মাহমুদুল ইসলাম মামুন। পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে অবদান রাখায় ২৫ জুন ব্যক্তি পর্যায়ে ‘জাতীয় পরিবেশ পদক ২০২৪’ অর্জন করেছেন। দেশের সর্বোত্তরের জনপদে পরিবেশ রক্ষায় লড়াই করে যাওয়া এই তরুণ শোনালেন তাঁর স্বপ্নের পথে ছুটে চলার গল্প। শুনেছেন আশিক মুস্তাফা
পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে অবদান রাখায় ব্যক্তি পর্যায়ে ‘জাতীয় পরিবেশ পদক ২০২৪’ পেয়েছেন মাহমুদুল ইসলাম মামুন। ২৫ জুন মা মাহমুদা বেগমকে সঙ্গে নিয়ে এই পদক গ্রহণ করেন মাহমুদুল। ২৬ জুন পদক হাতে এসেছিলেন সমকালে। জানতে চাইলাম, মাকে সঙ্গে রেখে জাতীয় পদক গ্রহণ করেছেন। কেমন লাগছে? মাহমুদুল বলেন, ‘মায়ের অনুপ্রেরণা ছাড়া এই অর্জন সম্ভব হতো না। ২০১৯ সালে বাবা আজহারুল ইসলামের মৃত্যুর পর মায়ের সহযোগিতা নিয়ে এসব কাজ করে আসছি। নিজের এসব কাজের অর্থ জোগাতে বাড়িতে হাঁস-মুরগি আর ছাগল পালন করেছি। পুকুরে মাছ চাষ করেছি। বাবার রেখে যাওয়া ছোট চা বাগানেরও পরিচর্যা করেছি। এই তো সেদিন ছাগল বিক্রি করে রকমারি থেকে বই কিনেছি। আমার এসব কাজকে অনেকে পাগলামি বলেন, অনেকে আবার বাঁকা চোখে দেখেন। মাকেও অনেক কথা শুনতে হয় এ জন্য। কেউ কেউ এসে মাকে বলেন, এসব কী করছে আপনার ছেলে! ওকে বিয়ে দেবেন না? এসব কথার কারণে অনেক আত্মীয়স্বজনের অনুষ্ঠানে যাওয়াও আমরা বাদ দিয়েছি। আসলে এসব কটুকথা আমার থেকে মাকেই বেশি শুনতে হয়। মা সব শুনেও আমাকে সাপোর্ট দেন। মায়ের সাপোর্ট ছাড়া আমার কোনো অর্জনই হতো না। তাই এই পদক মায়েরই প্রাপ্য!’
প্রকৃতির পাঠশালায়
পুরোনো ঝং ধরা সাইকেল। তার সামনে ঝুড়ি ভর্তি বই আর হ্যান্ডলে ঝোলানো ব্যাগে গাছের চারা নিয়ে গ্রামে গ্রামে ছুটে বেড়ান সমাজের চোখে ‘পাগল’খ্যাত মাহমুদুল ইসলাম মামুন। তাঁর প্রতিদিনের কাজ রুটিন করা। বলেন, ‘চারা বিতরণের পাশাপাশি শিশুদের নিয়ে রোজই বসাই পাঠের আসর। পরিষ্কার করি মাছ বাজারের ময়লা, সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া কুকুর-বিড়ালকে সড়ক পড়ে থাকতে দেখলে তা সরিয়ে মাটিচাপা দিই, পথে-ঘাটে পড়ে থাকা প্লাস্টিকের ব্যাগও কুড়াই। আবার কখনও সড়কের ধারের ঝোপঝাড় পরিষ্কার করার পাশাপাশি অপসারণ করি সড়কে জমে থাকা বৃষ্টির পানি। প্রায় এক যুগ ধরে প্রতিদিন কাজগুলো করে যাচ্ছি।’ মা মাহমুদা বেগমের কাছে ছেলের পাগলামির শুরুর কথা জানতে চাইলে বলেন, ‘শৈশব থেকেই আমার ছেলেটা একটু অন্য রকম। বাড়ির আঙিনায় গাছ লাগাত। পাখিদের খাবার খাইয়ে আনন্দ পেত। স্কুলের টিফিনের টাকা জমিয়ে কিনে নিয়ে আসত গাছের চারা। সেই চারা কিন্তু নিজেদের জন্য নয়; রোপণ করত এলাকাজুড়ে। এভাবেই তার শুরু। তখন থেকেই অনেকে তাকে পাগল বলত। আমার এই পাগলটাকে কখনও থামতে দিইনি। সেই পাগলামিরই ফল পেল সে। মায়ের জন্য এর চেয়ে আনন্দের আর কি-ইবা হতে পারে!’
জন্ম এবং বেড়ে ওঠা
মাহমুদুল ইসলাম মামুনের জন্ম পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার আজিজনগর গ্রামে। বাবা আজহারুল ইসলাম সরকারি চাকরি করতেন। বেশ কিছু কৃষিজমি ছিল তাদের। শৈশবে বাবা-মাকে দেখেছেন কঠোর পরিশ্রম করতে। বাড়িতে কৃষিকাজ দেখে দেখে মনটা কবে যে পুরোপুরি মিশে গেছে প্রকৃতির সঙ্গে, বুঝতে পারেননি তিনি। ২০১৩ সালে কলেজে ভর্তি হন মাহমুদুল। ছুটিতে বাড়ি ফিরতেন গাছের চারা নিয়ে। পরে সাইকেলে করে বিলি করতেন এলাকায়। সব সময় জাঁকজমক বিষয়টি এড়িয়ে চলেন মাহমুদুল। পরিবেশের কথা ভেবে সাইকেলই বেছে নিয়েছিলেন বাহন হিসেবে।
আকাশতলার পাঠশালা ও প্রকৃতির পাঠাগার
ছাত্রজীবনে ‘পথের পাঁচালী’ পড়ে মাহমুদুল ঠিক করেছিলেন, সাহিত্য নিয়েই পড়তে হবে তাঁকে। রংপুরের কারমাইকেল কলেজ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে। এরপর গ্রামে ফিরে অন্যদের বই পড়ানোটাকেও দায়িত্ব হিসেবে তুলে নেন নিজের কাঁধে। গ্রামে ঘুরে ঘুরে মাহমুদুল শিশুদের নিয়ে গল্প পাঠের আসর বসান। নিজে গল্প পড়ে শোনান তাদের। আবার বই পড়তেও দিয়ে আসেন। খোলা আকাশের নিচে এ আসরের নাম দিয়েছেন ‘আকাশতলার পাঠশালা’! সে পাঠশালায় শিশুদের জীবনাচার শেখান তিনি। তাঁর পাঠশালায় আসা শিশুরা ভালো আচরণ শিখছে। কেউ পাখি শিকার করে না। গাছ নষ্ট করে না। প্রাণীদের কষ্ট দেয় না। প্রকৃতি আর বই পড়ায় তাদের যত আগ্রহ। শুধু তাই নয়; মাহমুদুলের বাড়িতে আছে ‘প্রকৃতির পাঠাগার’। বাঁশ-ছন দিয়ে নির্মিত গোলাকৃতির এ পাঠাগারের জন্য নিজের টাকায় বই কেনেন তিনি। প্রতিদিন সকালে পাঠাগার খুলে দেন। পাশেই মাহমুদুল তৈরি করেন গাছের চারা। বিকেলটা বরাদ্দ থাকে এই কাজের জন্যই। সকাল থেকে সন্ধ্যা– প্রকৃতি আর শিশুদের সঙ্গেই কাটে তাঁর।
আগামীর স্বপ্ন
আগামীর স্বপ্নের কথা জানতে চাইলে মাহমুদুর বললেন, ‘আমি সবসময় সৃষ্টিকর্তাকে বলি, আমাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিন। কেউ কাজ করতে চায় না; পরিবেশের, জীবনের ক্ষতি করে বেড়ায়। আমি চাই তিনি যেন আমাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেন। পৃথিবীতে যতদিন বেঁচে আছি, এভাবেই কাজ করে যেতে চাই। শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার যেমন নির্দিষ্ট সময়কাল নেই, পরিবেশের সেবা করারও সময়কাল নেই। এটি সবসময় করে যেতে হবে বলে মনে করি আমি। তবে এই যে রাষ্ট্রীয় পদক পেলাম, এই পদক প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি আমার দায়বদ্ধতা আরও বাড়িয়ে দিল। আমি সানন্দে তা করে যেতে চাই– এমনটাই স্বপ্ন দেখি!’u
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প রক ত র প পর ব শ র ক জ কর র জন য এসব ক
এছাড়াও পড়ুন:
সংকটের গভীরতা সরকার বুঝতে পারছে না
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংস্কার ঘিরে আন্দোলনের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে জানিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা। তারা বলছেন, এনবিআরের অচলাবস্থার কারণে শুধু পোশাক খাতেই দৈনিক ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। সমস্যা সমাধানে দ্রুত সরকারকে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।
গতকাল শনিবার রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে শীর্ষস্থানীয় ১২টি ব্যবসায়ী সংগঠনের যৌথ জরুরি সংবাদ সম্মেলনে তারা এ দাবি জানান।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (আইসিসিবি) সভাপতি মাহবুবুর রহমান, বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি কামরান টি রহমান, সিরামিক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিসিএমইএর সভাপতি মঈনুল ইসলাম, বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন, এমসিসিআইর সহসভাপতি ও ট্রান্সকম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সিমিন রহমান, ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বিসিসিআইর সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী (পারভেজ)। তিনি বলেন, এনবিআরের চেয়ারম্যানের অপসারণ কোনোমতেই কাম্য নয়। এতে কোনো সফলতা নিয়ে আসবে বলে ব্যবসায়ীরা মনে করেন না। দেশ ও ব্যবসার স্বার্থে আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। আন্দোলনকারীসহ সব পক্ষের আলোচনায় বিদ্যমান সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে।
বিসিসিআই সভাপতি বলেন, রাজস্বনীতি ও বাস্তবায়ন কার্যক্রমকে আলাদাকরণ-সংক্রান্ত বিতর্কিত অধ্যাদেশ সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে করা হোক। এরপর তা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রভাবমুক্ত রেখে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও দেশের বাস্তবতার আলোকে বাস্তবায়ন করতে হবে।
ব্যবসা-বাণিজ্যের সার্বিক উন্নয়নে এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট সব জাতীয় প্রতিষ্ঠানে হয়রানিমুক্ত সেবা প্রদানের লক্ষ্যে এর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে পোশাক খাতের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, এনবিআরের অচলাবস্থার কারণে দৈনিক ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার অর্থনৈতিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে শুধু পোশাকশিল্পেই। শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষা, তথা সামগ্রিক অর্থনীতির স্বার্থে এ মুহূর্তে এনবিআর ইস্যুর সমাধান প্রয়োজন। এটি আমাদের শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষার বিষয়।
চলমান অচলাবস্থার কারণে যে সংকট তৈরি হয়েছে, সরকার তার সঠিক গুরুত্ব বুঝছে না– এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, স্থানীয় ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা চাপে আছেন। নতুন করে এ আন্দোলনের কারণে ব্যবসায়ীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। এটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এর থেকে ফিরে আসা উচিত। তাই মঙ্গলবার নয়, আজই (গতকাল) আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বসে আলোচনা করে এর সমাধান করতে হবে।
আন্দোলনের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে এসেছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলেন, কালক্ষেপণ না করে দ্রুত প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের নেতৃত্বে অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটিকে (বিডা) যৌথভাবে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসা জরুরি। তারা বলেন, এনবিআরের সব কর্মকর্তাই অসৎ নন। তাদেরও ভবিষ্যৎ আছে। সেই বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। অর্থনীতি যাতে আর ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেই পদক্ষেপও গ্রহণ করতে হবে। এ সময় তারা আন্দোলনকারীদের প্রতি দেশের অর্থনীতির স্বার্থে ‘কলমবিরতি’ ও ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি প্রত্যাহার করে কোনো শর্ত ছাড়া কাজে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান।
সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে আইসিসিবির সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, যে কোনো দেশের সরকারের সঙ্গে বেসরকারি খাতের ইন্টারেকশন বা মিথস্ক্রিয়া অতি জরুরি। কিন্তু বর্তমান সরকারের সঙ্গে এই যোগাযোগ বা সংলাপ অনেকটা স্তিমিত। তিনি বলেন, চেয়ারম্যানের অপসারণ কাম্য নয়। কারণ, এরপর হয়তো অন্য কোনো সদস্যের অপসারণের দাবিও উঠবে। তাতে সমস্যা বাড়তে থাকবে।
শাটডাউনের কারণে রপ্তানির ক্ষতির বিষয়টি উল্লেখ করে এলএফএমইএবি সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার বাংলাদেশের জন্য অপেক্ষা করবে না। যুদ্ধ ছাড়া কোনো দেশের কাস্টমস বন্ধ থাকে কিনা, সেটি জানা নেই। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা এনবিআরের সংস্কার চান। তবে এনবিআরে অনেক সৎ কর্মকর্তা আছেন। সংস্কারের ফলে তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে, সেটি বলার অধিকার তাদের আছে। সেটিও সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে।
বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, ‘যারা ব্যবসা করেন, তাদের সব সময়ই এনবিআর বলেন, কাস্টমস বলেন, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে ব্যবসা পরিচালনা করার চেষ্টা করতে হয়। কারণ, বাস্তবতা হলো ব্যবসায়ীরা তাদের কাছে জিম্মি। এখন ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ ও টাকা-পয়সার বণ্টন নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে। মাঝপথে ব্যবসায়ীরা বিপদগ্রস্ত হচ্ছেন। তারা (এনবিআরের কর্মকর্তারা) সারাজীবন ব্যবসায়ীদের জ্বালাইছে, এখন সরকারকে জ্বালাচ্ছে, এখন পুরো জাতিকে জ্বালাচ্ছে।’