জাতি গঠনের যে জরুরি কাজটি করেছেন জিয়া
Published: 30th, May 2025 GMT
আজ ৩০ মে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। আজকের এই দিনে তিনি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে চক্রান্তকারী সেনা কর্মকর্তাদের হাতে নিহত হন।
প্রতিবছর এই দিন বাংলাদেশের জনগণের জন্য এক নতুন বার্তা, এক নতুন অর্থ বহন করে আনে। জিয়াউর রহমানের জীবন ও কর্ম থেকে এই দিনে বাংলাদেশের বিপর্যয়কবলিত জনগণ নবতর শিক্ষা গ্রহণ করে। আমার মতে, ছয় বছরের কম সময়ের শাসনকালে জিয়ার সবচেয়ে বড় কীর্তি হলো বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি। এটি ছিল একটি বিশাল কর্ম, যদিও তা সম্পাদনের জন্য জিয়া খুব কম সময়ই পেয়েছিলেন।
জিয়া যে চেতনার অগ্নিশিখা প্রজ্বলিত করেছিলেন, তা আজও অম্লান। উপনিবেশোত্তর এশিয়া ও আফ্রিকার রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে আমরা অনেক জাতীয়তাবাদী নেতার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পরিচিত। সুকর্ণ, নাসের, বেনবেল্লা ও নক্রুমা তাঁদের নিজ নিজ দেশের উপনিবেশবাদবিরোধী সংগ্রামের ইতিহাসে বিশাল সব নাম। তাঁরা অনেকেই দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিলেন। তাঁদের ছিল আন্তর্জাতিক সুখ্যাতি। জাতির গঠনকর্মে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। কিন্তু তাঁদের মৃত্যুর পর জনগণ তাঁদের মতাদর্শ ধারণ করে রাখেনি। যে রাষ্ট্রীয় আদর্শ তাঁরা সৃষ্টি করেছিলেন, ক্ষমতার আসন থেকে সরে যাওয়ার পর তা টিকে থাকেনি। কিন্তু জিয়ার ক্ষেত্রে ঘটেছে ব্যতিক্রমী ঘটনা। জিয়া তাঁদের মতো বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। কিন্তু তিনি একটি দল ও একটি আদর্শ রেখে গেছেন, যা আজও বাংলাদেশের ইতিহাসের চালিকা শক্তি। তাঁর বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত হয়ে এক বিপুল বস্তুগত শক্তিতে পরিণত হয়েছে। প্রশ্ন হলো, এই অবাক ব্যাপারটি ঘটল কী করে?
ইতিহাসের যুগ বিভাগের সীমাবদ্ধতা মনে রেখেও উপনিবেশবাদ অপসারণের ইতিহাসে চারটি স্তর নির্ণয় করা যায়। এই স্তরগুলো হলো জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পত্তন ও দানা বাঁধার স্তর, এই আন্দোলনে বিজয়ের স্তর, আন্দোলনে বিজয়ের ফলে রাষ্ট্র গঠনের পরবর্তী পর্যায়, এই রাষ্ট্রের সঙ্গে অন্য রাষ্ট্রের এবং এর অভ্যন্তরের অসম সমাজের সম্পর্ক নির্ণয় ও একে স্থায়িত্ব প্রদানের স্তর। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমাদের দৃষ্টি দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরটির প্রতি সীমাবদ্ধ থেকেছে। কিন্তু বাস্তব ঘটনা হলো সমাজ বিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ বাঁক প্রথম ও চতুর্থ স্তরে সৃষ্টি হয়েছে। উপনিবেশবাদ থেকে মুক্তির ইতিহাসে জিয়া আমাদের ক্ষেত্রে তৃতীয় ও চতুর্থ স্তরে সংশ্লিষ্ট হয়েছেন। সাধারণত বিশ্বাস করা যায়, ‘সিক উই ফার্স্ট দ্য পলিটিক্যাল কিংডম’, ‘দ্য ন্যাশনালিস্ট কুড মেক দ্য স্টেট অ্যান্ড স্টেট কুড মেক দ্য নেশন।’ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জনগোষ্ঠীর প্রায় সর্বাংশ এক ভাষার ও এর হাজার বছরের ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও এ ধরনের মোহ পোষণ করার কোনো অবকাশ ছিল না।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিদায়ের মধ্য দিয়ে আমরা একদিন জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত এবং একটি সরকার পেলাম বটে; আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতার মূল্য হিসেবে ভারতের কাছে আমাদের জাতীয় সার্বভৌমত্ব বন্ধক রাখতে হলো। ভারতের প্রতি ‘কৃতজ্ঞতা’র দায় পরিশোধের জন্য আমাদের সেনাবাহিনীর আকৃতি ক্ষুদ্র রাখতে এবং একে সব দিক দিয়ে দুর্বল রাখতে আমরা বাধ্য হলাম—পাছে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তুললে তা ভারতের প্রতি বৈরী অভিসন্ধির প্রকাশ ঘটায়। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরপর ভারত তার জামার আস্তিনে লুকানো বাঘনখ উন্মুক্ত করল। অভিন্ন নদীগুলো থেকে পানি প্রত্যাহার, ছিটমহল নিয়ে অসম চুক্তি, এমনকি বাংলাদেশের প্রশাসন চালানোর জন্য ভারতীয় আমলা প্রেরণের প্রস্তাব ভারতের অসংখ্য অভিসন্ধির কয়েকটি দৃষ্টান্তমাত্র। উল্লেখ্য, পৃথিবীর যেসব দেশ জাতীয় মুক্তি বা পরিত্রাণের জন্য বিদেশি সেনাশক্তির ওপর নির্ভর করেছে, সেসব দেশ কেবল সীমিত সার্বভৌমত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো এর জ্বলন্ত প্রমাণ।
বাংলাদেশিরা তাদের নিজস্ব জীবনপ্রণালি অনুসরণ করতে চায় এবং যুগপৎ যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চায়। জিয়া ছিলেন এই দুই বোধের মূর্ত প্রতীক। আর সেখানেই তাঁর বিশালত্ব। তাঁর রাষ্ট্রীয় নীতি ও কর্মকাণ্ড থেকে অনেক দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়, যার মধ্য দিয়ে জিয়া দেশজ ‘জীবনাচরণ’ ও ‘যুগের দাবি’র সমন্বয় ঘটিয়েছেনএকটি প্রতীকী ঘটনার মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান আমাদের পরিপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব অর্জনের শিখাটি প্রজ্বলিত করেন। ১৯৭৫ সালের অক্টোবরে সেনাপ্রধান জিয়া বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ইউনিটের কাছে ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে ভারতীয় সেনা কমান্ডারের হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়া একটি পিস্তল হস্তান্তর করেন। এটা ছিল সৈনিক ও জনগণের প্রতি জিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকী বার্তা।
তাই ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর আমাদের জাতীয় জীবনের এক চরম সংকটময় মুহূর্তে সৈনিক ও জনগণ একাত্ম হয়ে জিয়াকে ষড়যন্ত্রকারীদের বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে এনে রাষ্ট্রের দায়িত্ব অর্পণ করেন। বিজয়ের এই সাফল্যে জনগণের মনে ছিল নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তার আশ্বাস। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে জিয়া অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের স্বরূপ নির্ণয় করলেন। তিনি গণচীনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতা গড়ে তুললেন। ওআইসিভুক্ত মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সুগভীর সম্পর্ক রচিত হলো। বাংলাদেশ মর্যাদাবান ‘আল কুদস’ কমিটির সদস্য হলো এবং যুদ্ধরত ইরান ও ইরাকের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা অর্জন করল। পশ্চিমা বিশ্বে জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থান সম্পর্কে জিয়া ভুল-বোঝাবুঝির নিরসন করলেন। এমনকি আমাদের বৈরী প্রতিবেশী ভারত গ্যারান্টি ক্লজসহ পাঁচ বছরের পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদন করায় বৈরিতা কিছুটা হ্রাস পেল। কারণ, জিয়া বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার নিয়ে জনসমাবেশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম জাতির মর্যাদা অর্জন করল।
গত ৪৪ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, বাংলাদেশ সৃষ্টি করা আর বাংলাদেশি সৃষ্টি করা সমার্থক নয়। রাজনৈতিক বিপ্লব সম্পন্ন হলে রাষ্ট্র হয়তো অর্জিত হয়, হয়তো এর ভিত্তিমূল আংশিক স্থিতি অর্জন করে, কিন্তু মৌলিক জিজ্ঞাসাটি থেকেই যায়, আমরা কারা—বিগত বছরগুলোয় আমরা কী অর্জন করেছি। স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদী আদর্শকল্পের একটি স্তর অতিক্রান্ত হয় মাত্র। শুধু পরাধীনতার নিন্দা করে কিংবা এর অবসানে উৎফুল্ল হয়ে পরবর্তী স্তরে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব নয়। এই স্তরে করণীয় হলো রাষ্ট্রের অন্তর্গত জনসমষ্টির চেতনায় সংহতি অর্জন করা এবং তারই মধ্য দিয়ে জাতির ভগ্নাংশগুলোকে একটি যৌথ সত্তায় রূপান্তরিত করা। আর এই যৌথ সত্তার চাহিদা অনুসারেই জাতীয় সরকারের কর্মকাণ্ডের ধারা নিরূপণ করা।
জিয়াউর রহমান এই কাজটিই করেছিলেন তাঁর বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ধারণার মধ্য দিয়ে। এই ধারণার মধ্য দিয়ে জিয়া দুটি বোধ, ‘দেশজ জীবনপ্রণালি’ ও ‘যুগচেতনা’র পারস্পরিক সম্পর্ক, গুরুত্ব এবং এ দুইয়ের অন্তর্নিহিত উপাদানগুলো নির্ণয় করেন। বাংলাদেশিরা তাদের নিজস্ব জীবনপ্রণালি অনুসরণ করতে চায় এবং যুগপৎ যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চায়। জিয়া ছিলেন এই দুই বোধের মূর্ত প্রতীক। আর সেখানেই তাঁর বিশালত্ব। তাঁর রাষ্ট্রীয় নীতি ও কর্মকাণ্ড থেকে অনেক দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়, যার মধ্য দিয়ে জিয়া দেশজ ‘জীবনাচরণ’ ও ‘যুগের দাবি’র সমন্বয় ঘটিয়েছেন। এর অর্থ হলো যুগদাবি ও সামাজিক বাস্তবতার মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সমাজ পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার উদ্বোধন।
জিয়া জানতেন, যাকে এডওয়ার্ড শিলস বলেছেন ‘উইল টু বি মডার্ন’ (আধুনিক হওয়ার প্রতিজ্ঞা) এবং ম্যাজিনি যাকে বলেছেন ‘নিড টু এক্সিট অ্যান্ড টু হ্যাভ আ নেম’ (অস্তিত্ব বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা ও একটি পরিচয় অর্জন করা), এই দুইয়ের কী করে সমন্বয় করা যায়। একজন রাষ্ট্রনায়ক এবং একজন জাতীয়তাবাদী নেতার জন্য এর চেয়ে মহৎ গুণ আর কী হতে পারে?
মাহবুব উল্লাহ অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: উপন ব শ র জন য আম দ র বছর র
এছাড়াও পড়ুন:
দেশের সমস্যার কথা বাইরে বলে লাভ নেই, ড. ইউনূসকে আমীর খসরু
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে ইঙ্গিত করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, দেশের সমস্যার কথা বারবার বাইরে গিয়ে বলে লাভ নেই, এখানেই বলতে হবে, এখানেই সমাধান।
আজ শুক্রবার বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর মুরাদপুর এলজিইডি মিলনায়তনে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৪৪তম শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
আমীর খসরু বলেন, আমরা নির্বাচনের অপেক্ষায় আছি। নির্বাচনের মাধ্যমে একটা নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত কিছু বাস্তবায়ন করা সম্ভব না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাংলাদেশে একটা নির্বাচিত সরকারের প্রয়োজন। এটা কোন দল চায়, আর কোন দল চায় না- এটা বড় কথা না। কারণ গণতন্ত্রের প্রত্যাশায় আছে বাংলাদেশের মানুষ।
সব সমস্যার সমাধান বাংলাদেশের জনগণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, দিন শেষে সংস্কার, বিচার যত কিছু বলেন, সমাধান বাংলাদেশের মানুষ। সমাধান দেওয়ার দ্বিতীয় কোনো অস্ত্র নেই। একটাই মাত্র অস্ত্র বাংলাদেশের জনগণ।
নেতাকর্মীদের ছোটখাটো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভুলে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে আমীর খসরু বলেন, বাংলাদেশকে সঠিকভাবে, সঠিক জায়গায় দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার চিন্তায়, জিয়াউর রহমানের চিন্তায় গড়তে হলে নেতাকর্মীদের মধ্যে স্পিড থাকতে হবে। স্পিড চলে গেলে হবে না। নিজেদের মধ্যে ছোটখাটো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভুলে যেতে হবে। এখন মানুষের যে প্রত্যাশা, ছোটখাটো দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে থাকলে ওরা পিছিয়ে পড়বে। যারা এসব দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে থাকবে, তারা আগাতে পারবে না, পিছিয়ে যাবে। সামনের বড় চিত্র দেখতে হবে।
নগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহর সভাপতিত্বে ও সদস্য সচিব নাজিমুর রহমানের সঞ্চালনায় সভায় প্রধান আলোচক ছিলেন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এস এম আবদুল আউয়াল। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবর রহমান শামীম। সভায় বিএনপি ও বিভিন্ন অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতারা বক্তব্য রাখেন।