গাজায় ত্রাণকেন্দ্রে আবার ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি হামলায় ২৭ জন নিহত
Published: 3rd, June 2025 GMT
গাজায় আবার ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের ওপর নৃশংসভাবে গুলি চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। গাজার দক্ষিণাঞ্চলে আজ মঙ্গলবার আবার একটি ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রের কাছে তাদের নির্বিচার গুলিতে অন্তত ২৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েক ডজন মানুষ। গাজার স্বাস্থ্য বিভাগ এ তথ্য জানিয়েছে।
ইসরায়েলি বাহিনী দাবি করেছে, রাফার একটি ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রের কাছে নির্ধারিত চলাচলের পথ ছেড়ে চলে যাওয়া কিছু লোককে লক্ষ্য করে তারা গুলি চালিয়েছে। এ ঘটনার তদন্ত এখনো চলছে।
এর আগে গত রোববার ফিলিস্তিনি ও আন্তর্জাতিক কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, গাজায় ত্রাণ নিতে গিয়ে হামলার শিকার হয়ে কমপক্ষে ৩১ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং বহু মানুষ আহত হয়েছেন। গতকাল সোমবার আরও তিনজন ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার খবর আসে।
আজ মঙ্গলবার ত্রাণকেন্দ্রে ফিলিস্তিনিদের হতাহতের ঘটনার কয়েক ঘণ্টা আগেই ইসরায়েল জানিয়েছিল, উত্তর গাজায় লড়াই চলাকালে তাদের তিনজন সেনা নিহত হয়েছেন।
হামাসের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি অভিযানের অংশ হিসেবে ইসরায়েল গাজায় নির্বিচার ও নৃশংসভাবে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের হামলায় ইতিমধ্যে গাজার বড় অংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে।
রয়টার্স স্বাধীনভাবে উত্তর ও দক্ষিণ গাজার এসব প্রতিবেদন যাচাই করতে পারেনি।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সমর্থিত বিতর্কিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) গত সপ্তাহে তাদের প্রথম ত্রাণ বিতরণকেন্দ্র চালু করেছে। যুদ্ধে বিধ্বস্ত গাজার বেশির ভাগ মানুষই ইতিমধ্যে নিজের ঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন।
জিএইচএফ জাতিসংঘসহ সেখানে কাজ করা আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলোকে পাশ কাটিয়ে গাজায় ত্রাণ বিতরণ করছে। জাতিসংঘসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত সাহায্য সংস্থাগুলো তাদের এই কর্মকাণ্ডের তীব্র সমালোচনা করেছে। তারা বলছে, এই পদ্ধতি আন্তর্জাতিক মানবিক নীতিমালা অনুযায়ী নয়।
তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সমর্থিত এই বেসরকারি গোষ্ঠী বলেছে, তারা মঙ্গলবার সকালেই ২১টি ট্রাকে করে খাবার বিতরণ করেছে এবং এ বিতরণকাজ ‘নিরাপদ ও নির্বিঘ্নে’ হয়েছে।
তবে রাফা এলাকায় ত্রাণ নেওয়ার জন্য ভিড় করার সময় আবারও হতাহতের খবর পাওয়া গেছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তারা ত্রাণ নিতে আসা সাধারণ মানুষের ওপর লক্ষ্য করে গুলি চালায়নি। গত রোববারের হত্যাকাণ্ডকে তারা ‘হামাসের পাতানো গল্প’ বলে দাবি করেছে।
ত্রাণকেন্দ্রে শিশুদের ওপর নির্বিচার গুলি চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। হাসপাতালে আহত শিশু। ৩ জুন, আল–নসর হাসপাতাল.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল ব তরণক র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
গাজায় ত্রাণ বিতরণকেন্দ্র আসলে ইসরায়েলের মারণকল
যখন কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়, তখন তা শুধু ক্ষুধার নয়, বরং সমাজের ভাঙনেরও প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। এ অবস্থায় মানুষ আবর্জনার স্তূপ থেকে খাবার খুঁজে আনে। কেউ গোপনে রান্না করে; কেউ আত্মীয়দের থেকে খাবার লুকিয়ে রাখে, কোনো পরিবার হয়তো খাবারের জন্য তাদের দাদিমার গয়না বিক্রি করে দেয়।
দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মুখে কোনো অনুভূতি থাকে না। তাদের চোখে থাকে ফাঁপা দৃষ্টি। মানুষ পশুর মতো খাবারের জন্য লড়াই করে। এটিই হলো সামাজিক অবক্ষয় ও অপমানের চরম রূপ। এটিই হলো মানবিক মর্যাদার বিলোপ। এ অবস্থার মধ্য দিয়ে আজকের গাজাবাসী যাচ্ছে।
গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন বা জিএইচএফ নামে একটি নতুন সংস্থা (যেটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সমর্থনে মে মাসে যাত্রা শুরু করে) নিজেদের কার্যক্রমকে একুশ শতকের আধুনিক ও সহানুভূতিশীল সংস্থা বলে দাবি করছে। তারা বলছে, তাদের চারটি ‘নিরাপদ বিতরণ কেন্দ্র’ থেকে তারা প্রতিদিন ২০ লাখের বেশি প্যাকেট খাবার বিতরণ করছে। সেখানকার ছবিতে দেখা যায়, বাচ্চাদের হাতে খাবার তুলে দিচ্ছেন সংস্থার কর্মীরা।
আমরা গাজায় যা দেখছি, সেটি কেবল ক্ষুধা নয়, বরং একটি সমাজকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া। ইসরায়েলি সরকার আদৌ চিন্তিত নয় যে ফিলিস্তিনিরা বাঁচবে, নাকি মরবে। তারা শুধু গণহত্যা ও দুর্ভিক্ষের অভিযোগ এড়াতে চায়। আর সেই ছদ্মাবরণ হিসেবে জিএইচএফ এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র চোখে ধুলো দেওয়ার যে চেষ্টা চালাচ্ছে, আমরা যেন তা বুঝতে পারি।ইসরায়েলি মুখপাত্ররা বলছেন, জাতিসংঘের ট্রাকগুলো গাজার সীমানার ভেতরে আছে কিন্তু জাতিসংঘ নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে খাবার বিতরণ করছে না। কিন্তু এ বক্তব্য খুব সহজ বিশ্লেষণেই ভেঙে পড়ে।
প্রথমত, সংখ্যা ঠিক মিলছে না। গত এপ্রিল মাসে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা হিসাব করে জানায়, ১৮ মাসের অবরোধ ও যুদ্ধের পর এবং দুই মাসের পূর্ণ ইসরায়েলি অবরোধের ফলে মে থেকে জুলাইয়ের মধ্যে গাজায় জীবন বাঁচানোর জন্য যে পরিমাণ খাবার দরকার, তার অর্ধেকের নিচে নেমে যাবে। অর্থাৎ গাজার সব মানুষের খাদ্যের পুরো চাহিদা পূরণ করতে হবে এই ত্রাণ কার্যক্রমের মাধ্যমে। কিন্তু প্রতিদিনের ২০ লাখ প্যাকেট খাবার গাজার প্রয়োজনের অর্ধেকও নয়।
আরও পড়ুনইসরায়েল কেন গাজায় অস্ত্রধারী গুন্ডা পোষে ১১ জুন ২০২৫দ্বিতীয়ত, শুধু সংখ্যায় খাবার পৌঁছালেই দুর্ভিক্ষ বন্ধ হয় না; দুর্ভিক্ষ আঘাত করে সবচেয়ে দুর্বল মানুষগুলোর ওপর। জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী, যখন ২০ শতাংশ পরিবার মারাত্মক খাদ্যসংকটে পড়ে, তখন সেটিকে ‘দুর্ভিক্ষ’ বলা যায়। এ অবস্থায় নারীরা, বিশেষ করে যাঁদের স্বামী নেই এবং যাঁদের অনেক শিশু বা বয়স্ক অভিভাবক আছেন, তাঁরাই সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকেন। সেসব পরিবারকে চিনে ত্রাণ পৌঁছানোই আসল কাজ।
জিএইচএফ গাজায় চারটি বিতরণ কেন্দ্র চালায়—তিনটি রাফার ধ্বংসস্তূপে, আরেকটি গাজার মাঝখানে। সব কটিই সামরিক এলাকায়। এরা খুব অল্প সময়ের জন্য এবং খাবার বিতরণের খুব অল্প আগে সবাইকে জানিয়ে খোলে। মানুষ ধ্বংসস্তূপে শিবির করে বসে থাকে, কখন দরজা খুলবে সেই আশায়। তারা জানে, ইসরায়েলি সেনারা ভিড় সামলাতে গুলি চালাতে দ্বিধা করে না। যেসব দুর্বল মা, বয়স্ক মানুষ বা প্রতিবন্ধী এই দৌড়ে অংশ নিতে পারেন না, তাঁরা কীভাবে খাবার পাবেন?
আরও পড়ুনইসরায়েল এখন শেষ সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো১২ এপ্রিল ২০২৫তৃতীয়ত, মানুষের বাস্তব প্রয়োজন অনুযায়ী ত্রাণ দেওয়া দরকার। যেমন অপুষ্ট শিশুদের জন্য দরকার বিশেষ ধরনের খাবার (যেমন ‘প্লাম্পিনাট’, যা সাধারণ খাবার খেতে না পারা শিশুর জন্য তৈরি) দেওয়া দরকার। কিন্তু জিএইচএফের বক্সে থাকে ময়দা, পাস্তা, তেল, চাল, ডাল, তাহিনি (তিলবীজ থেকে তৈরি একধরনের মাখনবিশেষ)। জিএইচএফের ত্রাণের মধ্যে কোনো শিশুখাদ্য বা প্লাম্পিনাট নেই। কোনো প্রশিক্ষিত নার্স বা পুষ্টিবিদও নেই, যাঁরা অপুষ্ট শিশুদের সেবা দিতে পারেন।
আমরা গাজায় যা দেখছি, সেটি কেবল ক্ষুধা নয়, বরং একটি সমাজকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া। ইসরায়েলি সরকার আদৌ চিন্তিত নয় যে ফিলিস্তিনিরা বাঁচবে, নাকি মরবে। তারা শুধু গণহত্যা ও দুর্ভিক্ষের অভিযোগ এড়াতে চায়। আর সেই ছদ্মাবরণ হিসেবে জিএইচএফ এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র চোখে ধুলো দেওয়ার যে চেষ্টা চালাচ্ছে, আমরা যেন তা বুঝতে পারি।
● অ্যালেক্স ডি ওয়াল যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের টাফ্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্ল্ড পিস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক
দ্য গার্ডিয়ান, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত