‘মানুষ মধু কেনার সময় প্রথমেই জিজ্ঞেস করেন, খাঁটি হবে তো’
Published: 23rd, May 2025 GMT
সুন্দরবনের মধুর জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার পর ভেজাল ঠেকিয়ে এর মর্যাদা ধরে রাখাটাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ। সম্মিলিতভাবে সেই চেষ্টাটুকু করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন বক্তারা। ‘সুন্দরবনের মধুর জিআই স্বীকৃতি এবং মধু সংগ্রহ, বিপণন ও ভেজাল প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর ও অংশীজনদের ভূমিকা’ শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা জানান তাঁরা।
গতকাল বৃহস্পতিবার খুলনার গ্র্যান্ড দরবার পার্টি সেন্টারে সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এটির আয়োজন করে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের খুলনা কার্যালয়।
আরও পড়ুনগা ছমছম বাঘের রাজ্যে মহাঝুঁকির মধু আহরণ১৫ ঘণ্টা আগেসভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের খুলনা কার্যালয়ের কর্মকর্তা মোকলেছুর রহমান বলেন, ‘সুন্দরবনের মধুর চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে অসাধু চক্র মুনাফার আশায় এতে ভেজাল মিশিয়ে বাজারে চড়া দামে বিক্রি করে। অথচ আমাদের দেশে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য হচ্ছে, শিশুদের জন্মের পরপরই মুখে মধু দেওয়া। কিন্তু মধুতে ভেজাল থাকলে জন্মের পর শিশুটির ভেজাল খাওয়ার মধ্য দিয়েই তার জীবন শুরু হয়, এটা নির্মম কাজ। ভেজালের কারণে এখন এমন অবস্থা যে মানুষ মধু কেনার সময় প্রথমেই জিজ্ঞেস করেন, খাঁটি হবে তো?’
মধুতে ভেজাল মেশানোকে আত্মঘাতী কাজ উল্লেখ করে খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) ইমরান আহমেদ বলেন, ‘আমার কাছেই যখন কেউ মধু চান, তখন ভয়ে ভয়ে দিই। কারণ, নিজে গিয়ে তো মৌচাক কেটে মধু আনা হয় না। কারও মাধ্যমেই নিতে হয়, তাঁরা যে ভেজাল দেয়নি তার নিশ্চয়তা কী! আসলে মধুতে ভেজাল মেশানো চরম আত্মঘাতী একটি কাজ। মধু সংগ্রহ থেকে শুরু করে বিপণন পর্যন্ত সবক্ষেত্রে এর সঙ্গে জড়িত সবাইকে বিষয়টি উপলব্ধি করতে হবে।’
আরও পড়ুনবিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে শুরু, এখন বছরে ১০০ টন মধু কেনাবেচা করেন তিনি৩১ মিনিট আগেদেশে প্রাকৃতিক মধুর সবচেয়ে বড় উৎস সুন্দরবন জানিয়ে মধু গবেষক সৈয়দ মইনুল আনোয়ার বলেন, জিআই স্বীকৃতিতে বিশ্বে বাংলাদেশের সুন্দরবনের মধুর নতুন ব্র্যান্ডিং করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। ভোক্তা অধিকার, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও বিএসটিআই—তিনটি প্রতিষ্ঠানের কাজ ভোক্তার হাতে খাঁটি জিনিস তুলে দেওয়া। সারা দেশের মধুওয়ালারাও তাদের সহযোগী হয়ে সেই কাজটি করবেন।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর খুলনা কার্যালয়ের উপপরিচালক মোহাম্মদ সেলিম বলেন, সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে বিদেশেও এ মধু রপ্তানি করা সম্ভব। কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর জন্য মধুর এই বাজার ধ্বংস হতে দেওয়া যাবে না।
মধুর সুনাম ধরে রাখতে সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর ড.
এদিকে আজ শুক্রবার সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা যায়, মুদি, কাপড়, মুঠোফোনে টাকা লেনদেন, ওষুধ, ফল, পান-সিগারেট এমনকি জুতার দোকানেও সুন্দরবনের খাঁটি মধু দাবি করে বোতলে ভর্তি মধু বিক্রি করা হচ্ছে। প্রকারভেদে প্রতি কেজি মধু ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা চাইছেন তাঁরা।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই অভিযোগ করেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সুন্দরবনে মধু আহরণ মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই মৌয়ালদের মোটা অঙ্কের টাকা দাদন দেন। তাঁরা মৌয়ালদের মধুর সঙ্গে চিনির সিরা ও অন্য উপকরণ মিশিয়ে বন থেকে লোকালয়ে আনতে বলেন।
উপজেলার একাধিক মৌয়াল জানান, বনে মধু আহরণ মৌসুমের শুরুতে গরান ও খলসি ফুলের মধু হয়। মৌসুম শেষের দিকে কেওড়া ফুলের মধুর মৌসুম। কিন্তু বনে গরান ও খলসি এই দুই জাতের গাছের সংখ্যা কম। আগের মতো মধুও পাওয়া যায় না। তাই একশ্রেণির অসাধু মৌয়াল বেশি লাভের আশায় ভেজাল মধু বানানোর জন্য বন বিভাগের চোখ ফাঁকি দিয়ে বস্তাভর্তি চিনি ও বড় বড় পাতিল নিয়ে বনে যান।
আরও পড়ুনক্ষুদ্র এক পতঙ্গের ওপর টিকে আছে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ২০ মে ২০২৫উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
সুন্দরবনের নতুন পর্যটন স্পট ‘আলী বান্দা’
পূর্ব সুন্দরবনের নিসর্গঘেরা অভয়ারণ্যে গড়ে তোলা হয়েছে নতুন পর্যটন কেন্দ্র ‘আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার’। সবুজ ম্যানগ্রোভ বনের বুক চিরে, নদীর নোনাজলে ভেসে, প্রকৃতির নীরব সৌন্দর্যে ঘেরা এই কেন্দ্রটি চলতি নভেম্বর মাস থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভ্রমণ করতে পারবেন পর্যটকরা।
পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের আওতাধীন আলী বান্দা এরইমধ্যে ভ্রমণপিপাসুদের দৃষ্টি কেড়েছে। শরণখোলা রেঞ্জ অফিস থেকে ট্রলারযোগে মাত্র ৪০ মিনিটের নৌপথ পেরিয়ে পৌঁছানো যায় সেখানে।
যাত্রাপথে চোখে পড়ে বনের গভীর সবুজ গাছগাছালি, ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাওয়া পাখি, কচুরিপানায় ঢাকা জলাশয় এবং সুন্দরী-গেওয়া গাছের সারি যা পর্যটকদের মোহিত করে।
বন বিভাগ জানিয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টারের অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হয়। এখানে তৈরি হয়েছে ছয়তলা ভবনের সমান উচ্চতার একটি ওয়াচ টাওয়ার, যেখান থেকে সুন্দরবনের বিস্তৃত সবুজাভ দৃশ্য চোখে ধরা পড়ে।
রয়েছে দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ ফুট ট্রেইল (ওয়াকওয়ে)। পথের দুই পাশে ঘন বনের মাঝে হাঁটলে দেখা যায় প্রকৃতির আসল রূপ। এছাড়া রয়েছে মিষ্টি পানির পুকুর, হরিণ রাখার সেড, জেটি, বিশ্রামাগার, সুভেনিয়ার শপ এবং পর্যটকদের নিরাপত্তায় বনরক্ষী ও স্থানীয় গাইডের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আলীবান্দা বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোর মানুষের জন্য সবচেয়ে সহজগম্য স্পট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কম সময় ও কম ঝুঁকিতে সুন্দরবনের সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে এখানে। স্থানীয় পর্যটকরা এরইমধ্যে আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা শাহিন বলেন, “আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার চালু হলে স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে স্থানীয় গাইড, নৌযানচালক, হোটেল ব্যবসায়ী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কর্মসংস্থান বাড়বে। পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব পর্যটনের মাধ্যমে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সচেতনতা বাড়বে।”
তবে পর্যটনকেন্দ্রে প্রবেশ ফি নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে। আলীবান্দায় প্রবেশের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৪৫ টাকা।
শরণখোলা ট্যুরিজম অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক রাসেল বয়াতী বলেন, ‘‘আলীবান্দায় প্রবেশ ফি ৩৪৫ টাকা, অথচ একই বনের করমজল পর্যটন পয়েন্টে ফি মাত্র ৪৬ টাকা। অনেকেই আলীবান্দায় যেতে আগ্রহী, কিন্তু ফি বেশি হওয়ায় নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।’’
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, “আলীবান্দা এখন প্রায় প্রস্তুত। চলতি মাসেই এখানে হরিণ আনা হবে। বর্তমানে পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে স্পটটি। যেহেতু এটি ২০১৭ সালে ঘোষণা করা অভয়ারণ্য এলাকার অন্তর্ভুক্ত, তাই সাধারণ বনাঞ্চলের তুলনায় কিছু বিধিনিষেধ ও প্রবেশ ফি বেশি রাখা হয়েছে। তবে পর্যটকদের দাবির বিষয়টি আমরা সরকারের কাছে জানাব।’’
ঢাকা/শহিদুল/এস