সাগরপাড়ের বাসিন্দা আবদুল গফুরের (৫৬) কাছে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলা নতুন কিছু নয়। জন্মের পর থেকেই এসব দুর্যোগ দেখে আসছেন তিনি। কিন্তু এখন যেভাবে জলোচ্ছ্বাস কিংবা সাগরের ঢেউয়ে বসতভিটা বা জমিজিরাত নষ্ট হচ্ছে, আগে তেমনটা দেখেননি।

আবদুল গফুরের বাড়ি কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর মাতারবাড়ী ইউনিয়নের জালিয়াপাড়া গ্রামে। তিনি মৎস্যজীবী। এই গ্রামে অন্তত দুই হাজার মানুষের বসবাস। বঙ্গোপসাগরের তীরঘেঁষা এ গ্রামের পশ্চিমে কোহেলিয়া নদী।

কয়েক বছর ধরে এ গ্রামে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনে গত পাঁচ বছরে এ গ্রামে বসতবাড়ি হারিয়েছে অন্তত ১০০ পরিবার। বর্ষা মৌসুমে প্রাকৃতিক জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়ে তাদের ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে যায়। ফলে বসতবাড়ি হারিয়ে গ্রামের অনেকেই এখন পার্শ্ববর্তী এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। গফুরও ঘরবাড়ি হারিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জলবায়ু নিয়ে নতুন শঙ্কার জানান দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) আর্থ, অ্যাটমোস্ফিয়ারিক এবং প্ল্যানেটারি সায়েন্সেস বিভাগের একদল গবেষক।

গৃহহারা ১০০ পরিবারের মধ্যে আছেন গ্রামের মৎস্যজীবী নূর হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক যুগ ধরে তাঁরা ওই গ্রামে বসবাস করছেন। বর্ষার মৌসুমে জলোচ্ছ্বাসের সময় তাঁদের ঘরবাড়িতে আগে তেমন পানি উঠত না। কিন্তু পাঁচ-ছয় বছর ধরে জলোচ্ছ্বাস নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবেই একবার বড় জলোচ্ছ্বাসের কবলে তাঁদের ঘরবাড়ি ভেঙে যায়। এখন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকছেন।

স্থানীয় মাতারবাড়ী ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে পড়েছে এই জালিয়াপাড়া। ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মোহাম্মদ আলীর কথা, বেড়িবাঁধ নির্মাণ না করলে সামনে আরও শ দুয়েক পরিবার তাদের বসতবাড়ি হারাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ঝড়ঝঞ্ঝা-জলোচ্ছ্বাস বাংলাদেশের, বিশেষ করে উপকূলের মানুষের কাছে নতুন কিছু নয়। এর সঙ্গে লড়াই করেই বেঁচে থাকতে শিখেছেন এসব অঞ্চলের মানুষ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্রকৃতি যেন বেশি বৈরী। জালিয়াপাড়া গ্রামের মানুষ শুধু নয়, এমন অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের দীর্ঘ উপকূলে থাকা অনেক মানুষের।

গবেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশে বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। আগে যে ধরনের বড় ঝড় ১০০ বছরে একবার হতো, এখন তা ১০ বছরেই হতে পারে। এই ঝুঁকি অঞ্চলভেদে ও মৌসুমভেদেও ভিন্ন হতে পারে।

বিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদদের কথা, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এমনটা হচ্ছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জলবায়ু নিয়ে নতুন শঙ্কার জানান দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) আর্থ, অ্যাটমোস্ফিয়ারিক এবং প্ল্যানেটারি সায়েন্সেস বিভাগের একদল গবেষক।

গবেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশে বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। আগে যে ধরনের বড় ঝড় ১০০ বছরে একবার হতো, এখন তা ১০ বছরেই হতে পারে। এই ঝুঁকি অঞ্চলভেদে ও মৌসুমভেদেও ভিন্ন হতে পারে।

দেশে বাড়ছে এসব ঘূর্ণিঝড়ে জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কাও। বাংলাদেশের উপকূলে ঘূর্ণিঝড়ের সময় জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকি ১০ গুণ বাড়তে পারে।

বাংলাদেশের জন্য জলবায়ু নিয়ে আরও শঙ্কা আছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভবিষ্যতে প্রাক্‌-মৌসুমি বা মৌসুমি বায়ু পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে ঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের প্রবণতা বাড়তে পারে। এতে অসময়ে প্লাবিত হবে নতুন নতুন এলাকা ও কৃষিজমি। দেশের উপকূলীয় এলাকায় কৃষি এবং সার্বিকভাবে জনজীবনে এর মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে।

বিশ্বের সবচেয়ে জলবায়ুঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর একটি বাংলাদেশের এই ভয়ানক ভবিষ্যতের চিত্র উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়ান আর্থ নামের বিজ্ঞান সাময়িকীতে। ১১ এপ্রিল এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত আন্তসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) সদস্য ও বুয়েটের পানিসম্পদ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘নতুন এ গবেষণায় যেদিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে, তা আমাদের নতুন দিকের সন্ধান দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় আমরা যেসব পরিকল্পনা করছি, তাতে এ গবেষণার ফলাফল ব্যাপক সহায়তা করবে। আমাদের অভিযোজন পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে হবে—এ গবেষণা সেই দিকেরই নির্দেশ দিচ্ছে।’

বিশ্বের সবচেয়ে জলবায়ুঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর একটি বাংলাদেশের এই ভয়ানক ভবিষ্যতের চিত্র উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়ান আর্থ নামের বিজ্ঞান সাময়িকীতে। ১১ এপ্রিল এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

কেন এই গবেষণা

এ কথা এখন বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত যে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। বাংলাদেশের অবস্থান এমন একটি ভৌগোলিক স্থানে যেখানে প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে। এটি নিচু বদ্বীপ অঞ্চল। এখানে আছে ফানেল আকৃতির উপকূল। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, তীব্র ঘূর্ণিঝড় এবং মৌসুমি বৃষ্টিপাত—বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির দিক প্রকট করছে।

নতুন এ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত গবেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম তথ্য-সংকটাপন্ন কিন্তু দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল। বৈজ্ঞানিকভাবে, বাংলাদেশ হলো জটিল ও ক্রমিক দুর্যোগ বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ স্থান।

এমআইটির এই গবেষকদের একজন এবং প্রতিষ্ঠানটির আর্থ, অ্যাটমোস্ফিয়ার অ্যান্ড প্ল্যানেটারি সায়েন্সেস বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সাই জ্যান্ডার সাভেলা প্রথম আলোকে ই-মেইলে বলেন, ‘বাংলাদেশ যে পরিমাণ ঝুঁকির মুখোমুখি, তা সর্বোচ্চ মানের মডেলিং, সর্বোত্তম বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং জরুরি সহযোগিতা দাবি করে। আমরা এখানে যে বিষয়গুলো তুলে ধরেছি, তা কেবল বাংলাদেশের জন্য নয়, বরং ভিয়েতনাম, দক্ষিণ চীন, ইন্দোনেশিয়া ও অন্যান্য সমমানের বদ্বীপ ও উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর জন্যও প্রাসঙ্গিক হবে।’

নতুন এ গবেষণায় যেদিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে, তা আমাদের নতুন দিকের সন্ধান দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় আমরা যেসব পরিকল্পনা করছি, তাতে এ গবেষণার ফলাফল ব্যাপক সহায়তা করবে। আমাদের অভিযোজন পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে হবে—এ গবেষণা সেই দিকেরই নির্দেশ দিচ্ছেআইপিসিসি সদস্য ও বুয়েটের পানিসম্পদ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম

এ উপমহাদেশের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত যোগাযোগের কথা উল্লেখ করে সাভেলা বলেন, ‘যদিও আমি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক এবং সেখানে কাজ করি, তবে আমি ভারতের সন্তান এবং বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের সঙ্গে আমার গভীর শিকড় রয়েছে। এ অঞ্চল আমার জন্য বৈজ্ঞানিক এবং ব্যক্তিগত—উভয় দিক থেকেই তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশের জন্য কাজ করতে পেরে আমি অপার আনন্দ ও শক্তি অনুভব করি।’

গবেষণায় বলা হয়েছে, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তাটি হলো: ভবিষ্যতের ঝুঁকি বোঝার জন্য শুধু অতীতের পর্যবেক্ষণের ওপর নির্ভর করা যাবে না। জলবায়ু ইতিমধ্যেই পরিবর্তিত হচ্ছে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের পুনরাবৃত্তির হার বাড়ছে। আমাদের গবেষণার ফলাফল দেখায়, যেসব ঝড়-জোয়ারকে আগে ১০০ বছরে একবারের ঘটনা বলে ধরা হতো, সেগুলো এই শতাব্দীর শেষের দিকে প্রতি ১০ বছর বা তারও কম সময়ে একবার করে ঘটতে পারে।’

কীভাবে হলো গবেষণা

এ গবেষণায় একটি সমন্বিত বিশ্লেষণ ও জলগতিশীলতা মডেল (হাইড্রোডাইনামিক) ব্যবহৃত হয়েছে। তিনটি প্রধান বিষয়কে কেন্দ্র করে এই বিশ্লেষণগুলো করা হয়েছে। সেগুলো হলো কৃত্রিম ঘূর্ণিঝড় বিশ্লেষণ, জলোচ্ছ্বাসের জলগতিশীলতা সিমুলেশন এবং পরিসংখ্যানভিত্তিক বিশ্লেষণ।

গবেষণায় প্রথমে একটি কৃত্রিমভাবে তৈরি ঘূর্ণিঝড় ট্র্যাক সেট ব্যবহার করা হয়েছে। যার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যেমন ঘূর্ণিঝড়ের স্বাভাবিক প্রবণতা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা বাংলাদেশের জলোচ্ছ্বাসে কীভাবে প্রভাব ফেলে, তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় মোখায় ক্ষতিগ্রস্ত সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সৈকতের বালিয়াড়ি ভেঙে আবাসিক এলাকার ঘরবাড়িতে ঢুকছে পানি। ২০২৩ সালের মে মাসে.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ঘ র ণ ঝড় র র জন য আম দ র নত ন এ পর ব র সবচ য় জলব য় উপক ল সদস য একব র ধরন র বলছ ন র ঘরব

এছাড়াও পড়ুন:

পবিত্র কোরআনে ‘রুকু’ কীভাবে এল

আমরা কোরআন তিলাওয়াত করার সময় প্রতিটি সুরার শুরুতেই আয়াত সংখ্যার সঙ্গে ‘রুকু’ সংখ্যাও লেখা দেখি। পৃষ্ঠার মাঝেও রুকু লেখা থাকে। এই রুকু মানে কী? কী কাজ এই রুকুর?

এই প্রবন্ধে রুকুর ধারণা, কোরআন তিলাওয়াতের সঙ্গে এর সম্পর্ক এবং কোরআনে রুকুর সংখ্যা নিয়ে আলোচনা করা হলো।

রুকু কী

রুকু আরবি শব্দ, যার অর্থ ‘নমন’ বা ‘বাঁকানো’। নামাজে রুকু বলতে কোমর ঝুঁকিয়ে আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের অঙ্গভঙ্গিকে বোঝায়।

তবে কোরআন তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে রুকু একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ আয়াতের সংকলনকে বোঝায়, যা তিলাওয়াতকে সংগঠিত ও সহজতর করে। এটি বিশেষ করে হাফেজদের (যাঁরা কোরআন মুখস্থ করেন) জন্য সুবিধাজনক।

ইমাম সারাখসি (মৃ. ৪৮৩ হি.) রুকুকে রাকাতের সঙ্গে সম্পর্কিত করে বলেছেন, এক রাকাতে তিলাওয়াতের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ আয়াতের সংকেত হিসেবে রুকু ব্যবহৃত হতো।কোরআন তিলাওয়াতে রুকুর ভূমিকা

রুকু নির্ধারণের উদ্দেশ্য ছিল তিলাওয়াতের সময় আয়াতের বিষয়বস্তুর ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এবং বিরতি নেওয়ার সুবিধা প্রদান। ইসলামের প্রাথমিক যুগে, বিশেষ করে হাফেজরা তিলাওয়াতের পর নির্দিষ্ট আয়াতে এসে রুকুতে যেতেন, যা এই প্রথার উৎপত্তির ইঙ্গিত দেয়।

ঐতিহাসিকভাবে রুকু নির্ধারণের প্রথা মা-ওয়ারাউন্নাহার (বুখারা, সমরখন্দ) অঞ্চলে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। এটি তারাবিহ নামাজের সময় কোরআন তিলাওয়াতকে সংগঠিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।

ইমাম সারাখসি (মৃ. ৪৮৩ হি.) রুকুকে রাকাতের সঙ্গে সম্পর্কিত করে বলেছেন, এক রাকাতে তিলাওয়াতের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ আয়াতের সংকেত হিসেবে রুকু ব্যবহৃত হতো। অন্য একটি মত অনুসারে, হাফেজরা নির্দিষ্ট পরিমাণ তিলাওয়াতের পর রুকুতে যাওয়ার কারণে এই নামকরণ হয়েছে। (আল-সারাখসি, আল-মাবসুত, বৈরুত: দার আল-মা’রিফা)

আরও পড়ুনধীরে ধীরে কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার কারণ৩০ মে ২০২৫কোরআনে রুকুর সংখ্যা

কোরআনে রুকুর সংখ্যা বিভিন্ন অঞ্চলে ও ঐতিহ্য অনুসারে ভিন্নতা দেখায়। প্রধানত তিনটি ধারা প্রচলিত: ৫৫৮, ৫৪০ ও ৪৮০।

৫৫৮ রুকু: বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মুসহাফে সাধারণত ৫৫৮টি রুকু ব্যবহৃত হয়। প্রতিটি সুরায় রুকুর সংখ্যা উল্লেখ থাকে এবং আরবি অক্ষর ‘আইন’ দিয়ে রুকু চিহ্নিত করা হয়। এই চিহ্নে তিনটি সংখ্যা থাকে:

 ১. ওপরের সংখ্যা: সুরার মধ্যে রুকুর ক্রম।

 ২. মাঝের সংখ্যা: রুকুর আয়াতসংখ্যা।

 ৩. নিচের সংখ্যা: পারার (জুজ) মধ্যে রুকুর ক্রম।

 এই পদ্ধতি তিলাওয়াতকে সুসংগঠিত করে এবং হাফেজদের জন্য সুবিধাজনক। (সিদ্দিকি, এ, ২০১৭, কোরআনিক ম্যানুস্ক্রিপ্টস অ্যান্ড দেয়ার ডিভিশনস, জার্নাল অব ইসলামিক স্টাডিজ, ২৮(২), (১৪৫-১৬৭)

বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মুসহাফে সাধারণত ৫৫৮টি রুকু ব্যবহৃত হয়। প্রতিটি সুরায় রুকুর সংখ্যা উল্লেখ থাকে এবং আরবি অক্ষর ‘আইন’ দিয়ে রুকু চিহ্নিত করা হয়।

৫৪০ রুকু: বুখারায় প্রথম রুকু নির্ধারণের সময় এর সংখ্যা ছিল ৫৪০। বুখারার মাশায়েখরা রমজানে তারাবিহ নামাজে প্রতি রাকাতে ১০টি আয়াত তিলাওয়াতের প্রথা অনুসরণ করতেন। এভাবে ৩০ দিনে কোরআনের প্রায় ৬ হাজার আয়াত তিলাওয়াত হতো। তবে দশ আয়াতের ভিত্তিতে তিলাওয়াত করলে বিষয়বস্তুর মাঝখানে বিরতি পড়ত, তাই তারা বিষয়ের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য রুকু নির্ধারণ করেন। (রহিম বখশ, আল-খাত্ত আল-উসমানি ফি রাসমিল কোরআন, লাহোর: মাকতাবা কুদ্দুসিয়া, ১৯৮২)

৪৮০ রুকু: সিন্ধুর হাশিম থাট্টুভি কোরআনের রুকুসংখ্যা ৪৮০ নির্ধারণ করেছিলেন। তিনি সুরাভিত্তিক নয়, বরং পারাভিত্তিক রুকু নির্ধারণ করেন। প্রতি পারায় ১৬টি রুকু ধরে ৩০ পারায় মোট ৪৮০ রুকু হয়।

তিনি ‘রুকু’ শব্দের পরিবর্তে ‘মাকরা’ বা ‘মাকারি’ শব্দ প্রস্তাব করেন, যা ‘কিরআত’ (পাঠ্যাংশ) থেকে উদ্ভূত। (আজমি, এম এম, ২০০৩, দ্য হিস্ট্রি অব দ্য কোরআনিক টেক্সট: ফ্রম রেভল্যুশন টু কম্পাইলেশন, যুক্তরাজ্য: আল-কোরআন সোসাইটি)

আরও পড়ুনসহজে কোরআন বোঝার পাঁচটি কৌশল০৩ মে ২০২৫রুকুর প্রচলন

হিজাজ, আন্দালুসিয়া, মিসর, আফ্রিকা ও সিরিয়ায় রুকুর প্রচলন তেমন ছিল না। রুকুর প্রচলন মূলত মা-ওয়ারাউন্নাহার (বুখারা, সমরখন্দ), ভারতবর্ষ ও তুরস্কে ব্যাপক ছিল। ওসমানি খেলাফতের পর তুরস্কে এটা বিলুপ্ত হয়ে, তবে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে এখনো রুকুর প্রচলন আছে।

বুখারার মাশায়েখরা রমজানে তারাবিহ নামাজে প্রতি রাকাতে ১০টি আয়াত তিলাওয়াতের প্রথা অনুসরণ করতেন। তবে এভাবে তিলাওয়াত করলে বিষয়বস্তুর মাঝখানে বিরতি পড়ত, তাই তারা বিষয়ের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য রুকু নির্ধারণ করেন।

ইমাম দানি (মৃ. ৪৪৪ হি.) তাঁর গ্রন্থ আল-বায়ান ফি আদ্দি আয়িল কোরআন-এ কোরআনের বিভিন্ন ভাগ নিয়ে আলোচনা করলেও রুকু নিয়ে বিস্তারিত বলেননি। তবে ইমাম সারাখসি এবং রহিম বখশ তাঁদের লেখায় রুকুর ঐতিহাসিক বিবরণ দিয়েছেন।

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সময়ে সাহাবিরা ১০টি আয়াত করে মুখস্থ করতেন এবং এর ব্যাখ্যা বুঝে পরবর্তী আয়াত শিখতেন, যা রুকু নির্ধারণের প্রাথমিক ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত। (আল-দানি, আল-বায়ান ফি আদ্দি আয়িল কুরআন, কায়রো: দার আল-মা’আরিফ)

সারকথা, রুকু কোরআন তিলাওয়াতকে সহজ ও সংগঠিত করে, বিশেষ করে হাফেজদের জন্য। এটি ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকে প্রচলিত একটি পদ্ধতি, যা বুখারা, সমরখন্দ ও ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছে। ৫৫৮, ৫৪০ ও ৪৮০ রুকুর ধারা বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত হলেও বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে ৫৫৮ রুকুই বেশি ব্যবহৃত হয়।

লেখক: খণ্ডকালীন শিক্ষক, আরবি বিভাগ, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুনযে ঘটনায় কোরআনে পূর্ণ দুটি রুকু নাজিল হয়১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সম্পর্কিত নিবন্ধ