পর সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী এনে এই ব্যবস্থা বাতিল করে। তার আগে সর্বোচ্চ আদালতের এক রায়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল।
ওই রায়ের ক্ষেত্রে দেশের প্রচলিত আইন ও আপিল বিভাগের রুলসের ব্যত্যয় ঘটেছে দাবি করে শুনানিতে জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘রায়ে সইয়ের আগেই তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার, সংসদ তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে সংবিধান সংশোধন (পঞ্চদশ সংশোধনী) করে। পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা ও স্বাক্ষরের (বিচারপতিদের রায়ে সই করা) আগে সরকার সংসদ তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের বলে তড়িঘড়ি করে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করে, যা দেশবাসীর জানা। দেশের বিবেকবান মানুষ আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে এই সংবিধান সংশোধনকে সরকারের হীন রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছিল। এটি জনগণের বিরুদ্ধে বড় ষড়যন্ত্র।’
বিএনপির একসময়ের আইনবিষয়ক সম্পাদক জয়নুল আবেদীন শুনানিতে বলেন, ‘সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যবহার করেছেন। সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে বহাল রাখার লক্ষ্যে সাবেক প্রধান বিচারপতি (বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক) দেশের প্রচলিত আইন ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রুলস যথাযথভাবে অনুসরণ না করে সর্বশেষ (পূর্ণাঙ্গ রায়) রায় দেন, যা প্রথমে দেওয়া রায়ের (শর্ট অর্ডার সংক্ষিপ্ত রায়) সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।’
শুনানিতে অবসরের পর রায়ে সই প্রসঙ্গ
অবসরের পর কোনো বিচারপতি রায়ে সই করলে তার আইনগত মূল্য কী হবে—এ প্রসঙ্গ ওঠে শুনানিতে। বিরতির পর শুনানিতে অংশ নিয়ে এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিবের অপর আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস বলেন, রায় ঘোষণা ও রায়ে সই করা দুটি ভিন্ন বিষয়। রায় ঘোষণার সময় এ বি এম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতির পদে আসীন ছিলেন। সংক্ষিপ্ত রায়ে যা ছিল, পূর্ণাঙ্গ রায়ে তা পরিবর্তন করা হয়েছে।
দেওয়ানি কার্যবিধি, আপিল বিভাগের রুলস ও সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ তুলে ধরে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘শর্ট অর্ডারের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ রায়ে যে পার্থক্য, তা পূর্ণাঙ্গ রায়ে উল্লেখ করেছেন একজন বিচারপতি। এই বিচারপতিও বলেননি অবসরের পরে বিচারপতি খায়রুল হকের লেখা রায়টি অবৈধ হয়েছে। স্বাক্ষর পরে করেছেন বলে রায় অবৈধ বলা যাবে না। কারণ, অবসরের পর কোনো বিচারপতি রায়ে সই করতে পারবেন না কিংবা কত দিনের মধ্যে সই না করলে সেটি অবৈধ হবে, এমন বাধ্যবাধকতা আইনে নেই।’
রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘প্রকাশ্য আদালতে কোনো বিচারপতি যখন কোনো রায় দেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতে দিলে ছোটখাটো দাড়ি, কমা, শব্দ বাদ পড়েছে—এগুলো ছাড়া যেকোনো পরিবর্তন করতে হলে অবশ্যই সেটি রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) ছাড়া হবে না, যার ওপর শুনানি চলছে।’
এ মামলায় সেন্টার ফর ল গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিসি নামের একটি সংগঠন ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে যুক্ত হয়। ওই প্রসঙ্গে সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এহসান এ সিদ্দিক বলেন, ‘অবসরের পর রায়ে সই করলে তা বাতিল বা অকার্যকর হবে না। যেদিন প্রকাশ্য আদালতে রায় ঘোষণা করলেন, সেই তারিখ হচ্ছে মূল। এটি হচ্ছে রায়ের তারিখ। কবে সই করলেন, এটি প্রাসঙ্গিক নয়। আপিল বিভাগের রুলসে বলা আছে, এ ক্ষেত্রে দেওয়ানি কার্যবিধির (সিপিসি) বিধান কার্যকর হবে না। আপিল বিভাগের জন্য সিপিসি প্রযোজ্য নয়।’
মামলার পূর্বাপর
আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আপিল বিভাগের ২০১১ সালের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ও নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন পৃথক আবেদন (রিভিউ) করেন। সেন্টার ফর ল গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিসি ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে যুক্ত হয়।
রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি শেষে গত ২৭ আগস্ট লিভ মঞ্জুর (আপিলের অনুমতি) করে আদেশ দেন আপিল বিভাগ। বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং বিএনপির মহাসচিবের করা রিভিউ আবেদন থেকে উদ্ভূত আপিলের সঙ্গে অপর রিভিউ আবেদনগুলো শুনানির জন্য যুক্ত হবে বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়। এ অনুসারে পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির করা আপিলের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলের করা রিভিউসহ অপর রিভিউ আবেদন এবং বিএনপির মহাসচিবের আপিল শুনানির জন্য আদালতের কার্যতালিকায় ওঠে।
পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির করা আপিলের ওপর ২১ অক্টোবর শুনানি শুরু হয়। এরপর ইন্টারভেনার হিসেবে যুক্ত সংগঠনের পক্ষে শুনানি করেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবী। এরপর জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির শুনানি করেন। এরপর বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেনের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম বদরুদ্দোজা বাদল এবং এ এস এম শাহরিয়ার কবির শুনানি করেন। শাহরিয়ার কবিরের বক্তব্য উপস্থাপনের পর হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (রিভিউ আবেদনকারী) পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ইমরান এ সিদ্দিক শুনানি করেন। এরপর বিএনপির মহাসচিবের পক্ষে জয়নুল আবেদীন শুনানি শুরু করেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের এক বছর পর গত আগস্টে বিচারপতি খায়রুল হক গ্রেপ্তার হন। তিনি এখন কারাগারে রয়েছেন।