Prothomalo:
2025-11-02@01:09:09 GMT

ঈদ এলেই আমার ইচ্ছে করে...

Published: 5th, June 2025 GMT

বিয়ের পর যেটাকে নিজের গ্রাম বলে জেনেছি, সেটা হলো শ্বশুরবাড়ি বেরাইদ। কেউ কেউ বলে ‘বড় বেরাইদ’। ঢাকা শহর থেকে মাত্র পাঁচ কি ছয় মাইল দূরত্বে এর অবস্থান। সেটাই মনে হতো কত দূর! যাতায়াতব্যবস্থার কারণেই দূর মনে হতো। বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন রকম যাতায়াতব্যবস্থা। যেমন শীত মৌসুমে ধানখেতের ওপর দিয়ে কোনাকুনি পথে হেঁটে যাওয়া যেত। হাঁটতে না পারলে নৌকা—ডেমরাঘাট থেকে বালু নদ হয়ে দু–তিন ঘণ্টার পথ অথবা রামপুরা ব্রিজের নিচ থেকে খাল বেয়ে তিন থেকে চার ঘণ্টার সুন্দর নৌভ্রমণেও যাওয়া যেত।

বর্ষায় অন্য চেহারা। গোটা এলাকা পানিতে ডুবে যাওয়ায় বেরাইদ হয়ে যেত একটি দ্বীপ—থই থই জলরাশিতে পাল তুলে নৌকা আপনাকে নিয়ে যেত ৪০ থেকে ৪৫ মিনিটে বাড্ডার হেমায়েতপুর থেকে বেরাইদ ঘাটে।

না, ঠিক বেরাইদের কথা বলতে বসিনি আজ। বয়স তো ৮০ পেরোল। মনটা টানে শুধু পেছন পানে। আর পেছনের স্মৃতির মধ্যে চট্টগ্রামের শৈশব-কৈশোরের দিনগুলো খুব মনে পড়ে। পাহাড়, রেললাইন, সমুদ্র—এসব বড়ই আপন ছিল তো। এরপর এল এই গ্রাম, এর সৌন্দর্যই আলাদা। বাংলাদেশ যে কত সুন্দর, এক বেরাইদই তার নমুনা।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় ঢাকা মেডিকেলে কোমাতে ছিলাম। অসুস্থ অবস্থাতেই একাত্তরের ২৯ মার্চ আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় বেরাইদ। প্রায় চার মাস ছিলাম সেখানে।

এই যে সময়টা, আমি গ্রাম দেখেছি। দেখেছি খুবই কাছে থেকে। অন্তরে অনুভব করেছি গ্রামের মানুষগুলোর আন্তরিকতা। তাঁদের কথাবার্তায়, চালচলনে, জীবনযাত্রার রকম–সকমে মুগ্ধ না হয়ে পারিনি। হ্যাঁ, ভিলেজ পলিটিকস বলে একটা কথা চালু আছে, কিন্তু তাতেও ছিল না কোনো হিংস্রতা, ছিল না কোনো নোংরামো।

১০–১২ বছর আগে টিভিতে একটি অনুষ্ঠান নির্মাণ করেছিলাম—‘মেধাবী দেশের মুখ’। সারা দেশের দুস্থ ছেলেমেয়েদের মধ্যে যারা জিপিএ-৫ পেয়েছিল, তাদের নিয়ে। তখন ঘুরে বেড়িয়েছি উত্তর–দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম সব দিকে।

এসব দৃশ্য মনে ভেসে ওঠে আমার প্রায়ই। ঈদ এলেই বেশি বেশি মনে পড়ে। আর এক মানুষকে মনে পড়ে—রূপগঞ্জ এলাকার সালাম মাস্টার। তিন পুরুষের মাস্টার আমার শ্বশুর।

দিনাজপুরের সাঁওতালপল্লিতে তাঁদের সঙ্গে সারা দিন কাটানো, আবার টেকনাফের হতদরিদ্র সংসারে এক দিন কাটানো, সিলেটে চা-বাগানের শ্রমিকের সংসারে বসে তাঁদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ, আবার রাজশাহীর আমবাগানে ছায়ায় বসে খাওয়াদাওয়া, গল্পগুজব। কাজের নেশায় ঘুরেছি, ঘুরেছি মনের আনন্দে। কখনো মাইক্রোবাসে, কখনো ট্রেনে, কখনো নৌকায়, আবার কখনো ঘোড়ার পিঠে—অদ্ভুত সব গল্পের সাক্ষী হয়েছিলাম।

বরিশালের এক চর্মকারের বাড়িতে দেখলাম, তাঁর তিন ছেলে পড়াশোনা করে। বড়জন বিএ পাস। সে জুতা সেলাই করছে বাবার অনুপস্থিতিতে, পড়াচ্ছে ছোট ভাইটিকে। রাজশাহীর পরিচ্ছন্নতাকর্মী তাঁর অতি স্বল্প রোজগারে ছেলেটিকে জিপিএ-৫ পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছেন।

যেখানেই গেছি, আদর–আপ্যায়নের কমতি তো ছিলই না, বরং তাঁদের ভালোবাসার আতিশয্যে বিব্রত হতে হয়েছে কখনো কখনো।

আরও পড়ুনআমলিগোলায় ঈদ আসত অনেক আনন্দ নিয়ে০৮ এপ্রিল ২০২৪

এই যে ৪০টি গ্রামে ঘুরেছি, সেখানকার মানুষগুলোর জীবনেও তো ঈদ আসে, ঈদ যায়। কীভাবে ঈদ আসে–যায়, তার খবর কি আমরা রাখি? বোধ হয় না। লোকদেখানো অনেক কিছু হয় পত্রপত্রিকায় দেখি, লাইন ধরে দান গ্রহণ করতে গিয়ে প্রাণও হারান অনেকে। তারপরও তাঁরাই আমাদের ত্রাতা। খাদ্য জোটান ১৮ কোটি মানুষের।

ফিরে আসি বাংলাদেশের প্রায় ৯০ হাজার গ্রামের মধ্যে একটি গ্রাম বেরাইদে। স্মৃতিতে ভাসছে—স্ত্রী ও দুই কন্যাকে নিয়ে নৌকায় যাচ্ছি রামপুরা খাল দিয়ে। বাচ্চারা খালের ঝকঝকে পানিতে পা ডোবাচ্ছে, হাত দিয়ে পানি ছিটাচ্ছে নিজেদের মাঝে, ঢোলকলমির ফুল তুলে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘কী ফুল, আব্বু?’

আবার যখন কেচি জালে মাছ ধরতে দেখে, তখন তাদের বিস্ময়ের শেষ নেই, যেন এ আবার কেমন জাল?

বালু নদে গিয়ে শুশুকের খেলা ওদের চোখকে করে বিস্ফোরিত, ‘এটা কী মাছ, আব্বু?’

‘এটা আমাদের ডলফিন।’

‘আমাদের দেশে ডলফিন আছে?’

‘হ্যাঁ, এটাই আমাদের ডলফিন—নাম হলো শুশুক।’

কচুরিপানাকেও আপন করে নেয় নৌকাভ্রমণে। ফুল তুলে তোড়া বাঁধে। পথে নৌকা থামিয়ে পাশের জমি থেকে লাল লাল মরিচ তুলে আনে ভাত দিয়ে খাবে বলে। আরও কত মজা ওদের চোখে গ্রামে। তেরমোহনীর ঘাটে গিয়ে একগাদা কটকটি কিনে সারা পথ খেতে খেতে গেল বেরাইদ ঘাট পর্যন্ত।

আরও পড়ুনসেবার কেন ২৮ রমজানে ঈদ হয়েছিল আরবে?১০ এপ্রিল ২০২৪

এসব দৃশ্য মনে ভেসে ওঠে আমার প্রায়ই। ঈদ এলেই বেশি বেশি মনে পড়ে। আর এক মানুষকে মনে পড়ে—রূপগঞ্জ এলাকার সালাম মাস্টার। তিন পুরুষের মাস্টার আমার শ্বশুর। সারাটা দিন হাঁটছেন। উত্তরে নদীর ঘাটের বাজার আর দক্ষিণের লঞ্চঘাট। আর খবর নিচ্ছেন ঢাকার। যাঁকে দেখছেন লঞ্চ বা নৌকা থেকে নামতে, তাঁকেই জিজ্ঞেস করেন, ‘ঢাকা থেকে ফিরলা?’

‘জি, কাকা।’

‘আমার জামাইয়ের লগে দেখা হইছিল?’

যেন দুনিয়ার লোকের আর কাজ নেই তাঁর জামাইয়ের খোঁজ নেওয়া ছাড়া।

শুধু জামাই নয়; প্রতিটি সন্তানের অপেক্ষায় থাকতেন দুই ঈদে। সবাই আসবে তো ঈদে, আশায় বসে থাকতেন। কখনো আশা পূরণ হতো, কখনো নিরাশায় ডুবতেন।

আজ দেশের ঘরে ঘরে, সে শহরেই হোক, গ্রামেই হোক, প্রবাসীর ভিড়। বিদেশ গেলে আর তাঁদের আসার সময় হয় না! ঈদ ঈদের মতোই হচ্ছে। শুধু মা–বাবা বুকে হাহাকার নিয়ে তড়পাচ্ছেন।

এই ছেলেমেয়েরা হয়তো আসবেন। মা–বাবার সঙ্গে ঈদ করবেন, কিন্তু আমার আর গ্রামে যাওয়া হবে না। কারণ, বেরাইদ আর গ্রাম নেই।

শেষ করি একটা গল্প দিয়ে। আগে শুনে থাকলে ক্ষমা চাই। না শুনলেই ভালো।

বাবা ইংল্যান্ডে বসবাসরত ছেলেকে ফোন করে বললেন, ‘শোনো বাবা, তোমাকে একটা কথা বলি। আমি আগামীকাল একটা কাজ করতে যাচ্ছি, সেটা তোমাকে জানানো প্রয়োজন।’

‘কী কাজ, বাবা। বাড়ি বিক্রি?’

‘না। তার চেয়ে অনেক জরুরি। তুমি খবরটা তোমার ভাইবোনদের জানিয়ে দিয়ো।’

‘খবরটা কী, সেটা বলো।’

‘তোমাদের মাকে ডিভোর্স দিচ্ছি।’

‘মানে? এসব কী বলো?’

‘হ্যাঁ, তাঁর সঙ্গে আমার আর বনছে না। আমার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছেন তিনি।’

‘মা কই, মাকে দাও।’

‘তিনি ঘর বন্ধ করে আছেন। আমার সঙ্গেও কথা বলছেন না।’

‘তুমি কি ফান করছ, বাবা?’

‘কোনো ফান নয়। মাই ডিসিশন ইজ ফাইনাল।’

‘দু-চারটে দিন ওয়েট করো। এত তাড়াহুড়া কিসের?’

‘সরি।’

আধঘণ্টার মধ্যে অন্য দুই সন্তানেরও ফোন এল। একজন সুইডেনের অধিবাসী, অন্যজন টেক্সাসের। সবার এক কথা, ‘বাবা, জাস্ট দুই দিন অপেক্ষা করো, আমরা টিকিট করে ফেলেছি। আমরা আসছি, তারপর যা হয় কোরো।’

‘ঠিক আছে, কিন্তু আমার ডিসিশন ফাইনাল।’

ফোন রেখে বাবা মাকে বললেন, ‘এবার ঈদে তো ওদের আনলাম, এরপর কী হবে জানি না।’

এই ছেলেমেয়েরা হয়তো আসবেন। মা–বাবার সঙ্গে ঈদ করবেন, কিন্তু আমার আর গ্রামে যাওয়া হবে না। কারণ, বেরাইদ আর গ্রাম নেই। ভূমিখেকোরা বেরাইদের চতুর্দিক গ্রাস করেছে।

প্রকৃতির বিপর্যয় হবে না কেন?

আরও পড়ুনবরেণ্য এই অভিনেতার প্রেম, বিয়ে ও সংসারের দিনগুলো রোমাঞ্চে ভরা, তাঁকে চিনতে পেরেছেন কি০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আর গ র ম আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

সম্পর্কের মতো জীবনঘনিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিতেও এআইয়ে ঝুঁকছে মানুষ, পরিণতি কী

চলতি বছরের এপ্রিলে কেটি মোরান প্রেমিকের সঙ্গে তাঁর ছয় মাসের সম্পর্কের ইতি টানার সিদ্ধান্ত নেন। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি এমন এক সাহায্যকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান, সচরাচর এমনটা দেখা যায় না। তাঁর কৃতজ্ঞতা পেয়েছে চ্যাটজিপিটি বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) চ্যাটবট।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির ৩৩ বছর বয়সী এই নারী চ্যাটবটটিকে স্নেহের সঙ্গে ‘চ্যাট’ নামে ডাকেন। তিনি বলেন, ‘এটি আমাকে কিছু বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতে এবং নিজের সঙ্গে আলাপে বাধ্য করেছে, যা আমি এড়িয়ে যাচ্ছিলাম।’

মোরান তাঁর বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সদস্যদের কাছেও মনের কথা খুলে বলেছিলেন। এরপরও তিনি মনে করেন, চ্যাটজিপিটিই তাঁকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছিল যে, তাঁর সম্পর্কের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাঁর দুশ্চিন্তার মূল কারণ। চ্যাটবটটির সঙ্গে এক সপ্তাহ কথা বলার পর, তিনি সম্পর্কটি ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

চ্যাটজিপিটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআইয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী, চ্যাটজিপিটিতে দেওয়া বার্তার প্রায় অর্ধেকই ‘জিজ্ঞাসা’ বিভাগে পড়ে। ওপেনএআই এটিকে ‘সিদ্ধান্ত নিতে তথ্য খোঁজা বা যাচাই’ বিভাগে রেখেছে।

বিচ্ছেদ, চাকরি পরিবর্তন বা অন্য দেশে চলে যাওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ জীবনঘনিষ্ঠ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মানুষই সাধারণত বন্ধুবান্ধব, পরিবার বা থেরাপিস্টের পরামর্শ নিতে অভ্যস্ত। তবে এখন কিছু মানুষ নিজের অনুভূতির বিষয়ে তাৎক্ষণিক নির্মোহ মূল্যায়ন পেতে এআইয়ের দিকে ঝুঁকছেন।

মোরানের মতো কেউ কেউ কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাস জোগানোর কৃতিত্ব এআইকে দিচ্ছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়ে বলছেন, এআইয়ের তোষামুদে স্বভাব কখনো কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার দিকে ঠেলে দিতে পারে।

নিখুঁত নয়

জুলি নাইসকে চ্যাটজিপিটির কাছে মনের কথা খুলে বলতে বাধ্য করেছিল মূলত অবসাদ। যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোর প্রযুক্তি শিল্পে তিন বছর কাজ করার পর তিনি দুশ্চিন্তা, বিষণ্নতা এবং ক্রমাগত ক্লান্তিতে ভুগতে শুরু করেন।

গত বছরের শেষের দিকের সেই সময়টি সম্পর্কে জুলি বলেন, ‘অবশেষে আমি এমন একটা পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছি, যেখানে মনে হচ্ছিল— আমাকে কিছু একটা করতেই হবে, পরিবর্তন আনতেই হবে। আমি তখন একটা মানব-খোলস মাত্র ছিলাম (নিষ্প্রাণ)।’

জুলি সিদ্ধান্ত নিলেন— স্থান পরিবর্তন করবেন, বিশেষত ফ্রান্সে চলে যাবেন। আর এ বিষয়ে পরামর্শের জন্য তিনি দ্বারস্থ হন চ্যাটজিপিটির। তিনি তাঁর চাওয়াগুলো (একটি শান্ত শহর, যেখানে ভালো সংখ্যক প্রবাসীর বসবাস থাকবে) এবং তাঁর অপছন্দগুলো (প্যারিসের মতো ব্যস্ত শহর নয়) বিশদভাবে উল্লেখ করলেন। চ্যাটবটটি তাঁকে ফ্রান্সের দক্ষিণের একটি ছোট্ট শহর ইউজেস সুপারিশ করল। সেখানকার বাসিন্দা ৮ হাজার ৩০০ জনের মতো।

জুলি চলতি বছরের এপ্রিলে সেখানে চলে যান। তিনি বলেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের এই প্রক্রিয়াটি চ্যাটজিপিটির হাতে তুলে দেওয়ায় পুরো ব্যাপারটি নিয়ে তাঁর অতিরিক্ত চাপ অনেক কমে গিয়েছিল। যদিও তিনি এখন বলছেন, সিদ্ধান্তটি নিখুঁত ছিল না। ইউজেসে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে আসা প্রবাসীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আছে ঠিকই। তবে চ্যাটজিপিটি যে তথ্যটি দিতে ব্যর্থ হয়েছিল, সেটি হলো এই প্রবাসীদের বেশিরভাগই অবসরপ্রাপ্ত। আর জুলির বয়স ৪৪ বছর।

তরুণদের মধ্যে জিজ্ঞাসার প্রবণতা বেশি

চ্যাটজিপিটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআইয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী, চ্যাটজিপিটিতে দেওয়া বার্তার প্রায় অর্ধেকই ‘জিজ্ঞাসা’ বিভাগে পড়ে। ওপেনএআই এটিকে ‘সিদ্ধান্ত নিতে তথ্য খোঁজা বা যাচাই’ বিভাগে রেখেছে। ওপেনএআইয়ের প্রধান নির্বাহী স্যাম অল্টম্যান উল্লেখ করেছেন, এই প্রবণতাটি তরুণ ব্যবহারকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।

গত মে মাসে ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সিকোইয়া ক্যাপিটালের ‘এআই অ্যাসেন্ট’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বয়সে ২০ থেকে ৩০ বছরের কোঠায় থাকা ব্যবহারকারীদের বিষয়ে অল্টম্যান বলেন, ‘তাঁরা চ্যাটজিপিটির কাছে জিজ্ঞাসা না করে আসলেই জীবনঘনিষ্ঠ সিদ্ধান্তগুলো নেন না।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘তাঁদের জীবনে আসা প্রতিটি ব্যক্তি এবং তাঁদের আলাপের সম্পূর্ণ প্রেক্ষাপট এআইয়ের কাছে আছে।’ (এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য ওপেনএআইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা সাড়া দেয়নি)।

আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এআইয়ের হাতে ছেড়ে দিলে, সমস্যা সমাধানের আমাদের নিজস্ব দক্ষতা কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়অধ্যাপক লিওনার্ড বুসিও, ফস্টার স্কুল অব বিজনেস, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন

তবে এভাবে তরুণেরাই শুধু এআইয়ের শরণাপন্ন হচ্ছেন, ব্যাপারটা তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের কানসাস সিটির বাসিন্দা মাইক ব্রাউন। ২০২৩ সালে ৫২ বছর বয়সে এসে নিজের ৩৬ বছরের বিবাহিত জীবন নিয়ে কী করা উচিত, সেই পরামর্শের জন্য একটি চ্যাটবটের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তিনি। তাঁর বন্ধু, যাজক এবং বিবাহ পরামর্শক সবাই তাঁকে বিচ্ছেদের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে তিনি বলেন, ওই বছরই চালু হওয়া একটি ইন্টারেকটিভ চ্যাটবট ‘পাই.এআই’-এর সঙ্গে ৩০ মিনিটের কথোপকথনের পরই তিনি তাঁর সিদ্ধান্তের বিষয়ে নিশ্চিত হন।

ব্রাউন বলেন, ‘আমার এই ভাবনাগুলো যাচাই করে নেওয়া দরকার ছিল এবং এই পথে এগোনোই যে সঠিক, সেটির জন্য নিশ্চয়তা পাওয়াটা দরকার ছিল।’ তিনি বলেন, এই পরিস্থিতিতে একটি ‘বিশ্বাসযোগ্য’ দৃষ্টিভঙ্গি পেতে তিনি চ্যাটবটটির ওপর আস্থা রেখেছিলেন।

আরও পড়ুনচ্যাটবট কি মানুষের মতো বুদ্ধিমান হতে পারবে২৯ মে ২০২৪

কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের ফস্টার স্কুল অব বিজনেসের অধ্যাপক লিওনার্ড বুসিও কীভাবে মানুষ ও এআইয়ের মধ্যে সহযোগিতায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের যথার্থতা বাড়ানো যায়, তা নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বুঝতে পারছেন, কেন মানুষ এভাবে এআইয়ের দিকে ঝুঁকছে। এর প্রধান কারণগুলো হলো সার্বক্ষণিক এটি হাতের কাছে পাওয়া যায়, বেশিরভাগ মানুষের চেয়ে অনেক দ্রুত উত্তর দিতে পারে এবং এটিকে তুলনামূলক বেশি নিরপেক্ষ বলেও মনে করা হয়।

বুসিও বলেন, ‘এআই সাধারণত অনেকটাই কূটনৈতিক ভাষায় অভ্যস্ত, পক্ষান্তরে মানুষ বিশেষত ব্যক্তিগত পরামর্শের ক্ষেত্রে নিজের চিন্তাভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মতামত দিয়ে থাকে।’

তবে বুসিও সতর্ক করে বলেন, বেশিরভাগ এআই মডেলের ‘তোষামোদী’ প্রবণতা থাকায় তারা ব্যবহারকারীকে খুশি করার বিষয়ে যতটা আগ্রহী, ততটা সেরা পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহী নয়। তিনি আরও বলেন, ‘তাদের (চ্যাটবট) এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা ব্যবহারকারীকে খুশি করতে পারে। কারণ, ব্যবহারকারী খুশি হলে, তারা আবার ফিরে আসে।’

কেটি মোরানের ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়েছিল। চ্যাটজিপিটি বন্ধুর মতো করে কথা বলায় তিনি অবাক হয়েছিলেন বলে জানান। চ্যাটবটটি তাঁকে এ রকম বলেছিল, ‘আপনি এমন কাউকে পাওয়ার যোগ্য, যে আপনাকে আশ্বস্ত করবে; এমন কাউকে নয়, যার নীরবতা আপনাকে দুশ্চিন্তার গোলকধাঁধায় ফেলে দেবে।’

আরও পড়ুনকিশোরকে আত্মহত্যায় উৎসাহ দিয়েছে চ্যাটবট, নির্মাতার বিরুদ্ধে মায়ের মামলা২৪ অক্টোবর ২০২৪

রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলা ব্যক্তিদের কেউই এআইয়ের ওপর নির্ভর করার জন্য অনুতপ্ত নন বলে জানিয়েছেন। মাইক ব্রাউনের মতে, এআই ‘আবেগী, নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের’ মতো কাজ করেছে। কেটি মোরানের কাছে এটি ছিল ‘সবচেয়ে কাছের বন্ধুর’ মতো। আর জুলি নাইস বলেন, এআই তাঁকে তিনি আসলে কী চান, তা উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছে।

এরপরও, অধ্যাপক বুসিও একটি সতর্কবার্তা দিয়েছেন। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, ‘আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এআইয়ের হাতে ছেড়ে দিলে, সমস্যা সমাধানের আমাদের নিজস্ব দক্ষতা কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।’

এই অধ্যাপক বলেন, ‘আমি বলব, একটু পিছিয়ে আসুন এবং নিজেদেরই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মধ্যে যে সৌন্দর্য আছে, তা নিয়ে ভাবুন। একই সঙ্গে এটাও নিশ্চিত করার জন্য যে, আমরা নিজেরাও চিন্তাভাবনার কাজটা করছি।’

আরও পড়ুনচ্যাটজিপিটিসহ অন্য এআই চ্যাটবটকে যে ৭ তথ্য দেওয়া যাবে না৩১ অক্টোবর ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ