কথা অস্পষ্ট, পারেন না লিখতে তবুও দিচ্ছেন এইচএসসি পরীক্ষা
Published: 30th, June 2025 GMT
মুখের ভাষা অস্পষ্ট। কোনো রকম হাটতে পারলেও পারেন না লিখতে। এরপরও নিজের ইচ্ছা শক্তিতে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন এইচ এম সিয়াম (১৮)। পরীক্ষার হলে তাকে শ্রুতি লেখক হিসেবে সাহায্য করছেন দশম শ্রেণির ছাত্র রাজিব। প্রশ্ন দেখে অস্পষ্ট ভাষায় উত্তর দিচ্ছিলেন সিয়াম। সেই উত্তর খাতায় লিখছিলেন রাজিব।
সিয়াম ভালো ফলাফল নিয়ে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বড় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবেন এমনটি আশা করছেন তার বাবা-মা ও শিক্ষকরা।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া পৌর শহরের রহমতপুর এলাকার এনজিও কর্মী ওবাইদুল ইসলামের বড় ছেলে এইচ এম সিয়াম। জন্মের এক বছর পর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন তিনি। এরপর তার স্বাভাবিক চলাফেরা ও কথা বলায় অনেক সমস্যা দেখা দেয়। তাকে সুস্থ করতে অনেক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন পরিবারের সদস্যরা। বর্তমানে তার শারীরিক অবস্থা উন্নতির দিকে।
আরো পড়ুন:
শাবিপ্রবিতে প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু ৭ জুলাই
মহানবী (সা.
স্বজনরা জানান, ছোট থেকেই পড়ালেখার প্রতি অনেক আগ্রহ ছিল সিয়ামের। পরিবারের সহযোগিতা ও নিজের ইচ্ছাশক্তিতে পড়ালেখা চালিয়ে যান তিনি। ২০২৩ সালে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ- ৪.০৭ নিয়ে উত্তীর্ন হন সিয়াম। এবার তিনি দিচ্ছেন এইচএসসি পরীক্ষা।
ইসমাইল তালুকদার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট টেকনোলজি বিভাগে ওই কেন্দ্রেই পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন সিয়াম। নিজে লিখতে না পারায় শিক্ষা বোর্ডে আবেদন করে নিয়েছেন শ্রুতি লেখক। পরীক্ষার হলে সিয়াম অস্পষ্টভাবে উত্তর বলেন আর তা শুনে খাতায় লিপিবদ্ধ করেন আমতলী উপজেলার কুকুয়া আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র শ্রুতি লেখক রাজিব। পরীক্ষা দিতে পেরে উচ্ছ্বসিত সিয়াম। সিনিয়র ভাইকে সহযোগিতা করতে পেরে খুশি রাজিব।
পরীক্ষার্থী এইচ এম সিয়াম বলেন, “আমার পড়াশুনা করতে অনেক ভালো লাগে। বাবা-মা এবং কলেজের শিক্ষকরা সবাই আমাকে সহযোগিতা করেন। আমার এইচএসসি পরীক্ষা খুব ভালো হয়েছে। বাংলা ও ইংরেজি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আমি পড়ালেখা করে যাতে ভালো পর্যায়ে পৌঁছাতে পারি এজন্য সবার কাছে দোয়া চাই।”
রাজিব বলেন, “আমি সিয়াম ভাইয়ের শ্রুতি লেখক হিসেবে পরীক্ষা দিতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি।”
সিয়ামের বাবা ওবাইদুল ইসলাম বলেন, “সিয়ামকে ঘরে বসিয়ে রাখা কোনো ভাবেই ভালো হতো না। ওর পড়ালেখা করার অনেক ইচ্ছা। শত কষ্ট হলেও আমি ওকে পড়ালেখা করাবো।”
সিয়ামের মা জয়নব বেগম কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলেন, “আমার ছেলের বয়স যখন এক বছর তখন সে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। ওর হাটা ও কথাবার্তায় সমস্যা শুরু হয়। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। অগের চেয়ে অবস্থার উন্নতি হয়েছে। এখনো তার ওষুধ চলে। আমার ছেলের জন্য সবার কাছে দোয়া চাই।”
ইসমাইল তালুকদার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ আবু সালেহ বলেন, “সিয়াম অন্য সব ছাত্রের সঙ্গেই ক্লাস করেছে। আমরা আলাদাভাবে তার খেয়াল রেখেছি। তিনি মেধাবী এবং তার শ্রবণ শক্তি অনেক ভালো। আশা করছি, ভালো রেজাল্ট নিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে বড় কোনো বিদ্যাপিঠে পড়ালেখা করতে পারবেন তিনি।”
কলাপড়া উপজেলা ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির সহকারী পরিচালক ও ইসলাম তালুকদার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট পরীক্ষা কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান খান বলেন, “সিয়ামের পরীক্ষায় কোনো আইনি জটিলতা নেই। তিনি বোর্ড থেকে অনুমতি নিয়ে শ্রুতি লেখকের মাধ্যমে পরীক্ষা দিচ্ছেন।”
ঢাকা/ইমরান/মাসুদ
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর এইচএসস পর ক ষ য়
এছাড়াও পড়ুন:
দ্বীপকন্যার ‘ডলার ধরা’র গল্প
স্বামী মোজাহেদ হাসান পুলিশ পরিদর্শক। কাজের ফাঁকে গান লিখেন, গান করেন। স্বামীর লেখা গানের একটি লাইন বেশ মনে ধরেছিল আসমাউল হোসনার– ‘ডলার বাতাসে উড়ে/যার যোগ্যতা আছে, সেই ধরতে পারে।’ হোসনা মনে মনে ঠিক করলেন, তিনি ডলার ধরবেন। যেই ভাবা সেই কাজ, গত বছরের শুরুর দিকে ফেসবুকে ‘কিছু করতে চাই’ নামের একটি গ্রুপে যুক্ত হন তিনি। সেই গ্রুপে ‘নারীদের সফলতার গল্প’ পড়েন আর নতুন কিছু করার স্বপ্ন দেখেন যৌথ পরিবারের বউ হোসনা। তবে সংসারের কাজের ফাঁকে ভিন্ন ট্র্যাকের কিছু করা নিয়ে কিছুটা উদ্বিগ্নও ছিলেন দুই সন্তানের এই জননী।
এই সময় আসমাউল হোসনা একদিন এনটিভিতে ফ্রিল্যান্সিং শেখানোর প্রতিষ্ঠান লিডিং লাইটের কর্ণধার সিনথিয়া আকতার লিজার সাক্ষাৎকার দেখেন। লিজা ফ্রিল্যান্সিং মাসে আয় করেন ৪ লাখ টাকা। হোসনা চোখ বন্ধ করে ভর্তি হয়ে যান লিডিং লাইটে। গত বছরের মার্চে শুরু হয় ফ্রিল্যান্সিং শেখার কোর্স। কোর্স চলাকালীন আগস্টে প্রথম নেদারল্যান্ডসের একজন ক্লায়েন্টের কাজ পান তিনি। কাজটা সফলভাবে সম্পন্ন করেন। গত বছরের আগস্টে দেশ ছিল টালমাটাল, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের রেশ তখনও চলছে দেশে। ২৩ আগস্ট আসমাউল হোসনা যখন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিছানায়, তখনই আসে প্রথম ৪৫ ডলারের পেমেন্ট। হোসনার ডলার ধরার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পেল।
এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি গৃহবধূ আসমাউল হোসনাকে। এখন তিনি ইউক্রেন,
জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী চারজন বায়ার এবং তিনটি গ্লোবাল সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানির ম্যানেজার। ফ্রিল্যান্সিং করে এখন তার মাসিক আয় ১২০০–১৫০০ ডলার, যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় দেড় লাখ টাকা। গত ঈদে নিয়মিত আয়ের পাশাপাশি পেয়েছেন বোনাস ডলার।
বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্ট ম্যানেজমেন্ট, ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম ক্যাম্পেইন রানের পাশাপাশি ওয়েবসাইট তৈরি করেন আসমাউল হোসনা। ডিজিটাল মার্কেটিং, কনটেন্ট স্ট্র্যাটেজি, অর্গানিক গ্রোথ টেকনিক এবং এনালিটিক্স ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রাহকদের ব্র্যান্ড ভ্যালু বৃদ্ধিতে অবদান রাখছেন তিনি।
প্রথম ডলার পাওয়ার অনুভূতি বললেন আসমাউল হোসনা–‘আমি তখন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে জ্বরে কাবু, বিছানায় পড়ে আছি। এই সময়ে এলো সুখবর, আমার একাউন্টে জমা হলো ৪৫ ডলার। তখন আমার মনে হলো কখনও কখনও দুঃসময়ও মানুষকে সেরা মুহূর্ত উপহার দেয়।’
কক্সবাজারের সাগরকন্যা খ্যাত কুতুবদিয়ার লেমশীখালীর মেয়ে আসমাউল হোসনা। সাগরের গর্জন আর ঝাউবনের গান শুনে বড় হয়েছেন তিনি। সেখান থেকে ডিজিটাল দুনিয়ায় নিজস্ব পরিচিতি গড়ে তোলা যেন এক ‘রূপকথার গল্প’। ২০১৫ সালে লেমশীখালী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেছেন হোসনা। ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম শহরের এনায়েত বাজার মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করা ছিল তার জন্য ‘টার্নিং পয়েন্ট’। এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরপরই পারিবারিক সিদ্ধান্তে পুলিশ কর্মকর্তা মোজাহেদ হাসানের সঙ্গে বিয়ে হয় হোসনার। পরে চট্টগ্রাম সরকারি হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজ থেকে গণিতে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন তিনি।
স্বামীর কর্মস্থল কখনো শহরে, কখনো মফস্বলে, কখনো পাহাড়ে–কখনো সমতলে। শুরু দিকে এই নতুন পরিবেশ মানিয়ে নিতে তাঁকে মানসিকভাবে লড়াই করতে হয়েছে। কিন্তু দ্বীপকন্যা ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া, তাই সবসময় সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস দেখিয়েছেন। আসমাউল হোসনা বলেন, ‘আমার স্বামী বাংলাদেশ পুলিশের একজন সদস্য, তিনিই আমার স্বপ্নের সারথী, আমার সাফল্যের চালিকা শক্তি। স্বামীর সহৃদয় সহায়তায় আমি নতুন দিনের আলো দেখেছি।’
স্বামী, সন্তান, সংসার দেখভাল করার পর ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য সময় বের করেন কিভাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে আসমাউল হোসনা বলেন, ‘এই পেশায় আমার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল টাইম ম্যানেজমেন্ট। আমাদের যৌথ পরিবার। সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সংসার সামলানোর পাশাপাশি পড়াশোনাও সমানতালে চালিয়ে যাচ্ছি। আমার বিশ্বাস–ইচ্ছা থাকলে সবই সম্ভব।’
‘ডলার তো ধরছেন, এখন আপনার পরিকল্পনা কী?’–এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা হলো, ডিজিটাল সেক্টরে গ্রামের মেয়েদের দক্ষ করে তোলা। আমি চাই এমন একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে, যেখানে প্রযুক্তিগতভাবে পিছিয়ে থাকা মেয়েরা ঘরে বসেই আয়ের পথ তৈরি করতে পারবেন। আমার বিশ্বাস, শিক্ষা ও প্রযুক্তির মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব এবং নারীদের দক্ষ করে তোলার মধ্যে দিয়েই দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো আরও শক্তিশালী করা যাবে।’
নতুন যারা ফ্রিল্যান্সিংয়ে আসতে চান, তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী? ‘মহান আল্লাহর দেওয়া অফুরন্ত শক্তির ওপর বিশ্বাস রেখে সঠিকভাবে চেষ্টা করে গেল সাফল্য আসবেই। শেখার কোনো শেষ নেই। প্রথম দিকে সবকিছুই একটু কঠিন লাগে, সময়ের সঙ্গে সহজ হয়ে যায়। আমি মনে করি, গৃহিণীদের জন্য ফ্রিল্যান্সিংয়ে দারুণ সুযোগ রয়েছে। আমরা রান্না, খাওয়া ও ঘুমানোর ফাঁকে একটু সময় পেলেই স্মার্ট ফোনে ঢু মারি। আমার পরামর্শ থাকবে ফেসবুক, ইউটিউবে অযথা সময় নষ্ট না করে গৃহবধু, তরুণ–তরুণীরা যে ফ্রিল্যান্সিং শিখে, আয়ের পথ খুঁজেন।’–বলেন আসমাউল হোসনা।