নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম আরমান মোল্লাকে হারিয়ে অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন তার পরিবার। ভরণ-পোষণ দিতে না পেরে তার দুই সন্তানের ঠাঁই মিলেছে এতিমখানায়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে রাজপথের শহীদ আরমান মোল্লা ওরফে নাহিদের বিধবা স্ত্রী সালমা বেগম জানান, আরমান মোল্লা ২০২৪ সালের ২১ জুলাই নরসিংদী শিলমান্দী ইউনিয়নের সামনে আন্দোলনরত অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান।

সালমা বেগম বলেন, “আমার জামাই ঝালমুড়ি বেচত। আমার ঘরে টাকা-পয়সা কম ছিল ঠিক। কিন্তু সুখের কমতি ছিল না। একটা গুলি আমাগো জীবন তছনছ কইরা দিল। আমার এখন আর চলার মতোন অবস্থা নাই। এল্লিগা, কোনো উপায় না দেইখা বড় মাইয়া আর একমাত্র পোলাডারে এতিমখানায় দিয়া সাইরা আমি এহন বুকে পাথর বাইন্ধা মরার মতোন ঘরে পইরা রইছি।’’

আরমান মোল্লা ছিলেন নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার কলাগাছিয়া নয়াপাড়ার এলাকার বাসিন্দা। তার মৃত্যুতে স্ত্রী সালমা বেগম তিনটি নাবালক অবুঝ সন্তান নিয়ে খুবই অসহায় হয়ে পড়েছেন।

ঘটনার দিন সকালের মধুর স্মৃতি স্মরণ করে সালমা বলেন, “সকালে আমি উইঠা রুটি বানাইয়া সাইরা ভাজি রানছিলাম। ওয় (আরমান মোল্লা) রুটি খাইয়া কয়, আজকার ভাজিডা খুব মজা অইছে। এমনেই বানাইয়ো। এরপর আমারে কয়, তুমি রান্নাডা সাইরালাও। আমি কাপড় ধুইয়া দিতাছি।”

তিনি বলেন, “আমার কোমরে ব্যাথা হওয়ার পর থিকা হেয় আমারে কোনো উডাইন্না কাম (ভারী কিছু ওঠানোর কাজ) করতে দিত না। আমার আর পোলাপানের সব কাপর-চোপর হেয়ই ধুইয়া দিত। বাচ্চাগো আর আমার অনেক আদর-যত্ন করত। হের মতোন ভালা মানুষ দুনিয়ায় কমই আছিল।”

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, “আন্দোলনে যাইব দেইখা আমারে কইল, আজকা ভাল্লাগতাছে না। আজকা মুড়ি বেচত যাইত না। এরমইধ্যে হের এক বন্ধু ডাক দিলে হেয় বাইরে যাওয়ার কথা কয়। শরীর ভালা না দেইখা আমি যাইতে বারবার কইরা না না করছি। কিন্তু হেয় আমার কোনো কথা শুনে নাই। তবে মুখে খালি কইছিল, একটু ঘুরে আসি।”

তিনি বলেন, “আমি পরে হের বন্ধুরথে শুনছি, হেয় আন্দোলনে যাওনের লাগিই বাইর অইছিল।”

সালমা বেগম ভয়াবহ সেই দুপুরের কথা স্মরণ করে বলেন, “দুপুরের খাওনের সময় গেলেও ওয় বাইত ঢুকে না। পরে আমি ফোন দিছি, ফোন ধরছে হের বন্ধু। ওই ভাইয়ে কয়, ভাবি নাহিদের (আরমান মোল্লার ডাকনাম) গুলি লাগছে। আপনে হাসপাতলে আসেন।”

সালমা বলেন, “কথা শুইনা ছোড মাইয়ারে লইয়া নারসিংদী সদর হাসপাতালে গিয়া দেখি, হের মুখের উপ্রে কাপড় দিয়া ঢাইকা রাখছে! আমার জামাই হাসপাতালে আনার আগেই দম ফালায় দিছে।”

নরসিংদীতে প্রথম জানাজা দিয়ে আরমান মোল্লাকে রাতে আড়াইহাজার কলাগাছিয়া নয়াপাড়া তার বাবার বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে নোয়াপাড়ায় স্থানীয় কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

আরমান মোল্লার তিন ছেলে-মেয়ে। বড় মেয়ে মাহি (১০) ও ছেলে রাফি (৭) কিছু দিন থেকে একটি এতিমখানায় থাকে। অর্থাভাবে তাদের এতিমখানায় দিতে বাধ্য হয়েছেন মা সালমা বেগম। ছোট মেয়ে আফরা মনির বয়স এখন ৩ চলছে। আফরা মনি মাত্র দুই বছর বয়সেই তার বাবাকে হারায়। কিন্তু বাবার স্মৃতি তার চোখে এখনও সজীব, সতেজ। এমনকি মাঝে মাঝে আফরা তার বাবাকে স্বপ্নে দেখে বলেও জানান সালমা।

সালমা বেগম বলেন, “সবাই ভুইলা গেলেও আমার ছোট মাইয়াডা তার বাপেরে ভুলতে পারে নাই। ঘুমের ভিত্রেও বাপরে ডাকে! বাপেরে স্বপ্ন দেইখা বাস্তবে দেখছে মনে কইরা বইলা ওঠে, আব্বু জামা ময়লা, জামা খুলো। আমার বুকডা ফাইট্টা যাইতে চায়।”

আরমান ছিলেন পাঁচ সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার মৃত্যুর পর পরিবারে চরম সংকট পড়েছে। তার পুরো পরিবার এখন তার অসুস্থ শ্বশুরের ওপর নির্ভরশীল। তিন সন্তান নিয়ে সালমা তার বাবা মীর আলীর সাথে বসবাস করছিলেন। সংসারের খরচ মেটাতে না পেরে বড় মেয়ে ও ছেলেকে এতিমখানায় দিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।

তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “আব্বার পক্ষে আমাগো সবার খরচ দেওয়া সম্ভব নাহ্। এল্লিগা মাইয়া আর পোলাডারে এতিমখানায় দিয়া দিছি।

‘কোমরের লিগা আমি ঘরের কাইজ-কাম বেশি করতে পারি না। আমার কোমরের ব্যাথার জন্য মাসে ৮০০ টাকার অষুধ লাগে। পেটে ঠিকমতো ভাতই জুটে না, অষুধ খামু কই থিকা। কোমরের ব্যাথায় আমি মাঝেমধ্যে বিছানা থেইকা উঠতে পারি না। আমার স্বামী ছাড়া আমাদের আর কেউ নেই।”

সরকার থেকে এখনও কোনো সহায়তা পাননি জানিয়ে সালমা বলেন, “সরকার থেকে লাখ লাখ টাকা দিছে শুনছি। কিন্তু আমি কোনো টাকা পাইনি। টাকার চেক পাইছে আমার শ্বশুর বাড়ির মানুষরা। তারা আমাকে এক টাকাও দিবে না বইলা জানায় দিছে।”

অভিমানভরা কণ্ঠে সালমা বলেন, “আমার স্বামী বেঁচে থাকতে তাগো লগে সম্পর্ক ভালাই আছিল। এহন আমার স্বামীও নাই, তারাও আমার উপ্রে জুলুম করা শুরু করছে। আমার পোলাপানের মুখের দিকেও চাইল না হেরা।”

সালমা বলেন, “আমি সরকারের কাছে, সকলের কাছে সাহায্য চাই। আমারে একটু সাহায্য করেন, যেন আমি আমার স্বামী শহীদ আরমান মোল্লার রেখে যাওয়া পোলাপান গুলারে আমার কাছে রাইখা মানুষ করতে পারি। শহীদের সম্মান রাখতে পারি।”

নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক জাহিদুল ইসলাম সালমা ও তার সন্তানদের সহায়তার আশ্বাস দিয়ে বলেন, “জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের বীর সন্তানরা আমাদের জাতীয় ইতিহাসের গৌরব। তাদের সাহসিকতা, আত্মত্যাগ ও অদম্য চেতনা আমাদের জাতি পুনর্গঠনের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। তাদের পরিবারের সদস্যরা আর্থিক সহায়তা থেকে বঞ্চিত হবে না।”

ঢাকা/অনিক/এস

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর আরম ন ম ল ল আম র স ব ম র পর ব র আম র ক র উপ র

এছাড়াও পড়ুন:

 শীতলক্ষ্যায় ট্রলার ডুবির ভয়ে নদীতে ঝাঁপ দিলেন যাত্রীরা

নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীতে কার্গো জাহাজের সাথে ধাক্কার আশংকায় নদীতে ঝাঁপ দিয়েছেন ট্রলারের যাত্রীরা। সোমবার (১৯ মে) দুপুর দেড়টায় শহরের টানবাজার ঘাট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

ঘটনার পরপরই আশপাশের লোকজন দুটি ট্রলার নিয়ে এসে নদী থেকে যাত্রীদের উদ্ধার করেন। ইতিমধ্যে এ ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। 

এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর নৌ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমিনুল হক জানান, দুপুরে ২০ থেকে ২৫ জন যাত্রী নিয়ে একটি ট্রলার নদী পারাপারের সময় ঢেউ ও স্রোতের কারণে এমভি আখতার হোসেন-১ নামে একটি কার্গো জাহাজের সাথে ধাক্কা লাগার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। 

এসময় ট্রলারটির যাত্রীরা সবাই আতংকিত হয়ে নদীতে ঝাঁপ দেন। তবে ঘটনার সাথে সাথেই আশপাশের লোকজন দুটি ট্রলার নিয়ে এসে নদী থেকে যাত্রীদের উদ্ধার করেন। 

নৌ থানা পুলিশের ওসি বলেন, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কেউ নিখোঁজের খবর পাওয়া যায় নি। নিখোঁজের কোন অভিযোগ পেলে নদীতে তল্লাশি ও উদ্ধার অভিযান চালানো হবে।
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আরও দুই মামলায় আইভীর জামিন আবেদন নামঞ্জুর,
  • সোনারগাঁয়ে অজ্ঞাত দুই যুবকের মরদেহ উদ্ধার 
  • নারায়ণগঞ্জে শিক্ষা বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে শিক্ষাবিদদের কর্মশালা
  • নারায়ণগঞ্জ সংবাদপত্র হকার্স বহুমুখী সমবায় সমিতির ভোটগ্রহণ সম্পন্ন
  • নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসে ২ দালাল আটক, দণ্ড
  • না.গঞ্জে স্ত্রীকে হত্যা, ২ সন্তান নিয়ে পালিয়েছে স্বামী
  • রাজস্ব ফাঁকি: নারায়ণগঞ্জের রয়েল টোব্যাকো কোম্পানি সিলগালা
  • এড. বারী ভূইয়াকে লাঞ্চিত করায় ফতুল্লা বিএনপির প্রতিবাদ সমাবেশ
  •  শীতলক্ষ্যায় ট্রলার ডুবির ভয়ে নদীতে ঝাঁপ দিলেন যাত্রীরা