বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উপদেষ্টা পদ থেকে সরে যাচ্ছেন। তিনি এমন এক সময়ে এই সিদ্ধান্ত নিলেন, যার আগে ট্রাম্পের আলোচিত ব্যয় বাজেট বিল নিয়ে তাঁর সঙ্গে প্রথম বড় ধরনের মতভিন্নতা দেখা দিয়েছিল।

ট্রাম্প প্রশাসনে মাস্ক মূলত সরকারি ব্যয় কমানোর দায়িত্বে ছিলেন।

‘বিশেষ সরকারি কর্মচারী’ ও ‘প্রেসিডেন্টের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও দক্ষিণ আফ্রিকার বংশোদ্ভূত এই ধনকুবের ট্রাম্পের সবচেয়ে দৃশ্যমান সমর্থক হিসেবে মার্কিন রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছেন।

‘নাৎসি’ স্যালুট

২০ জানুয়ারির ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানের মঞ্চে মাস্ক দাঁড়িয়ে দুবার হাত সোজা করে এমন ভঙ্গিতে স্যালুট করেন, যা অনেক ইতিহাসবিদ ও ডেমোক্র্যাট রাজনীতিবিদ ‘নাৎসি স্যালুট’-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাঁর ইভি গাড়িগুলোকে তখন সমালোচকেরা ‘সোয়াস্তিকারস’ বলে উপহাস করতে শুরু করেন।

মাস্ক তাঁর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এক পোস্টে লেখেন, ‘সবাইকে হিটলার বলার ট্রিকটা খুবই পুরোনো।’

মাস্কের সেই ভঙ্গিমার অর্থ যা–ই হোক না কেন, ট্রাম্পের বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় ফেরার দিনটি ঘিরে জনসাধারণের প্রতিক্রিয়ায় নাৎসি-সম্পর্কিত ঠাট্টা-তামাশা ও মিমই ছড়িয়ে পড়েছে সবচেয়ে বেশি।

জার্মানির চরম-ডানপন্থী দলকে সমর্থন

‘নাৎসি স্যালুট’ নিয়ে বিতর্কের পরই মাস্ক জার্মানির উগ্র-জাতীয়তাবাদী, অভিবাসনবিরোধী এএফডি দলের একটি সমাবেশে ভার্চুয়াল মাধ্যমে অংশ নেন।

মাস্ক সেখানে এএফডির সমর্থকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারাই জার্মানির শেষ ভরসা।’ দলটির সমর্থকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘জার্মান সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ নিয়ে গর্বিত হোন।’

এএফডির প্রতি মাস্কের প্রকাশ্য সমর্থন জার্মানির মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোকে চরমভাবে ক্ষুব্ধ করে। তাঁরা বলেন, ট্রাম্পের উপদেষ্টার এমন আচরণকে তাঁরা বিদেশি হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। এরপরই দুর্বৃত্তরা বার্লিনের রাস্তায় চারটি টেসলা গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।

রেকর্ড ভোট পেলেও শেষ পর্যন্ত এএফডি নির্বাচনে জার্মানির রক্ষণশীল দলের পরে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে।

ছেলেকে অফিসে আনা

মাস্ক প্রায়ই হোয়াইট হাউসে ‘আমেরিকাকে আবার মহান করো’ (এমএজিএ) টি-শার্ট পরে হাজির হতেন। একসময় তাঁর চার বছরের ছেলে এক্স-ও নিয়মিত সেখানে আসত।

সরকারের দক্ষতা বৃদ্ধি–সংক্রান্ত ডিওজিই পরিচালনার জন্য ওয়াশিংটনে আসার পর মাস্ক প্রথমবার যখন সাংবাদিকদের সামনে আসেন, তখন তাঁর ছেলেকেও সামনে আনা হয়। সেখানে ট্রাম্প বলেন, ‘সে হচ্ছে এক্স, আর সে দারুণ ছেলে।’

ভিডিওতে মাস্কের শিশু সন্তানকে নাক খুঁটতে দেখা যায়। ওই সময় তার বাবা ওভাল অফিসের রিসোলিউট ডেস্কের পাশে দাঁড়িয়ে নিজের খরচ কমানোর সাফল্যের গল্প বলছিলেন।

বাজেটে চেইন করাত চালু

সিনেটে অননুমোদিত এবং সরাসরি নির্বাচিত না হলেও মাস্ক বারবার আমলাতন্ত্রকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘অনির্বাচিত, অসাংবিধানিক চতুর্থ শাখা’ বলে আক্রমণ করেন। তিনি খুব দ্রুতই ফেডারেল জনবল ও বাজেটে ব্যাপক কাটছাঁট শুরু করেন।

নিজের ব্যবস্থাপনার ধরন বোঝাতে মাস্ক ওয়াশিংটনের এক রক্ষণশীল সমাবেশে সানগ্লাস পরে মঞ্চে ওঠেন। সেখানে হাতে তুলে নেন একটি চেইন করাত।

এই চেইন করাত মাস্ককে দেন ডানপন্থী আর্জেন্টাইন প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের মিলেই, যিনি নিজ দেশে আমলাতন্ত্র ও সরকারি খরচ কমানোর প্রতীক হিসেবে এই যন্ত্র ব্যবহার করেন।

ট্রাম্পের মন্ত্রিসভাকে ছাপিয়ে যাওয়া

গত ২৬ ফেব্রুয়ারির মন্ত্রিসভা বৈঠকে মাস্ক ‘টেক সাপোর্ট’ লেখা টি-শার্ট পরে দরজার পাশে দাঁড়ান, যদিও তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে মন্ত্রিসভার সদস্য নন।

মাস্ক ২০২৪ সালে ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারে ব্যাপক অর্থ দেন। তিনি দেশজুড়ে সবচেয়ে প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের ছাপিয়ে যান।

বৈঠকের ঠিক আগে ট্রাম্প এই উত্তেজনাকে গুরুত্ব না দিয়ে তাঁর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেন, ‘মন্ত্রিসভার সব সদস্যই ইলনের সঙ্গে দারুন খুশি।’

ট্রাম্প: টেসলার ‘বিক্রয় প্রতিনিধি’

মাস্কের টেসলা কোম্পানি যখন পুঁজিবাজারে ধাক্কা খাচ্ছিল এবং বিক্রি ব্যাপক হারে কমে যাচ্ছিল, সেই সময় ক্ষুব্ধ অনেকে ব্র্যান্ডটির ওপর হামলা শুরু করে। তখন টেসলার সুনাম বৃদ্ধি করতে হোয়াইট হাউস বহুল প্রচারিত একটি টেস্ট ড্রাইভ আয়োজন করে।

হোয়াইট হাউসের সাউথ পোরটিকোতে একটি টেসলা সাইবারট্রাক ও একটি মডেল ‘এস’ দাঁড় করানো হয়। আর ট্রাম্প ও মাস্ক মিলে সেটিকে ঘিরে বিক্রির প্রচার চালান।

এমনকি ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি নিজে একটি টেসলা কিনেছেন।

তবে ট্রাম্পের এই চেষ্টাও শেষ পর্যন্ত টেসলার বিক্রি ফেরাতে পারেনি। প্রথম প্রান্তিকে টেসলার মুনাফা ৭১ শতাংশ কমেছে বলে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।

উইসকনসিনে হার

উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচনে একজন ট্রাম্পপন্থী বিচারককে জেতাতে মাস্ক ২ কোটি ৫০ লাখ খরচ করেন।

রক্ষণশীল বিচারককে জয়ী করতে ভোটারদের ১০০ ডলার করে দেন ইলন মাস্ক। এমনকি ভোটারদের ১০ লাখ ডলারের চেকও দেন তিনি।

মাস্কের এত অর্থ ব্যয়ের পরও উদারপন্থী এক বিচারক বিশাল ব্যবধানে জয়ী হন।

২০২৪ সালে ট্রাম্পকে জেতাতে মাস্ক মোট ২৭ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার ব্যয় করেন।

শুল্কবিরোধী মাস্ক

ট্রাম্প যখন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন—যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর বড় প্রভাব ফেলেছে, তখন ইলন মাস্ক এই শুল্কের বিরোধিতা করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যে একটি ‘মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল’ গঠনের প্রস্তাব দেন।

মাস্কের এই প্রস্তাব সরাসরি ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

কিছুদিন পর মাস্ক ট্রাম্পের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পিটার নাভারোকে আক্রমণ করে বলেন, ‘তাঁর মাথায় বুদ্ধি কম।’

নাভারো তখন টেসলার সমালোচনা করে বলেন, কোম্পানিটি মূলত এশিয়ার কারখানা থেকে যন্ত্রাংশ এনে গাড়ি তৈরি করে।

এর জবাবে মাস্ক বলেন, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ‘টেসলাই সবচেয়ে বেশি আমেরিকান গাড়ি তৈরি করে।’

হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র ক্যারোলাইন লেভিট এই প্রকাশ্য বিবাদের গুরুত্ব কমিয়ে বলেন, ‘ছেলেরা তো ছেলেই! তাঁদের মধ্যে এ রকম একটু-আধটু হয়েই থাকে।’

‘বিগ, বিউটিফুল বিল’ নিয়ে বিরোধ

মাস্ক বলেছেন, ট্রাম্পের বিরোধপূর্ণ বড় ধরনের খরচ কমানোর বিল দেখে তিনি খুবই ‘হতাশ’ হয়েছেন। এটা একটা বিরল ঘটনা, যেখানে তিনি রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে একমত নন।

প্রযুক্তি উদ্যোক্তা মাস্ক বলেন, গত সপ্তাহে ইউএস হাউসে ‘ওয়ান বিগ, বিউটিফুল বিল অ্যাক্ট’ বিলটি পাস হয়েছে। বিলটি এখন সিনেটে পাঠানো হয়েছে। এটি দেশের ঘাটতি বৃদ্ধি করবে এবং হাজার হাজার মানুষকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া ডিওজিইর কাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

সমালোচকেরা সতর্ক করেছেন, এই আইন স্বাস্থ্যসেবা কমিয়ে দেবে এবং ১০ বছরের মধ্যে জাতীয় ঘাটতি চার লাখ কোটি ডলার পর্যন্ত বাড়িয়ে দেবে।

মাস্ক সিবিএস নিউজকে বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে, আমি সেই বিশাল খরচ কমানোর বিল দেখে হতাশ হয়েছি। কারণ, এটি বাজেট ঘাটতি কমানোর বদলে বাড়াচ্ছে এবং ডিওজিই দলের কাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।’

এর পরেই মাস্ক ঘোষণা করলেন, তিনি মার্কিন সরকারের পদ থেকে পদত্যাগ করছেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: খরচ কম ন র ইলন ম স ক উপদ ষ ট সরক র সবচ য়

এছাড়াও পড়ুন:

প্রতিষ্ঠার দেড় যুগ পর ইতিহাসের সাক্ষী হতে যাচ্ছে বেরোবি

‎বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ব্রাকসু) নিয়ে অপেক্ষার প্রহর শেষ হতে চলেছে শিক্ষার্থীদের। গত ২৮ অক্টোবর রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের মাধ্যমে ‎বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের গেজেট প্রকাশ হয়ছে গঠনতন্ত্র।

এরই মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১৭ বছর পর হতে যাচ্ছে কাঙিক্ষত কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ তথা ব্যাকসু নির্বাচন। তবে এর জন্য আমরণ অনশন থেকে শুরু করে সব ধরনের কর্মসুচিই পালন করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

আরো পড়ুন:

‘আমরা একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন করতে চাই’

‎বেরোবিতে শহীদ আবু সাঈদ স্মৃতিস্তম্ভের মডেল প্রদর্শন

‎জুলাই অভ্যুত্থান পর গণরুম ও গেস্ট রুমের যে সাংস্কৃতি ছিল, তা এখন বন্ধ হয়েছে। কোনো রাজনৈতিক দলের কমকাণ্ডে সামিল হওয়াও বাধ্যতামুলক নয়।

‎তাই শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এ ছাত্র সংসদ। যাতে শিক্ষার্থীদের অধিকার ও স্বার্থ সুরক্ষিত হবে।

‎কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বেরোবির বিধিমালা অনুযায়ী, ১৩টি পদে সরাসরি নির্বাচন ও হল সংসদে নয়টি পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে সব ধরনের কথা তুলে ধরতে পারবেন।

‎পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী শেখর রায় বলেন, “সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও লেজুরবিত্তিক রাজনীতি ব্যতীত একটি নির্বাচন হোক। যোগ্য, আদর্শ, উত্তম চরিত্র ও মনের প্রার্থী বিজয়ী হোক। নির্বাচিত হয়ে তারা হয়ে উঠুক বেরোবির একেকজন যোগ্য প্রতিনিধি। তারা ন্যায়ের পক্ষে থাকুক । তাদের হাত ধরেই এগিয়ে যাক বেরোবি।”

‎গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী জাওয়াদ সাজিদ বলেন, “ছাত্র সংসদ শিক্ষার্থীদের দাবি, অধিকার ও স্বার্থ রক্ষার প্রধান মঞ্চ। এটি প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে, যাতে প্রতিটি শিক্ষার্থীর কণ্ঠ পৌঁছে যায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের টেবিলে। কিন্তু এজন্য সংসদকে দলীয় প্রভাবমুক্ত, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হতে হবে। প্রকৃত অর্থে ছাত্র সংসদ তখনই সফল, যখন তা শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হয়ে তাদের সমস্যার সমাধান ও কল্যাণে কাজ করে।”

‎অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী আতিকুর রহমান বলেন, “আমরা এমন ছাত্র সংসদ চাই, ‎যেখানে যোগ্য নেতৃত্ব আসবে এবং সব শিক্ষার্থীর সমস্যা সমাধানের হাতিয়ার হয়ে কাজ করবে। সবমিলিয়ে সবার বিশ্বস্ত জায়গা হবে এই ছাত্র সংসদ।”

ঢাকা/সাজ্জাদ/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ