হাবিবুলের চোখে মুশফিকুর দশে সাড়ে নয়
Published: 17th, November 2025 GMT
এক নয়, দুই নয়, একশতম টেস্ট খেলার দ্বারপ্রান্তে মুশফিকুর রহিম।
আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ঢাকা টেস্ট দিয়ে বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে একশতম টেস্ট খেলার অপেক্ষায় মুশফিকুর। দীর্ঘ দুই দশকের টেস্ট ক্যারিয়ারে মুশফিকুর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বাংলাদেশের অন্যতম সফল ও নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান হিসেবে।
হাবিবুল বাশার সুমনের হাত ধরে লর্ডসে দেশের পতাকা বহন করা শুরু করেছিলেন। সাবেক অধিনায়ক মুশফিকুরকে আখ্যায়িত করলেন, পরিপূর্ণ ও আদর্শ ক্রিকেটার হিসেবে। তার পুরো টেস্ট ক্যারিয়ার মূল্যায়ন করে দশে সাড়ে নয় নাম্বার দিয়েছেন হাবিবুল।
মুশফিকুরকে কাছ থেকে দেখা, শুরুর সম্ভাবনা, ক্যারিয়ারের উঠা-নামা, অধিনায়কত্বের সফর, উইকেট কিপিংয়ের জেদ এবং সর্বোপরি পুরো ক্যারিয়ার সম্পর্কে জানা হাবিবুলের। সেসব নিয়েই রাইজিংবিডি-র মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। তার কথা শুনেছেন, রবিউল ইসলাম…
২০০৫ সালে মুশফিকুর রহিমের মতো তরুণ একজন ক্রিকেটারকে দেখে আপনার প্রথম অনুভূতি কেমন ছিল?
হাবিবুল বাশার সুমন: ২০০৫ সালে ইংল্যান্ড সফরের ক্যাম্পেই আমি প্রথম মুশফিকুরকে দেখি। মুশফিকুর দেখতে একেবারেই পিচ্চি একটা ছেলে। ওকে, দেখে প্রথম অনুভূতি হয়েছিলো, এই বাচ্চা ছেলেটা ইংলিশ কন্ডিশনে পারবেতো? তবে অনুশীলনে ওকে দেখেই বুঝে গিয়েছিলাম, ওর মধ্যে কিছু আছে! টেকনিক্যালি খুব ভালো ছিল। বয়সের তুলনায় মানসিকভাবে স্ট্রং ছিল। আমরা ড্রেসিংরুমে যখন আলাপ করতাম, তখন প্রায়ই বলতাম ছেলেটা বহুদূর যাবে।
তখন খালেদ মাসুদ পাইলটের দারুণ প্রভাব ছিল, তবুও মুশফিকুরকে দলে নেওয়া, বিশেষ কোন কারণ ছিল?
হাবিবুল: মুশফিকুর একজন টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান এবং খুব ভালো ব্যাটসম্যান। আমাদের ব্যাটিং শক্তি বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল। মুশফিকুর ও পাইলটকে নিয়ে অনেক আলোচনা শুনি ও শুনতাম। ওদের মধ্যে সমস্যা হয়েছিলো! এসব ভুল, মিথ্যা।
এক সাথে দুইজনই বেশ কিছু ম্যাচ খেলেছে। তখনতো আমি অধিনায়ক, পাইলটের কাছ থেকে আমি এমন কিছু কখনো দেখিনি। এমন না যে, পাইলট অখুশি কিংবা ইনসিকিউরিটির মধ্যে আছে। বরং সে মুশফিকুরকে সাহায্য করেছে। শুরুতে মুশফিকুর কিন্তু কিপার হিসেবেও সাধারণ মানের ছিল!
পরে কিন্তু কিপার মুশফিকুর অনেক উন্নতি করেছে। তখন আমাদের দলের পরিকল্পনা ছিলো একজন বাড়তি ব্যাটসম্যান নিয়ে খেলা। মুশফিকুর জয়েন করার পর আমাদের ব্যাটিংটা শক্তিশালী হয়ে যায়।
তার পুরো টেস্ট সফরকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
হাবিবুল: প্রথমত মুশফিকুর যখন শুরু করছিলো, তখন কিছু অর্জনের চেয়ে ওর লক্ষ্য ছিলো নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। মাঝে যখন অধিনায়ক ছিলো, তখন একরকম, শেষের দিকে আরেক রকম করে নিজেকে উপস্থাপন করেছে। মুশফিকুরের পরিশ্রম নিয়ে অনেক চর্চা হয়। শুরুতে বাকি সবাই যেমন করতো, ওর অনুশীলন প্যাটার্ন তেমনই ছিল। বহু ক্রিকেটার শুরুতে অনেক পরিশ্রম করার পর, পরে কেবল মেনটেইন করে। মুশফিকুরের ক্ষেত্রে উল্টা হয়েছে।
মুশফিকুর শুরুতে মেনটেইন করতো, যতদিন গেছে পরিশ্রম ততো বাড়িয়েছে। সবার আগে আসে, সবার পরে অনুশীলন শেষ করে…নিয়মিত ঘটনা হয়ে গেছে। এমনকি ছুটির দিনেও অনুশীলন করার ঘটনা অহরহ আছে। ওর খেলার প্রতি যে প্যাশন, বাকিদের থেকে ওকে আলাদা করেছে। মুশফিকুর সত্যিকার অর্থেই উদহারণ। ছুটির দিনে, কিংবা অবসরে সবাই বন্ধু কিংবা পরিবারকে সময় দেয়, ঘুরতে যায়। কিন্তু মুশফিকুরের কাছে ঘুরতে যাওয়ার চেয়ে বড় উপভোগ্য ব্যাপার অনুশীলন করা।
টেস্ট ক্রিকেটার মুশফিকুরকে দশে কত নাম্বার দেবেন?
হাবিবুল: দশে আমি সাড়ে নয় দিবো। পয়েন্ট ফাইভ আসলে একটু রেখে দিলাম। পুরো মার্ক দিলে সবাই ভাববে আমি পক্ষপাতিত্ব করছি। মুশফিকুর সত্যিই এটা ডিজার্ভ করে।
সতীর্থ হিসেবে মুশফিকুরের সাথে বিশেষ কোন স্মৃতি আছে?
হাবিবুল: অনেক স্মৃতি আছে। তার মধ্যে একটা বেশ মজার… মুশফিকুরের ক্যারিয়ারের শুরুর দিকের ঘটনা। পিচ্ছি একটা ছেলে, কিপিং গ্লাভস হাতে উইকেটের পেছনে। আমি স্লিপে দাঁড়িয়ে ওকে ক্ষেপাতাম.
মুশফিকুরের এই আচরণ কি ড্রেসিংরুমে কোন প্রভাব ফেলেছিল?
হাবিবুল: আমরা সবাই চাই জয়গুলো একসাথে উপভোগ করতে, হইচই করতে। যখন মুশফিকুর রান করে না, তখন একটু আলাদা হয়ে যায়। নিজের মতো করে ড্রেসিংরুমে থাকে। তবে প্রভাব পড়ে না। আমরা চাইতাম, কোন ম্যাচে ফেইল করলেও যেন ও আমাদের সাথে শামিল হয়। কিন্তু হতো না।
এজন্য মুশফিকুরের প্রতি আমাদের সব সময় উইশ থাকতো, ও যেন রান করতে পারে। যেন আমরা ওকে সঙ্গে নিয়ে আনন্দ করতে পারি। তবে ও কিন্তু কাউকে ডিস্টার্ব করতো না। এমন না যে খারাপ খেলে, কাউকে ডিস্টার্ব করছে। আমি সেটা কখনো দেখিনি। কেবলমাত্র নিজে খোলসবন্দী হয়ে যেত।
অধিনায়ক হিসেবে মুশফিকুর কেমন?
হাবিবুল: ইমোশনাল। ক্যাপ্টেন যখন ছিল, তখর ড্রেসিং রুমে এই জিনিসটা কিছুটা হলেও ইফেক্ট করেছে। এর বাইরে কোন কিছু ছিলো না। মাঠে তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা অন্য অনেকের চেয়ে ভালো ছিল।
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে মুশফিকুর অনেক স্ট্রাগল করেছে। ১৬ ইনিংসে ছিলো একটি ফিফটি। আপনার কি মনে হয় মুশফিকুর যথেস্ট সুযোগ পেয়েছেন বলেই আজকের মুশফিকুর হয়ে উঠেছেন?
হাবিবুল: অবশ্যই। নির্ভর করছে, আপনি কাকে সুযোগ দিচ্ছেন? মুশফিকুর ক্লাস খেলোয়াড়। মুশফিকুরকে আপনি ৩০ ইনিংস সুযোগ দিতে পারেন। কারণে আপনি জানেন, সে এক সময় রান করবে। এটাতো বোঝা যায়, কে কতটা প্রটেনশিয়াল প্লেয়ার।
আপনি জানেন মুশফিকুরকে সুযোগ দিলে আপনি বেনিফিটেড হবেন। আমরা যাকে নিয়ে কথা বলছি সে সেরা প্লেয়ার। ইনিংস দিয়ে ওকে বিচার করা ঠিক হবে না।
আরও রান, আরও সেঞ্চুরি হতে পারতো-এই নিয়ে কোন আক্ষেপ ব্যক্তিগতভাবে আপনার আছে?
হাবিবুল: ওর ফেজটা যদি আপনি দেখেন, ও রান করা শুরু করেছে যখন উইকেট কিপিং ছেড়েছে। তবে ও কিন্তু কিপিংটা উপভোগ করতো। ও ফিল করতো, কিপিং করলে ওর ফোকাস ভালো থাকে। আমি যখন খেলি, তখনো ওকে কিপিং বাদ দিয়ে কেবল ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলানোর কথা বলা হয়েছিলো।
সাঙ্গাকারা কিপিং ছেড়ে যখন ব্যাটিং করেছে, তার গড় বেড়ে গিয়েছিলো। মুশফিকুর ক্ষেত্রেও সেটি হয়েছে। ও কিন্তু ছয় নম্বরে ব্যাটিং করতো। আমি মনে করি সে চার নম্বরের ব্যাটসম্যান। তাছাড়া বেশিরভাগ সময়ে তাকে টেল নিয়ে ব্যাটিং করতে হয়েছে। চার নম্বরে খেললে রান করার সুযোগটা বেশি থাকে। ও যদি চার নম্বরে ব্যাটিং করতো, তাহলে নামের সাথে আরও ৩ হাজার রান বেশি থাকতো।
টেস্ট ক্রিকেটে তার কোন ইনিংসটাকে সেরা বলবেন?
হাবিবুল: মুশফিকুরের অনেক ভালো ভালো ইনিংস আছে। তবে আমার কাছে স্পেশাল গলের ডাবল সেঞ্চুরি। ওই ইনিংসটা আমি নিজ চোখে দেখেছি। যদিও ফ্লাট উইকেট। আমাদের কেউ তখনও ডাবল সেঞ্চুরি করেনি। ওটাই আমার চোখে বেশি লেগে আছে।
মানুষ তাকে কেন মনে রাখবে? প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিয়ান, প্রথম একশতম টেস্ট খেলতে নামছে নাকি অন্য কিছু?
হাবিবুল: মুশফিকুর সবার জন্য উদহারণ। মুশফিকুরের যে সব সময় ভালো সময় কেটেছে তা নয়, তাকে অনেক সমালোচনার মধ্য দিয়েও যেতে হয়েছে। তাকেও আপস এন্ড ডাউনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। পুরো ক্যারিয়ারটা কখনোই কিন্তু সরল রেখাতে যায়নি। স্ট্রাগল করতে হয়েছে।
তবে এক জায়গায় ব্যতিক্রম। প্রথম দিন থেকে যেভাবে ক্রিকেটকে ভালোবাসতো, এখনো তেমনই ভালোবাসে। ওকে সবাই মনে রাখবে, একজন আদর্শ ক্রিকেটার হিসেবে। যাকে অনুসরণ করলে পরিপূর্ন ক্রিকেটার হওয়া যাবে।
টেস্ট ক্যারিয়ার শেষে মুশফিকুরকে কোথায় দেখতে চান?
হাবিবুল: আমরা অনেকেই এখন বলি মুশফিকুর ১০০ ম্যাচ খেলে অবসর নেবেন কিনা? আমার মনে হয়, এই চিন্তার জায়গাটা ভুল। এটা পুরোটাই নির্ভর করছে, ওর উপরে। ও যদি উপভোগ করে ওর চালিয়ে যাওয়া উচিত। ওতো পারফরমার, ও নাম দিয়ে খেলছে না।
ক্রিকেটার হিসেবে এই সিদ্ধান্তটা মুশফিকুরের নেওয়া উচিত। নির্ভর করছে, মুশফিকুর খেলাটা কতটা উপভোগ করছে। আমি নিশ্চিত, প্রথম দিনের মতোই উপভোগ করছে খেলাটাকে। আমি চাই আরও লম্বা সময় খেলুক, কমপক্ষে এক বছর। আমাদের টেস্ট দলটা কিন্তু ভালো ভাবে তৈরি হচ্ছে। ও যদি থাকে, তাহলে বাকিদের উপর চাপটা কম পড়বে।
শততম টেস্টে মুশফিকুরের প্রতি আপনার বার্তা কি থাকবে?
হাবিবুল: আমি জানি সে অনেক ইমোশনাল। শততম টেস্ট ম্যাচে নিজের প্রতি কোন চাপ নিয়ে ফেলতে পারে। কারণ ভালো করার ইচ্ছা থাকবে ওর। কিন্তু আমি চাই, এই ম্যাচটা উপভোগ করুক।
সে পরীক্ষত ক্রিকেটার, তাকে আলাদা করে কিছু করতে হবে না। ও খেলুক, আমরা উপভোগ করবো। আমাদের একটা ছেলে শততম ম্যাচ খেলছে। দর্শকদের বলবো, আমরা যেন মুশফিকুরের উপর চাপ না দিয়ে দেই বিশেষ কিছু করতে!
মুশফিকুরের স্পেশাল কিছু করতে হবে না, ম্যাচটা খেললেই হবে।
ঢাকা/ইয়াসিন
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর হয় ছ ল আম দ র র ন কর আপন র প রথম উইক ট য টসম
এছাড়াও পড়ুন:
কলাপাড়ায় ইমামের স্ত্রীকে গলা কেটে হত্যা
প্রতীকী ছবি