সংসদ ছাড়া বাজেট ও জবাবদিহির প্রশ্ন
Published: 4th, June 2025 GMT
বার্ষিক বাজেট গণতন্ত্রের একটি মৌলিক স্তম্ভ। স্বভাবতই এটি একটি রাজনৈতিক দলিল। বাজেট জনগণ থেকে প্রাপ্ত রাজনৈতিক সরকারের ম্যান্ডেট ও অগ্রাধিকার প্রতিফলিত করার কৌশল ও বাস্তবায়নকাঠামোর আর্থিক প্রতিবেদন। জাতীয় সম্পদ কীভাবে বণ্টিত হবে এবং এর দ্বারা কারা উপকৃত হবে, তার একটি নীলনকশা হচ্ছে বাজেট।
এ কারণেই সরকার বাজেট সংসদে উপস্থাপনের মাধ্যমে জনসমক্ষে তুলে ধরে। প্রতিটি দফা যাচাই-বাছাই ও কাটছাঁট করে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা জনগণের মৌলিক অধিকারের আইনি কাঠামো প্রদান করেন।
সংগত কারণেই জুলাই অভ্যুত্থান–পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারকে ২০২৫-২৬ সালের বাজেট প্রণয়নে ভিন্ন পথ বেছে নিতে হয়েছে। সংসদ না থাকায় সংবিধানের ৯৩ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বাজেটসংক্রান্ত আইনকাঠামো নিষ্পন্ন করা হবে। সংসদীয় বিতর্ক এবং ‘অনুদানের দাবির’ ওপর ভোট অনুপস্থিত থাকায় সরকার জনগণের মতামত চেয়েছে।
তবে অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ন্যূনতম জাতীয় ঐকমত্য স্থাপনের মাধ্যমে আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটি সুবর্ণ সুযোগ ছিল। তা হাতছাড়া হলো। এটি হলে যুগান্তকারী নজির তৈরি হতে পারত। ৯৩ (৩) বিধান ধারাবাহিকতা রক্ষার সুযোগ দেয়।
জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্যে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল। তা ধারণ করতে সরকার জনগণের সঙ্গে ‘অনুপস্থিত সংযোগ’ পূরণে অন্যান্য বিষয়ে যেমন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করছে, বাজেট বিষয়েও আলোচনা করতে পারত। এতে বিভাজনের বদলে রাজনৈতিক ঐকমত্য মজবুত হতো। বাজেট বিষয়ে বর্তমান সংবিধানের জনগণের সার্বভৌমত্ব ও কর্তৃত্ব স্থাপনবিষয়ক ঘাটতি রয়েছে। এ আলোচনা করতে পারলে সেই ঘাটতি পূরণে সংস্কারের রূপরেখাও অর্জিত হতো।
বাজেট রাজনৈতিক প্রক্রিয়াবাজেটে সংসদীয় নিয়ন্ত্রণের যাত্রা দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ। ১২১৫ সালে ‘ম্যাগনাকার্টা’ রাজার কর আরোপের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে সীমিত করেছিল। এটি সম্পূর্ণ প্রতিনিধিত্বমূলক না হলেও এতে ‘রাজ্যের সাধারণ পরামর্শের’ সম্মতির প্রয়োজন ছিল। যুক্তরাজ্যে ১৬৮৮-৮৯ সালের বিপ্লব সুদৃঢ় করেছিল কর ও ব্যয়ের ওপর সংসদের কর্তৃত্বকে। পরবর্তী সময়ে ‘প্রতিনিধিত্ব ছাড়া কর আরোপ নয়’, এই স্লোগান অষ্টাদশ শতাব্দীতে আমেরিকান বিপ্লবকে প্রজ্বলিত করেছিল। অর্থাৎ যতক্ষণ না নাগরিকদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে কর ধার্য হয় ও সেই কর ব্যয় করা, ততক্ষণ নাগরিকদের কর দিতে বাধ্য করা উচিত নয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে উদীয়মান বুর্জোয়া ও সামন্ত শাসকশ্রেণির মধ্যে দীর্ঘ সংগ্রামের পর ফ্রান্স আধুনিক বাজেটপদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করেছিল। ফলে জনগণের তথা রাষ্ট্রীয় অর্থের ওপর সংসদের নিয়ন্ত্রণ থাকা গণতান্ত্রিক অগ্রগতির একটি বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে নিশ্চিত হয় যে আইন প্রণয়নকারী পক্ষ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছে এবং রাজস্ব সংগ্রহ ও ব্যয়ের বিষয়েও তাদের চূড়ান্ত অধিকার আছে।
বাজেট–ব্যবস্থা ও জবাবদিহির ঘাটতিঅর্থমন্ত্রী প্রতি অর্থবছরের জন্য প্রজাতন্ত্রের আনুমানিক আয় ও ব্যয়ের বিবরণ তথা বার্ষিক আর্থিক বিবরণী সংসদে পেশ করেন। তা করা হয় সংবিধানের ৮৭ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী। ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া অর্থবছরের পুরো এক মাস আগে বিতর্কের সুযোগ তৈরি করতে এই দলিল সংসদে উপস্থাপিত হয়।
সংসদ সদস্যরা ‘অনুদানের দাবি’ অর্থাৎ মন্ত্রণালয়গুলোর প্রস্তাবিত ব্যয় যাচাই-বাছাই করেন। ৮৯ (২) অনুচ্ছেদমতে, বার্ষিক আর্থিক বিবরণীর ব্যয়সংক্রান্ত বিষয় দাবির আকারে সংসদে অনুমোদনের জন্য পেশ করা হয়। আর সংসদ অনুমোদন বা অননুমোদন বা উল্লিখিত অর্থের পরিমাণ হ্রাস করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত। এটি নিছক আমলাতান্ত্রিক আচার নয়। এটি জবাবদিহির মৌলিক নীতি। অর্থাৎ সরকার রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক (৭ [১] অনুচ্ছেদ) তথা জনগণের কাছ থেকে তহবিল ‘দাবি’ করছে।
সংসদ সদস্যগণ বরাদ্দ কমাতে ‘কাটছাঁট প্রস্তাব’ আনতে পারেন এবং অনুমোদন, কমানো বা বাতিলও করতে পারেন। ৮৮ অনুচ্ছেদের কিছু অ-ভোটযোগ্য ব্যয়ের তালিকা বাদে প্রতিটি ‘অনুদানের দাবি’ ভোটে উপস্থাপিত হয়। এটি নিশ্চিত করে যে জনগণের প্রতিনিধিরা প্রতিটি ব্যয় সরাসরি অনুমোদন করেন। প্রতিটি দাবি অনুমোদিত হওয়ার পর আইনি কাঠামোয় স্থায়ী রূপ পায়। ৮৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কর প্রস্তাব নির্ধারণকারী ‘অর্থ বিল’ নিয়ে বিতর্ক হয়ে পাস হলে নতুন কর আইন কার্যকর হয়। ৯০ (১) অনুচ্ছেদ অনুসরণে ‘সমন্বিত তহবিল’ থেকে অর্থ উত্তোলনের অনুমোদন দিতে ‘আর্থিক অনুমোদন বিল’ উত্থাপন করে পাস করা হয়।
বাজেট ‘অর্থবিল’ হওয়ায় সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হয় না। দলের বাইরে গিয়ে ভোট দেওয়ার সুযোগ না থাকায় দলের বাইরের প্রস্তাব যুক্ত করা কঠিন। সত্যিকারের বিতর্কের অভাব এবং অর্থবহ সংশোধনী প্রস্তাব করার অক্ষমতা সংসদীয় জবাবদিহিকে উল্লেখযোগ্যভাবে দুর্বল করে। সংসদীয় কমিটির সুপারিশগুলো প্রায়ই মন্ত্রণালয় দ্বারা বাস্তবায়িত হয় না।
এই পদ্ধতিগত দুর্বলতা আইন প্রণয়নকারী শাখার তদারকি করার ক্ষমতাকে সীমিত করে। অবাস্তব রাজস্ব পূর্বাভাস এবং পরিপূরক বাজেটের ওপর ঘন ঘন নির্ভরতার কারণে বাজেটের সামগ্রিক বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রায়ই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। পদ্ধতিগত দুর্বলতা, সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশের বাজেট–ব্যবস্থায় প্রকৃত জবাবদিহিকে দুর্বল করে। মৌলিক প্রশ্ন থেকেই যায় যে জাতীয় বাজেট কার জন্য, কেন এবং কীভাবে নির্ধারিত হয়?
অন্তর্বর্তীকালীন শাসনসংক্রান্ত রীতিনীতির অনুপস্থিতিঅন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ডিসেম্বর-জুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছে। একটি সাধারণ নির্বাচন আসন্ন। এবারের বাজেটের অর্থবছরে নির্বাচিত সরকার আসার সম্ভাবনা আছে। বাজেট অনুমোদনের পদ্ধতিতে অবিচ্ছিন্ন সরকারি সেবার প্রয়োজনের সঙ্গে গণতান্ত্রিক বৈধতার নীতির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন পন্থা থাকে। বাংলাদেশের বহাল সংসদীয় গণতন্ত্রে তা নেই।
ওয়েস্টমিনস্টার ঐতিহ্য অনুসরণকারী দেশ, যেমন কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ইত্যাদি ‘অন্তর্বর্তীকালীন শাসনসংক্রান্ত রীতিনীতি’ মেনে চলে। তাদের অলিখিত কিন্তু দৃঢ়ভাবে অনুসৃত নিয়মগুলো নির্দেশ করে যে নতুন ম্যান্ডেট নেই এবং দায়িত্ব ছেড়ে দেবে, এমন সরকার বড় ধরনের নীতি পরিবর্তন, উল্লেখযোগ্য কর সমন্বয় বা নতুন, বৃহৎ আকারের আর্থিক প্রতিশ্রুতি এড়ানো উচিত।
উদাহরণস্বরূপ, যতক্ষণ না নতুন নির্বাচিত সরকার তার বাজেট উপস্থাপন করে, কানাডা নতুন অর্থবছরের প্রথম কয়েক মাসের সরকারি ব্যয় মেটানোর জন্য ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরবরাহ’ বা ‘হিসাবের ওপর ভোট’ ব্যবহার করে। একইভাবে ভারত ‘অন্তর্বর্তীকালীন বাজেট’ এবং ‘হিসাবের ওপর ভোট’ (সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের অধীনে) ব্যবহার করে অস্থায়ী আর্থিক পরিকল্পনা করে। জার্মানির সংসদীয় ব্যবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্পর্কে আরও সংজ্ঞায়িত আইনি কাঠামো রয়েছে। ব্রাজিলের মতো দেশগুলো ‘অংশগ্রহণমূলক বাজেটিং’ ব্যবস্থায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।
জবাবদিহির মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়াবাজেট অনুমোদনের জন্য প্রচলিত সাংবিধানিক পদ্ধতি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি সম্পর্কে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। সংবিধানে উল্লিখিত জনগণের চূড়ান্ত মালিকানা এবং সরকারি তহবিলের ওপর নিয়ন্ত্রণ-বাস্তবায়নে ব্যাপক সংস্কার জরুরি।
সংসদ না থাকা অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গণতান্ত্রিক জবাবদিহির চেতনাকে যথাসম্ভব সমুন্নত রাখা। আনুষ্ঠানিক সংসদীয় বিতর্ক না থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে বাজেট নিয়ে আলোচনা করা। জবাবদিহি এবং বাংলাদেশে সংসদীয় তদারকি শক্তিশালী করার জন্য মৌলিক সাংবিধানিক ও পদ্ধতিগত সংস্কারও অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে জুলাই সনদে সংসদীয় কমিটিকে শক্তিশালী করা, স্বচ্ছতা এবং জনসাধারণের অংশগ্রহণ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য পরিষ্কার নির্দেশিকাসহ বিস্তৃত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
● ড.
রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
* মতামত লেখকের নিজস্ব
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক অন চ ছ দ অন র জন য প প রস ত ব র জন ত ক সরক র র উপস থ প ন সরক র ব যবস থ জনগণ র কর ছ ল র র জন ব তর ক অন ম দ ন র জন উল ল খ আর থ ক ক ষমত র ওপর র একট
এছাড়াও পড়ুন:
বিএনপি ও জামায়াত কে কোন ফ্যাক্টরে এগিয়ে
ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের তারিখ এখনো জানা যায়নি, তবে সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে। এখন সরকার বা কোনো দলের পক্ষেই নির্বাচনের বাস্তবতা থেকে পিছিয়ে আসার সুযোগ নেই। কোন দল কতটা প্রস্তুত, কোন দলের জনসমর্থন কেমন এবং কে আসবে ক্ষমতায়—চায়ের কাপের আড্ডা থেকে শুরু করে সর্বত্র এ নিয়েই আলোচনা চলছে।
এ আলোচনা হচ্ছে পারিবারিক খাবার টেবিলে, গ্রামগঞ্জে, চায়ের দোকানে, শহরের ক্যাফেতে; আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তো বটেই। ইন্টারনেটের যুগে এসব আলোচনার কোনো ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা নেই।
তবে বেশির ভাগ আলোচনাই এখনো সাময়িক বা টেনটেটিভ—পরিপক্বতার পর্যায়ে পৌঁছায়নি। জনগণের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনাকে কেন্দ্র করেই আমাদের এ আলোচনা।
রাজনীতিতে জনগণ খুঁজছে কিছু আকাঙ্ক্ষিত ফ্যাক্টরজনগণ এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারছে না—দলগুলোর অবস্থান তাদের চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে কতটা মেলে এবং কোন দল সত্যিকারে দেশের শাসনক্ষমতা নিয়ে একটি সম্ভাবনাময় সরকার গঠন করতে পারবে। তবে অনেক অনিশ্চয়তার মধ্যেও কিছু বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বেশির ভাগ মানুষ এখনো দলগত সমর্থনে স্থায়ী বা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। জনগণ তাদের আশা, আকাঙ্ক্ষা ও চাওয়া-পাওয়ার উপাদানগুলোকে দলগুলোর সঙ্গে মেলাতে চেষ্টা করছে।
যেসব দল শৃঙ্খলাবোধ প্রদর্শন করতে পারছে এবং নিজেদের রাজনৈতিক শিষ্টাচার জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে পারছে, এখন পর্যন্ত তারাই তুলনামূলকভাবে বেশি লাভবান বলে মনে হচ্ছে।
একটা বিষয় স্পষ্ট—দেশের জনগণ চায়, প্রতিটি দল তাদের নেতিবাচক কার্যকলাপ থেকে বেরিয়ে আসুক। রাজনীতিতে ক্রমাগত বিশৃঙ্খলা দেখতে দেখতে মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
আরেকটি বিষয়, যা সাধারণ জনগণের খুবই অপছন্দ, তা হলো রাজনীতিবিদদের বাগাড়ম্বর। যাঁরা সফল হতে চান, তাঁদের শৃঙ্খল ও শালীন হতে হবে।
সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ‘রাজনীতিতে ডান ও বামের বিভাজন মুছে যাচ্ছে।’
সত্যিকার অর্থে দেশের মানুষ এখন আর আদর্শিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। গত ৩৫ বছরে আদর্শিক রাজনীতি ‘প্রমোট’ ও প্রচার করতে গিয়ে রাজনীতিবিদেরা দেশে চরম বিশৃঙ্খলা ও বিভাজন সৃষ্টি করেছেন। তাঁদের সেই আদর্শ জনগণের কোনো উপকারে আসেনি।
তাই আপাতত আদর্শ ও দফাভিত্তিক রাজনীতি সম্ভবত অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বামপন্থী দলগুলো। তারা আদর্শের কলহে রাজনীতির বেশির ভাগ সময় ব্যয় করেছে।
আরেকটি বিষয় এখনো খুব আলোচনায় আসেনি, সেটি হলো, বাংলাদেশে রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর পদচারণকে দেশের জনগণ ইতিবাচকভাবে দেখছে। তবে এককভাবে ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে নির্বাচনী রাজনীতিতে জনগণ আগে কখনো পূর্ণমাত্রায় সমর্থন দেয়নি।
আরও পড়ুনবিএনপি-জামায়াতের চার যুগের বন্ধুত্বের কী হলো১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলিমপ্রধান দেশগুলো (পাকিস্তান থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত) প্রায় সব ক্ষেত্রেই বিষয়টি প্রযোজ্য। কোনো রাজনৈতিক দলের নামে ‘ইসলাম’ শব্দটি থাকলেই যে আমাদের দেশের ধর্মভীরু মানুষ দলবদ্ধভাবে তাদের ভোট দেবে, তা কখনো হয়নি এবং সম্ভবত ভবিষ্যতেও হবে না।
যেসব রাজনৈতিক দল বৃহত্তর পরিসরে সাংগঠনিকভাবে আমাদের সমাজ ও জনগণের মতোই দেখতে, তারাই সব সময় ব্যাপকভাবে জনগণের স্বীকৃতি পাবে।
যেসব উপাদান বা ফ্যাক্টর বিবেচনা করে জনগণ এবার রাজনৈতিক দলগুলোকে বিচার করতে পারে, সেগুলো হলো—
১. সুশৃঙ্খল ও রাজনৈতিক শিষ্টাচার;
২. নেতিবাচক কার্যকলাপ পরিহার এবং শুদ্ধ রাজনীতির ধারক হওয়া;
৩. ভারসাম্যপূর্ণ ও বহুত্ববাদী সংমিশ্রণে দলীয় সংগঠন গঠন;
৪. আদর্শের রাজনীতি নয়, বরং দেশ পরিচালনায় বাস্তব সক্ষমতা।
এ পর্যায়ে আমরা বর্তমান বড় দুই রাজনৈতিক দল—বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী নিয়ে কথা বলব এবং দেশের রাজনৈতিক সংলাপে তাদের অবস্থানকে এই চার ফ্যাক্টরের নিরিখে মূল্যায়ন করব।
এনসিপি: ‘চাপের রাজনীতি’ ছাড়তে হবেএ আলোচনা থেকে আমরা এনসিপিকে বাইরে রাখব দুটি কারণে। প্রথম কারণ হলো, এনসিপির রাজনৈতিক পরিচিতি এখনো বিকশিত হচ্ছে। দ্বিতীয় কারণ হলো, এখন পর্যন্ত এনসিপির সব কার্যক্রম শুধু জুলাই আন্দোলনকে ঘিরে। ভোটের রাজনীতিতে তাদের খুব উৎসাহভরে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দেখা যাচ্ছে না। ভবিষ্যতে এনসিপি নিশ্চয়ই বাস্তবতা মেনে নিয়ে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিজেদের আরও প্রসারিত করবে।
এনসিপি সম্বন্ধে একটা মন্তব্য এখানে বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। সেটি হলো, তারা দলীয়ভাবে ‘চাপের রাজনীতি’কে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। যেমন শাপলা প্রতীক দিতেই হবে এবং অন্য সব বিষয়ও তাদের চাওয়ামতো হতে হবে। তাদের এই ‘চাপের রাজনীতি’ যে জনগণ খুব পছন্দ করছে না, তা তাদের বুঝতে হবে।
বিএনপি আগেও ক্ষমতায় ছিল। তাদের দলে অনেক পরিচিত নেতা রয়েছেন, যাঁরা আগেও দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে সরকার চালিয়েছেন। এটাও সত্য, তাদের কিছু নেতার বিতর্কিত অতীত রয়েছে। বিএনপিতে তরুণ একটা উচ্চশিক্ষিত গ্রুপও অপেক্ষা করছে নেতৃত্বে যোগ দিতে। তাঁদের অনেকেই নিজেদের মা–বাবার হাত ধরে বিএনপিতে এসেছেন। সব মিলিয়ে বিএনপি দাবি করতে পারে, তারা দেশ পরিচালনায় সক্ষম একটা রাজনৈতিক দল। বিএনপির ঘাটতি ও শক্তি কোথায়বিএনপির কেন্দ্রীয় ও জেলাভিত্তিক নেতারা গত ১৫ বছর সেই দিনটির জন্য অপেক্ষা করে আছেন, যেদিন অনুকূল পরিবেশে কে কোথায় শীর্ষ প্রতিনিধি বা সংসদ সদস্য হবেন, তা নির্ধারিত হবে। কোনো কোনো এলাকায় বিএনপির ১৫ থেকে ২০ জন সম্ভাব্য প্রার্থী দাঁড়িয়ে আছেন। একক প্রার্থী নির্ধারণ করতে গিয়ে তারা যত বেশি বিশৃঙ্খলা দেখাবে, ততই দলের নেতিবাচকতা বাড়বে।
বিএনপির চাঁদাবাজি, দখলদারি—এসব নেতিবাচক দিক এমনিতেই দিন দিন ‘আয়তনে’ বাড়ছে। দলকে শুদ্ধ করার তাদের ‘দন্তহীন’ প্রচেষ্টাগুলো কোনো কাজ দেয়নি। ডাকসু নির্বাচনের পরেই বলেছিলাম, বিএনপিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে। পরবর্তী সময়ে জাকসু, চাকসু ও রাকসুর ফলাফলেও তা প্রতিফলিত হয়েছে।
ধারণা করি, শিবিরের ‘ভালোত্ব’ নয়, আদতে বিএনপির জন্যই ছাত্রদল তলিয়ে যাচ্ছে। ছাত্রদলের দুর্ভোগ বিএনপির নির্বাচনী ভাগ্যেকে কতটুকু পিছিয়ে দেবে, সেদিকে সবারই চোখ থাকবে।
আরও পড়ুনবিএনপি ও এনসিপির টানাপোড়েনে ‘প্রিজনার্স ডিলেমায়’ পড়তে পারে দেশ ১৩ আগস্ট ২০২৫ডাকসুতে ছাত্রদলের হার, বিএনপিকে যা ভাবতে হবেবিএনপির সবচেয়ে বড় সুবিধা, তারা আমাদের দেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে সমানভাবে প্রতিনিধিত্ব করছে। তাদের ছোট-বড় যেকোনো সমাবেশে গেলে সেগুলোকে আমাদের দেশের জনগোষ্ঠীর একটা ভালো নমুনা মনে হবে। তাদের মধ্যে কিছুটা মৌলবাদী ঘরানার, কিছুটা ভাসানী–সমর্থক ঘরানার, কিছুটা মুজিবীয় ঘরানার, কিছুটা জাতীয়তাবাদী, কিছুটা বামপন্থী—সবই পাওয়া যাবে।
বিএনপির সবচেয়ে বড় শক্তি—দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বিএনপির এই বহুত্ববাদী রঙে আশ্বস্ত হবে। বৃহত্তর সমাজের ভারসাম্য বজায় না রাখতে পারলে যে উত্তাল অবস্থা হবে, তাতে কেউ–ই নিরাপদ থাকবে না।
বিএনপি আগেও ক্ষমতায় ছিল। তাদের দলে অনেক পরিচিত নেতা রয়েছেন, যাঁরা আগেও দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে সরকার চালিয়েছেন। এটাও সত্য, তাদের কিছু নেতার বিতর্কিত অতীত রয়েছে। বিএনপিতে তরুণ একটা উচ্চশিক্ষিত গ্রুপও অপেক্ষা করছে নেতৃত্বে যোগ দিতে। তাঁদের অনেকেই নিজেদের মা–বাবার হাত ধরে বিএনপিতে এসেছেন।
সব মিলিয়ে বিএনপি দাবি করতে পারে, তারা দেশ পরিচালনায় সক্ষম একটা রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশে অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে এ দাবি করা সহজ হবে না। যতই ভোটের সময় কাছে আসবে, ততই ‘দেশ পরিচালনায় সক্ষমতা’ ফ্যাক্টর বিএনপির জন্য সহায়ক হবে।
দুর্নীতিমুক্ত দল হিসেবে জামায়াত নিজেদের জন্য একটা ইমেজ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। এই ইমেজ অনেকটা তুলনামূলক। যেমন ৫ আগস্টের পর বিএনপির নেতা–কর্মীদের যত নেতিবাচক ঘটনা জনগণের চোখে ধরা পড়েছে, সে তুলনায় জামায়াতের ঘটনা অনেক কম। সিলেটের সাদাপাথর দুর্নীতিতে দুদকের প্রতিবেদনে যেহেতু সব দলই জড়িত ছিল, সেহেতু সে ঘটনা জামায়াতকে এককভাবে কলঙ্কিত করেনি।জামায়াতে ইসলামী কোথায় এগিয়েদুর্নীতিমুক্ত দল হিসেবে জামায়াত নিজেদের জন্য একটা ইমেজ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। এই ইমেজ অনেকটা তুলনামূলক। যেমন ৫ আগস্টের পর বিএনপির নেতা–কর্মীদের যত নেতিবাচক ঘটনা জনগণের চোখে ধরা পড়েছে, সে তুলনায় জামায়াতের ঘটনা অনেক কম। সিলেটের সাদাপাথর দুর্নীতিতে দুদকের প্রতিবেদনে যেহেতু সব দলই জড়িত ছিল, সেহেতু সে ঘটনা জামায়াতকে এককভাবে কলঙ্কিত করেনি।
জামায়াতকে তাদের মনোনীত প্রার্থী নিয়ে খুব বিশৃঙ্খলায় পড়তে হবে না। দলের নেতারাও মোটামুটি একই সুরে কথা বলবেন। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দল একক প্রার্থী নির্ধারণ করতে গিয়ে যত বেশি বিশৃঙ্খলায় পড়বে, ততই জামায়াতের ইমেজ ভালো দেখাবে। শৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক শিষ্টাচার জামায়াতের জন্য ইতিবাচক হিসেবে কাজ করবে।
জামায়াতে ইসলামীর বিগত কয়েকজন আমিরকে যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা বলবেন, বর্তমান আমির শফিকুর রহমানই তুলনামূলকভাবে অধিক নমনীয় এবং পরিবর্তনীয়। তিনি লেখাপড়া করেছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানে, ছাত্রাবস্থায় জাসদের রাজনীতি করতেন। তিনি যেহেতু ডগমা বা প্রচলিত সূত্র ধরে জামায়াতের রাজনীতিতে আসেননি, তাই তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আরও প্রসারিত।
শফিকুর রহমানের কিছু কিছু উদ্যোগ জামায়াতের জন্য ইতিবাচক মনে করা হয়।
সংখ্যালঘুদের জানমালের নিরাপত্তায় শফিকুর রহমানের উদ্যোগ—তাদের মন্দিরে গিয়ে অভয় প্রদান—অনেকের কাছে নির্ভেজাল মনে হয়েছে। তিনি হিন্দু জনগণকে জামায়াতকে সমর্থন করার আহ্বান জানিয়েছেন এবং তাঁদের জামায়াত থেকে মনোনয়ন দেওয়ার কথাও বলেছেন। তবে জামায়াতের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও অবকাঠামো যত দিন না বদলাবে, শফিকুর রহমানের একক প্রচেষ্টা সফল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই জামায়াত এখনো একটা সমজাতীয় বা হোমোজেনাস দল এবং এটা তাদের জন্য নেতিবাচক হয়েই থাকবে।
আরও পড়ুনজামায়াত এগিয়ে, বিএনপি কেন পিছিয়ে ০৪ অক্টোবর ২০২৫জামায়াতকে এখনো বিশেষ আদর্শ বা মতবাদের বাহক হিসেবে গণ্য করা হয়। জামায়াত তাদের আদর্শ ও মতবাদের ভিত্তিতে বড় কোনো সুবিধা পাবে না। আবার যাঁরা জামায়াতকে পাকিস্তানপন্থী বা একাত্তরে পাকিস্তানিদের সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত করে পরাস্ত করতে চান, তাঁরাও খুব সুবিধা করতে পারছেন না।
তবে এটা এখনকার অবস্থা—ভবিষ্যতে ‘একাত্তরের ইতিহাস’ হাওয়াইয়ের সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো যে কখন জামাতের জন্য বিস্ফোরিত হবে, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারবে না। তবে এখন অন্য ফ্যাক্টরগুলোই বেশি গুরুত্ব নিয়ে সামনে আসছে।
আরেকটা ফ্যাক্টর জামায়াতের বিপক্ষে কাজ করবে। সেটি হলো, দলের ওপরের সারির দু-চারজন নেতা ছাড়া অন্যরা সাধারণ জনগণের কাছে একদম অপরিচিত। একটা কর্মশীল সরকার গঠন এবং সুষ্ঠুভাবে আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁরা কতটুকু সক্ষম? কারা দেশের নেতা হবেন?
নির্বাচন যত কাছে আসবে, এই প্রশ্নগুলো আরও সামনে আসবে এবং অধিকতর গুরুত্ব পাবে।
চাই শুদ্ধতা ও বাস্তববাদী সংমিশ্রণনির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, জনগণের মধ্যে এই উপকরণগুলোর যাচাই-বাছাই আরও বাড়বে। কোন কোন উপকরণের গুরুত্ব আস্তে আস্তে বাড়বে কিংবা কোনগুলোর গুরুত্ব কিছুটা কমবে, তার ফয়সালা হতে আরও সময় লাগবে।
কিছু কিছু অনুমান হয়তো করা যায়, তবে এক্ষুনি কোনো শেষ কথা বলা ঠিক হবে না। যেমন একটা পর্যায়ে জনগণ শুধু ‘শুদ্ধ রাজনীতি’ কিংবা ‘দেশ পরিচালনায় সক্ষমতা’-কে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ভোটকেন্দ্রের দিকে যাবে। আবার এমনটা না–ও হতে পারে; হয়তো তারা সব ফ্যাক্টর বিবেচনা করেই ভোট দেবে।
আরেকটি দেখার বিষয় হলো, ৫ আগস্টের আগে বিএনপি ৪০ শতাংশ জনসমর্থন অধিকারে রাখা দল ছিল। এখন তাদের যারা প্রতিদ্বন্দ্বী, সেই জামায়াত ছিল ৫ শতাংশ লোকের সমর্থন পাওয়া দল। শুধু বিএনপির নেতিবাচকতা দিয়ে জামায়াত কি জনসমর্থনের এই বিরাট ব্যবধান এত সহজে ঘুচাতে পারবে?
বিশ্বজুড়ে এখন একটা অস্থিরতা চলছে। বিভিন্ন উন্নয়নকামী দেশের জনগণ নিজেদের দারুণভাবে প্রতারিত ভাবছে। এ অবস্থায় আমাদের দেশের জনগণ রাজনীতিতে খুঁজছে শুদ্ধতা ও বাস্তববাদী সংমিশ্রণ। যেসব রাজনৈতিক দল জনগণের চাওয়া–পাওয়ার ফ্যাক্টরগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে সামনের নির্বাচনে এগিয়ে আসবে, তারাই বেশি সুফল পাবে এবং সফল হবে।
সালেহ উদ্দিন আহমদ লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ই-মেইল: salehpublic711@gmail
*মতামত লেখকের নিজস্ব