মুখ ফিরিয়েছে বিশ্ব, গাজা কি নিভে আসছে
Published: 9th, June 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবসের (৪ জুলাই) এক মাস আগে দেশটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব ভেটো (‘না’ ভোট) দিয়ে আটকে দেয়।
প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, গাজায় সব পক্ষকে মেনে চলার জন্য ‘একটি স্থায়ী, নিঃশর্ত ও দ্রুত যুদ্ধবিরতির ঘোষণা’ দিতে হবে এবং হামাস ও অন্যান্য গোষ্ঠীর হাতে থাকা সব ইসরায়েলি বন্দীকে সম্মানজনকভাবে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে।
নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যদেশের মধ্যে ১৪টি দেশ এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলেও একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র বিরোধিতা করায় সেটি বাতিল হয়ে যায়।
প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছিল, গাজায় মানবিক ত্রাণ পৌঁছাতে যেসব বাধা আছে সেসব বাধা এবং গাজার ওপর আরোপ করা সব নিষেধাজ্ঞা তুলে দিতে হবে; জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থা যেন নিরাপদে বাধা ছাড়া ত্রাণ পৌঁছাতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
এই ভেটোর ঘটনার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ঘোষণা দেন, আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) চারজন বিচারককে নিষেধাজ্ঞার তালিকায় আনা হচ্ছে।
কারণ, তাঁরা ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার চেষ্টা করেছেন। এর আগে একই কারণে আন্তর্জাতিক আদালতের প্রধান কৌঁসুলিকেও নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
আরও পড়ুনগাজাবাসীর ঈদ: ‘কোরবানি দেওয়ার মতো কিছু নেই শুধু নিজেদের ছাড়া’০৬ জুন ২০২৫সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্র শুধু গাজায় যুদ্ধবিরতি থামানোর প্রস্তাবে বাধা দেয়নি, বরং যাঁরা যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে চান, তাঁদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির (আইসিআরসি) প্রধান মিরিয়ানা স্পলিয়ারিচ গাজাকে ‘পৃথিবীর নরক থেকেও ভয়াবহ’ বলে বর্ণনা করেছেন।
ইসরায়েলের মূল লক্ষ্য হলো গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের চূড়ান্তভাবে উচ্ছেদ করা। এই নীতিকে টিকে থাকতে সাহায্য করছে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন এবং আরব দেশগুলোর নীরবতা।
ইসরায়েলের সরকারে যাঁরা আছেন, তাঁরা তাঁদের এই সামরিক লক্ষ্য নিয়ে কোনো রাখঢাক করছেন না; বরং স্পষ্ট করেই বলে আসছেন, তাঁরা কী করতে চান।
আরও পড়ুনগাজায় গণহত্যায় যুক্তরাজ্য যেভাবে মদদ দিচ্ছে০৫ জুন ২০২৫গাজায় মানুষের জীবনধারণের জন্য যেসব মৌলিক জিনিস দরকার, যেমন পানি, বিদ্যুৎ, ঘরবাড়ি, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি হাসপাতাল—সবই ইসরায়েল ধ্বংস করে দিয়েছে। এখন গাজায় ঠিকমতো কাজ করতে পারছে, এমন হাসপাতাল আছে মাত্র দুটি।
জাতিসংঘ বলছে, এ দুটি হাসপাতালকে নিরাপদ রাখতে হবে, কারণ প্রতিদিন গাজায় বিমান হামলা আর ক্ষেপণাস্ত্র আঘাতে বহু মানুষ মারা যাচ্ছে বা আহত হচ্ছে। এদের মধ্যে শিশু আর বৃদ্ধের সংখ্যা অনেক বেশি। জাতিসংঘ আরও জানাচ্ছে, প্রতিদিন গাজায় অপুষ্ট শিশুদের সংখ্যা বাড়ছে।
এই অপুষ্টির প্রধান কারণ হলো ইসরায়েলের আরোপ করা খাদ্য অবরোধ। আন্তর্জাতিক অনেক সাহায্য সংস্থা এই অবরোধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে, কিন্তু ইসরায়েল তা গ্রাহ্য করেনি। বরং তারা নিজেরাই কিছু ‘খাদ্য বিতরণ কেন্দ্র’ চালু করেছে।
এসব জায়গায় বহু ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিকে (যাঁদের মধ্যে নারীও রয়েছেন) ইসরায়েলি ট্যাংকে বসানো মেশিনগান দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
গাজায় খাদ্যসংকটের এই জটিল পরিস্থিতির আরেকটি দিক হলো, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, তাঁর সরকার এমন একটি গোষ্ঠীকে অস্ত্র দিয়েছে, যাদের অনেকেই অপরাধী এবং যাদের সম্পর্কে ধারণা করা হয়, তারা ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিরোধী দলের রাজনীতিক আবিগদর লিবারম্যান ইসরায়েলি রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যমকে জানান, প্রধানমন্ত্রী নিজেই একতরফাভাবে আবু শাবাব নামের একটি গোষ্ঠীকে অস্ত্র দেওয়ার অনুমোদন দিয়েছেন এবং তাদের কাছে অস্ত্র হস্তান্তরও করেছেন।
তাঁর ভাষায়, ‘ইসরায়েলি সরকার একদল অপরাধী ও দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে অস্ত্র দিচ্ছে, যাদের অনেকেই আইএস গোষ্ঠীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।’
বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল একাধিক সূত্র জানিয়েছে, যাদের ইসরায়েলি সরকার অস্ত্র দিয়েছে, সেই গোষ্ঠীর নেতা ইয়াসির আবু শাহাব একজন সাবেক আইএস কমান্ডার এবং বর্তমানে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে কাজ করছেন।
ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর (ইসরায়েলি অকুপেশন ফোর্সেস) মতে, শাহাবের নেতৃত্বাধীন প্রায় ৩০০ জনের একটি দল গাজায় প্রবেশ করা খাদ্যবাহী ট্রাকগুলোর ‘রক্ষা করার’ কাজ করছে। কিন্তু গাজা থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, এই দল আসলে ঠিক তার উল্টো কাজ করছে।
তারা এই খাদ্যবাহী ট্রাকগুলো দখল করে নিচ্ছে এবং অপুষ্টিতে ভোগা, ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের জন্য বরাদ্দ খাদ্যসামগ্রী লুট করছে।
আরও পড়ুনগাজায় ‘জল্লাদের উল্লাস’ কি থামবে না১০ জানুয়ারি ২০২৫এই একতরফা জাতিগত নির্মূল কার্যক্রম (যা যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের সক্রিয় সহযোগিতায় পরিচালিত হচ্ছে) তা ইউরোপের অন্তত কিছু জনগণের মধ্যে মতামতের পরিবর্তন ঘটাচ্ছে।
স্টিভ উইটকফের বিরুদ্ধে একাধিকবার অভিযোগ উঠেছে, তিনি হামাসের সঙ্গে একরকম চুক্তি করে পরে তা অমান্য করেন এবং দোষ চাপান হামাসের ওপর। তিনি প্রকৃত সত্য গোপন করে ঘটনাকে নিজের মতো করে উপস্থাপন করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এই পরিস্থিতির কারণে ইউরোপে জনমত ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমে ইসরায়েলের পক্ষে কাজ করা প্রচারণাকারীদের এখন অনেক কঠিন প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। এত দিন তাঁরা কোনো বাধা ছাড়াই মিথ্যা প্রচার চালিয়ে যেতে পারলেও, এখন কিছু সাংবাদিক সেই প্রচারণার বিরুদ্ধেই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন।
ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কথা বলার মতো আরব বিশ্বের বন্ধু কম; বরং এই অঞ্চলের নেতারা ট্রাম্পকে হাত খুলে অর্থ দিয়েছেন, কিন্তু গণহত্যা বন্ধে কোনো চাপ প্রয়োগ করেননি। গাজায় যখন গণহত্যা চলছে, তখন আমরা দেখলাম, ‘উম্মাহ’র সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাশক্তি যে দেশটির হাতে, সেই দেশের ক্ষমতাধর অভিজাত কর্মকর্তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা মার্কিন দূতাবাসের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার ‘সম্মান’ পাওয়ার আশায়।সম্প্রতি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইউগোভ পরিচালিত একটি জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, ২০১৬ সাল থেকে ইসরায়েল বিষয়ে জনমত পর্যবেক্ষণ শুরু হওয়ার পর এই প্রথমবার সবচেয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। জরিপে অংশ নেওয়া অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড অন্যায্য।
তবু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্ভবত এখনো বিশ্বাস করেন, তাঁর ‘গাজা পুনর্গঠন পরিকল্পনা’ ঠিক পথেই রয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করাই হবে বাস্তবতা।
ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কথা বলার মতো আরব বিশ্বের বন্ধু কম; বরং এই অঞ্চলের নেতারা ট্রাম্পকে হাত খুলে অর্থ দিয়েছেন, কিন্তু গণহত্যা বন্ধে কোনো চাপ প্রয়োগ করেননি।
গাজায় যখন গণহত্যা চলছে, তখন আমরা দেখলাম, ‘উম্মাহ’র সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাশক্তি যে দেশটির হাতে, সেই দেশের ক্ষমতাধর অভিজাত কর্মকর্তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা মার্কিন দূতাবাসের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার ‘সম্মান’ পাওয়ার আশায়।
ডন থেকে নেওয়া
অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
আব্বাস নাসির ডন পত্রিকার সাবেক সম্পাদক
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র ইসর য় ল র প রস ত ব পর স থ ত গণহত য কর ছ ন ক জ কর সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
হাইতিতে গ্যাং হামলায় ৫০ জনের বেশি নিহত
ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশ হাইতিতে গত সপ্তাহে একাধিক গ্যাং হামলায় ৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কের (আরএনডিডিএইচ) তথ্যানুসারে, সংকটে জর্জরিত দেশটিতে সর্বশেষ ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা এটি।
মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বার্তা সংস্থা এএফপির বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্যারন’স।
গতকাল সোমবার এএফপিকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে আরএনডিডিএইচ জানায়, গত ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের উত্তর এলাকায় এই হামলাগুলো ঘটে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০২৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিহত হওয়া বহু মানুষের লাশ এখনও পাওয়া যায়নি। লাশগুলো এখনও ঝোপের মধ্যে পড়ে আছে এবং কুকুর লাশগুলো খেয়ে ফেলেছে।’
পশ্চিম গোলার্ধের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ হাইতি। দেশটির একটি অংশ ও রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের বেশিরভাগ এলাকা সশস্ত্র গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকায় সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২০২৪ সালের শুরুর দিকে গ্যাংগুলোর একটি জোট লাগাতার হামলা শুরু করলে পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। যার ফলে প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরি পদত্যাগ করেন এবং প্রেসিডেন্টের অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
হাইতির পুলিশকে সমর্থন করার জন্য কেনিয়ার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী মোতায়েন করার পরও সহিংসতা দমন করা সম্ভব হয়নি।
আরএনডিডিএইচ জানিয়েছে, ভিভ আনসানম গ্যাং জোট, যারা ২০২৪ সালের মার্চ মাস থেকে ক্যাবারেট শহরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তারা গত সপ্তাহে নিকটবর্তী ল্যাবোডেরি শহরে বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে অত্যন্ত নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়েছে। শহরটি রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্স থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত।
সংস্থাটি আরো জানায়, ‘তারা ৫০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে এবং বেশ কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।’
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘বেঁচে থাকা কয়েকজন পার্শ্ববর্তী এলাকায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। অন্যান্যরা আক্রমণকারীদের হাত থেকে বাঁচতে নৌকায় করে সমুদ্রে পালিয়ে যায়।’
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত মাসে সতর্ক করে বলেছেন, হাইতিতে ‘রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ভেঙে পড়ছে।’
তিনি নিরাপত্তা পরিষদকে সতর্ক করে বলেন, হাইতির রাজধানীর বাইরেও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানকার ৯০ শতাংশ অঞ্চলের ওপর গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
রবিবার, তিনি ক্যাবারে কমিউনে হামলার নিন্দা জানিয়েছেন এবং দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় ‘সরবরাহ, কর্মী ও তহবিল দিয়ে বহুজাতিক নিরাপত্তা সহায়তা মিশনকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করার’ আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে হাইতিতে কমপক্ষে ৩ হাজার ১৪১ জন নিহত হয়েছে।
ঢাকা/ফিরোজ