বিয়ের পর যেটাকে নিজের গ্রাম বলে জেনেছি, সেটা হলো শ্বশুরবাড়ি বেরাইদ। কেউ কেউ বলে ‘বড় বেরাইদ’। ঢাকা শহর থেকে মাত্র পাঁচ কি ছয় মাইল দূরত্বে এর অবস্থান। সেটাই মনে হতো কত দূর! যাতায়াতব্যবস্থার কারণেই দূর মনে হতো। বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন রকম যাতায়াতব্যবস্থা। যেমন শীত মৌসুমে ধানখেতের ওপর দিয়ে কোনাকুনি পথে হেঁটে যাওয়া যেত। হাঁটতে না পারলে নৌকা—ডেমরাঘাট থেকে বালু নদ হয়ে দু–তিন ঘণ্টার পথ অথবা রামপুরা ব্রিজের নিচ থেকে খাল বেয়ে তিন থেকে চার ঘণ্টার সুন্দর নৌভ্রমণেও যাওয়া যেত।
বর্ষায় অন্য চেহারা। গোটা এলাকা পানিতে ডুবে যাওয়ায় বেরাইদ হয়ে যেত একটি দ্বীপ—থই থই জলরাশিতে পাল তুলে নৌকা আপনাকে নিয়ে যেত ৪০ থেকে ৪৫ মিনিটে বাড্ডার হেমায়েতপুর থেকে বেরাইদ ঘাটে।
না, ঠিক বেরাইদের কথা বলতে বসিনি আজ। বয়স তো ৮০ পেরোল। মনটা টানে শুধু পেছন পানে। আর পেছনের স্মৃতির মধ্যে চট্টগ্রামের শৈশব-কৈশোরের দিনগুলো খুব মনে পড়ে। পাহাড়, রেললাইন, সমুদ্র—এসব বড়ই আপন ছিল তো। এরপর এল এই গ্রাম, এর সৌন্দর্যই আলাদা। বাংলাদেশ যে কত সুন্দর, এক বেরাইদই তার নমুনা।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় ঢাকা মেডিকেলে কোমাতে ছিলাম। অসুস্থ অবস্থাতেই একাত্তরের ২৯ মার্চ আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় বেরাইদ। প্রায় চার মাস ছিলাম সেখানে।
এই যে সময়টা, আমি গ্রাম দেখেছি। দেখেছি খুবই কাছে থেকে। অন্তরে অনুভব করেছি গ্রামের মানুষগুলোর আন্তরিকতা। তাঁদের কথাবার্তায়, চালচলনে, জীবনযাত্রার রকম–সকমে মুগ্ধ না হয়ে পারিনি। হ্যাঁ, ভিলেজ পলিটিকস বলে একটা কথা চালু আছে, কিন্তু তাতেও ছিল না কোনো হিংস্রতা, ছিল না কোনো নোংরামো।
১০–১২ বছর আগে টিভিতে একটি অনুষ্ঠান নির্মাণ করেছিলাম—‘মেধাবী দেশের মুখ’। সারা দেশের দুস্থ ছেলেমেয়েদের মধ্যে যারা জিপিএ-৫ পেয়েছিল, তাদের নিয়ে। তখন ঘুরে বেড়িয়েছি উত্তর–দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম সব দিকে।
এসব দৃশ্য মনে ভেসে ওঠে আমার প্রায়ই। ঈদ এলেই বেশি বেশি মনে পড়ে। আর এক মানুষকে মনে পড়ে—রূপগঞ্জ এলাকার সালাম মাস্টার। তিন পুরুষের মাস্টার আমার শ্বশুর।দিনাজপুরের সাঁওতালপল্লিতে তাঁদের সঙ্গে সারা দিন কাটানো, আবার টেকনাফের হতদরিদ্র সংসারে এক দিন কাটানো, সিলেটে চা-বাগানের শ্রমিকের সংসারে বসে তাঁদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ, আবার রাজশাহীর আমবাগানে ছায়ায় বসে খাওয়াদাওয়া, গল্পগুজব। কাজের নেশায় ঘুরেছি, ঘুরেছি মনের আনন্দে। কখনো মাইক্রোবাসে, কখনো ট্রেনে, কখনো নৌকায়, আবার কখনো ঘোড়ার পিঠে—অদ্ভুত সব গল্পের সাক্ষী হয়েছিলাম।
বরিশালের এক চর্মকারের বাড়িতে দেখলাম, তাঁর তিন ছেলে পড়াশোনা করে। বড়জন বিএ পাস। সে জুতা সেলাই করছে বাবার অনুপস্থিতিতে, পড়াচ্ছে ছোট ভাইটিকে। রাজশাহীর পরিচ্ছন্নতাকর্মী তাঁর অতি স্বল্প রোজগারে ছেলেটিকে জিপিএ-৫ পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছেন।
যেখানেই গেছি, আদর–আপ্যায়নের কমতি তো ছিলই না, বরং তাঁদের ভালোবাসার আতিশয্যে বিব্রত হতে হয়েছে কখনো কখনো।
আরও পড়ুনআমলিগোলায় ঈদ আসত অনেক আনন্দ নিয়ে০৮ এপ্রিল ২০২৪এই যে ৪০টি গ্রামে ঘুরেছি, সেখানকার মানুষগুলোর জীবনেও তো ঈদ আসে, ঈদ যায়। কীভাবে ঈদ আসে–যায়, তার খবর কি আমরা রাখি? বোধ হয় না। লোকদেখানো অনেক কিছু হয় পত্রপত্রিকায় দেখি, লাইন ধরে দান গ্রহণ করতে গিয়ে প্রাণও হারান অনেকে। তারপরও তাঁরাই আমাদের ত্রাতা। খাদ্য জোটান ১৮ কোটি মানুষের।
ফিরে আসি বাংলাদেশের প্রায় ৯০ হাজার গ্রামের মধ্যে একটি গ্রাম বেরাইদে। স্মৃতিতে ভাসছে—স্ত্রী ও দুই কন্যাকে নিয়ে নৌকায় যাচ্ছি রামপুরা খাল দিয়ে। বাচ্চারা খালের ঝকঝকে পানিতে পা ডোবাচ্ছে, হাত দিয়ে পানি ছিটাচ্ছে নিজেদের মাঝে, ঢোলকলমির ফুল তুলে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘কী ফুল, আব্বু?’
আবার যখন কেচি জালে মাছ ধরতে দেখে, তখন তাদের বিস্ময়ের শেষ নেই, যেন এ আবার কেমন জাল?
বালু নদে গিয়ে শুশুকের খেলা ওদের চোখকে করে বিস্ফোরিত, ‘এটা কী মাছ, আব্বু?’
‘এটা আমাদের ডলফিন।’
‘আমাদের দেশে ডলফিন আছে?’
‘হ্যাঁ, এটাই আমাদের ডলফিন—নাম হলো শুশুক।’
কচুরিপানাকেও আপন করে নেয় নৌকাভ্রমণে। ফুল তুলে তোড়া বাঁধে। পথে নৌকা থামিয়ে পাশের জমি থেকে লাল লাল মরিচ তুলে আনে ভাত দিয়ে খাবে বলে। আরও কত মজা ওদের চোখে গ্রামে। তেরমোহনীর ঘাটে গিয়ে একগাদা কটকটি কিনে সারা পথ খেতে খেতে গেল বেরাইদ ঘাট পর্যন্ত।
আরও পড়ুনসেবার কেন ২৮ রমজানে ঈদ হয়েছিল আরবে?১০ এপ্রিল ২০২৪এসব দৃশ্য মনে ভেসে ওঠে আমার প্রায়ই। ঈদ এলেই বেশি বেশি মনে পড়ে। আর এক মানুষকে মনে পড়ে—রূপগঞ্জ এলাকার সালাম মাস্টার। তিন পুরুষের মাস্টার আমার শ্বশুর। সারাটা দিন হাঁটছেন। উত্তরে নদীর ঘাটের বাজার আর দক্ষিণের লঞ্চঘাট। আর খবর নিচ্ছেন ঢাকার। যাঁকে দেখছেন লঞ্চ বা নৌকা থেকে নামতে, তাঁকেই জিজ্ঞেস করেন, ‘ঢাকা থেকে ফিরলা?’
‘জি, কাকা।’
‘আমার জামাইয়ের লগে দেখা হইছিল?’
যেন দুনিয়ার লোকের আর কাজ নেই তাঁর জামাইয়ের খোঁজ নেওয়া ছাড়া।
শুধু জামাই নয়; প্রতিটি সন্তানের অপেক্ষায় থাকতেন দুই ঈদে। সবাই আসবে তো ঈদে, আশায় বসে থাকতেন। কখনো আশা পূরণ হতো, কখনো নিরাশায় ডুবতেন।
আজ দেশের ঘরে ঘরে, সে শহরেই হোক, গ্রামেই হোক, প্রবাসীর ভিড়। বিদেশ গেলে আর তাঁদের আসার সময় হয় না! ঈদ ঈদের মতোই হচ্ছে। শুধু মা–বাবা বুকে হাহাকার নিয়ে তড়পাচ্ছেন।
এই ছেলেমেয়েরা হয়তো আসবেন। মা–বাবার সঙ্গে ঈদ করবেন, কিন্তু আমার আর গ্রামে যাওয়া হবে না। কারণ, বেরাইদ আর গ্রাম নেই।শেষ করি একটা গল্প দিয়ে। আগে শুনে থাকলে ক্ষমা চাই। না শুনলেই ভালো।
বাবা ইংল্যান্ডে বসবাসরত ছেলেকে ফোন করে বললেন, ‘শোনো বাবা, তোমাকে একটা কথা বলি। আমি আগামীকাল একটা কাজ করতে যাচ্ছি, সেটা তোমাকে জানানো প্রয়োজন।’
‘কী কাজ, বাবা। বাড়ি বিক্রি?’
‘না। তার চেয়ে অনেক জরুরি। তুমি খবরটা তোমার ভাইবোনদের জানিয়ে দিয়ো।’
‘খবরটা কী, সেটা বলো।’
‘তোমাদের মাকে ডিভোর্স দিচ্ছি।’
‘মানে? এসব কী বলো?’
‘হ্যাঁ, তাঁর সঙ্গে আমার আর বনছে না। আমার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছেন তিনি।’
‘মা কই, মাকে দাও।’
‘তিনি ঘর বন্ধ করে আছেন। আমার সঙ্গেও কথা বলছেন না।’
‘তুমি কি ফান করছ, বাবা?’
‘কোনো ফান নয়। মাই ডিসিশন ইজ ফাইনাল।’
‘দু-চারটে দিন ওয়েট করো। এত তাড়াহুড়া কিসের?’
‘সরি।’
আধঘণ্টার মধ্যে অন্য দুই সন্তানেরও ফোন এল। একজন সুইডেনের অধিবাসী, অন্যজন টেক্সাসের। সবার এক কথা, ‘বাবা, জাস্ট দুই দিন অপেক্ষা করো, আমরা টিকিট করে ফেলেছি। আমরা আসছি, তারপর যা হয় কোরো।’
‘ঠিক আছে, কিন্তু আমার ডিসিশন ফাইনাল।’
ফোন রেখে বাবা মাকে বললেন, ‘এবার ঈদে তো ওদের আনলাম, এরপর কী হবে জানি না।’
এই ছেলেমেয়েরা হয়তো আসবেন। মা–বাবার সঙ্গে ঈদ করবেন, কিন্তু আমার আর গ্রামে যাওয়া হবে না। কারণ, বেরাইদ আর গ্রাম নেই। ভূমিখেকোরা বেরাইদের চতুর্দিক গ্রাস করেছে।
প্রকৃতির বিপর্যয় হবে না কেন?
আরও পড়ুনবরেণ্য এই অভিনেতার প্রেম, বিয়ে ও সংসারের দিনগুলো রোমাঞ্চে ভরা, তাঁকে চিনতে পেরেছেন কি০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
ফাঁকা রাজধানী, ঘরমুখী মানুষের ভিড় টার্মিনালে
ঈদুল আজহার ছুটি শুরুর আগে বুধবার ছিল শেষ কর্মদিবস। ওই দিন বিকেল থেকেই রাজধানী ছাড়তে শুরু করেন ঘরমুখী মানুষ। গতকাল বৃহস্পতিবার বাস টার্মিনালে ছিল উপচে পড়া ভিড়। আর অনেকেই স্বস্তির জন্য ঢাকা ছাড়ছেন আজ শুক্রবার। এখন বাস টার্মিনালে ভিড় থাকলেও পাল্টে গেছে ব্যস্ততম রাজধানীর চিরচেনা দৃশ্য।
আজ সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সড়কে গণপরিবহন ছিল হাতে গোনা। ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যাও ছিল কম। সড়কে মানুষের উপস্থিতি কম হলেও যাঁরা ছিলেন, গণপরিবহন পেতে তাঁদের ঝক্কি পোহাতে হয়েছে। আছে বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগও।
রাজধানীর মহাখালীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন জান্নাতুল ফেরদৌস। ঈদের ছুটিতে গাজীপুরের কোনাবাড়ী যাচ্ছেন তিনি। গাড়ির জন্য দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকার কথা জানালেন জান্নাতুল। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি, গাড়ি পাচ্ছি না। আবার এক-দুটি গাড়ি পেলেও সেখানে অনেক মানুষের ভিড়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না। ভাড়াও দ্বিগুণের মতো চাচ্ছে।’
অবশ্য বাস টার্মিনালে ছিল মানুষের ভিড়। উত্তরের পথে দীর্ঘ যানজটের কারণে যাত্রীর চাপ আরও বেড়েছে। আগে টিকিট কেটেও অনেককে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে। বেশ ভোগান্তিতে পড়েছেন নারী ও শিশুরা। তবে যাত্রীদের নিরাপত্তায় পুলিশ ও র্যাবের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়।
মহাখালী বাস টার্মিনালে রাজশাহী, বগুড়া ও নাটোরগামী ‘একতা’ পরিবহনের টিকিট বিক্রি করছেন সাঈদুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের হাতে বিক্রি করার মতো এখন আর কোনো টিকিট নেই। আমাদের যাত্রীরা এসে বসে আছেন, তাঁরা যেতে পারছেন না। আমাদের গাড়িগুলো যমুনা সেতুর ওপারে জ্যামে আটকে আছে।’
ঈদ সামনে রেখে বাড়ি ফিরছেন মানুষ। ফাঁকা হতে শুরু করেছে রাজধানীর রাস্তাঘাট। শুক্রবার বেলা দেড়টায় রাজধানীর কুড়িলে