গ্রেপ্তারের সময় পরিবারের একজনকে প্রত্যক্ষদর্শী রাখা, জবানবন্দির সময় আইনজীবীর উপস্থিতিসহ নানা প্রস্তাব
Published: 3rd, June 2025 GMT
গ্রেপ্তারের সময় অভিযুক্ত ব্যক্তির পরিবারের একজনকে প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে রাখা, আসামিপক্ষের আইনজীবীর উপস্থিতিতে জবানবন্দি রেকর্ড করা, ৬০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করা, মামলার আগে প্রাথমিক তদন্ত করা, গ্রেপ্তারের পর অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অন্য কোথাও না রেখে শুধু থানায় রাখাসহ ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধনের প্রাথমিক খসড়ার বিভিন্ন প্রস্তাবের পক্ষে-বিপক্ষে মতামত দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলেছেন, প্রস্তাবিত খসড়ায় অনেক বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। সেগুলো চূড়ান্ত করতে হবে।
মঙ্গলবার রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে আয়োজিত ‘কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর (সংশোধন) অর্ডিন্যান্স-২০২৫’-এর খসড়া নিয়ে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় আইনজীবী, আইনের শিক্ষক, পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পেশার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা নিজেদের মত তুলে ধরেন। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করে।
খসড়া অনুযায়ী বেত্রাঘাতের বিধান বাতিল করার ভাবনাকে স্বাগত জানান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সারা হোসেন। তিনি বলেন, ‘এখানে যেসব চেঞ্জ (সংশোধন) নিয়ে কথা হচ্ছে, সেগুলো যথাযথভাবে করা গেলে আমি মনে করি, গত ২৫ বছরে যে পরিবর্তনের জন্য আমরা অপেক্ষা করছি, সেটা আমরা পেয়ে যাব।’
অ্যাটর্নি জেনারেল মো.
জিজ্ঞাসাবাদের সময় অভিযুক্ত ব্যক্তির আইনজীবীর উপস্থিতি থাকার সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে কথা বলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মো. তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, পুলিশ অ্যাক্ট, প্রিজন্স অ্যাক্ট, প্রিজনার্স অ্যাক্ট এবং জেল কোড ইত্যাদির ভেতর থেকে ঔপনিবেশিকতা বাদ দিতে হবে।
অভিযুক্ত ব্যক্তির জবানবন্দি নিয়ে সমস্যা হচ্ছে উল্লেখ করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিশির মনির বলেন, আসামির জবানবন্দি রেকর্ড করার সময় আইনজীবীর উপস্থিতি ও অডি-ভিডিও রেকর্ড করা উচিত। ভারত তাঁদের সিআরপিসিতে ইতিমধ্যে এটা যুক্ত করেছে। যদি কোনো অভিযুক্ত চান তাঁর আইনজীবীর উপস্থিতিতে জবানবন্দি নিতে হবে। একা একা গোপনে ম্যাজিস্ট্রেটের কক্ষে নেওয়া যাবে না।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, গ্রেপ্তারের সময় অভিযুক্ত ব্যক্তির পরিবার থেকে অন্তত একজনকে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু আসামি গ্রেপ্তারের সময় এটা অনুসরণ করা কঠিন হবে। এটা করতে গেলে অনেক সময় আসামির পালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সিআরপিসি সংশোধনের খসড়ার বিভিন্ন বিষয়ের ওপর মত দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান মিলন, পাবলিক প্রসিকিউটর মো. ওমর ফারুক ফারুকী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এহসান এ সিদ্দিকী, ব্যারিস্টার তানিম হোসেন শাওনসহ বেশ কয়েকজন।
মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল।
সরকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আইন সংস্কারের মাধ্যমে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইতিমধ্যে শতাধিক বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কার প্রস্তাব চিহ্নিত করা হয়েছে এবং এগুলোর বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।
আসিফ নজরুল বলেন, ‘আইনের এমন সংস্কার করতে সরকার কাজ করছে যেন আরেকটি ফ্যাসিবাদ গড়ে ওঠা কঠিন হয়ে ওঠে। তাদের (স্বৈরশাসকদের) জন্য আইন যতটা সম্ভব কঠিন করে যেতে চাই।’
আইনের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘অনেকে বলেন সংস্কার হচ্ছে না। আমরা এমন কাজ করেছি, যা কেউ কখনো করেনি। অনেক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এসব কাজের প্রশংসা করেছেন। এমনকি সমালোচকেরাও সাইবার সুরক্ষা আইন সংশোধনের প্রশংসা করেছেন।’ উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘অনেকের অনুরোধে আমরা পাওয়ার অব অ্যাটর্নির বিধান পরিবর্তন করেছি, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করেছি। এ কাজ করতে গিয়ে বাধা এসেছিল। অথচ যাঁরা তখন প্রতিবাদ করেছিলেন, এখন তাঁরা এসে বলেন ভালো হয়েছে।’
বিয়ের আশ্বাসে ধর্ষণ বিষয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘অনেক সুশিক্ষিত মানুষ প্রশ্ন তুলেছেন, এটা আলাদা অপরাধ কেন? এটা প্রতারণার জায়গায় ছিল, যার শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। এটাকে আমরা আলাদা করে ফেলেছি। আর ভয়ংকর যে ধর্ষণের ঘটনা, সেটাকে আমরা দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করেছি।’
সংস্কার চলমান থাকবে উল্লেখ করে আসিফ নজরুল বলেন, ‘মতবিনিময় সভায় যেসব গঠনমূলক পরামর্শ এসেছে, তা বিবেচনায় নিয়ে আইনটি সংশোধন করা হবে।’ মামলার জট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সবাই বলেন মামলার জট কমাতে হবে। আমরা সেদিকেই কাজ করছি। লিগ্যাল সার্ভিস অ্যাক্টে বড় পরিবর্তন আনছি। সেখানে একটা বিধান করা হবে, যাতে ছোটখাটো অপরাধ, পারিবারিক বিরোধ বা মীমাংসাযোগ্য মামলা আগে মধ্যস্থতায় যেতে হবে। মধ্যস্থতায় যাওয়ার পর আদালতে আসতে পারবে।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আইনজ ব র উপস থ ত গ র প ত র র সময় র আইনজ ব প রস ত ব ক জ কর উল ল খ তদন ত র আইন
এছাড়াও পড়ুন:
এনায়েত করিম ও গোলাম মোস্তফা পাঁচ দিন রিমান্ডে
রাজধানীর রমনা থানায় করা সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক এনায়েত করিম চৌধুরী ওরফে মাসুদ করিম ও এস এম গোলাম মোস্তফা আজাদকে পাঁচ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দিয়েছেন আদালত।
পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট সারাহ ফারজানা হক আজ বুধবার এ আদেশ দেন।
প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী।
পিপি ওমর ফারুক ফারুকী প্রথম আলোকে বলেন, সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত এনায়েত করিম চৌধুরী ও এস এম গোলাম মোস্তফাকে আদালতে হাজির করে সাত দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার আবেদন করে পুলিশ। আসামিপক্ষ থেকে জামিনের আবেদন করা হয়। উভয় পক্ষের শুনানি নিয়ে আদালত মাসুদ ও মোস্তফাকে পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এর আগে এনায়েত করিম ওরফে মাসুদ করিমকে গত সোমবার দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বলা হয়, এনায়েত করিম চৌধুরী ওরফে মাসুদ করিম মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। বাস্তবে তিনি র-এর (ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা) এজেন্ট। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল করার মিশন নিয়ে তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। বর্তমান সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত। তাঁর দুটি মুঠোফোন জব্দ করা হয়েছে। সেটির ফরেনসিক পরীক্ষা করা হলে তাঁর ষড়যন্ত্রের বিষয়ে আরও অনেক নতুন তথ্য জানা যাবে। এনায়েত করিম চৌধুরী ওরফে মাসুদ করিমসহ আর কারা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত, সেটি জানার জন্য তাঁকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা জরুরি।
অপরদিকে এনায়েত করিম চৌধুরীর পক্ষে তাঁর আইনজীবীরা আদালতের কাছে দাবি করেন, তিনি ৬ সেপ্টেম্বর দেশে এসেছেন, তাঁর আমেরিকায় ফিরে যাওয়ার কথা ১৪ সেপ্টেম্বর। তিনি বাংলাদেশে এসে গুলশানে অবস্থান করছিলেন।
এনায়েত করিম চৌধুরীর আইনজীবী ফারহান এমডি আরাফ বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে তাঁর মক্কেল কোনোভাবেই জড়িত নন। তিনি একজন মার্কিন নাগরিক। সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে তিনি কোনোভাবে যুক্ত নন।
এর আগে গত শনিবার এনায়েত করিম চৌধুরীকে (৫৫) সন্দেহভাজন হিসেবে আটকের পর ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত শনিবার সকালে রাজধানীর মিন্টোরোড থেকে এনায়েত করিম চৌধুরীকে আটক করা হয়। তাঁর কাছ থেকে জব্দ করা পাসপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, তিনি মার্কিন নাগরিক।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছে, এনায়েত করিম নিজেকে মাসুদ করিম নামে পরিচয় দেন। তিনি নিজেকে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের প্রধান বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। এই পরিচয়ে তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখান। ২০১৮ সালের ভোটের আগেও তিনি একাধিক রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে দেশের বাইরে বৈঠক করেন।
পুলিশ বলছে, গত শনিবার এনায়েত করিম চৌধুরী প্রাডো গাড়িতে করে মিন্টোরোড এলাকায় সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করছিলেন। গাড়ি থামিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে ওই এলাকায় ঘোরাঘুরি করার বিষয়ে সদুত্তর দিতে পারেননি। পরে তাঁকে আটক করে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠিয়ে ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। পাশাপাশি সোমবার রিমান্ড শুনানির দিন ধার্য করেন।
সংশ্লিষ্ট একজন পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এনায়েত করিম বলেছেন, বর্তমান সরকার পরিবর্তন করে নতুন জাতীয় সরকার গঠনে কাজ করতে তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। তাঁর দাবি, তিনি বিশেষ একটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার খুব নাজুক অবস্থায় আছে। সেনাবাহিনীর সঙ্গেও এই সরকারের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এই সুযোগে বর্তমান সরকারকে পরিবর্তন করতে বাংলাদেশে এসেছেন। সরকারি উচ্চ ও নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বলে জানিয়েছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করেছেন।