দেশে ৩৫ লাখ শিশু শ্রমিক, ১০ লাখ ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত
Published: 18th, June 2025 GMT
দেশে প্রায় ৩৫ লাখ শিশু শ্রমিক রয়েছে এবং ১০ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। এ তথ্য জানিয়ে শ্রম উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, শিশুশ্রম প্রতিরোধে শিশুদের কাজে নিয়োগ করা ব্যক্তিদের শাস্তি কয়েকগুণ বাড়ানো হবে। সেই সঙ্গে পরিবর্তন করা হবে শিশুশ্রমের সংজ্ঞা।
আজ বুধবার সচিবালয়ে বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে শ্রম উপদেষ্টা এ কথা বলেন। এ সময় শ্রমসচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান, দুই অতিরিক্ত সচিব অমল কৃষ্ণ মণ্ডল, মো.
১৯৯২ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) শিশুশ্রম বন্ধ করতে কর্মসূচি গ্রহণ করে এবং ২০০২ সালের ১২ জুন থেকে প্রতিবছর বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়ে আসছে। এ বছর ওই দিনে সরকারি ছুটি থাকায় সরকার তা পালন করছে আগামীকাল ১৯ জুন। এ জন্য জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আলোচনা সভা, র্যালি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য ‘স্বপ্নের ডানায় ভর করি, শিশুশ্রমের শৃঙ্খল ছিঁড়ি—এগিয়ে চলি দৃপ্ত পায়ে, আশার আগুন বুকে জ্বালি’।
বিদ্যমান শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের কাজ করানো হলে তা শিশুশ্রম হিসেবে গণ্য হবে। কেউ যদি শিশু শ্রমিক নিয়োগ দেন, তাঁকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করার কথা বলা আছে আইনে।
সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় আইএলওর প্রধান কার্যালয়ে ২ থেকে ১৩ জুন আন্তর্জাতিক শ্রম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে ৫ দিনের জন্য যোগ দিয়েছিলেন শ্রম উপদেষ্টা। তিনি জানান, ‘আন্তর্জাতিক শ্রম সম্মেলনে শিশুশ্রমের প্রসঙ্গও উঠেছিল। আমি তাঁদের বলেছি, শিশুশ্রম বলতে তোমরা যা বোঝাও, আমি তা বুঝি না।’
শ্রম উপদেষ্টা বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশের পরিসংখ্যান কতটা বিশ্বাসযোগ্য, আমি জানি না। তবে বর্তমান সংজ্ঞা অনুযায়ী শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ৩৫ লাখ। আর ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত ১০ লাখ শিশু। এটা কীভাবে কমানো যায়, দেখছি।’
দক্ষিণবঙ্গের উদাহরণ দিয়ে শ্রম উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, ‘দেখেছি যে বাবা জাল ও নৌকা নিয়ে নদীতে মাছ ধরতে যাচ্ছে, সঙ্গে ছেলেকেও নিল। ছেলে আবার স্কুলেও যায়। এটাকে এখন শিশুশ্রম বলব কি না, তা একটা প্রশ্ন।’ তিনি বলেন, শিশুশ্রমের সংজ্ঞা পরিবর্তন করা হবে। কাজ চলছে। নতুন সংজ্ঞায় আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রেখে শিশু শ্রমিকদের বয়সসীমা নির্ধারণ করা হবে।
শ্রম উপদেষ্টা বলেন, ‘অনেক পরিবার শিশুকে পাঠায় ওস্তাদের সঙ্গে কাজ করার জন্য। পরে সে নিজেই মেকানিক হয়ে যায়। আমি অনুরোধ করব, জোর করে কাউকে পাঠাবেন না। বাচ্চারা স্কুলের সময় শেষ করে যদি স্বেচ্ছামূলক কোনো কাজ করে, তাকে হয়তো আমরা অন্য রকমভাবে দেখব। তবে জোর করে কোনো শিশুকে কাজে পাঠানো যাবে না। এটা দণ্ডনীয় অপরাধ।’
শিশুশ্রম প্রতিরোধে সরকারের পাশাপাশি পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান ও উন্নয়ন সংস্থাসহ সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে বলে মনে করেন শ্রম উপদেষ্টা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কয়েক মাসের মধ্যেই শ্রম আইন সংশোধন করা হবে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সরকার আইএলও কনভেনশন ১৩৮ ও ১৮২ অনুসমর্থন করেছে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণসহ সব ধরনের শিশুশ্রম নিরসনে অঙ্গীকারবদ্ধ।
ইউনিসেফ ও আইএলও যা বলেছেজাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) গত ১২ জুন বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস পালন করেছে। আইএলও ও ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগে ওই দিন প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক প্রচেষ্টার ফলে শিশুশ্রম উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ২০২৪ সালে বিশ্বে প্রায় ১৩ কোটি ৮০ লাখ শিশুশ্রমে যুক্ত ছিল, যার মধ্যে ৫ কোটি ৪০ লাখ শিশুই ছিল ঝুঁকিপূর্ণ কাজে। এ কারণে তাদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ সালে বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের হার ছিল ৩ দশমিক ২ শতাংশ, ২০২২ সালে তা কমে ২ দশমিক ৭ শতাংশ (প্রায় ১০ লাখ ৭০ হাজার শিশু) হয়েছে। তবে একই সময়ে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে শ্রমে যুক্ত থাকার সামগ্রিক হার ৮ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে সামান্য বেড়ে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ হয়েছে। ক্ষতিকর কাজে যুক্ত শিশুশ্রমের হারও ৪ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ।
ইউনিসেফ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছে, পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট যে গত দুই দশকে বিদ্যালয়ে ভর্তির হার বাড়ায় বাংলাদেশের অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম নির্মূলের লক্ষ্যে পৌঁছানোর সঠিক গতিতে নেই বাংলাদেশ।
ইউনিসেফের মতে, শ্রমে যুক্ত অধিকাংশ শিশু কাজ করছে অনানুষ্ঠানিক খাতে, যেখানে তারা দীর্ঘ সময় ধরে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। পরিস্থিতির পরিবর্তন করতে হলে বাংলাদেশের জরুরি ভিত্তিতে দরকার স্থায়ী, দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই উদ্যোগ হাতে নেওয়া।
বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবসে আইএলও বাংলাদেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গুঞ্জন ডালাকোটি বাংলাদেশে শিশুশ্রম নিরসনের অগ্রগতির স্থবিরতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইউন স ফ ক জ কর ১০ ল খ দশম ক সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ভুলে যাবেন না, শরীরচর্চা একটি সুন্নত
খেলাধুলা ও শারীরিক ব্যায়াম আধুনিক জীবনে প্রায়ই অবহেলিত হয়, বিশেষ করে ব্যস্ততার কারণে। কিন্তু ইসলামে খেলাধুলার একটি গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে, যা নবীজি (সা.)-এর জীবন থেকে শুরু হয়েছে। তিনি নিজে বিভিন্ন খেলাধুলায় অংশ নিয়েছিলেন এবং এর আধ্যাত্মিক ও সামাজিক উপকারিতার কথা উল্লেখ করেছেন।
শরীরচর্চার আধ্যাত্মিক উপকারিতাশরীরচর্চা ইসলামে একটি ভুলে যাওয়া সুন্নাহ, যা আমাদের শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিকভাবে সমৃদ্ধ করে। এটি আমাদের মনোযোগ ও স্থিতিস্থাপকতা বাড়ায়, সম্প্রদায়ের বন্ধন জোরদার করে এবং হারাম থেকে দূরে রাখে। যেমন:
দুটি নিয়ামত এমন আছে, যার প্রতি অনেক মানুষ প্রতারিত হয়: স্বাস্থ্য ও অবসর সময়।সহিহ বুখারী, হাদিস: ৬,৪১২১. মনোযোগ ও অবিচলতা গড়ে তোলে
ইসলাম আমাদের নিজেকে উন্নত করতে ও পরকালে উত্তম স্থান অর্জনের জন্য সংগ্রাম করতে শেখায়। শরীরচর্চা এই প্রক্রিয়ায় সহায়ক; কারণ, এটি মনোযোগ, সংগ্রাম এবং ধৈর্যের মাধ্যমে আমাদের মন ও শরীরকে শক্তিশালী করে।
শারীরিক ব্যায়ামের সময় আমরা যখন মাত্রা অতিক্রম করে যাই, তখন তাৎক্ষণিক আরাম ত্যাগ করে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অর্জনের জন্য মানসিক শক্তি অর্জন হয়।
আরও পড়ুনউত্তম ব্যবসায়ী হওয়ার নববি কৌশল০৯ জুন ২০২৫২. সমাজের শক্তি বৃদ্ধি করে
ইসলামে সামাজিক ধারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সবাই এক উম্মাহর অংশ। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই এই যে তোমাদের উম্মাহ, এটা তো একই উম্মাহ, আর আমি তোমাদের রব, অতএব আমার ইবাদত করো।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ৯২)
জুমার নামাজ, হজের মতো ইবাদত আমাদের সম্প্রদায়ের বন্ধনকে শক্তিশালী করে।
দলগত খেলাধুলা বা ব্যায়াম অনুশলীন এই সমস্যার সমাধান দিতে পারে। সাইক্লিং, দৌড় বা সাঁতারের মতো সামাজিক আয়োজনের মাধ্যমে মুসলিমদের মধ্যে বন্ধন তৈরি করে এবং যোগাযোগ, দলগত কাজ ও স্থিতিস্থাপকতার দক্ষতা বৃদ্ধি করে। এটি ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
৩. হারাম থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেয়
আধুনিক সমাজে হারাম ক্রিয়াকলাপ—যেমন মদ্যপান, অবৈধ সম্পর্ক, জুয়া বা অনৈতিক কনটেন্ট—সহজলভ্য। এই প্রলোভনগুলো থেকে নিজেকে দূরে রাখা, বিশেষ করে তরুণদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। নিয়মিত শরীরচর্চা আমাদের সময় ও শক্তিকে ইতিবাচক কাজে লাগাতে সাহায্য করে। জিমে শরীরচর্চা বা মাঠে শারীরিক প্রশিক্ষণ আমাদের মনকে হারাম থেকে দূরে রাখে এবং দ্বীনের প্রতি নিবেদিত রাখে।
সাইক্লিং, দৌড় বা সাঁতারের মতো সামাজিক আয়োজনের মাধ্যমে মুসলিমদের মধ্যে বন্ধন তৈরি করে এবং যোগাযোগ, দলগত কাজ ও স্থিতিস্থাপকতার দক্ষতা বৃদ্ধি করে।নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘দুটি নিয়ামত এমন আছে, যার প্রতি অনেক মানুষ প্রতারিত হয়: স্বাস্থ্য ও অবসর সময়।’ (সহিহ বুখারী, হাদিস: ৬,৪১২)
শরীরচর্চা আমাদের স্বাস্থ্য ও সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে সাহায্য করে, যা আমাদের দ্বীন ও দুনিয়া উভয়ের জন্য কল্যাণকর।
আরও পড়ুনযে ৪টি পরীক্ষা নবীজি (সা.)–এর জীবনকে দৃঢ়তা দিয়েছে২২ জুলাই ২০২৫হাদিসে উল্লিখিত খেলাধুলানবীজি (সা.)-এর জীবনে খেলাধুলার গুরুত্ব উল্লেখযোগ্য। তিনি নিজে বিভিন্ন শারীরিক কসরতের মতো খেলায় অংশ নিয়েছিলেন এবং এর প্রশংসা করেছেন। কিছু উল্লেখযোগ্য খেলা হলো:
দৌড়: হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, তিনি নবী (সা.)-এর সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে দৌড় দিয়েছিলাম এবং তাঁকে হারিয়েছিলাম। পরে যখন আমার ওজন বেড়ে গেল, তিনি আমাকে হারিয়েছিলেন।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ২,৫৭৮)
বোঝা যায়, শুধু পুরুষ নয়, নারীদের জন্যও এ ধরনের খেলায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে শরীরচর্চা করা অনুমোদিত।
তিরন্দাজি: নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা তিরন্দাজি অনুশীলন করো, কারণ এটি তোমাদের শক্তি বৃদ্ধি করে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,৯১৭)
তিরন্দাজি শারীরিক ও মানসিক দক্ষতা বাড়ায়।
আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে দৌড় দিয়েছিলাম এবং তাঁকে হারিয়েছিলাম। পরে যখন আমার ওজন বেড়ে গেল, তিনি আমাকে হারিয়েছিলেন।হজরত আয়েশা (রা.), সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ২,৫৭৮ঘোড়দৌড়: নবীজি (সা.) ঘোড়দৌড়ের প্রশংসা করেছেন এবং এতে অংশগ্রহণকারীদের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছেন। (সুনানে নাসাঈ, হাদিস: ৩,৫৮৫)
সাঁতার: নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের সন্তানদের সাঁতার, তিরন্দাজি এবং ঘোড়সওয়ারি শেখাও।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ১৬,৫৮২)
কুস্তি: নবীজি (সা.) একবার নিজেই রুকানা নামক একজন ব্যক্তির সঙ্গে কুস্তি লড়েছিলেন এবং তাঁকে পরাজিত করেছিলেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৪,০৭৮)
এই হাদিসগুলো প্রমাণ করে যে খেলাধুলা শুধু শারীরিকভাবে উপকারী নয়, বরং এটি সুন্নাহের একটি অংশ। নবীজির (সা.) জীবন আমাদের জন্য অনুকরণীয়। আধুনিক বিশ্বে যেখানে সামাজিক বিভেদ ও হারামের প্রলোভন আমাদের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে, সেখানে এই খেলাধুলা ও শরীরচর্চা আমাদের দ্বীন ও সমাজকে শক্তিশালী করতে পারে।
আরও পড়ুনসুস্থ জীবনের জন্য নবীজি (সা.)–এর কয়েকটি সুন্নাহ২৯ জুন ২০২৫