মুখ ফিরিয়েছে বিশ্ব, গাজা কি নিভে আসছে
Published: 9th, June 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবসের (৪ জুলাই) এক মাস আগে দেশটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব ভেটো (‘না’ ভোট) দিয়ে আটকে দেয়।
প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, গাজায় সব পক্ষকে মেনে চলার জন্য ‘একটি স্থায়ী, নিঃশর্ত ও দ্রুত যুদ্ধবিরতির ঘোষণা’ দিতে হবে এবং হামাস ও অন্যান্য গোষ্ঠীর হাতে থাকা সব ইসরায়েলি বন্দীকে সম্মানজনকভাবে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে।
নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যদেশের মধ্যে ১৪টি দেশ এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলেও একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র বিরোধিতা করায় সেটি বাতিল হয়ে যায়।
প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছিল, গাজায় মানবিক ত্রাণ পৌঁছাতে যেসব বাধা আছে সেসব বাধা এবং গাজার ওপর আরোপ করা সব নিষেধাজ্ঞা তুলে দিতে হবে; জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থা যেন নিরাপদে বাধা ছাড়া ত্রাণ পৌঁছাতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
এই ভেটোর ঘটনার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ঘোষণা দেন, আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) চারজন বিচারককে নিষেধাজ্ঞার তালিকায় আনা হচ্ছে।
কারণ, তাঁরা ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার চেষ্টা করেছেন। এর আগে একই কারণে আন্তর্জাতিক আদালতের প্রধান কৌঁসুলিকেও নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
আরও পড়ুনগাজাবাসীর ঈদ: ‘কোরবানি দেওয়ার মতো কিছু নেই শুধু নিজেদের ছাড়া’০৬ জুন ২০২৫সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্র শুধু গাজায় যুদ্ধবিরতি থামানোর প্রস্তাবে বাধা দেয়নি, বরং যাঁরা যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে চান, তাঁদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির (আইসিআরসি) প্রধান মিরিয়ানা স্পলিয়ারিচ গাজাকে ‘পৃথিবীর নরক থেকেও ভয়াবহ’ বলে বর্ণনা করেছেন।
ইসরায়েলের মূল লক্ষ্য হলো গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের চূড়ান্তভাবে উচ্ছেদ করা। এই নীতিকে টিকে থাকতে সাহায্য করছে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন এবং আরব দেশগুলোর নীরবতা।
ইসরায়েলের সরকারে যাঁরা আছেন, তাঁরা তাঁদের এই সামরিক লক্ষ্য নিয়ে কোনো রাখঢাক করছেন না; বরং স্পষ্ট করেই বলে আসছেন, তাঁরা কী করতে চান।
আরও পড়ুনগাজায় গণহত্যায় যুক্তরাজ্য যেভাবে মদদ দিচ্ছে০৫ জুন ২০২৫গাজায় মানুষের জীবনধারণের জন্য যেসব মৌলিক জিনিস দরকার, যেমন পানি, বিদ্যুৎ, ঘরবাড়ি, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি হাসপাতাল—সবই ইসরায়েল ধ্বংস করে দিয়েছে। এখন গাজায় ঠিকমতো কাজ করতে পারছে, এমন হাসপাতাল আছে মাত্র দুটি।
জাতিসংঘ বলছে, এ দুটি হাসপাতালকে নিরাপদ রাখতে হবে, কারণ প্রতিদিন গাজায় বিমান হামলা আর ক্ষেপণাস্ত্র আঘাতে বহু মানুষ মারা যাচ্ছে বা আহত হচ্ছে। এদের মধ্যে শিশু আর বৃদ্ধের সংখ্যা অনেক বেশি। জাতিসংঘ আরও জানাচ্ছে, প্রতিদিন গাজায় অপুষ্ট শিশুদের সংখ্যা বাড়ছে।
এই অপুষ্টির প্রধান কারণ হলো ইসরায়েলের আরোপ করা খাদ্য অবরোধ। আন্তর্জাতিক অনেক সাহায্য সংস্থা এই অবরোধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে, কিন্তু ইসরায়েল তা গ্রাহ্য করেনি। বরং তারা নিজেরাই কিছু ‘খাদ্য বিতরণ কেন্দ্র’ চালু করেছে।
এসব জায়গায় বহু ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিকে (যাঁদের মধ্যে নারীও রয়েছেন) ইসরায়েলি ট্যাংকে বসানো মেশিনগান দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
গাজায় খাদ্যসংকটের এই জটিল পরিস্থিতির আরেকটি দিক হলো, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, তাঁর সরকার এমন একটি গোষ্ঠীকে অস্ত্র দিয়েছে, যাদের অনেকেই অপরাধী এবং যাদের সম্পর্কে ধারণা করা হয়, তারা ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিরোধী দলের রাজনীতিক আবিগদর লিবারম্যান ইসরায়েলি রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যমকে জানান, প্রধানমন্ত্রী নিজেই একতরফাভাবে আবু শাবাব নামের একটি গোষ্ঠীকে অস্ত্র দেওয়ার অনুমোদন দিয়েছেন এবং তাদের কাছে অস্ত্র হস্তান্তরও করেছেন।
তাঁর ভাষায়, ‘ইসরায়েলি সরকার একদল অপরাধী ও দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে অস্ত্র দিচ্ছে, যাদের অনেকেই আইএস গোষ্ঠীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।’
বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল একাধিক সূত্র জানিয়েছে, যাদের ইসরায়েলি সরকার অস্ত্র দিয়েছে, সেই গোষ্ঠীর নেতা ইয়াসির আবু শাহাব একজন সাবেক আইএস কমান্ডার এবং বর্তমানে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে কাজ করছেন।
ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর (ইসরায়েলি অকুপেশন ফোর্সেস) মতে, শাহাবের নেতৃত্বাধীন প্রায় ৩০০ জনের একটি দল গাজায় প্রবেশ করা খাদ্যবাহী ট্রাকগুলোর ‘রক্ষা করার’ কাজ করছে। কিন্তু গাজা থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, এই দল আসলে ঠিক তার উল্টো কাজ করছে।
তারা এই খাদ্যবাহী ট্রাকগুলো দখল করে নিচ্ছে এবং অপুষ্টিতে ভোগা, ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের জন্য বরাদ্দ খাদ্যসামগ্রী লুট করছে।
আরও পড়ুনগাজায় ‘জল্লাদের উল্লাস’ কি থামবে না১০ জানুয়ারি ২০২৫এই একতরফা জাতিগত নির্মূল কার্যক্রম (যা যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের সক্রিয় সহযোগিতায় পরিচালিত হচ্ছে) তা ইউরোপের অন্তত কিছু জনগণের মধ্যে মতামতের পরিবর্তন ঘটাচ্ছে।
স্টিভ উইটকফের বিরুদ্ধে একাধিকবার অভিযোগ উঠেছে, তিনি হামাসের সঙ্গে একরকম চুক্তি করে পরে তা অমান্য করেন এবং দোষ চাপান হামাসের ওপর। তিনি প্রকৃত সত্য গোপন করে ঘটনাকে নিজের মতো করে উপস্থাপন করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এই পরিস্থিতির কারণে ইউরোপে জনমত ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমে ইসরায়েলের পক্ষে কাজ করা প্রচারণাকারীদের এখন অনেক কঠিন প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। এত দিন তাঁরা কোনো বাধা ছাড়াই মিথ্যা প্রচার চালিয়ে যেতে পারলেও, এখন কিছু সাংবাদিক সেই প্রচারণার বিরুদ্ধেই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন।
ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কথা বলার মতো আরব বিশ্বের বন্ধু কম; বরং এই অঞ্চলের নেতারা ট্রাম্পকে হাত খুলে অর্থ দিয়েছেন, কিন্তু গণহত্যা বন্ধে কোনো চাপ প্রয়োগ করেননি। গাজায় যখন গণহত্যা চলছে, তখন আমরা দেখলাম, ‘উম্মাহ’র সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাশক্তি যে দেশটির হাতে, সেই দেশের ক্ষমতাধর অভিজাত কর্মকর্তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা মার্কিন দূতাবাসের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার ‘সম্মান’ পাওয়ার আশায়।সম্প্রতি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইউগোভ পরিচালিত একটি জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, ২০১৬ সাল থেকে ইসরায়েল বিষয়ে জনমত পর্যবেক্ষণ শুরু হওয়ার পর এই প্রথমবার সবচেয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। জরিপে অংশ নেওয়া অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড অন্যায্য।
তবু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্ভবত এখনো বিশ্বাস করেন, তাঁর ‘গাজা পুনর্গঠন পরিকল্পনা’ ঠিক পথেই রয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করাই হবে বাস্তবতা।
ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কথা বলার মতো আরব বিশ্বের বন্ধু কম; বরং এই অঞ্চলের নেতারা ট্রাম্পকে হাত খুলে অর্থ দিয়েছেন, কিন্তু গণহত্যা বন্ধে কোনো চাপ প্রয়োগ করেননি।
গাজায় যখন গণহত্যা চলছে, তখন আমরা দেখলাম, ‘উম্মাহ’র সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাশক্তি যে দেশটির হাতে, সেই দেশের ক্ষমতাধর অভিজাত কর্মকর্তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা মার্কিন দূতাবাসের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার ‘সম্মান’ পাওয়ার আশায়।
ডন থেকে নেওয়া
অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
আব্বাস নাসির ডন পত্রিকার সাবেক সম্পাদক
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র ইসর য় ল র প রস ত ব পর স থ ত গণহত য কর ছ ন ক জ কর সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ইসরায়েলি মানবাধিকার সংগঠনই বলছে, ‘গাজায় গণহত্যা চলছে’
ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি মানবাধিকার সংগঠন বিটসেলেম ‘আমাদের গণহত্যা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
সোমবার (২৮ জুলাই) প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধকে কঠোরভাবে নিন্দা করা হয়েছে। চলমান যুদ্ধে এখন পর্যন্ত অন্তত ৫৯ হাজার ৭৩৩ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে; আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৪৭৭ জন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের নীতি এবং এর ভয়াবহ পরিণতির বিশ্লেষণ, সঙ্গে ইসরায়েলি শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের ও সামরিক কর্মকর্তাদের এই হামলার উদ্দেশ্য নিয়ে দেওয়া বিবৃতিগুলো একত্রে বিচার করলে স্পষ্টভাবে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় যে, ইসরায়েল সমন্বিতভাবে এমন পদক্ষেপ নিচ্ছে যার উদ্দেশ্য গাজা উপত্যকার ফিলিস্তিনি সমাজকে ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস করা।”
আরো পড়ুন:
‘আমরা মরে যাচ্ছি’, গণঅনাহারে বৈশ্বিক নীরবতায় গাজার ধিক্কার
‘আজ তুমি কিছু খেয়েছো?’ গাজায় অনাহার আর টিকে থাকার গল্প
“অন্য কথায় বলতে হয়, ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালাচ্ছে,” বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস-নেতৃত্বাধীন হামলায় আনুমানিক ১ হাজার ১৩৯ জন ইসরায়েলি নিহত হন এবং প্রায় ২০০ জনকে জিম্মি করা হয়।
‘আমাদের গণহত্যা’
বিটসেলেমের প্রতিবেদনে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সংঘটিত বিভিন্ন নিপীড়নের বিশ্লেষণ করা হয়। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই নিপীড়ন শুরু হয়।
“এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই একটি সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য ছিল ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণাধীন পুরো অঞ্চলে ইহুদি গোষ্ঠীর প্রাধান্য স্থাপন করা,” বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এতে আরো বলা হয়েছে, “এই প্রেক্ষাপটে ইসরায়েল রাষ্ট্র উপনিবেশবাদী বসতি স্থাপন-ভিত্তিক কাঠামোর বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে, যার মধ্যে রয়েছে ব্যাপকভাবে বসতি স্থাপন, উচ্ছেদ ও জমি দখল, জনসংখ্যাগত প্রকৌশল, জাতিগত নির্মূল এবং ফিলিস্তিনিদের ওপর সামরিক শাসন চাপিয়ে দেওয়া।”
প্রতিবেদনটিতে দেখানো হয়েছে, ইসরায়েল কীভাবে ‘ইহুদি আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে আইনের শাসনের মিথ্যা ছদ্মাবরণ ব্যবহার করেছে, অথচ বাস্তবে ফিলিস্তিনিদের অধিকারগুলো রক্ষা করা হয়নি। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর এসব প্রচেষ্টা আরো ব্যাপকভাবে ত্বরান্বিত হয়েছে।”
‘গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে পরিচালিত বিস্তৃত ও সমন্বিত আক্রমণের’ কথা তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। যেখানে বলা হয়েছ, “অধিকাংশ ইহুদি-ইসরায়েলিদের পাশাপাশি ইসরায়েলের আইনগত ব্যবস্থাও নানাভাবে সমর্থন, বৈধতা ও স্বাভাবিকীকরণের গ্যারান্টি পেয়েছে।”
২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের প্রচেষ্টা আরো জোরদার করা হয়েছে।
“উত্তর গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে অনেক বিশেষজ্ঞ জাতিগত নির্মূলের প্রচেষ্টা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বাস্তবে ২০২৪ সালের নভেম্বরের মধ্যে উত্তর গাজায় বসবাসকারী প্রায় ১ লাখ মানুষ তাদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে,” তথ্য-প্রমাণ দিয়ে বলেছে বিটসেলেম।
প্রতিবেদনটি শুধু গাজার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এতে বলা হয়েছে, “৭ অক্টোবরের পর থেকে ইসরায়েল দখলকৃত পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে তাদের সহিংস অভিযান জোরদার করেছে এতটা ভয়ংকর মাত্রায়, যা ১৯৬৭ সালে পশ্চিম তীর দখলের পর থেকে আর দেখা যায়নি।”
বিটসেলেম প্রথম ২০২১ সালে ‘বর্ণবৈষম্যমূলক শাসন’ শব্দটি ব্যবহার করে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের জন্য ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনে বিরাজমান দ্বৈত বাস্তবতাকে তুলে ধরে।
কথায় ও কাজে গণহত্যা
বিটসেলেমের এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধের পরপর। ওই প্রবন্ধে হলোকাস্ট-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ অ্যামোস গোল্ডবার্গ গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। একইসঙ্গে ইসরায়েলের অভ্যন্তরেও যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে প্রতিবাদ আন্দোলন ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তবে গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধের বিরোধিতা এখনো ইসরায়েলি সমাজে ব্যাপকভাবে বিতর্কিত। জুন মাসে পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক জরিপ অনুযায়ী, মাত্র ১৬ শতাংশের কাছাকাছি ইহুদি-ইসরায়েলি মনে করেন, ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব।
জেরুজালেম সেন্টার ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড ফরেইন অ্যাফেয়ার্স (জেসিএফএ) এর একটি জরিপ অনুযায়ী, প্রায় ৬৪ শতাংশ ইহুদি ইসরায়েলি মনে করেন, ইসরায়েলের উচিত গাজা উপত্যকা সাময়িকভাবে দখলে নেওয়া।
ইসরায়েলের প্রচলিত মনোভাবের সমালোচকদের মধ্যে রয়েছেন দেশটির রাজনৈতিক ভাষ্যকার, সাবেক বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ওরি গোল্ডবার্গ, যিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ এই দৃষ্টিভঙ্গিগুলোকে ‘ঘৃণ্য’ বলে মন্তব্য করেছেন।
ওরি গোল্ডবার্গের মন্তব্যের বিষয়ে লেখক, গবেষক এবং ‘দ্য ফায়ার দেজ টাইমস’ পডকাস্টের প্রতিষ্ঠাতা এলিয়া আয়ুব আলজাজিরাকে বলেন, “আমি একমাত্র এই উপসংহারেই পৌঁছাতে পারি যে, ইসরায়েলি সমাজের ভেতরের চাপ সত্যিই ওরি গোল্ডবার্গ সম্প্রতি যেভাবে উল্লেখ করেছেন, ঠিক ততটাই গভীর।”
তিনি আরো বলেন, “ইসরায়েলি সমাজ প্রায় দুই বছর ধরে একটি গণহত্যাকে স্বাভাবিক করে তুলেছে এবং এটি তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মূলে থাকা এক গভীর নৈতিক পচনের প্রমাণ।”
ইসরায়েলের সরকারি কর্মকর্তারাও গাজার জনগণের বিরুদ্ধে তাদের সহিংস আহ্বান রেখে যাচ্ছেন।
গত সপ্তাহে ইসরায়েলি রেডিওতে হেরিটেজ মন্ত্রী আমিচাই এলিয়াহু বলেন, “সরকার গাজাকে নিশ্চিহ্ন করার কাজ করছে এবং ঈশ্বরের কৃপায় আমরা এই ‘পাপময়তা’ (গাজার বাসিন্দারা) নিশ্চিহ্ন করছি। গাজার সব অঞ্চল ইহুদিদের হবে।”
অনেক দেরিতে হলেও সাংবাদটিকে স্বাগত
বিটসেলেমের প্রতিবেদনটি ৭৯ পৃষ্ঠাবিশিষ্ট এবং এতে গাজায় গত ২২ মাস ধরে চলমান হামলার মধ্যে থাকা অসংখ্য ফিলিস্তিনির সাক্ষাৎকার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
ইসরায়েলের সবচেয়ে প্রখ্যাত মানবাধিকার সংগঠনগুলোর একটি বিটসেলেম। সংগঠনটি গাজায় ইসরায়েলের কার্যকলাপকে গণহত্যা বলে বর্ণনা করায় দেশের ভেতরে তারা ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গাজায় নিজেদের দেশের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করা অনেক ইসরায়েলি এরইমধ্যে তাদের দেশের নাগরিকদের কাছ থেকে কঠোর নিন্দার মুখোমুখি হয়েছেন।
এই কারণে বিটসেলেমের ‘গণহত্যা’ শব্দটি ব্যবহারের গুরুত্ব আরো বেড়ে যায়, যদিও কিছু লোক মনে করেন এটি আগেই হওয়া উচিত ছিল।
এ বিষয়ে এলিয়া আয়ুব বলেন, “এই সংবাদকে আমি স্বাগত জানাই, যদিও এটি গণহত্যার অনেক পরে এসেছে।”
২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক আদালতে (আইসিজে) ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে বলে মামলা করে। ব্রাজিল, স্পেন, তুরস্ক ও আইরিশ প্রজাতন্ত্রসহ কয়েকটি দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে মিলিত হয়ে আইসিজেতে মামলায় যোগ দিয়েছে।
ঢাকা/রাসেল