Risingbd:
2025-04-30@22:03:46 GMT

কাঠগড়ায় বিনোদন সাংবাদিকতা

Published: 25th, April 2025 GMT

কাঠগড়ায় বিনোদন সাংবাদিকতা

ষ্টুডিও পাড়ায় দেখা হলেই নায়ক-প্রযোজক সোহেল রানা বলতেন, আপনারা এ সপ্তাহে আমাকে নিয়ে কী নিউজ লিখছেন? আমরা আদৌ তাকে নিয়ে কোনো নিউজ করব কিনা বা তাকে নিয়ে করার মতো কোনো নিউজ আছে কিনা তা মাথায় না রেখেই প্রশ্নটি আসত। তখন গুছিয়ে কোনো জবাব দিলে সেটা তার পছন্দ হতো না। তিনি বলতেন, না না এসব না। ছবির ঘটনা নিয়ে নিউজ অহরহ হয়। আপনারা বরং ববিতার সঙ্গে আমার প্রেম নিয়ে লিখুন। তার কথা শুনে হাসি এলেও মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনতে হতো। প্লটও তিনি বলে দিতেন। আমরা যখন এসব বিষয় ববিতার কাছে উপস্থাপন করতাম তখন ববিতা হাসতেন আর বলতেন, তারকা বলে কথা! আলোচনায় তো কোনো না কোনোভাবে থাকতে হবে। 

এই ঘটনা থেকে আমি দুটি বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই। একটি হলো শিল্পী ও সাংবাদিকদের মধ্যে সম্পর্ক। এই সম্পর্ক প্রেম, বিয়ে বা দোস্তির সম্পর্ক নয়। নায়িকাদের উদ্দেশ্য ছিল সাংবাদিকদের কাছ থেকে তাদের সম্পর্কে লেখা অর্থাৎ নিয়মিত সংবাদ পরিবেশন এবং প্রশংসা করে প্রতিবেদন আদায় করে নেওয়া (যাকে বলে ইতিবাচক প্রতিবেদন লেখা)। দ্বিতীয়টি হলো, তারকারা সব সময় নিউজে থাকতে চাইতেন। এর কারণ হলো, মাধ্যমটির নাম ছায়াছবি। দর্শক হলো তারকাদের ছায়ার খদ্দের। তারা সিনেমা হলে গিয়ে একজন সোহেল রানা বা ববিতাকে সরাসরি পেতেন না, গাটের অর্থ ব্যয় করে তাদের ছায়াকে দেখতে যেতেন। এজন্য তাদের একটা বাজারমূল্য তৈরি করতে হয়। তারা চাইতেন কীভাবে নিজেকে সংবাদে উপস্থাপন করা হলে দর্শকের অন্তরে তাদের নাম গেঁথে যাবে। এজন্য তারা খবর না থাকলেও নানা গুজব-গুঞ্জন, সত্য-মিথ্যা সাজিয়ে নিজেদের উপস্থাপন করতেন। লক্ষ্য হলো দর্শকের অন্তরে স্থান করে নেওয়া, সেটা যে কোনো উপায়েই হোক না কেন। আর তা প্রকাশ করার একমাত্র মাধ্যম হলো সংবাদপত্র বা সাময়িকী। 

পক্ষান্তরে এখন যারা অভিনয় করেন, তারা ক্যামেরার সামনে এসে কথা বলতে বেশি পছন্দ করেন। তিনি যা বলবেন তা সরাসরি পরিবেশন হলে তারা খুশি হন। ফেসবুক, ইউটিউব, টেলিভিশন ইত্যাদি সামাজিক মাধ্যমে তাদের নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করা হলে তারা মনে করেন অনেকের কাছে পৌঁছে গেছেন। কিন্তু এসব ভার্চুয়াল বিষয়গুলো সেখানেই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু আগে তারকাদের নিয়ে যে প্রতিবেদন হতো, তাতে তারকার কথার গাথুনির জন্য সাংবাদিকের একটা বিশ্লেষণ থাকতো। আর সেটাই ছিল পাঠকদের কাছে বিবেচনার বিষয়। এখনকার তারকারা সেটা পান না। কারণ নানা প্রশ্নের মধ্য দিয়ে তারকারাই নিজেদেরকে নিজেদের মতো করে উপস্থাপন করেন। কোনো সাংবাদিক তাদের উপস্থাপন করেন না। এখন অহরহ ‘জনপ্রিয়’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। যাকে কেউ চেনেন না তার ক্ষেত্রেও শব্দটি দেদার ব্যবহার হচ্ছে। তাতে শব্দটি মাহাত্ম্য হারিয়ে ফেলেছে। এর ধারাবাহিকতায় আরো কিছু শব্দ আছে। 

আমাদের দেশে বিনোদন সাংবাদিকতা পেশাদারি মনোভাব নিয়ে শুরু হয় ষাটের দশকে। বিনোদন সাংবাদিকতা হলো সাংবাদিকতার একটি ধারা, যা মূলত বিনোদন ব্যবসায় এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ের সংবাদ সংগ্রহ, প্রতিবেদন তৈরি ও গণমাধ্যমে প্রকাশ পর্যন্ত সম্পাদিত কার্যক্রম নির্দেশ করে থাকে। এ ধারা বিনোদন শিল্প সংশ্লিষ্টদের বাইরেও সাধারণ পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হয়েছে। টেলিভিশন, চলচ্চিত্র সমালোচনা, সংগীত সাংবাদিকতা, ভিডিও গেম সাংবাদিকতা এবং সেলিব্রিটি সম্পর্কিত প্রচলিত সংবাদভিত্তিক কার্যক্রম বিনোদন সাংবাদিকতার অন্তর্ভুক্ত। তবে সেই সময়টাতে এ সাংবাদিকতা ‘চলচ্চিত্র সাংবাদিকতা’ বা ‘সংস্কৃতি সাংবাদিকতা’ হিসেবেই চিহ্নিত হয়। আশির দশক থেকে সাংবাদিকতায় তারকাপ্রথা জেঁকে বসতে শুরু করে। ষাট থেকে আশির দশক এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের কাছে প্রধান বিনোদন ছিল সিনেমা। বিনোদনে তারকাপ্রথা থাকলেও সুলভ টেকনোলজির অভাবে সাংবাদিকতায় তারকানির্ভরতা সহজ ছিল না। প্রথম পর্যায়ে ব্লক করে ছবি ছাপতে হয়েছে। পরে অফসেট পদ্ধতিতে প্রয়োজন হয়েছে ছবির পজিটিভ করা। নব্বইয়ের দশক থেকে প্রিন্ট টেকনোলজি আরো এক ধাপ এগিয়ে যায় ডেস্কটপ পাবলিশিংয়ের কল্যাণে।

সাংবাদিকতায়ও ধীরে ধীরে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা বাড়তে থাকে উপস্থাপনার বৈচিত্রের কারণে। একবিংশ শতকে সাংবাদিকতা বড় ধরনের বিশ্বাসযোগ্যতার সংকটে পড়েছে। গণমাধ্যমের করপোরেট মালিকানা, মুনাফার লক্ষ্যে পাঠকের অধিকার খর্ব, নৈতিকতায় ধ্বস, সাংবাদিকতার শত বছরের ঐতিহ্য কল্যাণকামিতার সঙ্গে আপস- এসব কারণে মানুষ সংবাদপত্র, টেলিভিশন বা অনলাইন পোর্টালের খবর সহজে বিশ্বাস করতে চান না। আর আজকের বিনোদন সাংবাদিকতাও গণমাধ্যমের মুনাফা অর্জনের অংশীদার। বিনোদনের বিষয়ভিত্তিক গভীরতার চেয়ে বাজার কাটতি ব্যক্তিনির্ভরতাই ভর করেছে এ ক্ষেত্রটিতে। সাংবাদিকতার মৌলিক উপাদান দায়িত্বশীলতার অভাব লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশে বিনোদন সাংবাদিকতার শুরু চলচ্চিত্রকে কেন্দ্র করেই।

সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমি যখন এই পেশার সঙ্গে যুক্ত হই তখন ফেসবুক, ইউটিউব তথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছিল না। সাধারণ মানুষের বিনোদনের জন্য সিনেমার পাশে এসে যুক্ত হয় ভিডিও ক্যাসেট রেকর্ডার বা ভিসিআর। এ মাধ্যমটি বাংলাদেশে আসার পরপরই শুরু হয় এর বাণিজ্যিক প্রদর্শনী। ঢাকার রায় সাহেব বাজার বা রাইশা বাজারে একটি কাঠ ব্যবসার দোকান বন্ধ করে দিয়ে সেখানে চলতো ভিসিআর-এর বাণিজ্যিক প্রদর্শনী। একই এলাকার আরেকটি স্থান ছিল নিষিদ্ধপল্লীর পাশের একটি ভবনে। সেখানকার বাসিন্দাদের সরিয়ে দিয়ে চলতো ভিসিআর। একটি ভিডিও ক্যাসেটে তিন বা সাড়ে তিন ঘণ্টার পুরো একটি ছবি। এদেশের দর্শকের বেশি আকর্ষণ ছিল ভারতীয় হিন্দি ছবি। তখনই দর্শক অনেক বেশি পরিচিত হয়েছে ভারতীয় তারকাদের সঙ্গে। এছাড়াও ঢাকার বাজারে আসত উল্টোরথ নামে একটি সাময়ীকী। তাতে ভারতীয় তারকাদের অনুপুঙ্খ পাওয়া যেত। যাহোক, ভিডিও ব্যবসা এতোটাই রমরমা হয়ে উঠেছিল যে রাজধানী ঢাকার আনাচে-কানাচে সেটা বিনা বাধায় ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু সমস্যা হয়ে উঠলো পর্নোগ্রাফি। রাত বারোটা পর্যন্ত মুম্বাইয়ের হিন্দি সিনেমা প্রদর্শন শেষ করার পর শুরু হতো পর্ণোগ্রাফি ছবির প্রদর্শনী। এই প্রদর্শনী শুরু হওয়ার কিছুদিন পরই এর বিরুদ্ধে ব্যাপক আপত্তি ওঠে। 

সাংবাদিকতার জগতে পর্নোগ্রাফি প্রদর্শনীর বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠেন কবি রফিক আজাদ। তিনি আমাকে ডেকে ভিসিআর ও পর্নোগ্রাফি নিয়ে সাপ্তাহিক ‘রোববার’ পত্রিকায় একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন লিখে দিতে বললেন। এই সময়টাতে আমি কাজ করতাম সাপ্তাহিক ‘দি নিউ নেশন’ পত্রিকায়। যেমন সম্পাদকীয় নির্দেশ, ঠিক তেমনি কাজ। ভিসিআর প্রদর্শনীর স্থান ও পরিবেশ বোঝার জন্য পরপর দুইদিন আমি সেখানে কাটালাম। তারপর একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন লিখলাম। তার শিরোনাম ছিল ‘ভিসিআর কি চলচ্চিত্রের প্রতিদ্বন্দ্বী?’। রফিক আজাদ আমার কাছ থেকে লেখাটি নিয়ে সম্পাদনার জন্য দিলেন কবি আতাহার খানকে। তিনি লেখাটি দেখে প্রেসে পাঠিয়ে দিলেন। আমার মনে সে কি আনন্দ- বাংলায় আমার লেখা একটি প্রথম সারির সাময়ীকীর প্রচ্ছদ হচ্ছে! নিশ্চয়ই এই প্রচ্ছদ প্রতিবেদনটি দিয়ে আমার ক্যারিয়ারে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। কারণ এই নতুন প্রযুক্তিটি নিয়ে এটাই ছিল বড় ধরনের লেখা। এজন্য আমাকে ‘গার্ডিয়ান’ ও ‘টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার বেশ কিছু প্রতিবেদন পড়তে হয়েছিল। একটি প্রতিবেদনে পেয়েছিলাম শতাব্দীর শেষ দিকে আসছে আকাশ সংস্কৃতি। মানুষ তখন ২৪ ঘণ্টা টেলিভিশন দেখতে পারবে। এ লেখাটিও আমি ‘রোববার’র জন্য অনুবাদ করেছিলাম। 

যাহোক রোববার পত্রিকার প্রচ্ছদ প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পর সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’ থেকে ডাক পেলাম। আমার শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক চিন্ময় মুৎসুদ্দী বিচিত্রার তখনকার বিনোদন প্রতিবেদক অনুপম হায়াতকে দিয়ে আমাকে খবর পাঠালেন। আমি তার সঙ্গে দেখা করার পর তিনি আমার সঙ্গে টুকটাক কথা বলে আমাকে নিয়ে গেলেন বিচিত্রা সম্পাদক প্রয়াত শাহাদৎ চৌধুরীর কাছে। তিনি আমাকে বললেন, তোমার ইংরেজী এবং বাংলা দুই ধরনের লেখাই আমি পড়েছি। তোমাকে আমার কাছে আধুনিক মন-মানসিকতার বলে মনে হয়েছে। তুমি বিচিত্রায় আমাদের সঙ্গে কাজ শুরু কর। আশাকরি তুমি খুবই ভালো করবে। তোমাকে মাথায় রেখেই আমি ‘আনন্দ বিচিত্রা’ শুরু করব। আমার সম্মতির জন্য অপেক্ষা না করে এই ক্ষণজন্মা মানুষটি আমাকে চিন্ময়দার হেফাজতে ছেড়ে দিলেন। বিনোদন সাংবাদিকতায় আমি যেটুকু পরিচিতি পেয়েছি সেটুকু এই বিচিত্রা ও আনন্দ বিচিত্রা থেকেই পেয়েছি।

বিনোদন সাংবাদিকতার সংবাদ কক্ষে আমার প্রায় চার দশকেরও বেশি সময় পার হয়েছে। এই সাংবাদিকতায় যুক্ত হয়ে কখনো আনন্দে সময় কেটেছে, কখনো বেদনাবিধুর। কিন্তু পরিস্থিতি যেমনটাই হোক না কেন কখনো সম্পাদকীয়-নীতি থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হইনি। সাংবাদিকতাকে বলা হয় থ্যাংকসলেস জব। অনেক থ্যাংকস পেয়েছি যাদের নিয়ে লিখেছি তাদের কাছ থেকে। কিন্তু আমাদের সময়ে কখনো হাতে খাম তুলে দেওয়া হতো না। সাংবাদিকতার মর্যাদা এতো উঁচু স্তরে ছিল যে, কেউ সেটা করতে সাহস পায়নি। এখন বিষয়টা একেবারে ডালভাত। আমার জানা মতে একজন সাংবাদিক তারকাদের কাছ থেকে ঠিকা নেন, তিনি লিখে আট-দশ পত্রিকায় ছেপে দেবেন, তাকে নির্দিষ্ট অঙ্কের একটা অর্থ দিতে হবে। লেখা ছাপাও হয় কিছু আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকায় বা যেগুলো ইন-হাউজ পত্রিকা। তারকার লাভের মধ্যে এটুকু লাভ হয়, তিনি ছাপার অক্ষরের টুকরোটি কেটে নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিতে পারেন। আর সেখানে লিখতে পারেন ‘থ্যাঙ্ক ইউ অমুক ভাই’।

কিছু সাংবাদিককে এখন দেখা যায়, তারা ছবি বা নাটকের লোকেশনে যান। দ্রুত গতিতে কিছু ছবিও তোলেন। তারপর বলতে শুরু করেন, ভাই আমি খাব না। যাতায়াত ভাড়াটা দিয়ে দেন আমি বা আমরা চলে যাই। প্রশ্ন হচ্ছে, সব কিছুরই ইতি এবং নেতিবাচক দিক আছে। বিদেশে বিনোদন সাংবাদিকতা বা তারকা প্রমোটিং এজেন্সি আছে। আমাদের দেশেও সে রকম কিছু গড়ে উঠতে পারে। এছাড়া আর বিকল্প কি হতে পারে?

তারকা সন্ধান বা প্রমোটিংয়ের জন্য আনন্দ বিচিত্রা ‘ফটোসুন্দরী’ প্রতিযোগিতা শুরু করেছিল। তার ফসল হিসেবে চলচ্চিত্রে যুক্ত হয়েছে মৌসুমী এবং পপি। কিন্তু আনন্দ বিচিত্রা শাবনূরকে সরাসরি আনলেও আনন্দ বিচিত্রার হাত ধরেই শাবনূর তারকা হয়ে উঠেছিলেন। সেখানে মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছি আমি। অনেকেই বলে থাকেন তারা শাবনূরকে নিয়ে এসেছেন, আমি শুনেও না শোনার ভান করি। কথা বলি না। একবার বিনোদন বিচিত্রার ঈদ সংখ্যার একটি লেখার জন্য সাংবাদিক শাহ আলমগীর মৌসুমীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন তার ক্যারিয়ারে কোন কোন সাংবাদিকের ভূমিকা ছিল। মৌসুমী তাকে এক ডজন সাংবাদিকের নাম বলেছিলেন। প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই তিনি দু’চার লাইন করে বলে গিয়েছেন। আমার নামটি এসেছে প্রতিবেদনের শেষ দিকে। বিনোদন বিচিত্রার দুই পৃষ্ঠা ধরে আমার কথা লেখা হয়েছিল। প্রবাদ আছে যেমন কর্ম তেমন ফল। আজকে যারা বিনোদন সাংবাদিকতায় রয়েছেন তাদের উপরই বিনোদন সাংবাদিকতার মর্যাদা নির্ভরশীল। আশাকরি, তারা বিনোদন সাংবাদিকতার মর্যাদা রক্ষা করবেন এবং পেশাদার সাংবাদিকতার মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখে আগামী প্রজন্মের কাছে অহঙ্কার হয়ে বেঁচে থাকবেন। নতুন বা বিনোদন সাংবাদিকতা কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান হয়েই থাকবে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক
 

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর আনন দ ব চ ত র ব দ কত র ম চলচ চ ত র ব দ কত য় র জন য পর ব শ আম দ র আম র ক ভ স আর র একট র দশক

এছাড়াও পড়ুন:

শ্রম অধিকার ও সুস্থ কর্মপরিবেশ

আজ মহান মে দিবস। ১৮৮৬ সালের পহেলা মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমিকের মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারকারী মেহনতি মানুষদের স্মরণ করিবার দিন। তৎসহিত সকল শ্রমজীবী মানুষের জন্য মর্যাদাকর জীবন নিশ্চিতকরণের সংগ্রামে নূতন শপথ গ্রহণের দিন।

মে দিবস বিশ্বের শ্রমিকদের সংহতি যদ্রূপ বৃদ্ধি করিয়াছে, তদ্রূপ তাহাদিগকে অধিকার সচেতনও করিয়াছে; প্রেরণা জোগাইয়া চলিয়াছে শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাইয়া যাইতে। মে দিবস বাংলাদেশসহ বিশ্বের উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের মধ্য দিয়া স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশসমূহের জন্য বিপুল প্রেরণার উৎসরূপে কাজ করিয়াছে।

তাহারই প্রতিফলনস্বরূপ এই সকল দেশে ছুটিসহকারে জাতীয়ভাবে দিবসটি পালিত হয়। উন্নত দেশসমূহ এই দিবসে পৃথক ছুটির ব্যবস্থা না করিলেও উহার প্রভাব উপেক্ষা করিতে পারে নাই। তাই ভিন্ন প্রকারে সেই সকল দেশেও দিবসটি পালিত হয়। আন্তর্জাতিকভাবে আজিকে শ্রমমান লইয়া যে আলোচনা হয়, জাতীয় ন্যূনতম মজুরিসহ শ্রমিকের বহু অধিকার আজিকে যে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বহু দেশে কার্যকর হইয়াছে, উহারও পশ্চাতে রহিয়াছে মে দিবসের চেতনা। তবে ইহা সত্য, বাংলাদেশে ঘটা করিয়া দিবসটি পালিত হইলেও মজুরি ও কর্মপরিবেশ প্রশ্নে খামতি সীমাহীন। প্রাতিষ্ঠানিক খাতসমূহে শ্রমিকদের জন্য এক প্রকার আইনি আশ্রয় থাকিলেও বিশাল অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে উহার লেশমাত্র নাই। শেষোক্ত খাতে কোটি কোটি শ্রমিক উপযুক্ত পারিশ্রমিক ও অন্যান্য অধিকার হইতে বঞ্চিত। 

এই বৎসর শ্রমিক দিবস এমন সময়ে উপস্থিত, যখন গণঅভ্যুত্থানের ফসলস্বরূপ দেশে নূতন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছে। সেই সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসাবে শ্রম খাতের সংস্কারেও উদ্যোগী। তাহাদের গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশন ইতোমধ্যে প্রতিবেদনও দাখিল করিয়াছে, যথায় দেশের সাড়ে সাত কোটি শ্রমজীবী মানুষের মৌলিক অধিকার-সংক্রান্ত একগুচ্ছ সুপারিশ রহিয়াছে। প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক, সরকারি-বেসরকারি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি পর্যায়ে নিয়োজিত সকল শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণে ‘জাতীয় ন্যূনতম মজুরি’ ন্যূনতম মানদণ্ডরূপে বিবেচিত হইবে– কমিশনের এই সুপারিশ যুগান্তকারী বলিয়া আমরা মনে করি। উপরন্তু কমিশন ইহাও বলিয়াছে, কোনো খাতের মজুরি কাঠামো নির্ধারণে পরিবারে একক উপার্জনকারী হিসাবে বিবেচনায় লইয়া এমন পরিমাণ নির্ধারণ করিতে হইবে, যাহাতে শ্রমিক তাঁহার পরিবারের প্রয়োজন মিটাইতে পারেন।

বিভিন্ন খাতের শ্রমিকের মজুরি তিন বৎসর অন্তর মূল্যায়ন ও পুনর্নির্ধারণ, মূল্যস্ফীতির ভিত্তিতে বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্প খাতের জন্য আপৎকালীন তহবিল, ট্রেড ইউনিয়ন করিবার শর্ত শিথিল, স্থায়ী কাজের জন্য আউটসোর্সিং নিয়োগ বন্ধ, নারী শ্রমিকের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস এবং স্থায়ী শ্রম কমিশন প্রতিষ্ঠা-সংক্রান্ত সুপারিশসমূহও প্রণিধানযোগ্য। একটা সময় ছিল যখন শ্রমিক আন্দোলন বলিতে কারখানা ভাঙচুর ও সম্পদ ধ্বংস বোঝাইত। পরিণামে নিজের রুটি-রুজি লইয়া শ্রমিকদেরই টানাপোড়েনে পড়িতে হইত। ইহার সমাধান দিয়াছিল ট্রেড ইউনিয়ন প্রথা। দুর্ভাগ্যবশত এই দেশে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার বিগত দশকসমূহে ক্রমশ জটিল রূপ ধারণ করে। উহার সহিত সুস্থ ধারার শ্রমিক আন্দোলনও বিরল হইয়া পড়ে।

আমাদের বিশ্বাস, শ্রম সংস্কার কমিশনের ট্রেড ইউনিয়ন-সংক্রান্ত প্রস্তাবসমূহ আলোর মুখ দেখিলে শ্রমিক-মালিক উভয়েরই স্বার্থ রক্ষা হইবে। সর্বোপরি দেশের বিকাশমান শিল্প খাত হইবে লাভবান। উৎপাদন ব্যবস্থার মূল চালিকা শক্তিরূপে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে উদ্যোক্তার যদ্রূপ অবদান, তদ্রূপ শ্রমিকেরও অবদান ব্যাপক। তাই শ্রমজীবী মানুষের অধিকার নিশ্চিতকরণে আর কোনো অবহেলা নহে। এইবারের মে দিবসে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলে এই অঙ্গীকার গ্রহণ করিবে– ইহাই আমাদের প্রত্যাশা। আমরা সমকালের পক্ষ হইতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল শ্রমজীবী মানুষকে মে দিবসের অভিনন্দন জানাই।

সম্পর্কিত নিবন্ধ