বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাদা কোয়ার্টারের সামনেই বড়সড় খেলার মাঠ। ওখানেই হয় বুয়েটের কেন্দ্রীয় ঈদ জামাত। বাসার সামনের জামাতেই ছেলেদের নিয়ে শরিক হই। দুপুরে মুগদাপাড়ায় আমার পৈতৃক বাড়িতে যাই। রাতে গোপীবাগ, আর কে মিশন রোডে শ্বশুরবাড়ি হয়ে ফেরত আসি বুয়েটের বাসায়। বহু বছর হলো, এ রকমই আমার ঈদের দিনের রুটিন।
ছোটবেলায় ঠিক কবে প্রথম ঈদের মাঠে গিয়েছিলাম মনে নেই। প্রথম যে ঈদের স্মৃতি বেশ মনে আছে, সেটি সম্ভবত ১৯৭৩ সালের। ক্লাস টুতে পড়ি। ঢাকায় তখন ঈদের প্রধান জামাত হতো পল্টন ময়দানে। এই ময়দানে এখন মওলানা ভাসানী স্টেডিয়াম। আব্বা বরাবরই আমাদের ভাইদের নিয়ে ঈদের প্রধান জামাতেই শরিক হতেন। সেই বছরও তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন পল্টন ময়দানে। জামাতের ইমাম ছিলেন জাতীয় নেতা আওয়ামী লীগের একসময়কার সভাপতি মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ।
নামাজ শেষে বঙ্গভবনে গেলাম। তখন সেখানে এত নিরাপত্তার বালাই ছিল না। চারদিকে চার ফুট উচ্চতার দেয়াল দিয়ে ঘেরা। সামনের রাস্তাটি তখন জনসাধারণের চলাচলের জন্য উন্মুক্ত ছিল।
বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী আগত জনতার সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেন। সবাইকে মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হলো। দুজন প্রবীণ ব্যক্তি আমাকে আদর করে ঈদ মোবারক জানালেন। পরে জানলাম দুজনই মন্ত্রী। একজন এ এইচ এম কামরুজ্জামান, অপরজন অধ্যাপক ইউসুফ আলী। তখনকার পরিবেশ ছিল এমনই।
সেদিন বাসায় ফিরে বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে বড় চাচাতো ভাইদের সঙ্গে গেলাম মেলায়। কমলাপুর রেলস্টেশনের যে জায়গায় এখন কাস্টমসের কনটেইনার ডিপোর অফিস, সেই জায়গাটি তখন ছিল পুরোপুরি ফাঁকা মাঠ; স্থানীয় লোকদের খেলাধুলা করা আর হাওয়া খাওয়ার জায়গা। এই জায়গায় বিভিন্ন উৎসবের সময় মেলা বসত। নানা স্বাদের ও রঙের বাতাসা-কদমা, খই আর মুড়ি-মুড়কি-মুরলিতে মেলা ছিল ভরপুর। মাটি, কাঠ ও রংবেরঙের কাগজের খেলনা ছিল আমাদের মতো ছোটদের কাছে প্রধান আকর্ষণ।
মেলায় এক লোক নিয়ে এসেছিল অটোমেটিক স্টিমার। টিনের তৈরি। চলে কেরোসিনে; পানিতে ভাসিয়ে কেরোসিন ভেজানো সলতেয় আগুন ধরিয়ে দিলে টিনের স্টিমারটি চলতে পারত। ওটি ছিল আমার দেখা প্রথম অটোমেটিক মেশিন। আমার ছোট্ট মনে রাজ্যের বিস্ময় এনেছিল যন্ত্রটি।
আমাদের বাসা রেলস্টেশনের কাছে হওয়ায় অনেক ভিক্ষুক আসত। ঈদের দিনে এক ভিক্ষুক এলে কিছু একটা খাবার দিয়ে তাঁকে বিদায় দিই। খুশি হয়ে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘বাবা, এটা কি সেমাই?’ জবাবে বলেছিলাম, না। ব্যাপারটি আমার কাছে অবাক লেগেছিল। লোকটি সেমাই চেনে না। আব্বা যখন ঘটনাটি শুনলেন, আমাকে মৃদু বকা দিলেন, কেন আমি তাঁকে সেমাই দিলাম না।
তখন সাদাকালো টিভির যুগ। শুধু বিটিভি। সেই টিভিও আমাদের মহল্লায় ছিল না। পরে যখন টিভি এল, দেখলাম ওটা একটা বড়সড় চারপেয়ে বাক্সের মতো। এখনকার মতো এত হালকা–পাতলা নয়।
ঈদের দিন রাতে সেই টিভিটি আবার বাড়ির উঠানে টেবিলের ওপর বসিয়ে দেওয়া হতো। ঈদের ছায়াছবি ও বিশেষ অনুষ্ঠান মহল্লার ছেলে–বুড়ো আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে দেখতাম। বাসার ছাদে টিভির অ্যানটেনা ঠিকমতো সেট করা না গেলে মাঝেমধ্যে ছবিও ভালো আসত না। তারপরও আমাদের আনন্দের কমতি ছিল না।
কোরবানির ঈদকে আমরা বলতাম বকরিদ। বকরিদে কমলাপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় পশুর হাট বসত। বাড়ির বড়রা হাটে হাটে ঘুরে গরু–ছাগল কিনে আনতেন। আমাদের ছোটদের কাজ ছিল বাড়ি বাড়ি ঘুরে গরু–ছাগল দেখে বেড়ানো। কোরবানির পর গরুর শরীর থেকে একধরনের পাতলা পর্দা নিয়ে মাটির কলসির ভাঙা মাথায় টান টান করে লাগিয়ে দিতাম। দু–এক দিন পর সেটি শুকিয়ে গেলে তৈরি হতো ঢোল। সেই ঢোলের আওয়াজে ঈদের পরের কয়েক দিন সারা মহল্লা থাকত সরগরম।
তখন আমাদের সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত এক দেশ। মানুষের হাতে এত অর্থকড়ি ছিল না। ঈদের দিনে তাই ছিল না এত জৌলুশ। তবে মানুষের মধ্যে সহজ–সরল আন্তরিকতায় ভরপুর সামাজিক বন্ধন ছিল অনেক বেশি।
ড.
মাহবুবুর রাজ্জাক, অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
শাহরুখের ব্যাপারে সাবধান করলেন জুহি চাওলা
বলিউড বাদশা শাহরুখ খান। অভিনয় গুণে কোটি কোটি ভক্তের হৃদয়ে দোলা দিয়েছেন তিনি। দীর্ঘ অভিনয় ক্যারিয়ারে যশ-খ্যাতি যেমন পেয়েছেন, তেমনি আয় করেছেন মোটা অঙ্কের অর্থও। রবিবার (২ নভেম্বর) ৬০ বছর পূর্ণ করে একষট্টিতে পা দেবেন এই তারকা।
অভিনয় ক্যারিয়ারে অনেক নায়িকার সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয় করেছেন শাহরুখ খান। তাদের মধ্যে অন্যতম জুহি চাওলা। ‘রাজু বান গায়া জেন্টলম্যান’, ‘রামজানে’, ‘ডর’, ‘ইয়েস বস’, ‘ডুপ্লিকেট’সহ আরো কিছু জনপ্রিয় সিনেমা উপহার দিয়েছেন এই জুটি। একসঙ্গে অভিনয় ছাড়াও, এই দুই তারকা বাস্তব জীবনে খুবই ভালো বন্ধু। কেবল তাই নয়, ব্যবসায়ীক অংশীদারও তারা।
আরো পড়ুন:
শাহরুখের অজানা এই সাত তথ্য জানেন?
পাকিস্তানের সন্ত্রাসী তালিকায় সালমান খান কেন?
বন্ধু শাহরুখের জন্মদিন উপলক্ষে হিন্দুস্তান টাইমসের সঙ্গে কথা বলেছেন জুহি। এ আলাপচারিতায় স্মৃতিচারণ তো করেছেনই, পাশাপাশি শাহরুখের বিষয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছেন এই অভিনেত্রী।
শাহরুখের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের বিষয়ে জুহি চাওলা বলেন, “আমি যখন প্রথম ‘রাজু বান গায়া জেন্টলম্যান’ সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হই, তখন সহপ্রযোজক বিবেক ভাসওয়ানি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার নায়ক দেখতে আমির খানের মতো।’ আমি শাহরুখকে দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। দেখি, শাহরুখের চুল চোখের ওপরে নেমে এসেছে। আর সে একেবারেই আমার কল্পনার সেই ‘চকলেট বয়’ নয়! যখন কাজ শুরু করি, তখন বুঝতে পারি, সে একদম নতুন অভিনেতাদের মতো নয়, সে পরিশ্রমী, দিনে তিন শিফটে কাজ করছে।”
একটি ঘটনা বর্ণনা করে জুহি চাওলা বলেন, “আমার মনে আছে, ‘ইয়েস বস’ সিনেমার শুটিংয়ের সময়, কোনো দৃশ্য ঠিকমতো লেখা না থাকলে পরিচালক আজিজজি (আজিজ মির্জা) বলতেন, ‘শাহরুখ আসুক, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ রোমান্স আর মজার মিশেলে থাকা দৃশ্যগুলো আমাদের সবচেয়ে ভালো ছিল। সেই সূত্রেই আমরা অনেকগুলো সিনেমায় একসঙ্গে কাজ করেছি।”
শাহরুখের পাশে অবস্থান করলে সাবধান থাকার কথার কথা বলেছেন জুহি। হাসতে হাসতে এ অভিনেত্রী বলেন, “শাহরুখের আশেপাশে থাকলে সাবধানে থাকবেন। কারণ সে কথা দিয়ে আপনাকে যেকোনো কিছু করাতে রাজি করিয়ে ফেলতে পারে। ওর কথাবলার ভঙ্গি এমন যে, আপনি ‘না’ বলতেই পারবে না। আমি ‘ডুপ্লিকেট’ সিনেমা করতে চাইছিলাম না, কারণ সেখানে আমার তেমন কিছু করার ছিল না। আমরা তখন আরেকটি সিনেমার শুটিং করছিলাম, আর শাহরুখ আমাকে সিঁড়িতে বসিয়ে দুই ঘণ্টা বোঝায় এবং আমি সিনেমাটিতে চুক্তিবদ্ধ হই। সে আপনাকে যেকোনো কিছু করতে রাজি করাতে পারে, তাই সাবধানে থাকবেন।”
শাহরুখ খানের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়ে জুহি চাওলা বলেন, “অফস্ক্রিনে আমাদের সম্পর্কেও উত্থান-পতন রয়েছে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা কোনো না কোনোভাবে আমাদের যুক্ত রেখেছেন, এমনকি আইপিএলের মাধ্যমেও। আমাদের বন্ধন কোনো পরিকল্পনার ফল নয়, এটা একেবারেই ভাগ্যের ব্যাপার।”
শাহরুখ খানের সঙ্গে আইপিএল দল কলকাতা নাইট রাইডার্সের (কেকেআর) সহ-মালিক জুহি ও তার স্বামী জয় মেহতা। এই দলের পেছনে জুহি বিনিয়োগ করেছেন ৬২৯ কোটি রুপি। বর্তমানে এই দলটির মূল্য আছে ৯ হাজার ১৩৯ কোটি রুপি। শাহরুখ খানের সঙ্গে ‘রেড চিলিস গ্রুপ’ প্রতিষ্ঠা করেন জুহি।
১৯৬৫ সালে ২ নভেম্বর ভারতের নয়াদিল্লিতে এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শাহরুখ খান। তার শৈশবের প্রথম পাঁচ বছর কেটেছে ম্যাঙ্গালুরুতে। শাহরুখের দাদা ইফতিখার আহমেদ স্থানীয় পোর্টের প্রধান ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। যার কারণে সেখানে বসবাস করেন তারা। শাহরুখের বাবার নাম তাজ মোহাম্মদ খান, মা লতিফ ফাতিমা।
দিল্লির হংসরাজ কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন শাহরুখ খান। তারপর জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়াতে গণযোগাযোগ বিষয়ে মাস্টার্সে ভর্তি হন। কিন্তু অভিনয় জীবন শুরু করার কারণে পড়াশোনা ছেড়ে দেন তিনি। তবে বলিউডে ক্যারিয়ার শুরুর দিকে দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা-তে ভর্তি হন এই শিল্পী।
১৯৯২ সালে ‘দিওয়ানা’ সিনেমার মাধ্যমে বলিউডে পা রাখেন শাহরুখ খান। রোমান্টিক ঘরানার এ সিনেমায় অভিনয় করে নজর কাড়েন তিনি। সিনেমাটিতে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের কারণে সেরা নবাগত অভিনেতা হিসেবে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার লাভ করেন শাহরুখ।
একই বছর ‘চমৎকার’, ‘দিল আসনা হে’ ও ‘রাজু বান গায়া জেন্টলম্যান’ সিনেমায় অভিনয় করেন শাহরুখ। তার পরের বছর ‘ডর’ ও ‘বাজিগর’ সিনেমায় অভিনয় করে নিজের জাত চেনান শাহরুখ। তার অভিনয়ের জাদুতে মুগ্ধ হন কোটি ভক্ত; পৌঁছে যান সাফল্যের চূড়ায়। তার অভিনয়ের খ্যাতি আরো বাড়তে থাকে যশরাজ ফিল্মসের সিনেমায় ধারাবাহিকভাবে অভিনয় করে। একের পর এক হিট সিনেমা দিয়ে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে অবস্থান করেন শাহরুখ। যদিও তার এই সফলতার জার্নির গল্প মোটেও সহজ ছিল। আর সে গল্প সবারই জানা।
অভিনয় ক্যারিয়ারে অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন শাহরুখ খান। তার মধ্যে মোট পনেরোবার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি। এর মধ্যে আটবার সেরা অভিনেতা হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। হিন্দি সিনেমায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০০২ সালে তাকে পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত করে ভারত সরকার। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি গ্রহণ করেছেন মোট পাঁচবার। তবে শাহরুখ খানের ৩৩ বছরের অভিনয় ক্যারিয়ারে অধরা ছিল জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। চলতি বছর ‘জওয়ান’ সিনেমার জন্য সেরা অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন শাহরুখ।
ঢাকা/শান্ত