গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের তিন ফসলি জমি নষ্ট করে কোনো মতেই ইপিজেড নির্মাণ করা যাবে না। সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের আগেই শান্তিপূর্ণ আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ফসলি জমি সাঁওতালদের ফিরিয়ে দিতে হবে। আগের সরকারের মতো বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও সাঁওতালদের জমিতে ইপিজেড নির্মাণের চেষ্টা করছে।

আজ সকালে রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের আবদুস সালাম হলে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন বক্তারা। ‘গাইবান্ধায় সাঁওতালদের পূর্বপুরুষের জমিতে বৈধ অধিকারের স্বীকৃতি এবং তিন ফসলি কৃষি জমি সুরক্ষার’ দাবিতে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে ১৩ টি সংগঠন। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা।

২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর রংপুর চিনিকলের আওতাধীন গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্মের জমিতে আখ কাটাকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে স্থানীয় সাঁওতালদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের তিনজন মারা যান। আহত হন পুলিশ সদস্যসহ উভয় পক্ষের অন্তত ৩০ জন। পরে পুলিশের অভিযানে চিনিকলের জমিতে গড়ে ওঠা বসতি থেকে সাঁওতালদের উচ্ছেদ করা হয়। এরপর থেকেই ওই জমি উদ্ধার এবং ফেরত পাওয়ার দাবিতে স্থানীয় সাঁওতাল ও বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন আন্দোলন করে আসছে।

আজকের লিখিত বক্তব্যে বেশ কয়েকটি দাবির কথা বলা হয়। দাবিগুলোর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে গোবিন্দগঞ্জ বাগদা ফার্ম এলাকায় ইপিজেড নির্মাণের আগে যথাযথ ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় উপযুক্ত বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে স্বাধীন নিরপেক্ষ সমীক্ষার মাধ্যমে প্রস্তাবিত প্রকল্পের পরিবেশগত ফলাফল (ইআইএ) এবং সামাজিক অর্থনৈতিক প্রভাব (এসআইএ) নিরূপণ করা। এ ছাড়া গোবিন্দগঞ্জ বাগদা ফার্ম এলাকা ছাড়াও বিভিন্ন অঞ্চলের ভূমি, পানি, পরিবেশ ও কৃষিতে এ প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদি ও সুদূরপ্রসারী  প্রভাব নিরূপণ করারও দাবি ওঠে।  জমি রক্ষার আন্দোলনে নিহত টমাস হেমব্রম, মঙ্গল মারডি ও রমেশ টুডু বিচার নিশ্চিত করতে আবুল কালাম আজাদসহ সকল অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান এবং নিহত ও আহতদের পরিবারকে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি করা হয় আজ।

সভাপতির সমাপনী বক্তব্যে এএলআরডি চেয়ারপারসন ও নিজেরা করির সমন্বয়ক খুশি কবির বলেন, বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে হলে কৃষি জমি সংরক্ষণ করা জরুরি।  এ জন্য সাঁওতালদের তিন ফসলি কোনো মতেই ইপিজেড নির্মাণের জন্য ব্যবহার করা যাবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, সাঁওতালরা পূর্ব পুরুষের জমি রক্ষার জন্য আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছে। অবিলম্বে তাদের জমি ফিরিয়ে দেওয়া হোক। এ ছাড়া কর্মসংস্থানের কথা বলে কৃষি জমিতেই ইপিজেড নির্মাণ সঠিক নয়। কৃষিই আমাদের কর্মসংস্থানের জোগান দেয়।

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, পাকিস্তান আমলে ইক্ষু চাষ ও চিনিকল নির্মাণের জন্য সাঁওতালদের ১৮৪২ দশমিক ৩০ একর জমি হুকুম দখল করা হয়। পরে ১৯৬২ সালে তৎকালীন সরকার এ জমি রংপুর সুগার মিলকে হস্তান্তর করে। কথা ছিল, যথাযথ কাজের জন্য এসব জমি ব্যবহার না করা হলে জমির মালিকে জমি ফেরত দেওয়া হবে। ২০০৪ সালে রংপুর সরকার মিল বন্ধ হয়ে গেলেও জমি ফেরত দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে বিগত স্বৈরাচারী আমলে এ জমিতে ইপিজেড নির্মাণের কথা বলা হয়েছিল। নানা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সে প্রকল্প বন্ধ হলেও ৫ ই আগস্টের পর অন্তর্বর্তী সরকার নতুন করে এটি করার চেষ্টা করছে। স্থানীয় প্রশাসনের কোনো কোনো কর্মকর্তা  ইআইএ ও এসআইএ সম্পন্ন হওয়ার আগেই সেখানে বসবাসরত সাঁওতাল ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।

সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনিন্দ্র কুমার নাথ, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী সাইদুর রহমান,নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন। সংবাদ সম্মেলনটি আয়োজন করে এএলআরডি, নিজেরা করি, টিআই-বি, ব্লাস্ট, বেলা, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন, বারসিক, নাগরিক উদ্যোগ, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, এইচডিআরসি, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, কাপেং ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গ ব ন দগঞ জ প রকল প চ ন কল র জন য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

গোলটেবিল মত: কৃষি, ভূসম্পত্তিতে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরব হতে হবে

ক্ষমতায়নে নারীদের এখনো পিছিয়ে পড়ার দিকটি দেখিয়ে কৃষি, ভূমিসহ প্রাকৃতিক সম্পদে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আহ্বান এসেছে ঢাকায় এক গোলটেবিল বৈঠক থেকে। আলোচনায় বৈষম্য অবসানে আন্দোলনের কথাও এসেছে।

অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) ও স্ট্যান্ড ফর ল্যান্ড ক্যাম্পেইন (এস ফোর এইচএল) বাংলাদেশের উদ্যোগে আজ শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘ভূমি, কৃষিসহ সব প্রাকৃতিক সম্পদ ও সম্পত্তিতে নারীর অধিকার: সরকার ও নাগরিক সমাজের করণীয়’ শিরোনামে এই গোলটেবিল আলোচনা হয়। আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস-২০২৫ উপলক্ষে ছিল এই আয়োজন। এবার দিবসটি পালিত হচ্ছে ‘সকল নারী ও মেয়েদের অধিকার, সমতা ও ক্ষমতায়ন’ প্রতিপাদ্যে।

আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনা করেন এএলআরডির উপনির্বাহী পরিচালক এবং স্ট্যান্ড ফর হার ল্যান্ড (এস ফোর এইচএল) ক্যাম্পেইন, বাংলাদেশ-এর ফোকাল পারসন রওশন জাহান মনি। তিনি বাংলাদেশে কৃষি খাতে নারীর অবস্থা তুলে ধরে বৈষম্য নিরসনে রাজনৈতিক দল, সরকার ও নাগরিক সমাজের করণীয় সুপারিশ করেন।

তৃণমূল থেকে আসা দিনাজপুরের আদিবাসী নারী সাবিনা হেমব্রম খাসজমি বরাদ্দে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, আদিবাসী নারীরা কৃষির ওপর নির্ভরশীল হলেও তাঁদের নিজস্ব কৃষিভূমি নেই। অথচ তাঁর এলাকায় প্রচুর খাসজমি থাকলেও দরিদ্র কৃষকদের বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে না।

পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়ন থেকে আসা মিতা রানী হিন্দুধর্মের নারীদের পারিবারিক সম্পত্তিতে আইনি অধিকার পেতে আর কত দিন অপেক্ষা করতে হবে, সেই প্রশ্ন রাখেন রাজনৈতিক দল ও সরকারের কাছে।

শ্রীমঙ্গল থেকে আসা তামান্না সিং বারাইক চা-শ্রমিকদের দুর্দশা লাঘবের বিষয়গুলো রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে আসবে কি না, তা জানতে চেয়ে বলেন, চা-বাগানের শ্রমিকেরা অমানবিক মজুরিতে (১৭৮ টাকা) কাজ করেন। তোলা পাতার ওজন কম দেখিয়ে নারীদের আরও কম মজুরি দেওয়া হয়। এ ছাড়া ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে তাঁরা ভূমিহীন।

সাতক্ষীরা থেকে আসা জয়ন্তী রানী মণ্ডল বলেন, দলিতরা সবচেয়ে পিছিয়ে আছে। দলিত নারীদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতিনিধিত্ব প্রত্যাশা করেন তিনি।

গোলটেবিল বৈঠকে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য ফেরদৌসী সুলতানা বলেন, একজন চা-শ্রমিকের জন্য দৈনিক ৫৭০ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এখানে ১৭০ টাকা প্রদান করে ৪০০ টাকা আবাসন ও চিকিৎসাসেবার নামে কেটে রাখা হচ্ছে। এখন ৪০০ টাকার সমপরিমাণ সেবা প্রদান করা হচ্ছে কি না, সেই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তীকালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন করেছে। সেই কমিশন একটি প্রতিবেদন সরকারকে দিয়েছে। কিন্তু কিছু রাজনৈতিক দলের সক্রিয় বিরোধিতা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের নির্লিপ্ততা এই কমিশনের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করেছে। আগামী রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে আদিবাসীদের স্বীকৃতি, নারীদের প্রতি বৈষম্য হ্রাস, ভূমিতে নারী অধিকারের বিষয়গুলো যুক্ত করতে হবে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, বাংলাদেশে গ্রামীণ নারীর বড় একটি অংশ কৃষির সঙ্গে জড়িত। পারিবারিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি কৃষিক্ষেত্রে শ্রম প্রদান করেও তাঁরা শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্য কিংবা মর্যাদার জায়গায় সম-অধিকার পাচ্ছেন না। সহিংসাসহ নানা ধরনের ঝুঁকির মধ্যে নারীরা নিমজ্জিত হয়ে আছেন।

নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে ফওজিয়া মোসলেম বলেন, যেখানে রাষ্ট্রের ইতিবাচক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন ছিল, সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্র তার দৃঢ়তা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে।

মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির বলেন, ‘প্রাকৃতিক সম্পদ যেখানেই রয়েছে, সেখানে নারী-পুরুষ উভয়ের ভূমিকাই রয়েছে। নারীদের বিচ্ছিন্নভাবে চিন্তা করার কোনো সুযোগ নেই। বিভিন্ন উন্নয়নে নারীর বিষয় অনুপস্থিত থেকেছে। আমাদের নারী সংস্কারবিষয়ক কমিশন যে রিপোর্ট প্রণয়ন করেছে, সেগুলো বর্তমান সরকার গ্রহণ না করলেও আমরা এই সুপারিশগুলোর কথা বলব।’

নারীদের অধিকার আদায়ে আন্দোলনে জোর দিয়ে খুশী কবির বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের পক্ষে কেউ কথা বললে তাঁদের কোণঠাসা করে দেওয়া হচ্ছে। পার্বত্য আদিবাসীদের মধ্যে আদিবাসী নারীরা আরও প্রান্তিক অবস্থানে রয়েছেন। কোনো সরকার আমাদের কথা শুনছে না, কিন্তু আমাদের কথা আমাদের জোর গলায় বলে যেতে হবে।’

এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, ‘আসন্ন নির্বাচনে যাঁরা অংশ নেবেন, তাঁদের ইশতেহারে আমাদের উল্লেখিত দাবিসমূহ তাঁরা অন্তর্ভুক্ত করবেন—এটা আমাদের দাবি। এর পাশাপাশি যাঁরা বর্তমানে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আছেন, তাঁদেরও দায়িত্বগুলো ভুলে গেলে চলবে না।’

‘আমরা দেখেছি সরকার ঐকমত্য কমিশন গঠন করেছে, তবে সেই কমিশনে নারী প্রতিনিধি নেই, আদিবাসীদের প্রতিনিধি নেই। গত জুলাইয়ের আন্দোলনের অন্যতম প্রেরণা ছিল সব ধরনের বৈষম্যের অবসান। এখন কি তবে এই সরকার গণ-অভ্যুত্থানের বৈষম্যবিরোধী অবস্থান ভুলতে বসেছে?’ প্রশ্ন রাখেন শামসুল হুদা।

ছবি: সিস্টেমে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গোলটেবিল মত: কৃষি, ভূসম্পত্তিতে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরব হতে হবে