ডাইনোসরের আগে পৃথিবীতে কাদের রাজত্ব ছিল, কী খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা
Published: 29th, June 2025 GMT
টাইরানোসরাস রেক্স নামের ডাইনোসর যুগেরও অনেক আগে পৃথিবীতে ছিল একদল হিংস্র মাংসাশী প্রাণীর রাজত্ব। এরা এতটাই অদ্ভুত ও ভীতিকর ছিল, যা হলিউড চলচ্চিত্রের কল্পকাহিনিকেও হার মানায়।
ধরা যাক, দুটি প্রাণী একে অপরকে ঘিরে ঘুরছিল। এ দুই প্রতিপক্ষ একে অপরের রোমহীন শরীর কতটা শক্তপোক্ত, তা পর্যবেক্ষণ করছিল। তাদের দাঁত ও থাবা ছিল অত্যন্ত ধারালো। আর চামড়া ছিল গন্ডারের মতো পুরু। একে অপরকে দেখতে দেখতে দুই প্রাণীই তাদের চোয়াল প্রায় ৯০ ডিগ্রি পর্যন্ত খুলে ফেলল। এরপর শুরু হলো লড়াই। একটি প্রাণীর ডান পাশে থাকা অপর প্রাণীটি ওপর থেকে প্রতিপক্ষকে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল। মুহূর্তেই সব শেষ। আক্রমণকারী প্রাণীটি তার ৫ ইঞ্চি (১২.
ধারণা করা হয়, প্রায় ২৫ কোটি বছর আগে পুরোপুরিভাবে না হলেও কাছাকাছি এমন কিছু একটা পৃথিবীতে ঘটেছে।
২৫ কোটি বছর পর ২০২১ সালের মার্চের এক রোদেলা দিনে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে ইজিকো ন্যাচারাল হিস্ট্রি জাদুঘরের দপ্তরে বসে কাজ করছিলেন জুলিয়েন বেনোয়া। তিনি জোহানেসবার্গের উইটওয়াটেরসরান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনবিষয়ক অধ্যাপক। জীবাশ্ম সংগ্রহগুলো দেখার জন্য তাঁকে সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেখানে তাঁর হাতে একটি পুরোনো বাক্স তুলে দেওয়া হয়। তাঁকে বলা হয়, এটা খুলে দেখতে। সেটি ছিল খুবই পুরোনো ও সাদামাটা কার্ডবোর্ডের বাক্স।
জুলিয়েন বেনোয়া বলেন, ‘এই বাক্স অন্তত ৩০ বছর ধরে খোলা হয়নি।’
বাক্সের ভেতরে অনেকগুলো হাড় এলোমেলোভাবে রাখা ছিল। এর মধ্যে ছিল অসংখ্য খুলি, যেগুলোর অনেকগুলোই ভুলভাবে শনাক্ত করা ছিল। তিনি সেগুলো গোছাতে গোছাতে ও সঠিকভাবে শনাক্ত করতে গিয়ে একটা ছোট চকচকে জিনিস দেখতে পান।
বেনোয়া বলেন, ‘ওই মুহূর্ত ছিল রোমাঞ্চকর। আমি সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেলি, আমি কী দেখছি।’ মুখে হাসি নিয়ে তিনি পাশের সহকর্মীর কাছে যান এবং মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করার অনুরোধ করেন।
যে খুলিটি পাওয়া গেছে, সেটি ছিল এক অজানা প্রজাতির গোরগোনোপসিয়ান প্রাণীর। এই গোরগোনোপসিয়ানরা ছিল তীক্ষ্ণ শিকারি, যারা ২৫ থেকে ২৬ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে বিচরণ করত। তারা বড় শিকারকে তাড়া করত এবং শিকারের মাংস ছিঁড়ে একবারে গিলে ফেলত।চকচকে জিনিসটা ছিল একটি দাঁত। দাঁতটি ছিল সুচালো ও খানিকটা গোল এবং সেটা আরেকটি প্রাণীর খুলির ভেতরে আটকে ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, এই প্রাণীটিও একই প্রজাতির সদস্য।
বেনোয়ার ধারণা, নেকড়ে আকারের ওই দুই প্রাণীর মধ্যে আধিপত্য নিয়ে লড়াই চলছিল। সেই লড়াইয়ের সময় একটির ছোট একটি দাঁত ভেঙে প্রতিপক্ষের খুলির মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল।
তবে এই দাঁত কোনো ডাইনোসরের ছিল না। এটি প্রাচীন পৃথিবীর এক নিদর্শন, যা টি–রেক্স, স্পিনোসরাস বা ভেলোসির্যাপটরের যুগ শুরুর অনেক আগেই স্মৃতি হয়ে গেছে।
যে খুলিটি পাওয়া গেছে, সেটি ছিল এক অজানা প্রজাতির গোরগোনোপসিয়ান প্রাণীর। এই গোরগোনোপসিয়ানরা ছিল তীক্ষ্ণ শিকারি, যারা ২৫ থেকে ২৬ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে বিচরণ করত। তারা বড় শিকারকে তাড়া করত এবং শিকারের মাংস ছিঁড়ে একবারে গিলে ফেলত।
এটি ছিল পার্মিয়ান যুগ, যা ভূতাত্ত্বিক ইতিহাসের এক স্বল্প পরিচিত যুগ। পৃথিবীতে তখন বিশাল আকারের ভয়ংকর সব প্রাণী রাজত্ব করত। এরা কখনো কখনো হাঙরও খেয়ে ফেলত। কখনো কখনো এমনও হয়েছে যে ভূমিতে শিকারের চেয়ে শিকারি প্রাণী বেশি ছিল।
‘জুরাসিক পার্ক’ সিনেমার নতুন পর্ব মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিবিসির সাংবাদিক জারিয়া গোরভেট পার্মিয়ান যুগের অদ্ভুত শিকারি প্রাণীদের দিকে নজর দেন। তিনি জানতে পারেন, এই প্রাচীন প্রাণীরা এতটাই বিচিত্র ও অস্বাভাবিক ছিল যে হলিউডের কল্পনাকেও যেন হার মানায়। যদিও এ নিয়ে নানা মত আছে।
পার্মিয়ানের শুরুতেই ছিল বরফযুগ, যা মহাদেশের দক্ষিণার্ধকে বরফে ঢেকে দিয়েছিল। সেখানে এত বেশি পানি বরফে আটকে পড়েছিল যে বিশ্বের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় ১২০ মিটার (৩৯৪ ফুট) পর্যন্ত কমে গিয়েছিল।অদ্ভুত পৃথিবী
পার্মিয়ান যুগ শুরু হয়েছিল প্রায় ২৯ কোটি ৯০ লাখ থেকে ২৫ কোটি ১০ লাখ বছর আগে। তখন পৃথিবীর সব স্থলভাগ একসঙ্গে মিলে প্যাঞ্জিয়া নামের একটি বিশাল মহাদেশ ছিল। এর আকৃতি ছিল অনেকটা খরগোশের মতো। এই মহাদেশ ঘিরে ছিল একটি বিশাল আন্তর্জাতিক সমুদ্র, যার নাম ছিল প্যানথালাসা।
এটি ছিল চরম পরিবেশের যুগ। পার্মিয়ানের শুরুতেই ছিল বরফযুগ, যা মহাদেশের দক্ষিণার্ধকে বরফে ঢেকে দিয়েছিল। সেখানে এত বেশি পানি বরফে আটকে পড়েছিল যে বিশ্বের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় ১২০ মিটার (৩৯৪ ফুট) পর্যন্ত কমে গিয়েছিল।
দক্ষিণ গোলার্ধ বরফে ঢাকা পড়ে যায়। এত পানি বরফে আটকে গিয়েছিল যে বিশ্বের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় ১২০ মিটার পর্যন্ত কমে গিয়েছিল।
বরফযুগ শেষ হলে প্যাঞ্জিয়া ধীরে ধীরে উষ্ণ হতে শুরু করে এবং মাটি শুকিয়ে যেতে থাকে। এত বিশাল একটানা জমির ভেতরের অংশে সাগরের ঠান্ডা বা আর্দ্র প্রভাব পৌঁছাত না, ফলে বিস্তীর্ণ এলাকা অনুর্বর ও শুষ্ক ভূমিতে পরিণত হয়।
পার্মিয়ান যুগের মাঝামাঝি সময়ে প্যাঞ্জিয়ার কেন্দ্রীয় অঞ্চলটি মূলত মরুভূমি ছিল। এর মাঝে মাঝে কিছু কোনিফার গাছ ছিল। আর কোথাও কোথাও হঠাৎ বন্যা দেখা দিত। কিছু এলাকা এতটাই গরম ছিল যে সেখানে থাকা কঠিন হয়ে পড়ত। তাপমাত্রা কখনো কখনো ৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছাত। এমন তাপমাত্রায় ধীরগতিতে টার্কি রোস্ট করাও সম্ভব।
যুক্তরাজ্যের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পল উইগনাল বলেন, ‘যদিও আবহাওয়া অনেকটা শুষ্ক ছিল, তবু মহাদেশের চারপাশে, বিশেষ করে উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে প্রচুর গাছপালা ছিল।’
এরপর পার্মিয়ান যুগের শেষ দিকে এসে হঠাৎ পুরো পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রায় ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যায়, যা বর্তমান বিশ্বে গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়তে থাকলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সবচেয়ে বাজে যে পরিস্থিতির আশঙ্কা করা হচ্ছে, তার তুলনায় দ্বিগুণ।
এই উষ্ণতা পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গণবিলুপ্তির পরিস্থিতি তৈরি করেছিল এবং সেটিই ছিল সেই পরিবেশ, যেখানে পরে ডাইনোসররা টিকে থাকার সুযোগ পায়।
এ ঘটনাই পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গণবিলুপ্তির পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। আর এরপর যে পরিবেশ গড়ে উঠেছিল, সেখানে ডাইনোসরদের রাজত্ব শুরু হয়েছিল।
আমরা এখন ডাইনোসরের যুগ থেকে যত বছর দূরে আছি, পার্মিয়ান যুগের সঙ্গে ডাইনোসরের যুগের দূরত্বটাও ততটুকু।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ছ ল এক
এছাড়াও পড়ুন:
উল্লাস করে, চরম বর্বরতা দেখিয়ে রূপলাল ও প্রদীপকে হত্যা করা হয়
রংপুরের তারাগঞ্জে চোর সন্দেহে রূপলাল দাস ও প্রদীপ লালকে যখন বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয়ে আনা হয়, তখনো তাঁরা জীবিত ছিলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ৫ মিনিট ২১ সেকেন্ডের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকেও তাঁদের বাঁচাতে পারেনি।
ভিডিওতে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের মাঠে একটি ভ্যানের ওপর রাখা হয়েছে রূপলাল ও প্রদীপকে। চারপাশে কয়েক শ মানুষ, প্রথম সারিতে তরুণ-যুবকেরা। পুলিশের চার সদস্য ভ্যানটি ঘিরে বাঁশিতে ফুঁ দিচ্ছিলেন এবং হাত তুলে জনতাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছেন। এ সময় রূপলাল দাঁড়াতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। শোয়া অবস্থায় খুলে যাওয়া লুঙ্গি ঠিক করছিলেন তিনি। পুলিশ ধাক্কা দিয়ে জনতাকে সরানোর চেষ্টা করলে তাঁরা আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। শোরগোল শুরু হলে পুলিশ পিটুনিতে অর্ধমৃত এই ব্যক্তিদের রেখে সরে যায়।
গত শনিবার রাত ৯টার দিকে তারাগঞ্জের সায়ার ইউনিয়নের বটতলা বুড়িরহাট এলাকায় দুজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এই দুজন হলেন উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর গ্রামের রূপলাল দাস (৪০) ও তাঁর আত্মীয় মিঠাপুকুরের ছড়ান বালুয়া গ্রামের প্রদীপ লাল (৩৫)। রূপলাল স্থানীয় বাজারে জুতা সেলাই করতেন ও প্রদীপ লাল ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, পুলিশ চলে যাওয়ার পর রূপলাল মাথা তুলতেই কালো গেঞ্জি পরা এক যুবক তাঁকে ঘুষি মারেন। এতে আবার লুটিয়ে পড়েন রূপলাল। এরপর ভ্যানের ওপর শোয়া অবস্থায় থাকা দুজনকে তরুণ-যুবকেরা যে যেভাবে পারেন কিল, ঘুষি, লাথি, লাঠি ও রড দিয়ে মারতে থাকেন। একপর্যায়ে ভ্যানের ওপর থেকে মাটিতে পড়ে যান প্রদীপ লাল। এ দৃশ্য মুঠোফোনের আলো জ্বালিয়ে ভিডিও করছিলেন অনেকেই।
ওই ভিডিওতে দেখা যায়, প্রদীপ লাল ভ্যান থেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে সেখানে তাঁকে অনবরত লাথি মারা হয়। রূপলালকে অর্ধনগ্ন অবস্থায় ভ্যানসহ প্রদীপ লালের ওপর উল্টে দেওয়া হয়। এতে দুজনই ভ্যানের নিচে চাপা পড়েন। এরপর তাঁদের ওপরে থাকা ভ্যানে চাপ দিতে থাকেন তাঁরা। এ সময় বাঁশির শব্দ শোনা গেলেও কোনো পুলিশ সদস্যকে দেখা যায়নি। কয়েকজনকে বলতে শোনা যায়, ‘এ মরে নাই এ্যালাও। দে দে চাপা দে। আরও দে।’
একপর্যায়ে ভ্যানটি কয়েকজন যুবক-তরুণ রূপলাল ও প্রদীপের ওপর থেকে সরিয়ে নেন। এরপর রশি, জুতা, গাছের ডাল, ভ্যানের প্যাডেল দিয়ে মারধর করতে থাকেন। তখন নিস্তেজ ছিলেন রূপলাল ও প্রদীপ। মৃত্যু নিশ্চিত করতে হলুদ, কালো, লাল গেঞ্জি পরা চার-পাঁচজন তরুণ-যুবক রূপলালের পিঠে লাথি মারতে থাকেন। হলুদ গেঞ্জি পরা দুই তরুণ দুই পায়ে পিঠ বরাবর একাধিকবার লাথি দেন। এ সময় পাশে থাকে কয়েকজন বলতে থাকেন, ‘দে দে, আরও দে।’ প্রদীপ লালকে দেখিয়ে আঙুল উঁচিয়ে একজন বলতে থাকেন, ‘এ ওইটাকও দে। মার। নড়ি পা** ঢুকি দেও’ বলে উল্লাস করতে থাকেন। এ কথা শুনে এক হলুদ গেঞ্জি পরা তরুণ গাছের ডাল দিয়ে আরও মারতে থাকেন। ছাইরঙা গেঞ্জি পরা এক যুবক রূপলালের মৃত্যু নিশ্চিত করতে গলায় পা তুলে দেন। আশপাশের কেউ কেউ তখন বলছিলেন, ‘পুলিশ পালাইছে।’
পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকেও তাঁদের বাঁচাতে পারেনি