এই প্রথম ফেসবুকের দিকে তাকিয়ে সরকার পরিচালনার সংস্কৃতি দেখলাম: আলতাফ পারভেজ
Published: 23rd, July 2025 GMT
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর গত এক বছরে ভালো অভিজ্ঞতা অল্প, খারাপ অভিজ্ঞতাই বেশি বলে মন্তব্য করেছেন লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ। তিনি বলেছেন, স্বল্প দক্ষ বা অনেকটাই অদক্ষ এমন একটা সরকারের অধীনে থাকার দুঃখ গত এক বছরে মোকাবিলা করতে হয়েছে।
আলতাফ পারভেজ বলেন, ‘এই প্রথম ফেসবুকের দিকে তাকিয়ে সরকার পরিচালনার একটা সংস্কৃতি দেখলাম এবং জনতুষ্টিবাদের কাছে বারবার আত্মসমর্পিত হতে দেখলাম। সমাজজুড়ে বিপজ্জনকভাবে সুনামির মতো একটা দক্ষিণপন্থী মনোভাবের বিস্তার ঘটেছে। ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে মব সহিংসতা বেড়েছে।’
আজ বুধবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে আলতাফ পারভেজ এ কথাগুলো বলেন। ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান: এক বছরের অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক এই গোলটেবিলের আয়োজক প্রথম আলো। গোলটেবিল বৈঠকের শুরুতে রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তে হতাহতের ঘটনায় শোক প্রকাশ করে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা হয়।
বৈঠকে আলতাফ পারভেজ গত এক বছরের কিছু ইতিবাচক দিকও তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, ‘তরুণ–তরুণীরা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি রাজনীতিমনস্ক হয়েছে। তাদের দিক থেকে দ্বিদলীয় ব্যবস্থার বাইরে রাজনৈতিক ধারা গড়ে উঠেছে, আরও গড়ে উঠবে। এগুলো একটা ভালো লক্ষণ। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের আলাপটা ৫০ বছর পর বাংলাদেশের মূল আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে রাজনীতির ক্ষেত্রে। এটা একটা ভালো দিক। তবে একধরনের ভীতির মধ্যে আছি আমরা লেখক–সাংবাদিকেরা। সেন্সরশিপ কমেছে, উঠে যায়নি। অবশ্য বড় প্রকল্পগুলা করে লুটপাটের যে ঘটনা ছিল বিগত সময়ে, সেটা কমেছে ধারণা করি। ব্যাংকগুলো রক্ষা পেয়েছে অনেকখানি। ভূরাজনীতিতে একদিকে হেলে পড়ার যে ব্যাপার ছিল, সেটা একটু কমেছে। যদিও এখন আবার অন্যদিকে হেলে পড়ার একটা ব্যাপার হয়েছে।’
কর্মসংস্থানমুখী আন্দোলনের ভেতর দিয়ে জুলাই অভ্যুত্থান হলেও গত এক বছরে কর্মসংস্থান বাড়েনি এবং প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগ কমেছে বলে মন্তব্য করেন আলতাফ পারভেজ। তিনি বলেন, অর্থনৈতিকভাবে বৈষম্য কমানোর কোনো উদ্যোগ পাওয়া যায়নি। বিদেশিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ক্ষেত্রে একটা গোপনীয়তার সংস্কৃতি দেখেছি।
চলমান সংস্কার কার্যক্রম প্রসঙ্গে এই গবেষক বলেন, ১১টি সংস্কার কমিশন হলো, টাস্কফোর্স হলো। কিন্তু ঐকমত্য কমিশন হলো মাত্র ছয়টি কমিশনের সুপারিশ নিয়ে। বাকি পাঁচটির সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত হলো না, তাদের কোনো সদস্যকেও ঐকমত্য কমিশনে যুক্ত করা হলো না। এমন কেন হলো, এটা একটা বড় প্রশ্ন। জুলাই অভ্যুত্থানের একটা বড় এজেন্ডা ছিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর যে দেবতাতুল্য ক্ষমতা, সেটাকে কমিয়ে এনে ভারসাম্যপূর্ণ করা। কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা কমাতে হলে তো স্থানীয় সরকারকে ক্ষমতায়ন করতে হবে। কিন্তু স্থানীয় সরকারের বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়টি কোনো আলোচনাতেই আসছে না।
গণ–অভ্যুত্থানের সরকারের পক্ষ থেকে গণ–অভ্যুত্থানের পুরো এজেন্সি বা প্রধান নকশাকার হিসেবে একজনকে তুলে ধরে অন্য এজেন্সিগুলোকে খাটো করা হয়েছে অভিযোগ করে আলতাফ পারভেজ বলেন, এর ফলে গণ–অভ্যুত্থানের এক বছর না পেরোতেই গত জুলাইয়ের ঐক্যটা আমরা আর এখন পাচ্ছি না। নাগরিক সমাজের যে অবশিষ্ট স্বাধীন কণ্ঠস্বরগুলো ছিল আওয়ামী আমলের শেষেও, তাঁদের বিভিন্ন সরকারি পদ–পদবি দিয়ে আটকে ফেলার কারণে নাগরিক সমাজটা দুর্বল হয়ে গেছে। অভ্যুত্থানের ভরকেন্দ্র থেকে নারীদের একদম সরিয়ে ফেলা হয়েছে। রীতিমতো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করে নারীদের যা যা বলা হয়েছে, আমি উচ্চারণ করতে চাই না। এটা গত এক বছরের একটা দুর্ভাগ্যজনক অভিজ্ঞতা।
ভবিষ্যতের বিপদ ও একটি ইতিবাচক দিক
প্রথম আলোর এই গোলটেবিল বৈঠকে আলতাফ পারভেজ ভবিষ্যতের বেশ কিছু বিপদের কথা উল্লেখ করে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে যেটা দেখতে পাচ্ছি, যেটাকে আমরা ২০২৪ সালে ফেলে এসেছি, সেই একই ধরনের রাষ্ট্র যেন আবার হাজির হচ্ছে। একই ধরনের সরকারব্যবস্থা বোধ হয় আমরা পেতে যাচ্ছি। এই মুহূর্তে সবচেয়ে উদ্বেগের ব্যাপার, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে জুলাই সনদ নিয়ে যে আলোচনা হচ্ছে, তার ভেতরের খবর যদি আমরা বিবেচনা করি, জুলাই সনদে উল্লেখযোগ্য তেমন মৌলিক কোনো রূপান্তরের আলাপ থাকছে না। যদি না থাকে এবং না থাকার পরও যদি একটা সনদ হয়, তার সাংবিধানিক কী স্ট্যাটাস হবে, সেটাও একটা উদ্বেগের ব্যাপার। যথেষ্ট সন্তোষজনক কিছু না থাকলে অনেকে জুলাই সনদ মেনে না–ও নিতে পারে এবং সে রকম অনেকে নির্বাচনে অংশ নিতে না–ও পারে। ফলে অভ্যুত্থানের পর একটা অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আমাদের ন্যূনতম যে চাওয়া, সেটাও যদি না হয়, তাহলে আমরা কী পেতে যাচ্ছি। ন্যূনতম একটা নির্বাচন যেন হয়, সবাই যেন অংশ নিতে পারে, সেই পরিবেশ যেন হয়, সেটায় জোর দেওয়া উচিত। এটা খুবই ন্যূনতম চাওয়া, বড়গুলো চাইতে এখন আর সাহস হচ্ছে না।
আগামী সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল না পাওয়ার বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে আলতাফ পারভেজ বলেন, বিরোধী দল দুর্বল হলে, ছোট হলেও কী হয়, অতীতে আমরা দেখেছি। সেটা আরেকটা ডিজাস্টার। সামনের আরেকটা ভীতির বিষয় হলো ডিজিটাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে রাজনীতিতে বড় আকারে ডানপন্থী শক্তির যে উত্থান ঘটছে, এটাকে কীভাবে সামাল দেওয়া যাবে, আমি জানি না। কারণ, এটা পদ্ধতিগতভাবে নানা মহল থেকে উসকানি এসেছে অতীতেও। গ্রামে-গঞ্জে বেনামি মামলার যে সুনামি বয়ে গেছে, সেটাও একটা বিপদের ব্যাপার। এ ছাড়া ট্রাম্পের শাসনামলে বর্তমান বিশ্বে সংরক্ষণবাদী জাতীয়তাবাদী অর্থনীতির যে উত্থান ঘটছে, সেখানে বাংলাদেশ একটা বিপদে পড়তে পারে।
তবে একটি ইতিবাচক দিকের কথাও আলোচনায় উল্লেখ করেন দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসবিষয়ক এই গবেষক। তিনি বলেন, ‘আগামীতে যদি আবারও অনাচার বা কোনো স্বৈরাচার জেঁকে বসতে চায়, তারা প্রবল প্রতিবাদের মুখে পড়বে। এই ব্যাপারে বাংলাদেশের তরুণদের মনোজগতে একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে। তারা কোনো এজেন্সি, কোনো বাহিনী, প্রশাসন বা গোলাগুলিকে আর ভয় করে না।’
প্রথম আলোর এই গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেন লেখক ও চিন্তক ফরহাদ মজহার, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান, গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন, অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস, নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমন, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান, লেখক ও গবেষক মাহা মীর্জা, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের গবেষণাবিশেষজ্ঞ সহুল আহমদ প্রমুখ।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রথম আল সরক র র র জন ত র একট
এছাড়াও পড়ুন:
খাগড়াছড়িতে সাংবাদিক মিলন ত্রিপুরার ওপর হামলার অভিযোগ তদন্তের আহ্বান সিপিজের
খাগড়াছড়িতে সাংবাদিক মিলন ত্রিপুরার ওপর হামলার অভিযোগ তদন্ত করতে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার বৈশ্বিক সংগঠন কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)। দোষীদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে বলে উল্লেখ করেছে সংগঠনটি।
মঙ্গলবার সিপিজের এক টুইটে এ আহ্বান জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ডিবিসি নিউজের প্রতিনিধি মিলন ত্রিপুরা ১৭ জুলাই একটি বিক্ষোভের সংবাদ সংগ্রহ করছিলেন। এ সময় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে মারধর করেন ও ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ মুছে ফেলতে বাধ্য করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।