ষ্টুডিও পাড়ায় দেখা হলেই নায়ক-প্রযোজক সোহেল রানা বলতেন, আপনারা এ সপ্তাহে আমাকে নিয়ে কী নিউজ লিখছেন? আমরা আদৌ তাকে নিয়ে কোনো নিউজ করব কিনা বা তাকে নিয়ে করার মতো কোনো নিউজ আছে কিনা তা মাথায় না রেখেই প্রশ্নটি আসত। তখন গুছিয়ে কোনো জবাব দিলে সেটা তার পছন্দ হতো না। তিনি বলতেন, না না এসব না। ছবির ঘটনা নিয়ে নিউজ অহরহ হয়। আপনারা বরং ববিতার সঙ্গে আমার প্রেম নিয়ে লিখুন। তার কথা শুনে হাসি এলেও মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনতে হতো। প্লটও তিনি বলে দিতেন। আমরা যখন এসব বিষয় ববিতার কাছে উপস্থাপন করতাম তখন ববিতা হাসতেন আর বলতেন, তারকা বলে কথা! আলোচনায় তো কোনো না কোনোভাবে থাকতে হবে।
এই ঘটনা থেকে আমি দুটি বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই। একটি হলো শিল্পী ও সাংবাদিকদের মধ্যে সম্পর্ক। এই সম্পর্ক প্রেম, বিয়ে বা দোস্তির সম্পর্ক নয়। নায়িকাদের উদ্দেশ্য ছিল সাংবাদিকদের কাছ থেকে তাদের সম্পর্কে লেখা অর্থাৎ নিয়মিত সংবাদ পরিবেশন এবং প্রশংসা করে প্রতিবেদন আদায় করে নেওয়া (যাকে বলে ইতিবাচক প্রতিবেদন লেখা)। দ্বিতীয়টি হলো, তারকারা সব সময় নিউজে থাকতে চাইতেন। এর কারণ হলো, মাধ্যমটির নাম ছায়াছবি। দর্শক হলো তারকাদের ছায়ার খদ্দের। তারা সিনেমা হলে গিয়ে একজন সোহেল রানা বা ববিতাকে সরাসরি পেতেন না, গাটের অর্থ ব্যয় করে তাদের ছায়াকে দেখতে যেতেন। এজন্য তাদের একটা বাজারমূল্য তৈরি করতে হয়। তারা চাইতেন কীভাবে নিজেকে সংবাদে উপস্থাপন করা হলে দর্শকের অন্তরে তাদের নাম গেঁথে যাবে। এজন্য তারা খবর না থাকলেও নানা গুজব-গুঞ্জন, সত্য-মিথ্যা সাজিয়ে নিজেদের উপস্থাপন করতেন। লক্ষ্য হলো দর্শকের অন্তরে স্থান করে নেওয়া, সেটা যে কোনো উপায়েই হোক না কেন। আর তা প্রকাশ করার একমাত্র মাধ্যম হলো সংবাদপত্র বা সাময়িকী।
পক্ষান্তরে এখন যারা অভিনয় করেন, তারা ক্যামেরার সামনে এসে কথা বলতে বেশি পছন্দ করেন। তিনি যা বলবেন তা সরাসরি পরিবেশন হলে তারা খুশি হন। ফেসবুক, ইউটিউব, টেলিভিশন ইত্যাদি সামাজিক মাধ্যমে তাদের নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করা হলে তারা মনে করেন অনেকের কাছে পৌঁছে গেছেন। কিন্তু এসব ভার্চুয়াল বিষয়গুলো সেখানেই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু আগে তারকাদের নিয়ে যে প্রতিবেদন হতো, তাতে তারকার কথার গাথুনির জন্য সাংবাদিকের একটা বিশ্লেষণ থাকতো। আর সেটাই ছিল পাঠকদের কাছে বিবেচনার বিষয়। এখনকার তারকারা সেটা পান না। কারণ নানা প্রশ্নের মধ্য দিয়ে তারকারাই নিজেদেরকে নিজেদের মতো করে উপস্থাপন করেন। কোনো সাংবাদিক তাদের উপস্থাপন করেন না। এখন অহরহ ‘জনপ্রিয়’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। যাকে কেউ চেনেন না তার ক্ষেত্রেও শব্দটি দেদার ব্যবহার হচ্ছে। তাতে শব্দটি মাহাত্ম্য হারিয়ে ফেলেছে। এর ধারাবাহিকতায় আরো কিছু শব্দ আছে।
আমাদের দেশে বিনোদন সাংবাদিকতা পেশাদারি মনোভাব নিয়ে শুরু হয় ষাটের দশকে। বিনোদন সাংবাদিকতা হলো সাংবাদিকতার একটি ধারা, যা মূলত বিনোদন ব্যবসায় এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ের সংবাদ সংগ্রহ, প্রতিবেদন তৈরি ও গণমাধ্যমে প্রকাশ পর্যন্ত সম্পাদিত কার্যক্রম নির্দেশ করে থাকে। এ ধারা বিনোদন শিল্প সংশ্লিষ্টদের বাইরেও সাধারণ পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হয়েছে। টেলিভিশন, চলচ্চিত্র সমালোচনা, সংগীত সাংবাদিকতা, ভিডিও গেম সাংবাদিকতা এবং সেলিব্রিটি সম্পর্কিত প্রচলিত সংবাদভিত্তিক কার্যক্রম বিনোদন সাংবাদিকতার অন্তর্ভুক্ত। তবে সেই সময়টাতে এ সাংবাদিকতা ‘চলচ্চিত্র সাংবাদিকতা’ বা ‘সংস্কৃতি সাংবাদিকতা’ হিসেবেই চিহ্নিত হয়। আশির দশক থেকে সাংবাদিকতায় তারকাপ্রথা জেঁকে বসতে শুরু করে। ষাট থেকে আশির দশক এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের কাছে প্রধান বিনোদন ছিল সিনেমা। বিনোদনে তারকাপ্রথা থাকলেও সুলভ টেকনোলজির অভাবে সাংবাদিকতায় তারকানির্ভরতা সহজ ছিল না। প্রথম পর্যায়ে ব্লক করে ছবি ছাপতে হয়েছে। পরে অফসেট পদ্ধতিতে প্রয়োজন হয়েছে ছবির পজিটিভ করা। নব্বইয়ের দশক থেকে প্রিন্ট টেকনোলজি আরো এক ধাপ এগিয়ে যায় ডেস্কটপ পাবলিশিংয়ের কল্যাণে।
সাংবাদিকতায়ও ধীরে ধীরে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা বাড়তে থাকে উপস্থাপনার বৈচিত্রের কারণে। একবিংশ শতকে সাংবাদিকতা বড় ধরনের বিশ্বাসযোগ্যতার সংকটে পড়েছে। গণমাধ্যমের করপোরেট মালিকানা, মুনাফার লক্ষ্যে পাঠকের অধিকার খর্ব, নৈতিকতায় ধ্বস, সাংবাদিকতার শত বছরের ঐতিহ্য কল্যাণকামিতার সঙ্গে আপস- এসব কারণে মানুষ সংবাদপত্র, টেলিভিশন বা অনলাইন পোর্টালের খবর সহজে বিশ্বাস করতে চান না। আর আজকের বিনোদন সাংবাদিকতাও গণমাধ্যমের মুনাফা অর্জনের অংশীদার। বিনোদনের বিষয়ভিত্তিক গভীরতার চেয়ে বাজার কাটতি ব্যক্তিনির্ভরতাই ভর করেছে এ ক্ষেত্রটিতে। সাংবাদিকতার মৌলিক উপাদান দায়িত্বশীলতার অভাব লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশে বিনোদন সাংবাদিকতার শুরু চলচ্চিত্রকে কেন্দ্র করেই।
সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমি যখন এই পেশার সঙ্গে যুক্ত হই তখন ফেসবুক, ইউটিউব তথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছিল না। সাধারণ মানুষের বিনোদনের জন্য সিনেমার পাশে এসে যুক্ত হয় ভিডিও ক্যাসেট রেকর্ডার বা ভিসিআর। এ মাধ্যমটি বাংলাদেশে আসার পরপরই শুরু হয় এর বাণিজ্যিক প্রদর্শনী। ঢাকার রায় সাহেব বাজার বা রাইশা বাজারে একটি কাঠ ব্যবসার দোকান বন্ধ করে দিয়ে সেখানে চলতো ভিসিআর-এর বাণিজ্যিক প্রদর্শনী। একই এলাকার আরেকটি স্থান ছিল নিষিদ্ধপল্লীর পাশের একটি ভবনে। সেখানকার বাসিন্দাদের সরিয়ে দিয়ে চলতো ভিসিআর। একটি ভিডিও ক্যাসেটে তিন বা সাড়ে তিন ঘণ্টার পুরো একটি ছবি। এদেশের দর্শকের বেশি আকর্ষণ ছিল ভারতীয় হিন্দি ছবি। তখনই দর্শক অনেক বেশি পরিচিত হয়েছে ভারতীয় তারকাদের সঙ্গে। এছাড়াও ঢাকার বাজারে আসত উল্টোরথ নামে একটি সাময়ীকী। তাতে ভারতীয় তারকাদের অনুপুঙ্খ পাওয়া যেত। যাহোক, ভিডিও ব্যবসা এতোটাই রমরমা হয়ে উঠেছিল যে রাজধানী ঢাকার আনাচে-কানাচে সেটা বিনা বাধায় ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু সমস্যা হয়ে উঠলো পর্নোগ্রাফি। রাত বারোটা পর্যন্ত মুম্বাইয়ের হিন্দি সিনেমা প্রদর্শন শেষ করার পর শুরু হতো পর্ণোগ্রাফি ছবির প্রদর্শনী। এই প্রদর্শনী শুরু হওয়ার কিছুদিন পরই এর বিরুদ্ধে ব্যাপক আপত্তি ওঠে।
সাংবাদিকতার জগতে পর্নোগ্রাফি প্রদর্শনীর বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠেন কবি রফিক আজাদ। তিনি আমাকে ডেকে ভিসিআর ও পর্নোগ্রাফি নিয়ে সাপ্তাহিক ‘রোববার’ পত্রিকায় একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন লিখে দিতে বললেন। এই সময়টাতে আমি কাজ করতাম সাপ্তাহিক ‘দি নিউ নেশন’ পত্রিকায়। যেমন সম্পাদকীয় নির্দেশ, ঠিক তেমনি কাজ। ভিসিআর প্রদর্শনীর স্থান ও পরিবেশ বোঝার জন্য পরপর দুইদিন আমি সেখানে কাটালাম। তারপর একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন লিখলাম। তার শিরোনাম ছিল ‘ভিসিআর কি চলচ্চিত্রের প্রতিদ্বন্দ্বী?’। রফিক আজাদ আমার কাছ থেকে লেখাটি নিয়ে সম্পাদনার জন্য দিলেন কবি আতাহার খানকে। তিনি লেখাটি দেখে প্রেসে পাঠিয়ে দিলেন। আমার মনে সে কি আনন্দ- বাংলায় আমার লেখা একটি প্রথম সারির সাময়ীকীর প্রচ্ছদ হচ্ছে! নিশ্চয়ই এই প্রচ্ছদ প্রতিবেদনটি দিয়ে আমার ক্যারিয়ারে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। কারণ এই নতুন প্রযুক্তিটি নিয়ে এটাই ছিল বড় ধরনের লেখা। এজন্য আমাকে ‘গার্ডিয়ান’ ও ‘টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার বেশ কিছু প্রতিবেদন পড়তে হয়েছিল। একটি প্রতিবেদনে পেয়েছিলাম শতাব্দীর শেষ দিকে আসছে আকাশ সংস্কৃতি। মানুষ তখন ২৪ ঘণ্টা টেলিভিশন দেখতে পারবে। এ লেখাটিও আমি ‘রোববার’র জন্য অনুবাদ করেছিলাম।
যাহোক রোববার পত্রিকার প্রচ্ছদ প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পর সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’ থেকে ডাক পেলাম। আমার শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক চিন্ময় মুৎসুদ্দী বিচিত্রার তখনকার বিনোদন প্রতিবেদক অনুপম হায়াতকে দিয়ে আমাকে খবর পাঠালেন। আমি তার সঙ্গে দেখা করার পর তিনি আমার সঙ্গে টুকটাক কথা বলে আমাকে নিয়ে গেলেন বিচিত্রা সম্পাদক প্রয়াত শাহাদৎ চৌধুরীর কাছে। তিনি আমাকে বললেন, তোমার ইংরেজী এবং বাংলা দুই ধরনের লেখাই আমি পড়েছি। তোমাকে আমার কাছে আধুনিক মন-মানসিকতার বলে মনে হয়েছে। তুমি বিচিত্রায় আমাদের সঙ্গে কাজ শুরু কর। আশাকরি তুমি খুবই ভালো করবে। তোমাকে মাথায় রেখেই আমি ‘আনন্দ বিচিত্রা’ শুরু করব। আমার সম্মতির জন্য অপেক্ষা না করে এই ক্ষণজন্মা মানুষটি আমাকে চিন্ময়দার হেফাজতে ছেড়ে দিলেন। বিনোদন সাংবাদিকতায় আমি যেটুকু পরিচিতি পেয়েছি সেটুকু এই বিচিত্রা ও আনন্দ বিচিত্রা থেকেই পেয়েছি।
বিনোদন সাংবাদিকতার সংবাদ কক্ষে আমার প্রায় চার দশকেরও বেশি সময় পার হয়েছে। এই সাংবাদিকতায় যুক্ত হয়ে কখনো আনন্দে সময় কেটেছে, কখনো বেদনাবিধুর। কিন্তু পরিস্থিতি যেমনটাই হোক না কেন কখনো সম্পাদকীয়-নীতি থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হইনি। সাংবাদিকতাকে বলা হয় থ্যাংকসলেস জব। অনেক থ্যাংকস পেয়েছি যাদের নিয়ে লিখেছি তাদের কাছ থেকে। কিন্তু আমাদের সময়ে কখনো হাতে খাম তুলে দেওয়া হতো না। সাংবাদিকতার মর্যাদা এতো উঁচু স্তরে ছিল যে, কেউ সেটা করতে সাহস পায়নি। এখন বিষয়টা একেবারে ডালভাত। আমার জানা মতে একজন সাংবাদিক তারকাদের কাছ থেকে ঠিকা নেন, তিনি লিখে আট-দশ পত্রিকায় ছেপে দেবেন, তাকে নির্দিষ্ট অঙ্কের একটা অর্থ দিতে হবে। লেখা ছাপাও হয় কিছু আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকায় বা যেগুলো ইন-হাউজ পত্রিকা। তারকার লাভের মধ্যে এটুকু লাভ হয়, তিনি ছাপার অক্ষরের টুকরোটি কেটে নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিতে পারেন। আর সেখানে লিখতে পারেন ‘থ্যাঙ্ক ইউ অমুক ভাই’।
কিছু সাংবাদিককে এখন দেখা যায়, তারা ছবি বা নাটকের লোকেশনে যান। দ্রুত গতিতে কিছু ছবিও তোলেন। তারপর বলতে শুরু করেন, ভাই আমি খাব না। যাতায়াত ভাড়াটা দিয়ে দেন আমি বা আমরা চলে যাই। প্রশ্ন হচ্ছে, সব কিছুরই ইতি এবং নেতিবাচক দিক আছে। বিদেশে বিনোদন সাংবাদিকতা বা তারকা প্রমোটিং এজেন্সি আছে। আমাদের দেশেও সে রকম কিছু গড়ে উঠতে পারে। এছাড়া আর বিকল্প কি হতে পারে?
তারকা সন্ধান বা প্রমোটিংয়ের জন্য আনন্দ বিচিত্রা ‘ফটোসুন্দরী’ প্রতিযোগিতা শুরু করেছিল। তার ফসল হিসেবে চলচ্চিত্রে যুক্ত হয়েছে মৌসুমী এবং পপি। কিন্তু আনন্দ বিচিত্রা শাবনূরকে সরাসরি আনলেও আনন্দ বিচিত্রার হাত ধরেই শাবনূর তারকা হয়ে উঠেছিলেন। সেখানে মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছি আমি। অনেকেই বলে থাকেন তারা শাবনূরকে নিয়ে এসেছেন, আমি শুনেও না শোনার ভান করি। কথা বলি না। একবার বিনোদন বিচিত্রার ঈদ সংখ্যার একটি লেখার জন্য সাংবাদিক শাহ আলমগীর মৌসুমীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন তার ক্যারিয়ারে কোন কোন সাংবাদিকের ভূমিকা ছিল। মৌসুমী তাকে এক ডজন সাংবাদিকের নাম বলেছিলেন। প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই তিনি দু’চার লাইন করে বলে গিয়েছেন। আমার নামটি এসেছে প্রতিবেদনের শেষ দিকে। বিনোদন বিচিত্রার দুই পৃষ্ঠা ধরে আমার কথা লেখা হয়েছিল। প্রবাদ আছে যেমন কর্ম তেমন ফল। আজকে যারা বিনোদন সাংবাদিকতায় রয়েছেন তাদের উপরই বিনোদন সাংবাদিকতার মর্যাদা নির্ভরশীল। আশাকরি, তারা বিনোদন সাংবাদিকতার মর্যাদা রক্ষা করবেন এবং পেশাদার সাংবাদিকতার মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখে আগামী প্রজন্মের কাছে অহঙ্কার হয়ে বেঁচে থাকবেন। নতুন বা বিনোদন সাংবাদিকতা কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান হয়েই থাকবে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর আনন দ ব চ ত র ব দ কত র ম চলচ চ ত র ব দ কত য় র জন য পর ব শ আম দ র আম র ক ভ স আর র একট র দশক
এছাড়াও পড়ুন:
খুলনায় এক মাসে ১৩ লাশ উদ্ধার, বাড়ছে উদ্বেগ
বাড়িতে ঝগড়া চলছিল বড় ভাই ও ভাবির। ছোট ভাই এসে ঝগড়া থামানোর চেষ্টা করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বড় ভাই ছোট ভাইয়ের মাথায় শাবল দিয়ে আঘাত করেন। মাটিতে লুটিয়ে পড়লে ধারালো বঁটি দিয়ে ছোট ভাইকে হত্যা করেন। পরে বড় ভাই শহিদুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিনি এখন কারাগারে। ঘটনাটি ঘটেছে গত ৩০ মে, খুলনার কয়রা উপজেলার বাগালী ইউনিয়নের উলা গ্রামে।
এর আগে ২৭ মে কয়রার ইসলামপুর গ্রামের কয়রা নদীর চর থেকে শিকলে বাঁধা অবস্থায় আবদুল মজিদ (৬২) নামের এক বৃদ্ধের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ছাড়া ৮ জুন কয়রার কাছারিবাড়ি বাজার-সংলগ্ন পুকুর থেকে নমিতা (৪০) নামের এক নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়।
১০ জুন কয়রা সদরের গোবরা সড়কে এক ভ্যানচালকের সঙ্গে এক মোটরসাইকেলচালকের কথা-কাটাকাটিকে কেন্দ্র করে দুই গ্রামের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে আহত হন অন্তত ১৫ জন। ঘটনায় ১২ জনকে আসামি করে থানায় মামলাও হয়েছে। এ ছাড়া কথা-কাটাকাটির জেরে কয়রার পল্লীমঙ্গল গ্রামে গত তিন দিনে কয়েক দফা মারামারি, হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
অসন্তোষ-দ্বন্দ্বের জেরে কয়রা উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় হত্যা–সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। ১০ মে থেকে ৯ জুন পর্যন্ত এক মাসে খুলনার ১০টি থানা এলাকায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনাসহ ১৩টি লাশ উদ্ধার হয়েছে। এ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে।
কয়রা কপোতাক্ষ মহাবিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষক বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপাদান কমে যাওয়ায় মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। মূল্যবোধ ও ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব ও ভালোবাসা কমে যাচ্ছে। এতে খুনখারাবি বাড়ছে। একসময় সমাজের একজনের ভালোতে সবাই আনন্দ পেতেন। নেতিবাচক দিকগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করতেন। এখন সেই ব্যবস্থা উঠেই গেছে বলা যায়। পাশাপাশি রাজনৈতিক আধিপত্যের লড়াইয়ে প্রভাববলয় সৃষ্টি করতেও সহিংসতার ঘটনা ঘটছে।
৩ জুন খুলনা শহরে দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে সবুজ হাওলাদার (৩০) নামের এক যুবকের মৃত্যু হয়। ৪ জুন খুলনা সদর থানার মতিয়াখালী খালের মধ্যে আটকে ছিল এক নারীর মরদেহ। পরে পুলিশ গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করে। ওই নারীর পরিচয় না পেয়ে বেওয়ারিশ হিসেবে আঞ্জুমান মুফিদুলে দাফন করা হয়। গত ৯ জুন বিকেলে রূপসা উপজেলার আঠারোবেকী নদীতে পাওয়া যায় অজ্ঞাতনামা যুবকের মরদেহ। মরদেহের শ্বাসনালিতে গভীর ক্ষতচিহ্ন ছিল। রূপসা নৌ পুলিশের ওসি আবুল খায়ের বলেন, ধারণা করা হচ্ছে, এটি একটি হত্যাকাণ্ড।
এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে রহস্য উদ্ঘাটন ও অপরাধী শনাক্তে দীর্ঘসূত্রতার কারণেই অপরাধ বেড়ে চলেছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ মানবাধিকার ব্যুরোর কয়রা উপজেলা শাখার সভাপতি তরিকুল ইসলাম। তাঁর ভাষ্য, প্রতিটি ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত শেষে দোষীদের আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারলে অপরাধপ্রবণতা কমে আসবে। আইনি প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার কারণে অপরাধ বেড়ে চলেছে।
কয়রা উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুলী বিশ্বাস বলেন, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনায় এলাকার মানুষের মধ্যে উৎকণ্ঠা বাড়ছে, এটা ঠিক। তবে প্রতিটি ঘটনায় পুলিশও তাৎক্ষণিকভাবে আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যে বিষয়গুলো পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধের মধ্য দিয়ে সমাধান করা যায়, সেখানে খুনাখুনি, অস্থিরতা, মামলা-হামলার মধ্য দিয়ে একধরনের বিভীষিকাময় পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে; যা সবার জন্যই অকল্যাণকর ও ভয়ানক।