নির্বাচন নিয়ে চাপের মুখে অধ্যাপক ইউনূসের পদত্যাগের হুমকি
Published: 24th, May 2025 GMT
শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে একটি আদর্শবাদী আন্দোলন যখন গত আগস্টে ক্রম কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠা শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটায়, সে সময় বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ গণতন্ত্রের আসন্ন পুনরুজ্জীবন উদ্যাপন করেছিলেন।
এরপর ৯ মাস হতে চললেও অন্তর্বর্তী সরকার সবাইকে হতাশ করেছে, যাঁরা দ্রুত নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। এখন দেশটির খ্যাতিমান নেতা শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস হুমকি দিচ্ছেন যে যদি তাঁকে তাঁর কাজ করতে দেওয়া না হয় এবং ধীরগতিতে দেশকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করার সুযোগ না দেওয়া হয়, তাহলে তিনি পদত্যাগ করবেন।
আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত মুহাম্মদ ইউনূসকে সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত সবকিছু গুছিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সেরা সম্ভাবনা হিসেবে দেখা হচ্ছিল। তাঁকে যখন অন্তর্বর্তী সরকার পরিচালনার নেতৃত্বে আনা হয়, তখনো রাস্তাঘাটে রক্তপাত চলছিল।
কিন্তু তাঁর সহযোগীরা বলছেন, বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল ও সেনাবাহিনীর মধ্যে বিকাশমান ঐক্যের কারণে তিনি বাধাগ্রস্ত অনুভব করছেন। এই ঐক্য তাঁর নীতিগুলোর সমালোচনা করছে এবং বলছে, তিনি নির্বাচনের পরিকল্পনায় অত্যন্ত ধীরগতিতে এগোচ্ছেন।
বৃহস্পতিবার মুহাম্মদ ইউনূস বাধাহীনভাবে কাজ করার জন্য রাজনৈতিক ও সামরিক সমর্থন না পেলে পদত্যাগের হুমকি দেন।
মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর পদত্যাগ ঘোষণার ভাষণের খসড়া তৈরির পর্যায়ে গিয়েছিলেন বলে তাঁর সরকারের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন। অন্যান্য উপদেষ্টা তাঁকে বোঝান যে তাঁর পদত্যাগে বাংলাদেশ আরও অস্থিতিশীল হবে। ওই কর্মকর্তা ফোনে বলেন যে এ বছর নির্বাচন হওয়া উচিত বলে সেনাপ্রধান সম্প্রতি যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে অখুশি হয়েছেন মুহাম্মদ ইউনূস। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষগুলোর সমালোচনায় তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বোধ করছেন।
হাসিনার পুরোনো বিরোধীরা যেকোনো নির্বাচনে জয় পাওয়ার মতো অবস্থায় রয়েছেন। নির্বাচন যত দ্রুত হবে, সেই সম্ভাবনা তত বেশি। শেখ হাসিনার দল লাঞ্ছনার মধ্যে রয়েছে এবং সম্প্রতি দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর ফলে বর্তমানে দেশটিতে কার্যত অর্থবহ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নেই।
বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলারও অবনতি ঘটেছে, আর তা ঠিক করার উদ্যোগগুলোও চলছে অগোছালোভাবে। সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে থাকা মুহাম্মদ ইউনূসের নিজের কোনো রাজনৈতিক সমর্থন নেই।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ফেলো মোবাশ্বার হাসান বলেন, ‘মুহাম্মদ ইউনূস একজন চমৎকার ব্যাংকার হতে পারেন, প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রেও তিনি দারুন হতে পারেন; কিন্তু তাঁর যে ঘাটতি রয়েছে, দিনের পর এটা স্পষ্ট হচ্ছে যে তাঁর দৃঢ় ও শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব নেই।’ তার বদলে মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর উপদেষ্টাদের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হতে পারেন বলে মনে করেন মোবাশ্বার হাসান।
অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা একজন কর্মকর্তা বলেন, দেশের গণতন্ত্রকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে যাঁদের তাঁকে সাহায্য করার কথা ছিল, তাঁদের কেউ কেউ তাঁকে উপেক্ষা করছেন বলে অধ্যাপক ইউনূস মনে করছেন। ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হওয়া উচিত গত বুধবার সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের এমন বক্তব্যের পর তিনি ধৈর্য হারিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে।
অধ্যাপক ইউনূস এর আগে বলেছিলেন, ২০২৬ সালের জুন নাগাদ দেশ নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রস্তুত হতে পারে। তবে তিনি কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সীমা দেননি। তিনি তাঁর মন্ত্রিসভাকে বলেছেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশ একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত বলে তিনি মনে করেন না।
গত নভেম্বরে জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে অধ্যাপক ইউনূস বলেছিলেন, ‘নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে। এটি আর থামবে না। তবে এই যাত্রাপথে আমাদের অনেক কাজ শেষ করতে হবে।’
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) জোর দিয়ে বলে আসছে যে দেশের ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণের আগে একটি গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেট প্রয়োজন। নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ার পর সাবেক এই বিরোধী দল ক্ষমতা লাভের সুযোগ নিতে চায়।
বিএনপি প্রথম দিকে অধ্যাপক ইউনূসের সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল। তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে নীতিগত নানা বিষয়ে মতবিরোধের কারণে দলটি সহযোগিতা বন্ধ করেছে। এসব বিষয়ের মধ্যে রয়েছে, অধ্যাপক ইউনূস ও তাঁর কর্মকর্তারা দেশের সবচেয়ে বড় সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দরকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে চান; যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারের কিছু অঞ্চলে মানবিক সাহায্যের করিডর চালু করতে চান এবং দেশের প্রধান কর কর্তৃপক্ষকে (এনবিআর) ভাগ করতে চান।
রাজনৈতিক অস্থিরতা ঠিক করা ৮৪ বছর বয়সী এই অর্থনীতিবিদের জন্য চ্যালেঞ্জ প্রমাণিত হয়েছে এবং অনেকাংশে প্রায় অসম্ভব কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের একটি নিষিদ্ধ আর অপরটি তড়িঘড়ি নির্বাচন চাইছে। এমন পরিস্থিতিতে অধ্যাপক ইউনূস সময় নিতে চাইছেন বলে মনে হয়।
এতে সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল বিশ্লেষকেরাও বিরক্ত। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মোবাশ্বার হাসান বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে এই নির্বাচন হতে না পারার কোনো কারণ নেই। এটি সম্পূর্ণ সরকারের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে।
এদিকে শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা ছাত্র আন্দোলনের সদস্যরা ওই সময় থেকে তাঁর (হাসিনার) সমর্থকদের সঙ্গে সহিংস সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছেন; কিন্তু তাঁর (শেখ হাসিনা) পুরোনো শত্রু বিএনপিকে তাঁর সে জায়গায় বসাতে ভয় পান তাঁরা। বেশির ভাগ মানুষ এখনো অধ্যাপক ইউনূসের ওপর আস্থা রাখেন।
ফেব্রুয়ারিতে অধ্যাপক ইউনূসের সাবেক উপদেষ্টা মো.
নাহিদ ইসলাম বলেন, তিনি অধ্যাপক ইউনূসকে পদত্যাগ না করতে অনুরোধ জানিয়েছেন। বৃহস্পতিবার দুজন কথা বলেন। অধ্যাপক ইউনূস তাঁকে বলেন যে দায়িত্ব গ্রহণের সময় তিনি যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেগুলো রক্ষা করা যাচ্ছে না।
নাহিদ ইসলাম বলেন, বিভিন্ন গোষ্ঠী অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে এবং সরকারকে চাপ দিচ্ছে, তিনি (অধ্যাপক ইউনূস) মনে করছেন, তাঁর পক্ষে কার্যকরভাবে নিজের দায়িত্ব পালন করা আর সম্ভব নয়।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: কর মকর ত র জন ত ক পদত য গ সরক র র র জন য ন র জন ব এনপ করছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
২% শুল্ক কমানো হতাশাজনক
যুক্তরাষ্ট্র গত ২ এপ্রিল পাল্টা শুল্কের ঘোষণা দেওয়ার পরপরই বাংলাদেশ সরকার এটি নিয়ে আলোচনা শুরু করে। প্রধান উপদেষ্টা এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে চিঠি লিখলেন। সেখানে আমরা কিছু ছাড় দেওয়ার কথা বললাম। পরবর্তী সময়ে আমাদের বাণিজ্য উপদেষ্টা কথা বলেছেন। এরপর ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটেও যুক্তরাষ্ট্র সুবিধা পাবে—এমন কিছু পণ্যে শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আরও যেসব অশুল্ক বাধার কথা যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, যেমন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সমস্যা, মেধাস্বত্ব আইন প্রয়োগ প্রভৃতি নিয়ে আমরা আলাপ-আলোচনা অব্যাহত রাখলাম।
প্রায় তিন মাসের আলাপ-আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে পাল্টা শুল্ক ৩৭ শতাংশ থেকে কমে ৩৫ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ আলাপ-আলোচনায় তেমন কোনো সুবিধা আমরা করতে পারিনি।
শুল্ক আলোচনার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র যে ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্টের (চুক্তি) খসড়া পাঠিয়েছিল, সেটার মধ্যে কী ছিল, আমরা কিছুই জানি না। যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদা কী ছিল এবং বিনিময়ে কী দেবে বলেছে; বিপরীতে আমাদের (বাংলাদেশের) চাহিদা কী ছিল এবং বিনিময়ে আমরা কী দেব বলেছি—এই চারটি বিষয়ের কোনোটিই আমরা স্পষ্টভাবে জানি না।
ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক আরোপের পর সব দেশের মধ্যে বাংলাদেশই নাকি সবার প্রথমে আলাপ-আলোচনা শুরু করেছে, এ রকম একটা ধারণা আমরা পেয়েছিলাম। কিন্তু তিন মাস আলাপ-আলোচনা করে এইটুকুই আমরা এখন জানতে পারছি যে শুল্ক মাত্র ২ শতাংশ কমানো গেছে। এটা অবশ্যই হতাশাজনক।
সরকার থেকে জানানো হয়েছে, চুক্তির খসড়ায় একটি নন-ডিসক্লোজার ক্লজ (তথ্য প্রকাশ করা যাবে না এমন ধারা) ছিল। তবে আমি মনে করি সরকার দর-কষাকষির জন্য অংশীজন ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি বিশেষ দল (টিম) গঠন করতে পারত। ওই দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে আমাদের কৌশল নির্ধারণ করা হলে সেটি বেশি কার্যকর হতে পারত। কিন্তু আমরা দেখেছি অল্প কয়েকজন লোক কাজটি করেছেন। তাতে শেষমেশ দেখা যাচ্ছে, আদতে কোনো লাভ হয়নি।
ট্রাম্পের নতুন শুল্ক আমাদের জন্য উদ্বেগের। কারণ, আমাদের মূল প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশে নামাতে পেরেছে, যা আমাদের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি। এতে আমাদের তৈরি পোশাক খাতের জন্য বড় ধরনের ধাক্কা লাগবে। বিদেশি ক্রেতারা এই বাড়তি শুল্কের ভার কতটা নিতে চাইবে, তা বলা যায় না। ধারণা করছি, এটা তারা আমাদের রপ্তানিকারকদের ঘাড়ে দিতে চাইবে। কিন্তু এত বড় শুল্ক ব্যবধান নিয়ে প্রতিযোগীসক্ষম থাকা খুবই কঠিন।
সব মিলিয়ে বলা যায়, নতুন পাল্টা শুল্কে আমাদের জন্য খুব বড় একটা ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে স্বল্প মেয়াদে আমরা প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাতে পারি। আর এই শুল্ক অব্যাহত থাকলে মধ্য মেয়াদে আমাদের পণ্যের ক্রেতারা অন্যত্র চলে যেতে পারে। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র বড় একটি আমদানিকারক দেশ। সুতরাং তাদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে। ১ আগস্ট থেকে নতুন পাল্টা শুল্ক কার্যকর করার ঘোষণা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। তাই পরবর্তী তিন সপ্তাহে আমরা তাদের আরও কী দিতে পারি, তা দেখতে হবে।
বাণিজ্য আলোচনার মধ্যে ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ও রয়েছে। আমরা তো আর সেগুলো জানতে পারছি না। এখন বাংলাদেশ কতটুকু দিতে পারবে, সেটি দেখতে হবে। কারণ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সদস্য হওয়ায় বিভিন্ন ধরনের বিধিনিষেধও রয়েছে। সে দিক দিয়ে আমাদের পক্ষে হয়তো অনেক কিছু সম্ভব হবে না। ফলে এ বিষয়গুলো বিচার-বিবেচনা করেই আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে।
শুল্ক কমানোর বিষয়ে আমাদের অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে। শুল্ক অন্ততপক্ষে ভিয়েতনামের সমপরিমাণও যদি নামাতে পারি, তাহলে প্রতিযোগিতা সক্ষমতার দিক থেকে আমরা মোটামুটিভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো অবস্থায় থাকতে পারব। কিন্তু ৩৫ শতাংশ শুল্ক অব্যাহত থাকলে আমাদের পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া বোধ হয় কঠিন হয়ে যাবে বা সম্ভব হবে না।