রাজধানীর বেইলি রোডে সড়ক দুর্ঘটনায় তাজুল ইসলাম (৪৫) নামে এক ব্যক্তি মারা গেছেন। তিনি একটি বায়িং হাউসে চাকরি করতেন।

তাজুল ইসলামের ছেলে আবদুল্লাহ জিহাদ হাসপাতালে প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল বুধবার বিকেলে বেইলি রোডে মোটরসাইকেলের ধাক্কায় তাঁর বাবা আহত হন। গুরুতর অবস্থায় তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে গতকাল দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে তাজুল মারা যান বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের সহকারী উপপরিদর্শক মো.

মাসুদ আলম বলেন। তিনি বলেন, মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে রাখা হয়েছে। তাজুল সপরিবার রাজধানীর তুরাগ থানার দলিপাড়ায় থাকতেন।

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

সোনালি কুকুর

শুয়ে পড়ার অনেকক্ষণ পর শহিদের মনে হলো, মশারি যতটা কাঁপছে, জোরে ঘুরতে থাকা ফ্যানের বাতাস ততটা গায়ে লাগছে না। শব্দও হাওয়ার চেয়ে বেশি। এখন বর্ষাকাল, ঘুমিয়ে পড়লে কখন বৃষ্টির ছাট এসে ভিজিয়ে দেয় বিছানা, সে আশঙ্কায় ঘরের সব জানালা বন্ধ করে শহিদ শুয়েছিল। তবে কেবল একটিই খানিকটা ফাঁক করে রেখেছিল, সেখান দিয়ে হাওয়া ঢুকলে পর্দা কাঁপে। গত রাতে তার বড় ছেলে, ৯ বছরের অর্ক প্রশ্ন করেছিল, ‘বাবা, বলো তো, কোন দেশে আত্মার জানালা আছে?’ শুনে সে চমকে উঠে বলল, ‘এ রকম আছে নাকি!’

‘হ্যাঁ বাবা, সুইজারল্যান্ডের একটা শহরে সব বাড়িতেই আছে। আত্মার জানালা। একটা করে।’ মাথা দুলিয়ে বলতে থাকে সে, ‘কিন্তু খুব ছোট, একটা ঘরেই শুধু থাকে, সেখানে আর কোনো জানালা থাকে না।’ নিজের সন্তানের কাছে এ রকম অদ্ভুত এক তথ্য আছে ভেবে শহিদ সম্ভবত পুলক বোধ করে। বলে, ‘সত্যি! কীভাবে জানলে?’ তখন জনকের প্রায়-পশমসংকুল তামাটে বুকের ওপর অর্কের বাদামি নরম হাত; সে বলে, ‘শোনো বাবা, যখন কারও মরে যাওয়ার সময় হয়, বাড়ির লোকজন তাকে সেই ঘরে নিয়ে যায়। লোকটা যখন মারা যায়, তখন তার আত্মা ওই জানালা দিয়ে বের হয়ে যায়।’ দম ফেলার আগে সে কোনো বাক্যই শেষ করে না। শহিদের মনে পড়ে, অর্ক জানতে চেয়েছিল, মরে যাওয়ার আগে মানুষ কি জানতে পারে কখন তার মৃত্যু হবে। কিন্তু সে শুধু বলেছে, ‘হোমওয়ার্কটা করে ফ্যালো বাবা, কাল তো স্কুল আছে তোমার।’

শহিদ দেখল, মাঠ থেকে একটা সিঁড়ি সোজা ওপরের দিকে উঠে গেছে। সে অনুভব করল, এ বাড়িতেই তাকে যেতে হবে। সিঁড়ি বেয়ে সে একটা ঘরে ঢুকল। সেখানে বন্ধ হয়ে থাকা একটা জানালা ছিল। খুলতে গেলে পেছন থেকে এক লোক তাকে নিষেধ করল। বারান্দায় এল সে। দেখল, নিচে সশস্ত্র এক লোক তার ঘর বরাবর ‘কিছুই ঘটছে না’ চোখে তাকিয়ে আছে। তার মনে হলো, এই জায়গা থেকে সে বেরোতে পারবে না; কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে নামতে পারবে এবং ওঠার সময় তাকে ওই লোক গুলি করে যে মারবে, এটা নিশ্চিত। একটা জনাকীর্ণ জায়গায় সে গেল এবং শুনতে পেল, আগামী শুক্রবারই তাকে হত্যা করা হবে; কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় নয়, যখন তার জন্য নির্ধারিত ঘরে ঢুকবে, তখনই লোকটি তাকে গুলি করবে। সে ভাবল, কাপুরুষের মতো পিঠে গুলি খেয়ে মরে যাওয়া তার ঠিক হবে না। লোকটির কাছে সে একবার ঘরে ঢোকার সুযোগ চাইবে এবং অনুরোধ করবে, সে যেন বারান্দায় দাঁড়ানো অবস্থায় বুকে গুলি চালায়। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় স্বপ্নের মধ্যেই শহিদের মনে হলো, পরিবারের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেলে ভালো হতো। কিন্তু মোবাইলটা বেশ আগেই কেড়ে নেওয়া হয়েছে; যেন খুব স্বাভাবিক, সে ওই ঘরে ঢুকে দেখল তার স্ত্রী রাকা সেখানকার একটা খাটে দাঁড়িয়ে জানালাটি খোলার চেষ্টা করছে এবং পারছে না। একটা লোক দরজায় এসে তাকে লক্ষ করে বলল, ‘নিষেধ আছে। বের হয়ে যান।’

লোকটা প্যান্টের পকেট থেকে একটি খাম বের করে বলল, ‘এই ওষুধগুলা খাবেন।’

রাকা বলল, ‘দেখি কী ওষুধ!’ লোকটা তাকে ঘর থেকে বের করে দিলে শহিদ তার পিছু ছোটে, কিন্তু বারান্দায় গিয়ে দেখে মাঠ থেকে ওই লোক তার দিকে অস্ত্র তাক করে আছে। আর এগোয় না সে। ঘরে ঢুকে ভাবে, এখান থেকে পালানো দরকার অথবা আত্মহত্যা করতে হবে। তবে তার মনে হয়, শুক্রবারের আরও দুই দিন বাকি। এর মধ্যে বাঁচার একটা চেষ্টা করা যায়। রাকা ও অন্যরা নিশ্চয় সেটা করছে। যদি মরতেই হয়, হত্যাকারীরা তার শেষ ইচ্ছা কী, জানতে চাইবে। চাইবে না? সে বলবে যে মৃত্যুর আগে পরিবারের সবাইকে একসঙ্গে দেখতে চায়, তাদের উদ্দেশে কিছু বলতেও চায়। সে জানে যে তারা তাকে বলবে, ‘আপনার পরিবার আজই আসছে। তবে তিন মিনিটের জন্য আপনি বারান্দা থেকেই তাদের দেখবেন, বলতেও পারবেন কিছু।’ শহিদ দেখে, তারা এসেছে। বৃষ্টির পরের নীল আকাশের নিচে ঘাসের রং যেমন হয়, তেমন তাজা-সবুজের ওপর সশস্ত্র লোকটির পাশে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মাঠ থেকে অর্ক ডাকছে, ‘বা-বা!’ সে ভাবে যে কী বলবে, নাকি দেখেই শেষ করবে তিনটি মিনিট। কিন্তু তাদের এবং পৃথিবীর উদ্দেশে তিনটি বাক্য সে মনে করতে পারে:

‘তোমরা ভালো থেকো।’

‘মানবতার জয় হোক।’

‘পৃথিবী এগিয়ে যাক।’

স্বপ্নের ভেতর শহিদের মনে হয়, একটা দিন তো চলে গেল। শুক্রবারের আর মাত্র এক দিন বাকি। রাকা নিশ্চয়ই তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে।...তাকে আরেক অচেনা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে তার ঊর্ধ্বতন সহকর্মী কালামের সঙ্গে দেখা হয়। পরের দিন তাকেও যে হত্যা করা হবে, সে জানায়। সিঁড়ি এখানেও আছে, তবে আগেরটির চেয়ে অনেক চওড়া, লোকজনও কম নয়। শহিদের মনে হয়, এখানে সবাই মৃত্যুদণ্ডিত, নিজেকে রক্ষার শেষ চেষ্টার জায়গা এটা। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় তার হাতে এক টুকরা কাগজ ওই লোক দেয়। তারা একটা ঘরে ঢোকে। শহিদ দেখে, এক পুলিশ অফিসার বসে আছে। তাকে কাগজটি দিলে সেটি সে পড়ে বলে, ‘বৈষম্য, অধিকার, নারী—এসব নিয়ে তো যথেষ্ট গবেষণা করেছেন আপনি।’ চোখের কালো বৃত্ত হাইলাইট করে হাসে, বলে, ‘ঠিক হয়ে যাবে। সময়মতো মুক্তি পাবেন।’ কথাটা ভীতিকর রকমের ইঙ্গিতপূর্ণ মনে হয় শহিদের। তবু সে বলে, ‘আমার বাচ্চাটা খুব ছোট।’...লরিতে ওঠার আগে কালাম তাকে বলে, ‘তোমাকে আরেকটু সময় দেওয়া হইছে, বুঝলা!’ বাহনটি চলতে শুরু করলে শহিদ চেঁচিয়ে ওঠে, ‘আমার সন্তানকে আপনাদের কাছে রেখে গেলাম।’...কিছু লোক রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে ছিল।

পাশের বাড়ির ছাদের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা খোপ থেকে কবুতরগুলোর সম্মিলিত ও একক স্বর ভেসে আসছে। শহিদের মনে পড়ে, জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে অর্ক বলেছিল, ‘বাবা, কবুতরের জানালা কত ছোট, দ্যাখো!’

বিছানার যে অংশে পিঠ রেখেছিল, ঘামে সেটি ঠান্ডা হয়ে গেছে, সে টের পায়। ভাবে, কী অপরাধ সে করেছে জীবনে। তেমন কিছু করেছিল কি? কৃত অপকর্মের একটা তালিকা করতে গিয়ে আকস্মিক হাওয়ায় কেঁপে ওঠা পর্দায় চোখ পড়ল তার। ভাবল, আত্মা বিষয়ে এই অদ্ভুত তথ্য কোত্থেকে অর্ক পেল, জানা দরকার।

দুপুরের পর অফিসে অচেনা এক দুলুনি টের পায় শহিদ। অনুভব করে, শরীর চেয়ারে রেখে মাথা উড়ে যেতে চাইছে কোথাও। মনে হলো, এত বড় বড় জানালায় কী কাজ, যদি ওপরের দিকে ছোট একটা ছিদ্র না থাকে! ছাদই-বা কেন! ...ফেরার পথে, বিকেলবেলা, তার খুব বমি হয়েছিল। মাথা পাক খাচ্ছিল সুতায় টান-পড়া ঘুড়ির মতো। বাশারকে জানাতেই প্যারেড গ্রাউন্ডের পাশে গাড়ি থামিয়ে দরজা খুলে দিয়েছিল সে। এমন ঝাঁজালো গন্ধের বমি মদ্যপেরও হয় নাকি! আর এত যন্ত্রণাদায়ক! তার মনে হলো, আত্মা বের হওয়ার জন্য কোনো জানালা লাগে না। করোটি কাঁপিয়ে ডায়াফ্রাম চুরমার করে ফেলা বমনে ভর দিয়ে ফুটপাত, দুলতে থাকা দেয়াল পেরিয়ে তার মুক্তি ও ঊর্ধ্বগমন।...গাড়িটি চলতে শুরু করলে মুহূর্তের মধ্যে সে নেতিয়ে পড়ে আর অনুভব করে ঠান্ডা একটা ঘরে সে বসে আছে। এইচ আর শরমিন তার সামনের চেয়ারে মুখোমুখি উপবিষ্ট, স্লিভলেস কালো জামার ওপর সরু সোনালি শিকল তার বুকের উচ্চতাবশত অর্ধতরঙ্গ তৈরি করেছে। টেবিলে ছড়ানো তার সোনালি নখগুলো দেখতে দেখতে শহিদ শুনল, ‘আপনার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আছে। আপনি কলিগদের নিয়ে ঘন ঘন ছাদে যান আর বাদাম খান।’

‘আর?’

‘বৈষম্য, অধিকার আর মেয়েদের নিয়া কথা বলেন। খেপিয়ে তোলেন।’

শহিদ নিজের স্বর শুনতে পেল, ‘বাহ্, বেশ লাগছে, লাগছে তো!’

‘কী?’

‘দুঃখিত, আপনি যা শুনতে চান, তা বলা সম্ভব না।’

সোনালি নখ থেকে খনখনে আওয়াজ এল, ‘ইয়ার্কি না, সারপ্লাস ভ্যালু আর মালিকের আরাম–আয়েশ নিয়া কী বলছেন আপনি? প্রমাণ আছে আমার কাছে।’ পাশে রাখা ফাইল থেকে হলুদ একটি খাম বের করল সে। শহিদ খেয়াল করল, সোনালি নখে অনাবশ্যক সুন্দর, কালো আর ভৌতিক হয়ে উঠেছে আঙুলগুলো। আরেকটা কাগজ বের করে এগিয়ে দিতে দিতে সেই নারী বলল, ‘এখানটায় সাইন করেন।’ সে দেখল, কাগজটিতে মোটাসোটা একটা কুকুরের ছবি। প্রাণীটির গায়ে শরমিন কী যেন মাখছে। হ্যাঁ, তেলই তো, ওই যে, সারমেয়টির পশ্চাৎ পদযুগলের পাশে বাটি দেখা যাচ্ছে। কাগজের মধ্যেই ছবিটি গতিশীল হয়ে উঠল, তেল মাখতে মাখতে অমিত, লাবু, মতিন, প্রজ্ঞা, মুরাদ এবং আরও কয়েকজন এসে পড়ল হামাগুড়ি দিয়ে। তাদের শরীর কুকুরটির আড়াল রচনা করেছে। তবে যখন মিলিতভাবে ও পালা করে ওই কুকুরের লেজে তারা জিব বোলাতে লাগল, তখন ফের প্রকাশ্য হলো। যন্ত্রণাক্লিষ্ট অভিভূতের মতো শহিদ দেখল, কুকুরটি সোনালি হয়ে উঠছে এবং লেহনকারীদের উধাও করে দিয়ে পৃষ্ঠাজুড়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। শরমিনকে খুঁজতে লাগল শহিদ। সম্ভবত সে কারণে তার সেই সোনালি শিকল কুকুরটির গলায় দেখতে পেল।...

বাশার বলল, ‘নামেন স্যার। আপনারে বাসায় রাইখা আসি। আর তো দেখা হইব না। দোয়া কইরেন স্যার।’

বমনের পর যা হয়, নিজের শরীরকে নির্দোষ মনে হলো শহিদের। শিশুরা হাওয়াই মিঠাইওয়ালার সামনে জড়ো হয়েছে; কিন্তু অস্পষ্ট লাগছে সবকিছু। আকাশ কালো হয়ে এল নাকি! বাসার দিকে যেতে যেতে শহিদ ভাবে, একটা ঝামেলা তো গেল, এখন চালাক হওয়া দরকার। রাজনীতিটা শিখতে হবে।

রেলিং ধরে সিঁড়ি পেরোতে পেরোতে তার মনে পড়ল, কোনো এক বই থেকে সে জেনেছিল, বের হয়ে যাওয়ার পর আত্মা বদলে যায়, অন্য শরীর ধারণ করে। ভাবল, ওই কুকুরের শরীর যদি নেয়? ‘মন্দ হয় না, বেশ হয়’ বাক্যসুদ্ধ নিজের মৃদু হাসি, সম্মতিসূচক, শুনতে পেল সে।...

পেছন ফিরে দেখল, কেউ নেই। ইঞ্জিনের শব্দ শোনা গেল, হর্নও বাজল দুবার। শহিদের চোখ ভিজে আসছিল।

সম্পর্কিত নিবন্ধ