ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলীয় জনপদের জীবন ও সম্পদ সুরক্ষায় ঢাল হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় সুন্দরবন। এ বন খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার হাজার হাজার মানুষের জীবন ও জীবিকারও উৎস। সে কারণে সুন্দরবনকে পরিবেশকর্মীরা মহাপ্রাণ বলেন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর প্রকল্প, অপরিকল্পিত পর্যটনসহ সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া প্রভাবশালী ব্যক্তিরা আগুন দিয়েও সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকায় ক্ষতিসাধন করে চলেছেন।

এ বাস্তবতায় সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য বন বিভাগ জুন-আগস্ট পর্যন্ত তিন মাস বনটিতে প্রবেশে যে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আসছে, সেটাকে আমরা স্বাগত জানাই। কেননা, মানুষের পদচারণ ও সম্পদ আহরণের কারণে সারা বছর বনটির দেহে যে বিপুল ক্ষত সৃষ্টি হয়, বর্ষা মৌসুমের তিন মাস তা উপশমের একটা সুযোগ পায়।

আমলাতান্ত্রিক চিন্তানির্ভর বাংলাদেশের যেকোনো সরকারি উদ্যোগের প্রধান সমস্যাটি তৈরি হয় তার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে। কেননা, কোনো মন্ত্রণালয় যখন একটা সিদ্ধান্ত নেয়, তখন এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা শুধু নিজেদের বৃত্তের মধ্যেই চিন্তা করে; সামগ্রিকভাবে নয়। ফলে পরিবেশ মন্ত্রণালয় যখন সুন্দরবনে প্রবেশে তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তখন এই বনের ওপর নির্ভরশীল বনজীবী, যেমন জেলে, মৌয়ালরা কীভাবে টিকে থাকবেন, সেই ভাবনা অনুপস্থিত। ফলে বনজীবী পরিবারগুলো নিষেধাজ্ঞার তিন মাস কীভাবে জীবনধারণ করবে, সেই ব্যবস্থা না করলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষার অতি দরকারি উদ্যোগটিও ব্যর্থ হতে পারে।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, এ নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের ৫০ হাজারের বেশি বনজীবী ও ট্রলারচালক বেকার হয়ে পড়বেন। গত কয়েক বছরের চিত্র হচ্ছে, এ সময়ে সুন্দরবন–লাগোয়া পল্লিগুলোয় তীব্র অভাব দেখা যায়। ফলে অনেক পরিবারকেই অর্ধাহারে–অনাহারে মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়।

প্রকৃতি-পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় এ রকম বিধিনিষেধ দেওয়াটা স্বাভাবিক। ইলিশ সুরক্ষায় যেমন ৬৫ দিন মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা দেওয়া আছে; এই নিষেধাজ্ঞার সময় আমরা দেখি তালিকাভুক্ত জেলে পরিবারগুলোকে ৮০ কেজি করে চাল সহায়তা দেওয়া হয়। ফলে নিষেধাজ্ঞা দিলে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকে সহায়তা দেওয়ার দৃষ্টান্ত তো আছেই। সুন্দরবনের ক্ষেত্রে সেই দৃষ্টান্ত কেন অনুসরণ করা হলো না?

বন বিভাগ জানাচ্ছে, বেকার জেলেদের জন্য তারা খাদ্যসহায়তা চেয়ে দুই বছর আগে চিঠি দিয়েছে। মৎস্য বিভাগ জেলেদের তালিকাও তৈরি করেছে। প্রশ্ন হলো, এবার ১ জুনের আগেই কেন এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এটা প্রান্তিক মানুষের প্রতি আমলাতন্ত্রের অবহেলার একটা চাক্ষুষ দৃষ্টান্ত।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: জ বব চ ত র য স ন দরবন র পর ব শ বনজ ব

এছাড়াও পড়ুন:

এক দশকে ১ লাখ হেক্টর বনভূমি কমেছে 

দেশে এক দশকে বনভূমি হ্রাস পেয়েছে ১ লাখ ১ হাজার হেক্টর, যা ঢাকা শহরের আয়তনের প্রায় সাড়ে তিন গুণ। গত এক দশকে দেশ থেকে হারিয়ে গেছে ৬৪ প্রজাতির গাছ।

সারা দেশে বনাঞ্চলে যে পরিমাণ গাছ আছে, গ্রামাঞ্চলে গাছের সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। তবে গ্রামে গাছের ঘনত্ব কম। আর বন উজাড় বেশি হয়েছে পার্বত্যাঞ্চলে। সেখানে একমুখী প্রজাতির ফসল চাষের প্রসার ও সড়ক সম্প্রসারণের কারণে বন উজাড় হচ্ছে।

বনের সার্বিক চিত্র জানতে ২০২৪ সালে বন অধিদপ্তরের করা জাতীয় বন জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। জরিপটি প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।

পার্বত্য অঞ্চলে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। সেটাকে মাথায় রেখে আমরা একটা পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছি। বান্দরবানের লামা অঞ্চল দিয়ে ফরেস্ট রিস্টোরেশনের (বন পুনরুদ্ধার) কাজ শুরু করব আমরা।সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, উপদেষ্টা, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় 

২০১৫ সালে জাতীয় বন জরিপে বন আচ্ছাদনের পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ৭৬ শতাংশ, সেটি এখন কিছুটা হ্রাস পেয়ে ১২ দশমিক ১১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক বন জরিপে দেশে বনভূমি আছে ১৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর। আগের বন জরিপে যেটির পরিমাণ ১৮ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর।

জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পার্বত্য অঞ্চলে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। সেটাকে মাথায় রেখে আমরা একটা পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছি। বান্দরবানের লামা অঞ্চল দিয়ে ফরেস্ট রিস্টোরেশনের (বন পুনরুদ্ধার) কাজ শুরু করব আমরা।’

‘জীববৈচিত্র্য রক্ষা, অবক্ষয়িত বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা’র আহ্বান জানিয়ে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ দিবস। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৭২ সালে এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক দিবসের মর্যাদা দেয়।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ফাওয়ের তথ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিকভাবে বন উজাড়ীকরণের হার ১ দশমিক ১ শতাংশ হলেও বাংলাদেশে সেটি ২ দশমিক ৬ শতাংশ।

বন অধিদপ্তরের ২০টি দল মাঠপর্যায়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ শুরু করে ২০২৪ সালের মার্চে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে তাদের তথ্য সংগ্রহ শেষ হয়। উপকূলীয় বন, শালবন, সুন্দরবন, পার্বত্যাঞ্চল ও গ্রামীণ এলাকায় মোট ১ হাজার ৮৫৮টি নমুনা প্লটের ভিত্তিতে এ জরিপের ফলাফল নির্ধারণ করা হয়েছে।

জরিপে দেশে প্রতি হেক্টরে গাছের ঘনত্ব পাওয়া গেছে ১১৭টি। সবচেয়ে বেশি গাছের ঘনত্ব আছে সুন্দরবনে। এখানে গাছের ঘনত্ব প্রতি হেক্টরে ৭০২টি। বনাঞ্চলের চেয়ে গ্রামীণ এলাকায় গাছের ঘনত্ব কম হলেও মোট গাছের পরিমাণ বেশি। গ্রামীণ এলাকায় মোট গাছের সংখ্যা প্রায় ৯০ কোটি।

২০১৫ সালের বন জরিপে গাছের সংখ্যা ছিল ১৬৯ কোটি। সাম্প্রতিক জরিপে সেটা কিছুটা কমে হয়েছে ১৫৭ কোটি। গত এক দশকে হ্রাস পাওয়া গাছের সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি। জরিপে সারা দেশে ৩২৬টি গাছের প্রজাতি শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২৪২টি প্রজাতি পাওয়া গেছে পার্বত্যাঞ্চলে। সুন্দরবনে পাওয়া গেছে ২২ প্রজাতির গাছ। এর আগে বন জরিপে (২০১৫) ৩৯০ প্রজাতির গাছ শনাক্ত করেছিল বন অধিদপ্তর। গত এক দশকে হারিয়ে গেছে ৬৪ প্রজাতির বৃক্ষ।

কেন কমছে পার্বত্যাঞ্চলের বন

২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ডারউইন ইউনিভার্সিটি পরিচালিত এক গবেষণায় পার্বত্যাঞ্চল বাংলাদেশের মোট বন আচ্ছাদনের ৪০ শতাংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে দ্রুত প্রসার ঘটছে অর্থকরি ফলের চাষ (হর্টিকালচার) ও একমুখী প্রজাতির বনায়ন (মনোকালচার), যেমন রাবারবাগান।

জানতে চাইলে জাতীয় বন জরিপের সঙ্গে যুক্ত থাকা বন অধিদপ্তরের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (সদ্য অবসরপ্রাপ্ত) জহির ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে বৈধ ও অবৈধভাবে বন উজাড় হয়ে আসছে। এখানে একদিকে বন উজাড় হচ্ছে, অন্যদিকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কারণে বনায়ন করা যায় না। যার কারণে এখানে বনভূমি হ্রাস পাওয়ার পরিমাণ বেশি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অধ্যাপক কামাল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে বন বিভাগ কিছু করতে পারে না। পাহাড়িরা কিছু গামার আর সেগুনগাছের বাগান করেন। পুরো পার্বত্য অঞ্চলে সড়ক সম্প্রসারণ হয়েছে গত কয়েক দশকে। যেমন সীমান্ত রোড হয়েছে।

কামাল হোসাইন বলেন, এ ছাড়া এখানে বিনোদনকেন্দ্র ও রিসোর্টের সংখ্যা বাড়ছে। এটা একটা দিক। অন্যদিকে অনেক প্রভাবশালী এখন ড্রাগন, কাজু ও আমের চাষ করছেন প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে। এ অঞ্চলের বনের ওপর বহুমুখী চাপের কারণে এখানে বনাঞ্চল হ্রাস পাওয়ার হার অন্যান্য অঞ্চল থেকে বেশি।

কামাল হোসাইন আক্ষেপ করে বলেন, ‘কেউ বনকে ভালোবাসে না। মানুষের লোভের শিকার হয়েছে এখানকার প্রাকৃতিক বন। এটাই আমাদের সর্বনাশ করেছে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বাঘ রক্ষায় সুন্দরবনের চারপাশে হবে সুরক্ষাবলয়: পরিবেশ উপদেষ্টা
  • চোরা শিকারিদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি প্রয়োগের আহ্বান উপদেষ্টার 
  • বাঙালির বাঘ সংস্কৃতি: ‘যে বনে বাঘ নেই সে বনে শিয়ালই রাজা!’
  • বাঘ বাঁচলে সুন্দরবন বাঁচবে
  • পাচারকারীসহ আরও কিছু কারণে হুমকির মুখে সুন্দরবনের বাঘ
  • এক দশকে ১ লাখ হেক্টর বনভূমি কমেছে