বাঘ কেড়ে নিয়েছে স্বামী, নদী দিয়েছে জীবিকা, সুন্দরবনের জুলেখার নিরন্তর লড়াই
Published: 9th, June 2025 GMT
সকাল, বিকেল কিংবা রাত নয়, ভাটা হলেই জাল হাতে নদীতে নামেন। নদীর এ মাথা থেকে ও মাথা জাল টানেন। কোনো ঝুঁকিই তাঁর কাছে ঝুঁকি মনে হয় না। বড় আপন মনে হয় সুন্দরবনের এই মামুদো নদীকে। এই নদীতে যে তাঁর জীবন বাঁধা। স্বামী করিম গাজী বাঘের পেটে যাওয়ার পর এ নদীই তাঁকে দিয়েছে দিশা। সেখানে জাল টেনে চিংড়ি রেণু ধরে প্রায় ২২ বছর চলছে জুলেখা বিবির (৫২) বেঁচে থাকার নিরন্তর লড়াই।
জুলেখা বিবির বসবাস সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবনের একেবারে পেটের মধ্যে গোলাখালী গ্রামে। হঠাৎ করে দেখলে মনে হবে এ তো গ্রাম নয়, সুন্দরবন। তিন দিক দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে সুন্দরবন, একদিকে ধনচিখালী নদী। এখানে ৭৮টি পরিবারের পাঁচ শতাধিক মানুষের বসবাস। আধুনিক কোনো সুযোগ–সুবিধা এখানকার মানুষকে স্পর্শ করেনি। সবার একমাত্র বেঁচে থাকার অবলম্বন সুন্দরবন আর সুন্দরবন–সংলগ্ন নদীগুলো।
সাতক্ষীরা শহর থেকে গোলখালী গ্রাম প্রায় ১০০ কিলোমিটার। সম্প্রতি ভাঙচোরা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হয় জুলেখা বিবির সঙ্গে। সকাল তখন সাড়ে ১০টা। গোলাখালী গ্রামের মানুষ নদীতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। জুলেখা বিবিও প্রস্তুতি নিচ্ছেন নদীতে নামার।
জুলেখা বলে চলেন তাঁর জীবনের গল্প, ‘তখন আমার বয়স ২৯ কিংবা ৩০ হবে। তিন মেয়ে ও এক ছ্যালের মা আমি। কুলে সাবর ছোট সাবাল (ছেলে) মোস্তাফা কামাল। বয়স তাঁর বছর পেরুয়ে সবে। একদিন সুকালে ওর বাপ করিম গাজী ও একই এলাকার নওসাদ সরদার, গণি সরদার, ইউসুফ মোল্যাসহ পাঁচ-ছয় জন সুন্দরবনে গিইলো মাছ মারতি। পরের দিন ২০০১ সালের ২৭ মে খবর এল আমার স্বামীকে বাঘে খাইছে। এক দিন পরে দুপুরে ওর বাপের লাশ এল। চিনতে পারিনি ক্ষতবিক্ষত দেহ। কবর দিলাম এই গোলাখালী গেরামে।’
স্বামীকে হারানোর পর কয়েক দিন নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন চার সন্তানের মা জুলেখা। কীভাবে সংসার চলবে, তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যান। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে এক বছরের মোস্তফাকে বাড়িতে রেখে নদীতে নামেন রেণু ধরতে।
গোলাখালী গ্রামে পাঁচ কাঠা জমি কিনে মাথা গোঁজার ঠাঁই করেছেন জুলেখা বিবি.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ন দরবন
এছাড়াও পড়ুন:
বাবাকে টেনে নিয়েছিল বাঘ, ছেলে বড় হয়ে হন কিংবদন্তি বাঘশিকারি
খুলনার কয়রা উপজেলার কালিকাপুর গ্রামে জন্ম আর্জান সর্দারের। আর্জানের বয়স যখন মাত্র দুই বছর, তখন তাঁর বাবাকে সুন্দরবনের বাঘ টেনে নিয়েছিল। মুখে করে ঝুলিয়ে নেওয়ার সময় দুই হাতে যা পেয়েছেন, আঁকড়ে ধরে প্রাণ রক্ষার চেষ্টা করেছিলেন। তবে শেষরক্ষা হয়নি। বাবার লাশটাও পাওয়া যায়নি।
সেই বাবার ছেলে আর্জান সময়ের ব্যবধানে হয়ে ওঠেন সুন্দরবনের কিংবদন্তি বাঘশিকারি। ছোটখাটো গড়নের শান্ত চেহারার মানুষটির ছিল চওড়া কপাল আর বিরাট গোঁফ। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে শিকারি আর্জান সর্দারের সঙ্গে দেখা হয় বহু গ্রন্থের প্রণেতা শিবশঙ্কর মিত্রর। সুন্দরবনসংলগ্ন উপকূলীয় জনপদে থাকা পৈতৃক জমি উদ্ধারে এসে লেখকের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল। তাঁর বর্ণনায় আর্জান সর্দারের চেহারা এমন।
শিবশঙ্কর মিত্র ‘সুন্দরবনের আর্জান সর্দার’ বইয়ে লিখেছেন, আর্জান সর্দার তাঁর জীবনের এক ‘আবিষ্কার’। আর্জান তাঁর জন্মস্থান কালিকাপুর থেকে পরে কয়রার সুন্দরবনসংলগ্ন মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের সর্দারপাড়ায় এসে বসবাস শুরু করেছিলেন। এক দশকের বেশি সময় ধরে আর্জানের সঙ্গে লেখকের যোগাযোগ ছিল। একসঙ্গে তাঁরা ঘুরেছেন সুন্দরবনের গহিনে। আর্জানের বাঘ শিকারের গল্প উঠে এসেছে তাঁর লেখায়।
একবার সুন্দরবনের ঝাপসি এলাকায় গোলপাতা বহনের নৌকার ভেতর থেকে এক বাওয়ালির ঘাড় কামড়ে নিয়ে যায় মানুষখেকো বাঘ। বাঘটিকে শিকারের দায়িত্ব পান আর্জান। ছোট ডিঙিনৌকা নিয়ে একাই জঙ্গলে ঢুকে বাঘের পায়ের ছাপ দেখে আর্জান বুঝতে পারেন, এটা বাঘ নয়, বাঘিনী। কিছুদূর এগিয়ে ঝোপের পাশে মৃত মানুষের পা চোখে পড়ে আর্জানের। কিন্তু পাশে বাঘিনী ছিল না। অনেক খুঁজে আর্জান স্থির করলেন, রাতে নিশ্চয় বাঘিনী আসবে। পাশের একটি গাছে উঠে অপেক্ষা করতে থাকেন। তবে সে রাতে বাঘিনী আর আসেনি।
সুন্দরবনের বাঘশিকারি আর্জান সর্দারকে নিয়ে শিবশঙ্কর মিত্রের লেখা বইয়ের প্রচ্ছদ