সুন্দরবনের চতুষ্পার্শ্বের প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ইসিএর ১০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে নূতন শিল্প কাঠামো নিষিদ্ধের যেই সিদ্ধান্ত সরকার গ্রহণ করিয়াছে, উহাকে আমরা স্বাগত জানাই। আমরা জানি, প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ বিবিধ কারণে হুমকির সম্মুখীন। বস্তুত সুন্দরবন ঘিরিয়া পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ অনুসারে ১৯৯৯ সালে দেশের প্রথম ইসিএ ঘোষণা করা হইয়াছিল। এই বন সুরক্ষায় প্রতিবেশ অঞ্চলের চতুষ্পার্শ্বে এই প্রকার পরিবেশ গঠন করা জরুরি হইলেও উহা বাস্তবায়ন না হওয়া বিস্ময়কর। বিশ্বব্যাপী তো বটেই, এমনকি প্রতিবেশী ভারতেও বন ও বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণ কৌশল হিসাবে যথায় এই সীমারেখা ১০ হইতে ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত নির্ধারণ করা হইয়া থাকে, তথায় দেশে উহা উপেক্ষিত হইয়াছিল কেন?
২০১৭ সালে আগস্টে ঘোষিত হাইকোর্টের এক রায়েও সুন্দরবনের চতুষ্পার্শ্বে ১০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে নূতন কোনো শিল্পকারখানা স্থাপন না করিবার নির্দেশনা দেওয়া হইয়াছিল। উক্ত রায়ে এই সীমানার মধ্যে থাকা শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থানান্তর করিতে বলা হইলেও উহা বাস্তবায়ন হয় নাই।
২০২১ সালের শেষ দিকে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় যখন সুন্দরবনের প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার সীমা হ্রাসের ‘পর্যালোচনা’ করিয়াছিল তখনও এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে আমরা ঐ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করিয়াছিলাম। আমাদের বক্তব্য ছিল, ইসিএর পর্যালোচনা হইতে পারে কেবল ইতোমধ্যে স্থাপিত কলকারখানা স্থানান্তরকরণ, নূতন স্থাপনা রোধকল্পে এবং উক্ত এলাকা হ্রাসকরণের অর্থ হইবে রাষ্ট্রের স্বঘোষিত আইন ও নীতির বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের অবস্থান।
স্বস্তির বিষয় হইল, সোমবার সচিবালয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আয়োজিত জাতীয় পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন কমিটির নির্বাহী সভায় সুন্দরবনের পরিবেশগত সুরক্ষায় ২০১৭ সালের জাতীয় পরিবেশ কমিটির ৩.
স্বয়ং বন বিভাগের ২০১৮ সালের প্রতিবেদনেই স্পষ্ট, সুন্দরবনের ইসিএ এলাকায় অন্তত দুইশত শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়িয়া উঠিয়াছে, যথায় উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান ‘লাল’ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ এই সকল কারখানা ভয়াবহভাবে পানি, বায়ু ও মাটি দূষণ করিয়া থাকে। সেই সকল কারখানা বন্ধ হয় নাই। উপরন্তু এই প্রকার কারখানার সংখ্যা যে আরও বৃদ্ধি পাইয়াছে, বলিবার অপেক্ষা রাখে না। সুন্দরবনকে সর্বাপেক্ষা নাজুক করিয়াছে উহার ১৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাগেরহাটের রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র লইয়া পরিবেশকর্মীদের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও তৎকালীন সরকার উহা নির্মাণ করিয়াছিল। যাহার ফলে উন্মুক্তভাবে কয়লা পরিবহনে দূষিত হইতেছে সুন্দরবন এলাকার নদী ও বন। যাহার বিরূপ প্রভাব পড়িয়াছে জলজ ও বনজ জীববৈচিত্র্যের উপর।
আমরা বিশ্বাস করি, সুন্দরবন সুরক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগ যথাযথরূপে প্রতিপালিত হইবে। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ এবং দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই প্রাকৃতিক সম্পদের চতুষ্পার্শ্বের প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার মধ্যে নূতন করিয়া শিল্পকারখানা যাহাতে গড়িয়া না উঠে, উহা নিশ্চিত করিতে হইবে। সুন্দরবন যদ্রূপ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ন্যায় দুর্যোগে আমাদের প্রাকৃতিক বর্মরূপে ভূমিকা পালন করিয়া থাকে, তদ্রূপ ইহার বনজ সম্পদ দেশের অর্থনীতিতে বিপুল অবদান রাখে। ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্বঐতিহ্যস্থল ও রামসার সাইটের মর্যাদাপ্রাপ্ত সুন্দরবনে ইতোপূর্বে যেই ক্ষতি সাধিত হইয়াছে, নূতন করিয়া মনষ্যসৃষ্ট এইরূপ অবিমৃষ্যকারিতা রোধ করিতে হইবে। ইসিএ সীমানার মাধ্যমেই ইহার সূচনা হইতে পারে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স ন দরবন র ব শগত স পর ব শ ণ কর য় কর য় ছ ন এল ক হইয় ছ
এছাড়াও পড়ুন:
এক দশকে ১ লাখ হেক্টর বনভূমি কমেছে
দেশে এক দশকে বনভূমি হ্রাস পেয়েছে ১ লাখ ১ হাজার হেক্টর, যা ঢাকা শহরের আয়তনের প্রায় সাড়ে তিন গুণ। গত এক দশকে দেশ থেকে হারিয়ে গেছে ৬৪ প্রজাতির গাছ।
সারা দেশে বনাঞ্চলে যে পরিমাণ গাছ আছে, গ্রামাঞ্চলে গাছের সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। তবে গ্রামে গাছের ঘনত্ব কম। আর বন উজাড় বেশি হয়েছে পার্বত্যাঞ্চলে। সেখানে একমুখী প্রজাতির ফসল চাষের প্রসার ও সড়ক সম্প্রসারণের কারণে বন উজাড় হচ্ছে।
বনের সার্বিক চিত্র জানতে ২০২৪ সালে বন অধিদপ্তরের করা জাতীয় বন জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। জরিপটি প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।
পার্বত্য অঞ্চলে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। সেটাকে মাথায় রেখে আমরা একটা পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছি। বান্দরবানের লামা অঞ্চল দিয়ে ফরেস্ট রিস্টোরেশনের (বন পুনরুদ্ধার) কাজ শুরু করব আমরা।সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, উপদেষ্টা, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়২০১৫ সালে জাতীয় বন জরিপে বন আচ্ছাদনের পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ৭৬ শতাংশ, সেটি এখন কিছুটা হ্রাস পেয়ে ১২ দশমিক ১১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক বন জরিপে দেশে বনভূমি আছে ১৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর। আগের বন জরিপে যেটির পরিমাণ ১৮ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর।
জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পার্বত্য অঞ্চলে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। সেটাকে মাথায় রেখে আমরা একটা পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছি। বান্দরবানের লামা অঞ্চল দিয়ে ফরেস্ট রিস্টোরেশনের (বন পুনরুদ্ধার) কাজ শুরু করব আমরা।’
‘জীববৈচিত্র্য রক্ষা, অবক্ষয়িত বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা’র আহ্বান জানিয়ে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ দিবস। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৭২ সালে এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক দিবসের মর্যাদা দেয়।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ফাওয়ের তথ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিকভাবে বন উজাড়ীকরণের হার ১ দশমিক ১ শতাংশ হলেও বাংলাদেশে সেটি ২ দশমিক ৬ শতাংশ।
বন অধিদপ্তরের ২০টি দল মাঠপর্যায়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ শুরু করে ২০২৪ সালের মার্চে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে তাদের তথ্য সংগ্রহ শেষ হয়। উপকূলীয় বন, শালবন, সুন্দরবন, পার্বত্যাঞ্চল ও গ্রামীণ এলাকায় মোট ১ হাজার ৮৫৮টি নমুনা প্লটের ভিত্তিতে এ জরিপের ফলাফল নির্ধারণ করা হয়েছে।
জরিপে দেশে প্রতি হেক্টরে গাছের ঘনত্ব পাওয়া গেছে ১১৭টি। সবচেয়ে বেশি গাছের ঘনত্ব আছে সুন্দরবনে। এখানে গাছের ঘনত্ব প্রতি হেক্টরে ৭০২টি। বনাঞ্চলের চেয়ে গ্রামীণ এলাকায় গাছের ঘনত্ব কম হলেও মোট গাছের পরিমাণ বেশি। গ্রামীণ এলাকায় মোট গাছের সংখ্যা প্রায় ৯০ কোটি।
২০১৫ সালের বন জরিপে গাছের সংখ্যা ছিল ১৬৯ কোটি। সাম্প্রতিক জরিপে সেটা কিছুটা কমে হয়েছে ১৫৭ কোটি। গত এক দশকে হ্রাস পাওয়া গাছের সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি। জরিপে সারা দেশে ৩২৬টি গাছের প্রজাতি শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২৪২টি প্রজাতি পাওয়া গেছে পার্বত্যাঞ্চলে। সুন্দরবনে পাওয়া গেছে ২২ প্রজাতির গাছ। এর আগে বন জরিপে (২০১৫) ৩৯০ প্রজাতির গাছ শনাক্ত করেছিল বন অধিদপ্তর। গত এক দশকে হারিয়ে গেছে ৬৪ প্রজাতির বৃক্ষ।
কেন কমছে পার্বত্যাঞ্চলের বন
২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ডারউইন ইউনিভার্সিটি পরিচালিত এক গবেষণায় পার্বত্যাঞ্চল বাংলাদেশের মোট বন আচ্ছাদনের ৪০ শতাংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে দ্রুত প্রসার ঘটছে অর্থকরি ফলের চাষ (হর্টিকালচার) ও একমুখী প্রজাতির বনায়ন (মনোকালচার), যেমন রাবারবাগান।
জানতে চাইলে জাতীয় বন জরিপের সঙ্গে যুক্ত থাকা বন অধিদপ্তরের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (সদ্য অবসরপ্রাপ্ত) জহির ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে বৈধ ও অবৈধভাবে বন উজাড় হয়ে আসছে। এখানে একদিকে বন উজাড় হচ্ছে, অন্যদিকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কারণে বনায়ন করা যায় না। যার কারণে এখানে বনভূমি হ্রাস পাওয়ার পরিমাণ বেশি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অধ্যাপক কামাল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে বন বিভাগ কিছু করতে পারে না। পাহাড়িরা কিছু গামার আর সেগুনগাছের বাগান করেন। পুরো পার্বত্য অঞ্চলে সড়ক সম্প্রসারণ হয়েছে গত কয়েক দশকে। যেমন সীমান্ত রোড হয়েছে।
কামাল হোসাইন বলেন, এ ছাড়া এখানে বিনোদনকেন্দ্র ও রিসোর্টের সংখ্যা বাড়ছে। এটা একটা দিক। অন্যদিকে অনেক প্রভাবশালী এখন ড্রাগন, কাজু ও আমের চাষ করছেন প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে। এ অঞ্চলের বনের ওপর বহুমুখী চাপের কারণে এখানে বনাঞ্চল হ্রাস পাওয়ার হার অন্যান্য অঞ্চল থেকে বেশি।
কামাল হোসাইন আক্ষেপ করে বলেন, ‘কেউ বনকে ভালোবাসে না। মানুষের লোভের শিকার হয়েছে এখানকার প্রাকৃতিক বন। এটাই আমাদের সর্বনাশ করেছে।’