কুমিল্লার মুরাদনগরে মব সন্ত্রাসের মাধ্যমে যেইভাবে দুই সন্তানসহ মাকে গণপ্রহারে হত্যা করা হইয়াছে, উহাতে আমরা ক্ষুব্ধ, হতাশ এবং উদ্বিগ্ন। মব সহিংসতা প্রতিরোধে বারংবার আমরা এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে তাগিদ দিয়া আসিলেও এইবারের অঘটন যেন পূর্বের সকল মাত্রা অতিক্রম করিয়াছে। মাদক কারবার কিংবা ফোন চুরি– অপরাধ যাহাই হউক না কেন, এই প্রকারে একটি পরিবারের উপর সহস্রাধিক মানুষের আক্রমণ কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য হইতে পারে না। যাহা অধিক বেদনার, এই মব সন্ত্রাসের সহিত সংশ্লিষ্ট ছিলেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ। তথায় চেয়ারম্যান ও মেম্বারের উপর হামলার ঘটনা ঘটিয়াছে বলিয়া এলাকার মসজিদ হইতে মাইকে ঘোষণা দিয়া জনসাধারণকে উত্তেজিত করা হইয়াছে। তাহারা ভুক্তভোগীর বাড়িতে হামলা–ভাঙচুর করিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই; তিনজনকে হত্যা করিয়া মরদেহ বাড়ির সম্মুখে ফেলিয়া রাখিয়াই তবে নিষ্ক্রান্ত হইয়াছে!
এই মব সহিংসতা এক ভয়ানক ব্যাধির নজির। যাহার আস্ফালন গত ১১ মাস ধরিয়া চলমান এবং ইহা কেবল মুরাদনগরে সীমাবদ্ধ নহে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই বৎসরের জানুয়ারি হইতে মুরাদনগরের ঘটনা পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত গণপ্রহারের ঘটনায় প্রায় শত মানুষ প্রাণ হারাইয়াছেন। মানুষ কেন স্বীয় হস্তে আইন তুলিয়া লইতেছে? ইহার পশ্চাতের প্রধান কারণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। রাষ্ট্র পরিচালিত যে বাহিনীর উপর এই ব্যবস্থা অর্পিত, তাহাদের উপর কেন মানুষ আস্থা রাখিতে পারিতেছে না, উহার কারণ অনুসন্ধান জরুরি।
সরকারের তরফ হইতে মব সন্ত্রাসে শূন্য সহিষ্ণুতা প্রদর্শনের কথা বলা হইলেও উল্লিখিত অনাচারে সংশ্লিষ্টদের বিচারের দৃষ্টান্ত না থাকিবার কারণে অপরাধের পুনরাবৃত্তি হইতেছে। মুরাদনগরের ঘটনায় কীরূপে চেয়ারম্যান-মেম্বারদের ন্যায় জনপ্রতিনিধিগণ মব সহিংসতায় অংশ লইলেন? আমরা মনে করি, তাহাদের অবশ্যই জবাবদিহি করিতে হইবে। মসজিদের মাইকই বা কীরূপে এমন সহিংসতার উস্কানিতে ব্যবহৃত হইল? এই ঘটনায় জড়িত প্রত্যেককে দ্রুত শনাক্ত করিয়া আইনের আওতায় আনিতে হইবে। সমকালের খবর অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার ঐ মব সহিংসতার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আসিয়া গুরুতর আহত পরিবারের এক সদস্যকে উদ্ধার করিতে সক্ষম হয়। প্রশ্ন হইল, উহাদের আগমনে এত বিলম্ব ঘটিল কেন? মঙ্গলবার মোবাইল ফোন চুরি হইতে যেই ঘটনার সূত্রপাত, তাহা যে এত শাখা-প্রশাখা মেলিবে– পুলিশ ধারণা করিতে ব্যর্থ হইয়াছে কেন? যাহা হউক, আমরা প্রত্যাশা করিব, আহত সদস্যের নিরাপত্তা, চিকিৎসা ও আইনি সহায়তা রাষ্ট্রীয়ভাবে নিশ্চিত করা হইবে।
ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা দীর্ঘদিন মাদক ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট বলিয়া এলাকাবাসীর সহিত তাহাদের বিরোধ ছিল। তবে কেন তাহাদের আইনের হস্তে সোপর্দ না করিয়া গণপ্রহারে হত্যা করা হইল? ইহা কেবল গুরুতর ফৌজদারি অপরাধই নহে, মানবাধিকার লঙ্ঘনও বটে। গণপ্রহার বা মব সহিংসতার নামে বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।
কোনো ব্যক্তি অপরাধের সহিত সংশ্লিষ্ট হইলে তাহার প্রতিকারে রাষ্ট্রীয় বিচার ব্যবস্থা বিদ্যমান। উক্ত ব্যবস্থার উপর নাগরিকদের আস্থা রাখিতে হইবে। উহার ব্যত্যয় ঘটিলে মব সহিংসতায় কেবল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিই ধ্বংস হইবে না, দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হইবে। আমরা মনে করি, জননিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে মব সহিংসতাকে কঠোর হস্তে দমন করা আশু কর্তব্য। এই ক্ষেত্রে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্রিয়তার বিকল্প নাই। সরকারের দিক হইতেও তাহাদের প্রতি কঠোর হইবার বার্তা দেওয়ার পরও উহার বাস্তবায়ন না হইবার কারণ খতাইয়া দেখা দরকার। কোনো সভ্য সমাজে এই ধরনের বেআইনি কর্মকাণ্ড ধারাবাহিকভাবে চলিতে পারে না। নাগরিকদেরও উৎকর্ণ থাকিতে হইবে। কোথাও মব সহিংসতার আভাস পাইলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তৎক্ষণাৎ অবহিত করা কিংবা নিজেরাই সংগঠিত হইয়া উক্ত দুষ্কর্মকে রুখিয়া দিতে হইবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ম র দনগর ব যবস থ হইয় ছ র ঘটন অপর ধ র উপর
এছাড়াও পড়ুন:
অজ্ঞাতনামা লাশ আর কারা হেফাজতে মৃত্যু বেড়েছে, শৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকায় জনমনে সন্দেহ: এমএসএফ
চলতি অক্টোবর মাসে দেশে অজ্ঞাতনামা লাশ এবং কারা হেফাজতে মৃত্যু সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় বেশ খানিকটা বেড়েছে। এ তথ্য তুলে ধরেছে মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)। প্রতিষ্ঠানটির অক্টোবর মাসের মানবাধিকার প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এমএসএফ বলেছে, এসব ঘটনায় জনজীবনের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি জোরালোভাবে সবার সামনে প্রতিফলিত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ দুই ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে জনমনে সন্দেহ আছে।
এমএসএফ প্রতি মাসে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরে। আজ শুক্রবার অক্টোবর মাসের প্রতিবেদন গণমাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং নিজস্ব তথ্যানুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে এমএসএফ মানবাধিকার প্রতিবেদন তৈরি করে।
বেড়েছে অজ্ঞাতনামা লাশএমএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অক্টোবর মাসে মোট ৬৬টি অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে। এটি অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়; বরং নাগরিক জীবনে নিরাপত্তাহীনতার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত মাসে (সেপ্টেম্বর) এর সংখ্যা ছিল ৫২। এসব অজ্ঞাতনামা লাশের বেশির ভাগই নদী বা ডোবায় ভাসমান, মহাসড়ক বা সড়কের পাশে, সেতুর নিচে, রেললাইনের পাশে, ফসলি জমিতে ও পরিত্যক্ত স্থানে পাওয়া যায়। অল্পসংখ্যক মৃতদেহ গলাকাটা, বস্তাবন্দী ও রক্তাক্ত বা শরীরে আঘাতের চিহ্নসংবলিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে।
এমএসএফ বলেছে, অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের ঘটনা বেড়েই চলেছে এবং তা জনজীবনের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি জোরালোভাবে সবার সামনে প্রতিফলিত হচ্ছে। পাশাপাশি অজ্ঞাতনামা লাশের পরিচয় উদ্ধারে অপারগতায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। এমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ১টি শিশু, ১ কিশোর, ১১ জন নারী ও ৫৩ জন পুরুষের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭ বছর বয়সী শিশু; ১৫ বছর বয়সী কিশোর; ২০ থেকে ৩০ বয়সী ১৫ জন পুরুষ ও ২ জন নারী; ৩১ থেকে ৪০ বয়সী ১৯ জন পুরুষ ও ৬ জন নারী; ৪১ থেকে ৫০ বয়সী ১ নারী ও ৫ জন পুরুষ এবং ৫০ বছর বয়সের বেশি ১১ জন পুরুষ ও ১ নারী রয়েছেন। এর মধ্যে অজ্ঞাতনামা তিনজনের বয়স শনাক্ত করা যায়নি।
এমএসএফ বলেছে, শুধু অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে বলে জানিয়েই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না; বরং পরিচয় জানার বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। পরিচয় উদ্ধার করে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।
কারা হেফাজতে মৃত্যু বাড়ছেইএমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে কারা হেফাজতে মোট ১৩ জন বন্দীর মৃত্যু হয়েছে। গত মাসে এ সংখ্যা ছিল মোট ৮। এ মাসে ছয়জন কয়েদি ও সাতজন হাজতির মৃত্যু হয়েছে।
কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চারজন কয়েদি ও দুজন হাজতি, গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে একজন কয়েদি ও শেরপুর জেলা কারাগারে একজন কয়েদি মারা যান। এ ছাড়া খুলনা জেলা কারাগারে, টাঙ্গাইল জেলা কারাগারে, চট্টগ্রাম জেলা কারাগারে, সিরাজগঞ্জ কারাগারে ও মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারে একজন করে হাজতি বন্দী মারা যান। সব বন্দীর মৃত্যু হয় কারাগারের বাইরে হাসপাতালে।
এমএসএফের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কারা হেফাজতে মৃত্যু এবং অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের সংখ্যা বৃদ্ধি মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম অবনতির চিত্র তুলে ধরে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই লাশ উদ্ধার করেই ক্ষান্ত হচ্ছে। কিন্তু এসব লাশ উদ্ধার করে তার পরিচয় শনাক্ত করা এবং সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত করে মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটন করাই শুধু নয়, এসব লাশ আত্মীয়-পরিজনের কাছে পৌঁছে দেওয়া এসব বাহিনীর কাজ। কিন্তু একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু মামলা করা ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আর কোনো কাজ নেই।
সাইদুর রহমান বলেন, অজ্ঞাতনামা লাশের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং হেফাজতে মৃত্যু বৃদ্ধি জনমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করে।
গণপিটুনিতে হত্যা চলছেই, বেড়েছে রাজনৈতিক সহিংসতাঅক্টোবর মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ৪৯টি ঘটনার শিকার হয়েছেন ৫৪৯ জন। এর মধ্যে ২ জন নিহত এবং ৫৪৭ জন আহত হয়েছেন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে চারজন গুলিবিদ্ধ এবং নিহত ব্যক্তিরা বিএনপির কর্মী–সমর্থক। সেপ্টেম্বর মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ৩৮টি ঘটনা ঘটেছিল।
সহিংসতার ৪৯টি ঘটনার মধ্যে ১১টি ঘটনায় রাজনৈতিক বিরোধ ও সহিংসতাকে কেন্দ্র করে পার্টি অফিস, বসতবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা ও অগ্নিকাণ্ড এবং ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। তবে এসব ঘটনায় হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
অক্টোবর মাসে মোট গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে ৪৪টি। আগের মাসে এ ঘটনা ঘটেছিল ৪৩টি। এ মাসে গণপিটুনির শিকার হয়ে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ১২। আগের মাসে নিহত হয়েছিলেন ২৪ জন।