২৩৮ বছরে কী পেল আর কী পেল না ময়মনসিংহ জেলা
Published: 1st, May 2025 GMT
‘হাওর জঙ্গল মইষের শিং—এই তিনে ময়মনসিং’ প্রবাদ-প্রবচনে এভাবেই পরিচয় করানো হতো ময়মনসিংহ জেলাকে। ১৭৮৭ সালের ১ মে প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন এই জেলা ২৩৮ বছর পূর্ণ করল আজ বৃহস্পতিবার। দীর্ঘ আন্দোলন–সংগ্রামের পর ২০১৫ সালে চারটি জেলা নিয়ে বিভাগ এবং ২০১৮ সালে ৩৩টি ওয়ার্ড নিয়ে সিটি করপোরেশন পেয়েছে ময়মনসিংহ। তবে অপ্রাপ্তিও কম নয়।
ময়মনসিংহ জেলায় ৩৩টি ওয়ার্ড নিয়ে সিটি করপোরেশন আছে। জেলাটি ১৩টি উপজেলা, ১৪টি থানা, ১০টি পৌরসভা, ১৪৭টি ইউনিয়ন, ২১০১টি মৌজা, ২৭০৯টি গ্রাম ও ১১টি সংসদীয় আসন নিয়ে গঠিত। জেলার জনসংখ্যা প্রায় ৫৯ লাখ।
সরকারিভাবে ময়মনসিংহ জেলাকে ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে ‘শিল্প-সংস্কৃতির’ নগরী হিসেবে। কিন্তু শিল্প-সংস্কৃতির এ শহরকে এখন আলাদাভাবে চেনার কোনো উপায় নেই। সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রগুলো দিন দিন সংকুচিত হয়েছে। সংস্কৃতিপল্লির দাবি উঠলেও সংস্কৃতির শহরে তা হয়নি। এ প্রসঙ্গে কবি ও নাট্যকার ফরিদ আহমদ দুলাল বলেন, ‘শিল্প-সংস্কৃতি’ নামের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যাওয়ায় আর সংস্কৃতিচর্চার প্রয়োজন নেই বলেই হয়তো কোনো অগ্রগতি নেই।
ময়মনসিংহকে শিক্ষার শহর বলা হলেও আছে নানা সংকট। এখানে আছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও ত্রিশালে অবস্থিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। জেলায় কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়নি। স্থানীয়রা ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজকে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং আনন্দ মোহন কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবি জানিয়ে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে।
আনন্দ মোহন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মো.
নাগরিক সংগঠন ময়মনসিংহ নাগরিক আন্দোলন বেশ কিছু দাবি জানিয়ে আসছে। তাদের দাবির মধ্যে আছে এক হাজার শয্যার ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে দুই হাজার শয্যায় উন্নীত করা ও মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, আলাদা সদর হাসপাতাল স্থাপন, ময়মনসিংহ-ঢাকা রুটে ময়মনসিংহ থেকে দুই জোড়া বিশেষ ট্রেন চালু, বিভাগীয় শহর হিসেবে ময়মনসিংহে একটি বিমানবন্দর স্থাপন, কৃষিপ্রধান অঞ্চল হওয়ায় কোল্ডস্টোরেজ স্থাপন, অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন, ব্রহ্মপুত্র নদে প্রাণ ফেরানো।
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক নূরুল আমিন কালাম বলেন, ‘২৩৮ বছরের পুরোনো এ জেলায় আমাদের আন্দোলনের ফসল হিসেবে বিভাগ ও সিটি করপোরেশন পেয়েছি। কিন্তু আমরা দেশের অন্য বিভাগের তুলনায় অগ্রসর হতে পারিনি, বিভিন্ন খাতে পিছিয়ে আছি। এর মূল কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করলেও মানুষের জীবনমান উন্নয়নে তাঁরা চিন্তা করেননি।’
বিভাগীয় শহর কত দূর২০১৫ সালে ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর ও নেত্রকোনা জেলা নিয়ে ময়মনসিংহকে দেশের অষ্টম বিভাগ ঘোষণা করা হয়। এরপর বিভাগীয় শহর স্থাপনের জন্য ময়মনসিংহ শহর থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপারে ‘ময়মনসিংহ বিভাগীয় সদর দপ্তর ও নতুন বিভাগীয় শহর প্রতিষ্ঠার জন্য ভূমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের’ প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু হয়। শুরুতে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার একর জমিতে বিভাগীয় শহর স্থাপনের প্রস্তাব তৈরি হলেও স্থানীয়দের প্রতিবাদের মুখে সেটি অনুমোদন হয়নি। পরে চরাঞ্চলের গোবিন্দপুর, চর ঈশ্বরদিয়া, পাড়ালক্ষ্মীর আলগী ও চর সেহরা মৌজায় ২০২২ সালে প্রায় ৯৪৫ একর জমিতে বিভাগীয় শহর স্থাপনের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। নতুন শহরে বিভাগীয় প্রশাসনের অফিসসহ বিভিন্ন দপ্তর, আবাসিক এলাকা, সড়ক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান, বাঁধ, জাদুঘর, নভোথিয়েটার, কৃত্রিম জলাশয়, আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র ও মানসম্মত হোটেল থাকবে। প্রকল্প অনুমোদনের পর জমি অধিগ্রহণ, উচ্ছেদ হওয়া ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া যায়। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এই প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এক বছর সময় বাড়ানো হয়েছে।
বিভাগীয় শহর বাস্তবায়নে কত সময় লাগবে, তা বলা যাচ্ছে না। শুরুতে জটিলতা সৃষ্টি না হলেও এত দিন অনেক দূর এগিয়ে যেত বিভাগীয় শহর।তাহমিনা আক্তার, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব), ময়মনসিংহবিভাগীয় শহর স্থাপন প্রকল্পের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ময়মনসিংহের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) তাহমিনা আক্তার বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়াতে হবে। এ কাজ শেষ হলে পরে অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প শুরু হবে। তবে বিভাগীয় শহর বাস্তবায়নে কত সময় লাগবে, তা বলা যাচ্ছে না। শুরুতে জটিলতা সৃষ্টি না হলেও এত দিন অনেক দূর এগিয়ে যেত বিভাগীয় শহর।
অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্বপ্ন শেষময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের চর রামমোহন মৌজায় প্রায় ২০০ একর জমিতে ২০১৮ সালে ২ নভেম্বর ময়মনসিংহ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল। তবে চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে অনুমোদন পাওয়া ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের সঙ্গে ময়মনসিংহ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কার্যক্রমও বাতিল করা হয়েছে।
ক্রীড়াঙ্গনে নতুন আশাপ্রাচীন এই জেলায় নেই মানসম্মত কোনো স্টেডিয়াম। দেশের ক্রীড়ার মান উন্নয়ন, উচ্চতর ও আধুনিক প্রশিক্ষণের জন্য ময়মনসিংহের ত্রিশালে একটি মাল্টিস্পোর্টস অলিম্পিক কমপ্লেক্স তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জেলার ত্রিশালে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৭৩ একর জমিতে হবে এটি। এতে ক্রীড়াক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন ক্রীড়াবিদেরা। স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত ক্রীড়াবিদ ফিরোজা খাতুন বলেন, এ জেলায় মানসম্মত স্টেডিয়াম না থাকায় এবং প্রশিক্ষণের সুযোগ কম পাওয়ায় দক্ষ ক্রীড়াবিদ তৈরি হচ্ছে না। কিন্তু এখন নতুন আশা দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রকল প র জন য থ কল ও সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ওসির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ছেলের মুক্তি চেয়ে কাঁদলেন মা
জমিসংক্রান্ত বিরোধে ময়মনসিংহ কোতোয়ালী মডেল থানায় সালিশ ডেকে আল-আমিন (২৮) নামে এক যুবককে আটকের পর নগরীর কেওয়াটখালীতে গ্রেপ্তার দেখিয়ে রাজনৈতিক মামলায় জেলে পাঠিয়েছেন থানার ভারপ্রাপ্ত (ওসি) কর্মকর্তা মুহাম্মদ শিবিরুল ইসলাম। সংবাদ সম্মেলনে এমন অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীর মা আনোয়ারা বেগম।
মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) দুপুরে ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে প্রতিকার চেয়ে অঝোরে কাঁদেন তিনি।
আল-আমিন নগরীর বলাশপুর এলাকার মৃত নুরুল ইসলাম ও আনোয়ারা বেগম দম্পতির সন্তান। ২০২১ সাল থেকে জমি নিয়ে আনোয়ারা বেগম ও প্রকৌশলী মনিরুজ্জামানের দ্বন্দ্ব চলে আসছে। মনিরুজ্জামান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগের উপ-প্রধান প্রকৌশলী। সেই দ্বন্দ্বের জের ধরে ঘটনাটি ঘটেছে বলে আনোয়ারা বেগমের অভিযোগ।
আনোয়ারা বেগম সংবাদ সম্মেলনে জানান, ২০২১ সালে বলাশপুরে স্বামীর পেনশনের টাকায় তিনি জমি কেনেন। এর আগে ২০০৮ সালে একই দাগে ৪ শতাংশ জমি কেনার দাবি করে ২০২২ সালে জোরপূর্বক জমিতে প্রাচীর দেন মনিরুজ্জামান। এ নিয়ে স্থানীয়ভাবে সালিশ হলেও সুরাহা হয়নি। ৫ আগস্টের পর জমিতে বাড়ি করার উদ্যোগ নিলে বাধা দেন মনিরুজ্জামান।
আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘‘আমার ছেলে আল-আমিনসহ আরও কয়েকজনকে অভিযুক্ত করে মনিরুজ্জামান কোতোয়ালি মডেল থানাসহ প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে চাঁদাবাজির অভিযোগ করেন। বিষয়টি সমাধানের লক্ষ্যে কোতোয়ালি থানার ওসি শিবিরুল ইসলাম থানায় উভয় পক্ষকে ডাকেন।’’
‘‘শনিবার (২৬ জুলাই) রাত আটটায় থানার মধ্যেই দরবার শুরু হয়। চলে রাত ১২টা পর্যন্ত। দরবারে যখন জমির কাগজপত্র আমাদেরগুলো ঠিক প্রমাণিত হয় তখন ওসি আল-আমিনকে তার রুমে নিয়ে পিটিয়ে হাড়গোড় ভেঙে ফেলার হুমকি দেন। পিছন পিছন আমি গিয়ে প্রতিবাদ করলে আমার সাথেও খারাপ ব্যবহার করেন তিনি। এরপর আল-আমিনকে লকাপে ঢুকিয়ে সাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করার জন্য চাপ দেন। ছেলে রাজি না হওয়ায় সাজানো রাজনৈতিক মামলায় তাকে জেল পাঠানো হয়েছে।’’ বলে অভিযোগ করেন আনোয়ারা বেগম।
আনোয়ারা বেগম এ সময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘‘স্বামী মারা যাওয়ার পর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সন্তানদের মানুষ করেছি। আল-আমিন ক্রোকারিজের ব্যবসা করে পুরো সংসার চালায়। রাজনীতির সাথে কোনোভাবেই সে জড়িত নয়। অথচ ওসি তাকে রাজনৈতিক মামলায় জেলে ঢুকিয়েছে। মনিরুজ্জামানের টাকা ও ক্ষমতার কাছে আমি হেরে গেছি। এই দেশে কোনো বিচার নাই। আমার ছেলে যদি মুক্তি না পায় তাহলে অদূর ভবিষ্যতে সে বিপথে গেলে পুলিশ, সমাজ এবং রাষ্ট্র এ জন্য দায়ী থাকবে।’’
‘‘ওসি সালিশের এক পর্যায়ে প্রভাবিত হয়ে আল-আমিনকে সালিশ থেকে আটক করে রাজনৈতিক মামলায় জেলে ঢুকিয়েছে। এ সময় হাতে-পায়ে ধরেও লাভ হয়নি,’’ উল্লেখ করে আনোয়ারা বেগম কড়জোরে ঘটনার সঠিক বিচারের পাশাপাশি আল-আমিনের মুক্তি দাবি করেন।
এ দিকে আল-আমিনের বিরুদ্ধে মামলার বিবরণে জানা যায়, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রাত ১টা ৩৫মিনিটে পুলিশের টহল টিম আকুয়া ভাঙ্গাপুল এলাকায় অবস্থানকালে পুলিশ গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারে, সদরের উত্তর দাপুনিয়ার সরকারি পুকুরপাড়ে একদল সন্ত্রাসী রাস্তা বন্ধ করে গাড়ি ভাংচুর ও দাঙ্গাহাঙ্গামা করছে। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে ৫টি মশাল, ২০টি লাঠি, ৩০টি ইটের টুকরো, ২৫টি কাচের টুকরো জব্দ করে। এ ঘটনার পরদিন পুলিশ কোতোয়ালী মডেল থানায় অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলা দায়ের করে। ওই মামলায় আল-আমিনকে সন্দিগ্ধ আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ।
এ প্রসঙ্গে ওসি মুহাম্মদ শিবিরুল ইসলাম বলেন, ‘‘আল-আমিন যুবলীগ করে। কারণ যুবলীগের নেতাকর্মীদের সাথে তার ছবি রয়েছে।’’
আল-আমিনকে থানায় সালিশ ডেকে পরে আটক করা হয়েছে কিন্তু মামলায় দেখানো হয়েছে তাকে কেওয়াটখালী থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘‘এ
বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ভালো বলতে পারবে।’’
জেলা পুলিশ সুপার কাজী আখতার উল আলম বলেন, ‘‘আল-আমিনের মা ছেলের মুক্তির দাবিতে ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছে। আমি শুনেছি। তার অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’
মিলন//