জুলাই আন্দোলনে শহীদের সন্তানদের ঠাঁই হলো এতিমখানায়!
Published: 21st, May 2025 GMT
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম আরমান মোল্লাকে হারিয়ে অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন তার পরিবার। ভরণ-পোষণ দিতে না পেরে তার দুই সন্তানের ঠাঁই মিলেছে এতিমখানায়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে রাজপথের শহীদ আরমান মোল্লা ওরফে নাহিদের বিধবা স্ত্রী সালমা বেগম জানান, আরমান মোল্লা ২০২৪ সালের ২১ জুলাই নরসিংদী শিলমান্দী ইউনিয়নের সামনে আন্দোলনরত অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান।
সালমা বেগম বলেন, “আমার জামাই ঝালমুড়ি বেচত। আমার ঘরে টাকা-পয়সা কম ছিল ঠিক। কিন্তু সুখের কমতি ছিল না। একটা গুলি আমাগো জীবন তছনছ কইরা দিল। আমার এখন আর চলার মতোন অবস্থা নাই। এল্লিগা, কোনো উপায় না দেইখা বড় মাইয়া আর একমাত্র পোলাডারে এতিমখানায় দিয়া সাইরা আমি এহন বুকে পাথর বাইন্ধা মরার মতোন ঘরে পইরা রইছি।’’
আরমান মোল্লা ছিলেন নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার কলাগাছিয়া নয়াপাড়ার এলাকার বাসিন্দা। তার মৃত্যুতে স্ত্রী সালমা বেগম তিনটি নাবালক অবুঝ সন্তান নিয়ে খুবই অসহায় হয়ে পড়েছেন।
ঘটনার দিন সকালের মধুর স্মৃতি স্মরণ করে সালমা বলেন, “সকালে আমি উইঠা রুটি বানাইয়া সাইরা ভাজি রানছিলাম। ওয় (আরমান মোল্লা) রুটি খাইয়া কয়, আজকার ভাজিডা খুব মজা অইছে। এমনেই বানাইয়ো। এরপর আমারে কয়, তুমি রান্নাডা সাইরালাও। আমি কাপড় ধুইয়া দিতাছি।”
তিনি বলেন, “আমার কোমরে ব্যাথা হওয়ার পর থিকা হেয় আমারে কোনো উডাইন্না কাম (ভারী কিছু ওঠানোর কাজ) করতে দিত না। আমার আর পোলাপানের সব কাপর-চোপর হেয়ই ধুইয়া দিত। বাচ্চাগো আর আমার অনেক আদর-যত্ন করত। হের মতোন ভালা মানুষ দুনিয়ায় কমই আছিল।”
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, “আন্দোলনে যাইব দেইখা আমারে কইল, আজকা ভাল্লাগতাছে না। আজকা মুড়ি বেচত যাইত না। এরমইধ্যে হের এক বন্ধু ডাক দিলে হেয় বাইরে যাওয়ার কথা কয়। শরীর ভালা না দেইখা আমি যাইতে বারবার কইরা না না করছি। কিন্তু হেয় আমার কোনো কথা শুনে নাই। তবে মুখে খালি কইছিল, একটু ঘুরে আসি।”
তিনি বলেন, “আমি পরে হের বন্ধুরথে শুনছি, হেয় আন্দোলনে যাওনের লাগিই বাইর অইছিল।”
সালমা বেগম ভয়াবহ সেই দুপুরের কথা স্মরণ করে বলেন, “দুপুরের খাওনের সময় গেলেও ওয় বাইত ঢুকে না। পরে আমি ফোন দিছি, ফোন ধরছে হের বন্ধু। ওই ভাইয়ে কয়, ভাবি নাহিদের (আরমান মোল্লার ডাকনাম) গুলি লাগছে। আপনে হাসপাতলে আসেন।”
সালমা বলেন, “কথা শুইনা ছোড মাইয়ারে লইয়া নারসিংদী সদর হাসপাতালে গিয়া দেখি, হের মুখের উপ্রে কাপড় দিয়া ঢাইকা রাখছে! আমার জামাই হাসপাতালে আনার আগেই দম ফালায় দিছে।”
নরসিংদীতে প্রথম জানাজা দিয়ে আরমান মোল্লাকে রাতে আড়াইহাজার কলাগাছিয়া নয়াপাড়া তার বাবার বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে নোয়াপাড়ায় স্থানীয় কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
আরমান মোল্লার তিন ছেলে-মেয়ে। বড় মেয়ে মাহি (১০) ও ছেলে রাফি (৭) কিছু দিন থেকে একটি এতিমখানায় থাকে। অর্থাভাবে তাদের এতিমখানায় দিতে বাধ্য হয়েছেন মা সালমা বেগম। ছোট মেয়ে আফরা মনির বয়স এখন ৩ চলছে। আফরা মনি মাত্র দুই বছর বয়সেই তার বাবাকে হারায়। কিন্তু বাবার স্মৃতি তার চোখে এখনও সজীব, সতেজ। এমনকি মাঝে মাঝে আফরা তার বাবাকে স্বপ্নে দেখে বলেও জানান সালমা।
সালমা বেগম বলেন, “সবাই ভুইলা গেলেও আমার ছোট মাইয়াডা তার বাপেরে ভুলতে পারে নাই। ঘুমের ভিত্রেও বাপরে ডাকে! বাপেরে স্বপ্ন দেইখা বাস্তবে দেখছে মনে কইরা বইলা ওঠে, আব্বু জামা ময়লা, জামা খুলো। আমার বুকডা ফাইট্টা যাইতে চায়।”
আরমান ছিলেন পাঁচ সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার মৃত্যুর পর পরিবারে চরম সংকট পড়েছে। তার পুরো পরিবার এখন তার অসুস্থ শ্বশুরের ওপর নির্ভরশীল। তিন সন্তান নিয়ে সালমা তার বাবা মীর আলীর সাথে বসবাস করছিলেন। সংসারের খরচ মেটাতে না পেরে বড় মেয়ে ও ছেলেকে এতিমখানায় দিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।
তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “আব্বার পক্ষে আমাগো সবার খরচ দেওয়া সম্ভব নাহ্। এল্লিগা মাইয়া আর পোলাডারে এতিমখানায় দিয়া দিছি।
‘কোমরের লিগা আমি ঘরের কাইজ-কাম বেশি করতে পারি না। আমার কোমরের ব্যাথার জন্য মাসে ৮০০ টাকার অষুধ লাগে। পেটে ঠিকমতো ভাতই জুটে না, অষুধ খামু কই থিকা। কোমরের ব্যাথায় আমি মাঝেমধ্যে বিছানা থেইকা উঠতে পারি না। আমার স্বামী ছাড়া আমাদের আর কেউ নেই।”
সরকার থেকে এখনও কোনো সহায়তা পাননি জানিয়ে সালমা বলেন, “সরকার থেকে লাখ লাখ টাকা দিছে শুনছি। কিন্তু আমি কোনো টাকা পাইনি। টাকার চেক পাইছে আমার শ্বশুর বাড়ির মানুষরা। তারা আমাকে এক টাকাও দিবে না বইলা জানায় দিছে।”
অভিমানভরা কণ্ঠে সালমা বলেন, “আমার স্বামী বেঁচে থাকতে তাগো লগে সম্পর্ক ভালাই আছিল। এহন আমার স্বামীও নাই, তারাও আমার উপ্রে জুলুম করা শুরু করছে। আমার পোলাপানের মুখের দিকেও চাইল না হেরা।”
সালমা বলেন, “আমি সরকারের কাছে, সকলের কাছে সাহায্য চাই। আমারে একটু সাহায্য করেন, যেন আমি আমার স্বামী শহীদ আরমান মোল্লার রেখে যাওয়া পোলাপান গুলারে আমার কাছে রাইখা মানুষ করতে পারি। শহীদের সম্মান রাখতে পারি।”
নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক জাহিদুল ইসলাম সালমা ও তার সন্তানদের সহায়তার আশ্বাস দিয়ে বলেন, “জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের বীর সন্তানরা আমাদের জাতীয় ইতিহাসের গৌরব। তাদের সাহসিকতা, আত্মত্যাগ ও অদম্য চেতনা আমাদের জাতি পুনর্গঠনের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। তাদের পরিবারের সদস্যরা আর্থিক সহায়তা থেকে বঞ্চিত হবে না।”
ঢাকা/অনিক/এস
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর আরম ন ম ল ল আম র স ব ম র পর ব র আম র ক র উপ র
এছাড়াও পড়ুন:
ফতুল্লায় নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের নিচে অবৈধ পাকিংয়ে তীব্র যানজট, জনদুর্ভোগ চরমে
বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো যানজট। এ যানজটের কারণে মাত্র ৫ মিনিটের রাস্তা পেরুতে সময় লেগে যায় ঘন্টার পর ঘন্টা। ফলে প্রতিনিয়ত চরম বিপাকে পড়তে হচ্ছে নারায়ণগঞ্জবাসীকে।
নারায়ণগঞ্জ ট্রাফিক বিভাগ কিংবা সিটি কর্পোরেশন এ যানজট থেকে জেলাবাসীকে পরিত্রাণ দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে দিন যতই বড়ছে ততই বাড়ছে নারায়ণগঞ্জবাসীর দুর্ভোগ।
নারায়ণগঞ্জে এমন কোন সড়ক নাই সেই সড়কে যানজট নাই। মূল সড়ক থেকে শুরু করে অলি-গলি সব জায়গায়ই যানজট আর যানজট। তবে এ যানজটের পেছনে মূল সড়কের যানজটকেই দায়ি করছেন অনেকে।
তারা বলছেন, মূল সড়ক যদি যানজট মুক্ত থাকতো তাহলে এর আশেপাশের সড়কগুলো যানজটের সুষ্টি হতো না। মূল সড়কে তীব্র যানজটের কারণেই এর প্রভাব পড়ছে অন্য সড়কগুলোতেও।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বর্তমানে শহরের চাইতে চাষাঢ়া-পঞ্চবটি সড়কে যানজট ভয়াবহ আকার ধারণে করেছে। এ সড়ক দিয়ে চলাচলের কথা শুনলেই মানুষ আতকে উঠে। কারণ, যানজটের মাত্র পনেরো মিনিটের রাস্তা পাড় হতে সময় লাগে ঘন্টার পর ঘন্টা।
এ রাস্তায় এ্যাম্বুলেন্স ও ফায়ার সার্ভিসের গাড়ীকেও যানজটে আটতে থাকতে দেখা যায় ঘন্টার পর ঘন্টা। একবার যানজটে আটকা পড়লেই দিন শেষ। কখন বাড়ী কিংবা অফিসে যাবেন তার কোন ঠিক নেই।
অনুসন্ধানে জানাগেছে, এ যানজটের প্রধান কারণ হচ্ছে পঞ্চবটি-মুক্তারপুর ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ। ফ্লাইওভারের কর্মযজ্ঞের ফলে যানবাহনগুলোকে একটু ধীর গতিতে যেতে হয়। ফলে যানজটের সৃষ্টি হয়।
তবে এ যানজটের আরও একটি বড় কারণ চোঁখে পড়ে, আর তা হলো পঞ্চবটি এলাকায় ফ্লাইওভারের নিচে এবং চাষাঢ়া-পঞ্চবটি সড়কের দু’পাশে ট্রাক ও কভার্ডভ্যানগুলো অবৈধভাবে পাকিং করে রাখা।
এসব যানবাহনগুলো সড়কের দু’পাশে পার্কিং করে রাখার কারণে মূল সড়ক অনেকটাই সরো হয়ে যায়। ফলে এ সড়ক দিয়ে অন্যসব যানবাহনগুলো ঠিকমত চলাচল করতে পারে না। ফলে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।
অথচ, পঞ্চবটির খুব কাছেই রয়েছে ট্রাক ও কভার্ডভ্যান স্ট্যান্ড। যানবাহনের চালকরা ওই স্ট্যান্ডে গাড়ী না রেখে সড়কের পাশে অবৈধভাবে বাঁকাত্যাঁড়া গাড়ীগুলো রাখছেন। এর ফলে যে, ওই সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে এবং যানজটের কবলে পড়ে মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে, এ বিষয়ে যেন তাদের কোন মাথা ব্যথা নেই।
তাদের ভাব-নমুনা দেখা মনে হয় যে, তারাই যেন এ সড়কটির মূল মালিক। না পুলিশে তাদের কিছু বলে, না তারা জনগণের কোন কথা শোনে। তারা তাদের ইচ্ছেমত গাড়ীগুলো রেখে যানজটের সৃষ্টি করছেন।
চাষাঢ়া-পঞ্চবটি সড়কে চলাচল করা ভুক্তভোগী পথচারিরা বলছেন, এ সড়ক দিয়ে যাতায়াত করাটা বর্তমানে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এত ভয়াবহ যানজট আমরা কখনোই চোঁখে দেখিনি। পঞ্চবটি ফ্লাইওভারের নিচে যেভাবে ট্রাক-কভার্ডভ্যানগুলো রাখা হয় পুরো সড়কটা তারা কিনে নিয়েছে। পুলিশও কিছু বলে না।
এছাড়া চাষাঢ়া থকে পঞ্চবটি পর্যন্ত পুরো সড়কে দু’পাশেই তারা গাড়ীগুলো রাখছেন। রাস্তাটি পাশে এমনিতেই জায়গা কম, আবার যদি তারা এভাবে গাড়ী রাখেন তাহলে যানজটের সৃষ্টিতো হবেই। এ বিষয়ে পুলিশ প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের সচেতন মহল বলেন, আসলে নিতাইগঞ্জ এলাকা থেকে ট্রাক স্ট্যান্ডটি সরিয়ে নেয়ার জন্য সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র আইভী একটি উদ্যোগ গ্রহণ করে। তিনি শহরে শৃঙ্খলা ফেরাতে পঞ্চবটি এলাকাতে সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নে একটি ট্রাক স্ট্যান্ড গড়ে তোলেন এবং সেখানে এ স্ট্যান্ডকে স্থানান্তর করেন। কিন্তু কোন লাভ হয়নি।
এখন তারা কিছু গাড়ী ওই স্ট্যান্ডে রাখে বাকি গাড়ীগুলো সড়ক দখল করে এলোপাথারিভাবে রাখে। এতে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হলেও যেন কারো কোন কিছু বলার নেই। কারণ, এ সমস্যা নিয়ে বহুবার ডিসি-এসপির সাথে বসা হয়েছে, আলোচনা হয়েছে কিন্তু সুরাহা হয় নাই।
তবে, ৫ আগস্টে দেশে একটি বড় পরিবর্তনের পর আশা করছিলাম এবার হয়তো এর একটা সুরাহা হবে। কিন্তু না। সড়ক দখল করে রাখা ট্রাক-কভার্ডভ্যানগুলো বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত তেমন কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে মানুষকে বাধ্য হয়েই যানজটের মত দুর্ভোগ দুর্দশাময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে পথ চলতে হচ্ছে।
তারা বলেন, আসলে দেশে শান্তি শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য সেদিন ছাত্র-জনতা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে এতবড় একটা পরিবর্তন নিয়ে এসেছিলো। কিন্তু দেশের মানুষ যদি সেই শান্তি শৃঙ্খলা ভোগই করতে না পারে, তাহলে এত প্রাণ দিয়ে কি লাভ হলো?
আমরা জানিন না, প্রশাসন আসলে কাদেরকে খুশি করাতে চাচ্ছেন? মুষ্টিম কিছু চালকদের জন্য হাজার হাজার মানুষের এ কষ্ট কোন ভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আমরা প্রশাসনের কাছে দাবি করবো, তারা যেন খুব শীঘ্রই এ সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেয়। নারায়ণগঞ্জবাসীকে যেন কিছুটা স্বস্তি দেয়।
এ বিষয়ে টিআই করিম বলেন, ৫ আগস্টের পর নারায়ণগঞ্জে যানজটের যে ভয়াবহতা সৃষ্টি হয়েছিলো বর্তমানে তা কমে আসছে। আশাকরছি, আগামীতে পরিস্থিতি আরও ভালো হবে। পঞ্চবটি সড়কে ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। এজন্য এ রুটে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে।
এমতাবস্তায় যদি কোন চালক রাস্তা দখল করে অবৈধভাবে গাড়ী পার্কিং করে তাহলে তার বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেবো।