ডিএনএ ফলাফলের অপেক্ষায় রাইসার মা–বাবা
Published: 24th, July 2025 GMT
রাইসা মণি মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের স্কাই (আকাশ) সেকশনে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ত। গত সোমবার দুপুরে এ স্কুলেরই একটি ভবনে বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় রাইসাকে খুঁজে পাচ্ছিল না পরিবার। পরদিন ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) মর্গে পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া একটি মরদেহ দেখে রাইসার মা–বাবা ধারণা করলেন, এটাই তাঁদের মেয়ে। কিন্তু আরেকটি পরিবারও লাশটি নিজেদের সন্তান বলে দাবি করছে। এখন লাশ শনাক্তের আইনি প্রক্রিয়া ডিএনএ টেস্টের ফলাফলের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে পরিবার দুটিকে।
লাশটি যদি আসলেই রাইসার হয়, তাহলে কখন একটু স্পর্শ করতে পারবেন, আদর করতে পারবেন, দাফন করতে পারবেন—তা নিয়ে অস্থিরতায় দিন পার করছেন বাবা মোহাম্মদ শাহাবুল, মা মিসেস মিম, বড় বোন সিনথিয়া। ছোট ভাই রাফসানের অবশ্য এত কিছু বোঝার বয়স হয়নি। সে বোনকে নাম ধরেই ডাকত। একটু পরপর রাইসা আসছে না কেন, প্রশ্ন করে।
রাইসার মা বললেন, ‘সবাই দোয়া করেন, আমার পাখিকে যেন ফিরে পাই। ডিএনএ স্যাম্পল যাতে আমাদের সঙ্গে মিলে যায়।’
লাশটি যদি আসলেই রাইসার হয়, তাহলে কখন একটু স্পর্শ করতে পারবেন, আদর করতে পারবেন, দাফন করতে পারবেন—তা নিয়ে অস্থিরতায় দিন পার করছেন বাবা মোহাম্মদ শাহাবুল, মা মিসেস মিম, বড় বোন সিনথিয়া।তুরাগ থানার অধীনে নয়ানগর মসজিদ মার্কেট, তিন রাস্তার মোড়ে শাহাবুল পরিবার নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন। গতকাল বুধবার দুপুরে ভ্যাপসা গরমে ঘেমে শাহাবুল বাইরে থেকে ঘরে ফিরলেন। কোনো এক আত্মীয় এক গ্লাস পানি এনে দিলেন। ওই বাসায় প্রতিবেদকের উপস্থিতিতে বিছানায় বসে শাহাবুল চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন, ‘আমার মেয়েটা থাকলে ঠিকই প্রথমে জড়িয়ে ধরত। পরে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এনে দিত। তাকে বলতে হতো না।’ এ কথা শুনে ওই আত্মীয় দ্রুত ঠান্ডা পানি এনে দিলেন শাহাবুলকে।
মঙ্গলবার রাতে শাহাবুল এবং তাঁর স্ত্রীর রক্ত নেওয়া হয়েছে ডিএনএ টেস্টের জন্য। কিন্তু এখন তো আর সময় পার হচ্ছে না। একবার মর্গে যান, একবার থানায় যান—যাতে দ্রুত মেয়ের লাশ বাসায় আনতে পারেন।
রাইসার মা সিএমএইচের মর্গে লাশটি দেখেননি। বাবাকে শুধু লাশটি দেখানো হয়েছে। মায়ের দাবি, এটি তাঁরই মেয়ে। মেয়ের ডান কানটা অন্যদের চেয়ে একটু স্পেশাল বা বিশেষ ছিল। অন্যরকম খাঁড়া ছিল। লাশটি কালো হয়ে গেলেও কান, মুখের আদল কেমন যেন চেনাচেনা লাগছে মায়ের কাছে। বললেন, ‘আমি তো মা। মেয়েকে গোসল করিয়ে দিতাম। শরীর মুছে দিতাম। মুখে ভাত তুলে খাইয়ে দিতাম। আমি আমার মেয়েকে চিনব না? কিন্তু আমাকে তো দেখতেই দিল না। মোবাইলে লাশের ছবি দেখেছি শুধু।’
মঙ্গলবার রাতে শাহাবুল এবং তাঁর স্ত্রীর রক্ত নেওয়া হয়েছে ডিএনএ টেস্টের জন্য। কিন্তু এখন তো আর সময় পার হচ্ছে না। একবার মর্গে যান, একবার থানায় যান—যাতে দ্রুত মেয়ের লাশ বাসায় আনতে পারেন।রাইসার বাবা শাহাবুল বললেন, ‘আগে তো লাশ খুঁজিনি। কোনো মা–বাবা কি সন্তানের লাশ খুঁজে? মেয়ে বেঁচে আছে ভেবে স্কুলে খুঁজেছি। সব হাসপাতাল চষে বেড়িয়েছি। যে যেখানে যেতে বলেছে গিয়েছি। একজন জানায়, সিএমএইচের মর্গে সাতটি লাশ এবং আরও কিছু লাশের খণ্ডিত অংশ আছে। একটি লাশ দেখে মনে হয়েছে এটিই আমার রাইসা। কিন্তু আরেক বাবা ও মা যেহেতু মনে করছেন, এটি তাঁদের মেয়ে হতে পারে, তাই আমরাও ডিএনএ টেস্টের ফলাফলের অপেক্ষা করছি। আমরা যেমন বাবা-মা, তাঁরাও তো বাবা-মা।’
শাহাবুল ব্যবসা করেন। তাঁর বড় মেয়ে সিনথিয়াও মাইলস্টোন স্কুলে পড়ে, অষ্টম শ্রেণিতে। ছোট ছেলে এখনো স্কুলে ভর্তি হয়নি।
স্কুলের হায়দার আলী ভবনে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। এ ভবনেই রাইসার ক্লাসরুম ছিল। ঘটনার ঠিক আগে রাইসা চার বন্ধু মিলে ক্লাস রুমের একদম শেষ বেঞ্চে বসে টিফিন খাচ্ছিল বলে একজন শিক্ষক দেখেছেন।
আমি তো মা। মেয়েকে গোসল করিয়ে দিতাম। শরীর মুছে দিতাম। মুখে ভাত তুলে খাইয়ে দিতাম। আমি আমার মেয়েকে চিনব না? কিন্তু আমাকে তো দেখতেই দিল না। মোবাইলে লাশের ছবি দেখেছি শুধু।রাইসার মাবড় বোন সিনথিয়ার ক্লাস হায়দার আলী ভবন থেকে একটু দূরে। কয়েক দিন ধরেই রাইসা বড় বোনের কাছে বাজারে আসা নতুন আইসক্রিম খাওয়ানোর জন্য বায়না করছিল। সোমবার স্কুলে যাওয়ার সময় সে কথা মনেও করিয়ে দিয়েছে। সিনথিয়া ভেবেছিল, বোনের স্কুল ছুটির পর টিফিনের বিরতিতে সেই আইসক্রিমটি কিনে দেবে। কিন্তু তার তো আর সময় পেল না।
একটি লাশ দেখে মনে হয়েছে এটিই আমার রাইসা। কিন্তু আরেক বাবা ও মা যেহেতু মনে করছেন, এটি তাঁদের মেয়ে হতে পারে, তাই আমরাও ডিএনএ টেস্টের ফলাফলের অপেক্ষা করছি। আমরা যেমন বাবা-মা, তাঁরাও তো বাবা-মা।রাইসার বাবা শাহাবুলসকালে গরম ভাত খাইয়ে মেয়েদের স্কুলে পাঠাতেন রাইসা ও সিনথিয়ার মা। সেদিন রুই মাছের কাটা বেছে রাইসাকে ভাত খাইয়ে দিয়েছিলেন। সকাল সাড়ে ১০টায় টিফিনের জন্য বনরুটি আর কোচিং ছিল বলে দুপুরের খাওয়ার জন্য মুরগির মাংস দিয়েছিলেন। মেয়েটা মুরগি দিয়ে পুরো ভাত খেতে পেরেছিল কি না, তা তো জানেন না মা। কোচিংয়ে না দিলে মেয়ে হয়তো স্কুল ছুটির পরই বাসায় চলে আসত—এ আক্ষেপ করলেন মা।
গত সোমবার বেলা একটায় স্কুল ছুটির পরপরই বোন সিনথিয়া প্রচণ্ড শব্দ শুনতে পায়। এরপর আগুন আর ধোঁয়া। বোনের কাছে যেতে চাইলেও সেনাসদস্যসহ উদ্ধারকর্মীরা তাকে সেখানে যেতে দেয়নি। সিনথিয়া দ্রুত বাসায় গিয়ে মা–বাবাকে ঘটনার কথা জানায়। এর আগেই এক আত্মীয়ের ফোনে ঘটনার কথা জেনেছেন তাঁরা।
সকালে গরম ভাত খাইয়ে মেয়েদের স্কুলে পাঠাতেন রাইসা ও সিনথিয়ার মা। সেদিন রুই মাছের কাটা বেছে রাইসাকে ভাত খাইয়ে দিয়েছিলেন। সকাল সাড়ে ১০টায় টিফিনের জন্য বনরুটি আর কোচিং ছিল বলে দুপুরের খাওয়ার জন্য মুরগির মাংস দিয়েছিলেন। মেয়েটা মুরগি দিয়ে পুরো ভাত খেতে পেরেছিল কি না, তা তো জানেন না মা।ছোট রাইসা বাসার সবাইকে আনন্দে মাতিয়ে রাখত বলে জানালেন মা। মেয়ের কত স্মৃতি যে মনে হচ্ছে। সোমবার মেয়েটা স্কুলে যাওয়ার আগে মোজা পরার সময় বেশ কয়েকবার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়েছিল। তখন তো বুঝতে পারেননি মেয়ে শেষবারের মতো মাকে দেখছে।
বাবাও ভুলতে পারছেন না তাঁর পাখিটার কথা। সেদিন রাইসা বাবার সঙ্গে স্কুলে গিয়েছিল। রাতে দুই মেয়েকে ভাত মেখে খাইয়ে দিতেন বাবা। আর ঘরে ফিরতে যত রাতই হোক, রাইসা ঠিকই বাবার অপেক্ষায় জেগে বসে থাকত। মেয়েকে নাম ধরে ডাকতেন না, মা বলে ডাকতেন। মেয়ে গোলাপি রং পছন্দ করত বলে ঈদে গোলাপি জামা কিনে দিতেন। নতুন ফ্ল্যাটে এখনো থাকা শুরু না করলেও মেয়ের পছন্দেই ঘরে গোলাপি রঙের টাইলস লাগিয়েছেন।
শাহাবুল বললেন, ‘মেয়ে জীবিত, সে আশা ছাইড়া দিছি। এখন শুধু মেয়ের লাশটা চাই।’
গোলাপি ব্যান্ড দিয়ে চুলে দুটি ঝুঁটি করা, গোলাপি জামা ও জুতা পায়ে দিয়ে একটি ছোট মেয়ের ছবি এঁকে ছবির নিচে ইংরেজিতে লেখা ‘রাইসা’। শেষ স্কুলে যাওয়ার দুই দিন আগে রাইসা এঁকেছিল ছবিটি। সেই আঁকা ছবিতে বড় বোন সিনথিয়া লিখেছে, বোন, প্লিজ তুই আয়। ঘরের দেয়ালে রাইসার বিভিন্ন আঁকাআঁকি চোখে পড়ছে। লাল রঙের একটি খেলনা গাড়ি দিয়ে খেলত। পড়ার টেবিলে কয়েকটি বই, খাতা সেভাবেই পড়ে আছে। ড্রয়ারে রঙিন ফ্রকগুলোও উঁকি দিচ্ছে। শুধু রাইসা নেই কোথাও।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ড এনএ ট স ট র ফল ফল র পর ব র প রব ন স মব র র জন য একব র করছ ন র সময় বলল ন
এছাড়াও পড়ুন:
খাগড়াছড়িতে সাংবাদিক মিলন ত্রিপুরার ওপর হামলার অভিযোগ তদন্তের আহ্বান সিপিজের
খাগড়াছড়িতে সাংবাদিক মিলন ত্রিপুরার ওপর হামলার অভিযোগ তদন্ত করতে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার বৈশ্বিক সংগঠন কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)। দোষীদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে বলে উল্লেখ করেছে সংগঠনটি।
মঙ্গলবার সিপিজের এক টুইটে এ আহ্বান জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ডিবিসি নিউজের প্রতিনিধি মিলন ত্রিপুরা ১৭ জুলাই একটি বিক্ষোভের সংবাদ সংগ্রহ করছিলেন। এ সময় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে মারধর করেন ও ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ মুছে ফেলতে বাধ্য করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।