প্রাণ দিয়ে সহযোদ্ধাদের বাঁচান শহীদ ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের
Published: 27th, April 2025 GMT
পশ্চিম পাকিস্তানের হায়দ্রাবাদের কর্মস্থল থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১-এ ছুটিতে ঢাকার বাড়িতে আসেন ৪০ ফিল্ড আর্টলারি রেজিমেন্টের টগবগে তরুণ সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের। ১৯ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম এসে খালাতো বোন মোর্শেদা জুলিয়াকে কোর্ট ম্যারেজ করে আবার ফিরে যান ঢাকায়। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সেনারা নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যার নৃশংস ঘটনায় তরুণ এ সেনা কর্মকর্তার মনে জ্বলে ওঠে ঘৃণা আর প্রতিশোধের আগুন। ২৭ মার্চ ঢাকা থেকে চলে যান চট্টগ্রামে। সেখান থেকে ২ এপ্রিল পার্বত্য চট্টগ্রামের ভারত সীমান্তবর্তী মহকুমা শহর রামগড়ে আসেন।
তেজোদীপ্ত বাংলার বীর সেনানী ক্যাপ্টেন কাদেরের নেতৃত্বে রামগড় হাই স্কুল মাঠে চলতে থাকে যুব প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। রামগড়ের একমাত্র সেনা অফিসার কাদের স্থানীয় ইপিআরের সুবেদার মফিজুল বারী, হাবিলদার আবুল কাশেমসহ কয়েকজন ইনস্ট্রাক্টর এবং স্বল্পসংখ্যক অস্ত্র নিয়ে পরিচালনা করেন গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ। এর মধ্যে মেজর জিয়াউর রহমানও এসে পৌঁছেন রামগড়ে। তিনি এসে চালু করেন মুক্তিফৌজের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
রামগড় আসার পর ক্যাপ্টেন কাদের সর্বপ্রথম অপারেশন পরিচালনা করেন ফেনীর শুভপুর এলাকায়। রণকৌশলের আবশ্যকীয়তায় তিনি পরিকল্পনা নিয়ে ইপিআরের হাবিলদার কাশেমের প্লাটুনসহ মীরেরসরাইর জোরারগঞ্জে স্থাপন করেন প্রতিরক্ষা ঘাঁটি। রাঙামাটি শহরে পাকবাহিনীর বড় সমাবেশের খবর পেয়ে ক্যাপ্টেন কাদের তাঁর গ্রুপ নিয়ে বন্দুক ভাঙ্গা নামক এক দ্বীপের মতো স্থানে অবস্থান নেন। এখানে ২১ এপ্রিল দুই লঞ্চ বোঝাই পাক সেনাদল হঠাৎ আক্রমণ চালায় মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর। ক্যাপ্টেন কাদেরের নেতৃত্বে যুদ্ধ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছাত্র শওকত ও অন্য সদস্যরা শত্রুদের ওপর বৃষ্টির মতো গুলি চালায়। ঘণ্টাব্যাপী চলা এ প্রচণ্ড যুদ্ধে শত্রুপক্ষের বেশ কয়েকজন হতাহত হওয়ার পর তারা পিছু হটে। বন্দুক ভাঙ্গায় দুই দিন অবস্থানের পর মেজর শওকতের নির্দেশ পেয়ে ২৪ এপ্রিল তিনি গ্রুপ নিয়ে রওনা হন মহালছড়ির উদ্দেশে। মহালছড়ি যাওয়ার পথে বুড়িঘাট এলাকায় শত্রুপক্ষের অতর্কিত আক্রমণের শিকার হন ক্যাপ্টেন কাদের এবং তাঁর দুই সহযোদ্ধা হাবিলদার সায়ীদ ও হাবিলদার তাহের। এই তিনজন তিনটি এলএমজি নিয়ে প্রবল আক্রমণ চালান পাকস্তানি বাহিনীর ওপর। এখানেও শত্রুরা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়ে লঞ্চ নিয়ে পালিয়ে যায়। এভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের একের পর এক প্রচণ্ড হামলার মুখে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে স্থল আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে বিমান ও হেলিকপ্টারের সাহায্যে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্ভাব্য অবস্থান ও ঘাঁটির ওপর প্রবল হামলা।
এ অবস্থায় পার্বত্য এলাকায় পূর্ব ট্রেনিংহীন মুক্তিযোদ্ধারা ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়েন। রসদ এবং গোলাবারুদ সংকট দেখা দেয় তাদের। এই প্রতিকূল ও দুর্বল মুহূর্তে ২৭ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে পাকবাহিনীর দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের এক কোম্পানি সৈন্য (১৩৬ জন) এবং একটি মিজো ব্যাটালিয়নকে (১০০০ জন) সঙ্গে নিয়ে আক্রমণ চালায় মহালছড়িতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর। মেজর মীর শওকত এবং চন্দ্রঘোনা পেপার মিলের প্রকৌশলী ইসহাকের নেতৃত্বে ওই সময় আক্রমণ প্রতিহত করা হচ্ছিল। এর মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী হেলিকপ্টারে দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের আরও এক কোম্পানি সৈন্য এখানে নামিয়ে দিয়ে যায়। দুই পক্ষের প্রচণ্ড এ যুদ্ধের মধ্যে বেলা ৩টায় ক্যাপ্টেন কাদেরের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপটি মহালছড়ি এসে পৌঁছে। অসীম সাহস আর সুদক্ষ যুদ্ধ কৌশল গ্রহণ করে তরুণ সেনা অফিসার কাদের সঙ্গীদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন শত্রু মোকাবিলায়। তাদের এ সম্মিলিত কঠিন প্রতিরোধের মুখে মিজো বাহিনী প্রথম অবস্থায় পিছু হটলেও এক পর্যায়ে পাকিস্তানি সেনা এবং তাদের সহযোগী মিজো ও চাকমা মুজাহিদরা মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্য করে বেপরোয়া গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে যায়। ৩-৪ গুণ অধিক সংখ্যক শত্রুপক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় চারপাশ ঘিরে ফেলে। চরম এ বিপজ্জনক অবস্থায় সহযোদ্ধারা পশ্চাৎপসরণের পরামর্শ দেন ক্যাপ্টেন কাদেরকে। কিন্তু অকুতোভয় সহযোদ্ধা ছাত্র শওকত, ফারুক এবং দুই ইপিআর সৈনিককে সঙ্গে নিয়ে তিনটি এলএমজির অবিরাম গুলিবৃষ্টি কোণঠাসা করে ফেলে শত্রুদের। এই চরম মুহূর্তে হঠাৎ শত্রুর অস্ত্রের কয়েকটি গুলি এসে বিঁধে তাঁর ডান বগলের কয়েক ইঞ্চি নিচে এবং পেটের বাম পাশে। গুলিবৃষ্টির মধ্যেই গুরুতর আহত কাদেরকে বহন করে একটু নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসেন শওকত, ফারুক ও ইপিআরের ড্রাইভার আব্বাস।
সেখান থেকে জিপ গাড়িতে রামগড়ে আসার পথে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন এ তরুণ বীরযোদ্ধা। তখনও তাঁর বিয়ের মেহেদির রং হাত থেকে মুছে যায়নি। ওইদিন শেষ বিকেলে সহযোদ্ধা ফারুক, শওকত ও আব্বাস বীর শহীদের মরদেহ নিয়ে আসেন রামগড়ে। পরে রামগড় কেন্দ্রীয় কবরস্থানে পূর্ণ সামরিক ও ধর্মীয় মর্যাদায় তাঁকে দাফন করা হয়।
ক্যাপ্টেন কাদেরের দুঃসাহসিক অবস্থান ও ভূমিকার কারণে মেজর শওকতের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীর কমপক্ষে ৫০০ সদস্য নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ওইদিন রক্ষা পেয়েছিল। ওই ভয়াবহ যুদ্ধে মিজো ব্যাটালিয়নের ৪০০ সৈন্য এবং পাকবাহিনীর কমান্ডো কোম্পানির ৪০ জনের মতো সৈনিক হতাহত হয়। মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ ও গৌরবোজ্জ্বল অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ সালে সরকার ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরকে মরণোত্তর ‘বীরউত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করে।
লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জের টিওরী গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও সাহিত্যিক ড.
নিজাম উদ্দিন লাভলু: সাংবাদিক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ক য প ট ন আফত ব ল ক দ র সহয দ ধ অবস থ ন র শওকত র মগড় র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পের বিমা দাবি নিষ্পত্তির অনুরোধ বিটিএমএর
গত বছরের জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের সময় ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পকারখানার বিমা দাবি নিষ্পত্তি করে ক্ষতিপূরণ দিতে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছে বস্ত্রকলের মালিকদের সংগঠন বিটিএমএ। তাদের অভিযোগ, বিমা কোম্পানিগুলো নানা ধরনের পদ্ধতিগত জটিলতা ও পলিসির শর্তের অপব্যাখ্যা করে বিমা দাবি পরিশোধে বিলম্ব করছে। অনেক ক্ষেত্রে দাঙ্গা, হাঙ্গামা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা–সংক্রান্ত ক্ষতির অজুহাতে বিমা দাবি সরাসরি প্রত্যাখ্যানের ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে, যা বিমাশিল্পের মূলনীতির পরিপন্থী।
আজ বুধবার অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদকে দেওয়া এক চিঠিতে বিমা দাবি পরিশোধের অনুরোধ জানান বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ। তিনি বলেন, ‘গত বছরের জুলাই-আগস্টে দেশব্যাপী সৃষ্ট অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে আমাদের অনেক সদস্যের কারখানা, গুদাম ও অন্যান্য স্থাপনা ব্যাপক ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের শিকার হয়েছে। আকস্মিক এই সহিংসতায় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদনব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে।’
বিটিএমএ সভাপতি বলেন, সব ধরনের অপ্রত্যাশিত ক্ষতি মোকাবিলায় প্রায় প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানই যথাযথ প্রিমিয়াম পরিশোধের মাধ্যমে বিমা কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে অগ্নিসহ বিভিন্ন ঝুঁকির বিপরীতে বিমা পলিসি নিয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত, ঘটনার পর বছর পেরিয়ে গেলেও অধিকাংশ বিমা দাবি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।
চিঠিতে বিটিএমএ সভাপতি জানান, গত ৩ মার্চ সাধারণ বীমা করপোরেশনের প্রধান কার্যালয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পকারখানার উত্থাপিত বিমা দাবি নিয়ে সভা হয়। এতে বিমা দাবি নিয়ে বিভিন্ন বিমাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা বিভিন্নভাবে ক্ষতির বিবরণ ও ব্যাখ্যা দেন। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ঘটনাগুলো গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে হওয়ায় তা স্ট্যান্ডার্ড ফায়ার পলিসি (এসএফপি) বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অল রিস্ক (আইএআর) পলিসির আওতায় কোনো বিমা দাবি পরিশোধযোগ্য হবে না। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পকারখানার মালিকেরা চরম হতাশায় ভুগছেন।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) থেকে সব নন-লাইফ বিমা কোম্পানিকে সুস্পষ্ট প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে গত বছরের জুলাই-আগস্টের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিমা দাবি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে নিষ্পত্তির জন্য নির্দেশনা দেওয়ার অনুরোধ করেছেন বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ। তিনি বলেন, বিমা আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে দাবি নিষ্পত্তির বিধানটির কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করা দরকার।