পিআর না, ফেয়ার নির্বাচন চায় জনগণ: দুলু
Published: 12th, July 2025 GMT
বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেছেন, পিআর না, ফেয়ার নির্বাচন চায় জনগণ। বিএনপির ভাবমূর্তি ও সুনাম নষ্ট করতে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। বিএনপি এখন ক্ষমতায় না যেতেই চক্রান্তের শিকার হচ্ছে। চক্রান্তের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
শনিবার (১১ জুলাই) দুপুরে নাটোর জেলা পরিষদ অডিটেরিয়ামে আয়োজিত শ্রমিকদলের সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দুলু এসব কথা বলেন।
রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, ‘‘গত ১৮ বছর বিএনপিকে ধ্বংস করতে নেতাকর্মীদের ওপর নিপীড়ন ও নির্যাতন করা হয়েছে যেন বিএনপি দেশ থেকে চিরতরে নিঃশেষ হয়ে যায়। বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মীকে হামলা করে পুঙ্গ করা হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ এমন কোনো নেতাকর্মী নেই, যারা নির্যাতনের স্বীকার হননি। বর্তমানে বিএনপির ভাবমূর্তি ও সুনাম নষ্ট করতে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।’’
‘‘গত ৫ আগস্টের পর সবাই বিএনপি হয়ে গেছে। আগে মিছিল করতে লোক পেতাম না, এখন মঞ্চে জায়গা পাই না। যারা আগে অন্যায় অপরাধ করেছে, তাদের দল থেকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। যারা অন্যায় অত্যাচারের সঙ্গে জড়িত তাদের বিএনপিতে কোনো জায়গা নেই। শহীদ জিয়াউর রহমান বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, খুনিদের দলে স্থান দেননি। তারেক রহমানও বিএনপিতে কোনো অপরাধী, সন্ত্রাসী, খুনিদের জায়গা দেবেন না।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘জুলাই আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি শ্রমিকরা ভূমিকা পালন করেছেন। ছাত্ররা যখন গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে, তখন একজন ভ্যানচালক সিএনজি, অটোতে করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছেন। একজন রিকশাচালক তার গাড়িতে করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ক্লিনিকে ভর্তি করেছেন। ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতা ও শ্রমিক, কুলিদের রক্তে আমরা ফ্যাসিবাদ মুক্ত হয়েছি।’’
নাটোর জেলা যুবদলের সভাপতি আবু রায়হান ভুলুর সভাপতিত্বে ও জেলা শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক মো.
ঢাকা/আরিফুল//
উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
মুক্তির প্রাথমিক শর্ত বৈষম্যের অবসান
জল ও পানির বিরোধের খবর তো আমরা জানিই। জিনিসটা একই। একই কল থেকে পাওয়া যাচ্ছে, একইভাবে তৃষ্ণা নিবারণ করছে। কিন্তু হিন্দু বলছে, সে জল পান করছে; মুসলমান বলছে, সে পান করছে পানি। এ নিয়ে ভীষণ গোলযোগ ছিল। অথচ ‘জলপানি’ পেতে হিন্দু-মুসলমান কোনো ছাত্রেরই আপত্তি ছিল না। আপত্তি থাকবে কেন? ওটা তো পুরস্কার, তাতে জল ও পানি মেশামেশি করে থাকলে অসুবিধাটা কোথায়? জলখাবারও ঠিকই চলত। পানিফল পেলে কেউ যে নামের কারণে তা ফেলে দিত, এমন মোটেই নয়।
সাধারণ মানুষ জল ও পানির পার্থক্য নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাত না; তারা জিনিসটা পেলেই খুশি থাকত। কিন্তু মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণির মানুষ নিয়েই যত মুশকিল ছিল। তারা ভাষার ওই পার্থক্যকে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের চিহ্নগুলোর একটি হিসেবে আঁকড়ে ধরেছিল। সাম্প্রদায়িকতা জনগণের ব্যাপার ছিল না। ছিল দুই দিকের দুই মধ্যবিত্তের। তারা তাদের নিজেদের স্বার্থে ঝগড়া-ফ্যাসাদ বাধিয়ে এমন ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি করল; অখণ্ড ভূমিকে দুই টুকরো করা ছাড়া গত্যন্তর রইল না। তাতে প্রকৃতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি সব কিছুরই ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে ভাষা বিকাশেরও।
বাংলা প্রাকৃত ভাষা। প্রাকৃতজনের ভাষা। তারাই একে রক্ষা করেছে। শাসক শ্রেণির অবজ্ঞা ও উন্নাসিকতা ছিল; কিন্তু তারা ধ্বংস করতে পারেনি জনগণের ভাষাকে। বাংলা ভাষা রয়েই গেছে। ওই যে দুই মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, তাতে বাংলা ভাষার ওপর যে চাপটা পড়েছে, সেটা সামান্য নয়। হিন্দু মধ্যবিত্ত মুসলিম মধ্যবিত্তের তুলনায় এগিয়ে ছিল। এক সময়ে ফার্সি ছিল রাজভাষা; তখনকার অভিজাত শ্রেণি ওই ভাষা রপ্ত করেছে নিজেদের আভিজাত্যের অনুরোধে ও স্বার্থে। হিন্দুরাও ফার্সি শিখেছে। রাজা রামমোহন রায় চমৎকার ফার্সি জানতেন। যখন ইংরেজ এলো তখন ফার্সির জায়গায় ইংরেজি হলো রাষ্ট্রভাষা। হিন্দু অভিজাত শ্রেণি ইংরেজি শিখে নিয়েছে; মুসলমানরা সেভাবে শিখতে পারেনি। কিছুটা ছিল অভিমান, কিছুটা অর্থনৈতিক দুর্বলতা, যে জন্য তারা পিছিয়ে পড়ল। হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণিও গড়ে উঠল শিক্ষা, পেশা এবং বিশেষভাবে জমিদারি ব্যবস্থার কারণে। আধুনিক বাংলা গদ্য এই মধ্যবিত্তের হাতেই তৈরি। এরা সংস্কৃত জানতেন এবং ধর্মীয় কারণে সংস্কৃতের প্রতিই তাদের টানটা ছিল অধিক ও স্বাভাবিক। তাই তাদের হাতে যে গদ্য তৈরি হলো, তাতে আধিপত্য থাকল সংস্কৃতের। ফলে ভাষার মধ্যে একটা কৃত্রিমতা চলে এলো।
পরে মুসলিম মধ্যবিত্ত নিজেকে গড়ে তুলেছে। তারা এসে দেখে, তারা যে ধরনের ফার্সি-আরবি ও দেশীয় শব্দ ব্যবহার করতে অভ্যস্ত, বাংলা গদ্যে সেগুলোর স্থান হয় সংকুচিত নয়তো অবলুপ্ত। তাদের অভিমানে লাগল। তাদের একাংশ বাংলা ভাষাতে তথাকথিত মুসলমানি শব্দ কীভাবে প্রয়োগ করা যায়, সে ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে পড়ল।
এই উৎসাহ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে উৎকট আকার ধারণ করেছিল। তখন কেবল যে আরবি-ফার্সি শব্দ বাড়াবার চেষ্টা হয়েছে, তা নয়। আরবি হরফে বাংলা লেখার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথকে বাদ দেওয়া; নজরুলকে সংশোধন করার চেষ্টা যে হয়নি, তা-ও নয়। সর্বোপরি ছিল উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ভয়াবহ সিদ্ধান্ত। পূর্ববঙ্গ বিদ্রোহ করেছে, স্বভাবতই।
বিদ্রোহী পূর্ববঙ্গ শেষ পর্যন্ত স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু এখনকার অবস্থাটা কী? ভাষার কাছ থেকে কোন খবরটা পাওয়া যাচ্ছে? সাহিত্যকে আমরা দর্পণ বলি। বলি সমাজ ও সংস্কৃতির দর্পণ। কিন্তু ভাষার ব্যবহারেও ছবি পাওয়া যায় বৈ কি– সমাজ, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রের ছবি। বলা বাহুল্য, ওই ছবি তৃপ্তিকর নয়। ওখানে এমন খবর মোটেই পাওয়া যাচ্ছে না যে, আমরা প্রকৃত প্রস্তাবে স্বাধীন হয়েছি।
এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই– বাঙালি মধ্যবিত্তের কারণেই বাংলা ভাষার এতটা উন্নতি ঘটেছে। সাহিত্য, সাংবাদিকতা, ব্যবহারিক জীবন– সর্বত্র বাংলা ভাষা আজ ব্যবহৃত ও সমৃদ্ধ। আমাদের সাহিত্যের সাধারণ অর্জনও সামান্য না মোটেই। কিন্তু এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি এটা মনেপ্রাণে চায়নি যে, সাধারণ মানুষ শিক্ষিত হোক। সবাই যদি শিক্ষিত হয় তাহলে মধ্যবিত্তের অহংকারের জায়গাটা বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়বে। ভয় ছিল সেটাই, যদিও প্রকাশ্যে সে তা স্বীকার করেনি। এ দেশে শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল ব্যক্তিগত সমৃদ্ধি। সমষ্টিগত উন্নতিকে প্রধান বিবেচ্য করা হয়নি। হয়নি যে, তার কারণ ওই মধ্যবিত্ত শ্রেণিই।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির একাংশ উচ্চবিত্ত হয়ে গেছে। তারাই এখন দেশের শাসক। তারাই শাসন করে নানা নাম নিয়ে। এই শাসক শ্রেণি জনগণের সম্পদ ও অর্জনগুলোকে লুণ্ঠন করছে এবং তাদের যে রাজনীতি, সেটি ওই লুণ্ঠনের প্রতিযোগিতার বাইরে অন্য কিছু নয়। জনগণ থেকে এরা যে দূরবর্তী, তার নানা প্রাচীর, প্রকরণ ও চিহ্ন সাড়ম্বরে তুলে ধরে। এগুলোর মধ্যে ভাষাও একটি। এই ব্যাপারে আগেকার শাসকদের থেকে বর্তমান শাসকদের আচরণে কোনো পার্থক্য নেই। বিদেশি শাসকরা যেমন বাংলা ব্যবহার করত না; বাংলাদেশের শাসক শ্রেণিও পারলে সেই কাজই করে। অন্তত চেষ্টা যে করে, তা নিয়ে তো সন্দেহ করার সুযোগ নেই।
এই শ্রেণির সন্তানেরা ইংরেজির মাধ্যমে পড়াশোনা করে। অনেকেই বিদেশে চলে যায়। সম্পত্তিবানেরা সম্পত্তির প্রাচুর্যের অনুপাতে বিদেশ ভ্রমণ করে। পরিবারের একাংশ সেখানেই থাকে। দেশে যে থাকে তা অনেকটা বিদেশিদের মতোই। পণ্য, আসবাব, পোশাক-পরিচ্ছদ, জীবনযাত্রার ধরনে বাঙালিত্বের বড়ই অভাব। ওদের স্মার্টফোন, ই-মেইল, ইন্টারনেট, সিডি– সর্বত্র ইংরেজির একচেটিয়া রাজত্ব। সবচেয়ে উৎকট হচ্ছে মুখের ভাষা। বাংলা বলে ইংরেজি মিশিয়ে।
ওদিকে স্মার্টফোন, টেলিভিশনের কারণে বই পড়ার অভ্যাস কমছে। ওই অভ্যাস অবশ্য কখনোই উল্লেখযোগ্য ছিল না। অধিকাংশ বাঙালিই ছিল অক্ষরজ্ঞানবঞ্চিত। এখন শিক্ষিতের হার বেড়েছে, কিন্তু পাঠাভ্যাস সে তুলনায় বৃদ্ধি পায়নি। আমাদের সংস্কৃতিতে দেখতে পাই যে, পড়ালেখার তুলনায় স্মৃতি ও শ্রুতির ওপরই জোরটা ছিল বেশি।
আগের কালের মানুষ স্মৃতির ওপরই নির্ভর করতে চাইতেন। শোনা কথার জোর ছিল; যে কারণে গুজব ও পরনিন্দার চর্চা ছিল প্রায় সর্বজনীন। মুখস্থ বিদ্যা ছিল সর্বোচ্চ বিদ্যা। পরে ‘পড়ালেখার’ চল বেড়েছে। এখানেও দেখা যাচ্ছে, বাঙালি পড়েছে যত, লিখেছে সে তুলনায় অনেক কম। আমরা শুনেছি এমন গুরুজনীয় পরামর্শ– একবার লেখা দশবার পড়ার সমান। পরামর্শটা যে ভিত্তিহীন ছিল, তাও নয়। তবু লেখার ব্যাপারে বাঙালি তেমন এগোয়নি। তার জীবনে কাগজের ব্যবহার ছিল নগণ্য।
বাংলা ভাষা যে বাংলাদেশে ভালো অবস্থায় নেই, তার দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয়– বাংলাদেশ এখন প্রকৃত প্রস্তাবে স্বাধীন হয়নি। মুক্তির জন্য সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন দরকার হবে, যা সকল প্রকার বৈষম্যের অবসান ঘটাবে। এর জন্য প্রয়োজন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও পুঁজিবাদবিরোধী আন্দোলন। যে আন্দোলন সমাজকে মুক্ত করবে; মুক্ত করবে সমাজের মানুষকে। তখন আমরা স্বাভাবিক হবো।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়