শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে ৬৫ জন চিকিৎসকের নিয়োগ বাতিল করার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। কমিটি বলছে, বিধি না মেনেই মেডিকেল অফিসার পদে তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এই নিয়োগে মেধা যাচাই করা হয়নি। তা ছাড়া জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক নিয়োগের মতো কোনো পরিস্থিতিও হাসপাতালে সৃষ্টি হয়নি।

শিশু হাসপাতালে ৬৫ জন চিকিৎসক নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে গঠিত কমিটি সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ৬ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে নিয়োগের ক্ষেত্রে বেশ কিছু অনিয়ম ও অসংগতি তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি এই নিয়োগ বাতিলসহ বেশ কিছু সুপারিশও কমিটির সদস্যরা করেছেন। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কী সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তা এখনো জানা যায়নি।

গত মাসের শেষ সপ্তাহে শিশু হাসপাতালে ৬৫ জন চিকিৎসককে জরুরি ভিত্তিতে ছয় মাসের জন্য অ্যাডহক নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগের আগে সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমে কোনো বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেনি কর্তৃপক্ষ। তবে হাসপাতালের নোটিশ বোর্ডে একটি বিজ্ঞপ্তি টাঙানো হয়েছিল। চাকরির জন্য এই হাসপাতালের বাইরের কোনো চিকিৎসক আবেদন করেননি। নিয়োগের আগে লিখিত বা মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়নি।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ২ জুলাই শিশু হাসপাতালের পরিচালককে চিঠি দিয়ে জানতে চায়, অ্যাডহক পদে নিয়োগের জন্য দরখাস্ত আহ্বানসহ যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছিল কি না। ৭ জুলাই মন্ত্রণালয়কে দেওয়া চিঠিতে পরিচালক বলেন, পরিচালনা বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এবং হাসপাতালের চাকরি ও নিয়োগবিধি অনুসরণ করে চিকিৎসকদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এরপর ১০ জুলাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠন করে। তিন সদস্যের কমিটির আহ্বায়ক করা হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সেবা বিভাগের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন অধিশাখা) খন্দকার মোহাম্মদ আলীকে। কমিটির সদস্যসচিবের দায়িত্বে ছিলেন যুগ্ম সচিব (শৃঙ্খলা শাখা) শব্বির ইকবাল এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন।

তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেব। আপাতত এর বেশি কিছু বলতে পারছি না।’

কী কী অনিয়ম হয়েছে

তদন্ত কমিটি হাসপাতাল পরিদর্শন করে এবং হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক মো.

মাহবুবুল হক, চাকরি পাওয়া ১৪ জন চিকিৎসক, বঞ্চিত চারজন চিকিৎসক, পরিচালনা বোর্ডের দুজন সদস্যের বক্তব্য নেয়। এ ছাড়া তাঁরা সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র, আইন, বিধি পর্যালোচনা করেন।

তদন্ত কমিটি বলেছে, শিশু হাসপাতালে ৬৫ জন আবাসিক মেডিকেল অফিসার নিয়োগ বিধিসম্মত হয়নি। নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা ও মেধা যাচাই হয়নি। এ ছাড়া অ্যাডহক ভিত্তিতে চিকিৎসক নিয়োগের এমন কোনো জরুরি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি।

তদন্ত কমিটি বলেছে, দ্রুততার সঙ্গে নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে, যা নিয়োগপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ২৮ মে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়ে ৩০ জুন নিয়োগপ্রক্রিয়া শেষ করা হয়।

নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে যোগসাজশে। জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এ ধরনের নিয়োগ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি

গুরুতর অনিয়ম আরও আছে। নোটিশ বোর্ডে ৪২ জন মেডিকেল অফিসার নিয়োগ করা হবে—এমন বিজ্ঞপ্তি টাঙানো হয়েছিল। কিন্তু নিয়োগ দেওয়া হয় ৬৫ জনকে। ২৩ জন নিয়োগে গুরুতর অনিয়ম হয়েছে বলে তদন্ত কমিটি মতামত দিয়েছে।

তদন্ত কমিটি সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছে, এই নিয়োগ আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। কারণ হিসেবে কমিটি বলেছে, আবেদনপত্র গ্রহণের কোনো রেজিস্ট্রি সংরক্ষণ করা হয়নি। কার পরে কে আবেদন করেছেন, তেমন কোনো ক্রম বা সিরিয়াল অনুসরণ করা হয়নি। আবেদনকারীকে কোনো ধরনের প্রাপ্তি স্বীকারপত্রও দেওয়া হয়নি। কর্তৃপক্ষ আবেদনপত্রে সই করেছে ঠিকই, কিন্তু কোন তারিখে সই করা হয়েছে, তার উল্লেখ নেই।

এখন কী করণীয়

তদন্ত কমিটি সুপারিশের শুরুতেই বলেছে, ৬৫ জন মেডিকেল অফিসার নিয়োগ বাতিল করতে হবে। বাতিল করার পর গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি অনুসরণ

করে নিয়োগ কমিটি গঠন করতে হবে এবং নিয়োগের ব্যাপারে জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হবে।

তদন্ত কমিটি বলেছে, অবিলম্বে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট আইন, ২০২১-এর প্রবিধান তৈরি করতে হবে। এই প্রবিধান তৈরি হওয়ার আগপর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের নিয়োগসহ গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়ে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমোদন নিতে হবে। এ ছাড়া শিশু হাসপাতালের কার্যক্রম নজরদারি করতে হবে।

শিশু হাসপাতালসহ দেশের বহু হাসপাতালে দুর্নীতি-অনিয়মের ঘটনা নতুন নয়। এত বিপুলসংখ্যক চিকিৎসককে এর আগে এমন ঢালাওভাবে নিয়োগ দেওয়ার নজির বিরল।

দুর্নীতি প্রতিরোধবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে যোগসাজশে। এর সঙ্গে জড়িত সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। নির্বাচিত বা অন্তর্বর্তী কোনো সরকারের আমলে এ ধরনের নিয়োগ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম ড ক ল অফ স র জন চ ক ৎসক ন চ ক ৎসক প রক র য় ব ত ল কর কম ট র সদস য

এছাড়াও পড়ুন:

কমিশনের ‘অগ্রহণযোগ্য’ সুপারিশ জাতিকে বিভক্ত করবে: মির্জা ফখরুল

সনদ বাস্তবায়নে ঐক্যমত কমিশনের সুপারিশ ‘অগ্রহণযোগ্য’ উল্লেখ করে এই সুপারিশ জাতিকে বিভক্ত করবে, ঐক্যের বদলে অনৈক্য সৃষ্টি করবে বলে হুঁশিয়ার করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই অবস্থান তুলে ধরেন তিনি।

মির্জা ফখরুল বলেন, “জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি দেওয়ার জন্য জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন তাদের সুপারিশ সরকারের কাছে পেশ করেছে। সেখানে যে সকল বিষয়ে ভিন্নমত বা নোট ডিসেন্টসহ ঐকমত্য হয়েছে, তার উল্লেখ না রেখে দীর্ঘ আলোচনায় যেসব প্রসঙ্গ আলোচনা আসেনি, তা অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের অন্য সকল সুপারিশ অগ্রহণযোগ্য বিধায় আমরা একমত হতে পারছি না।’’

“আমরা অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ্য করেছি যে, এই সকল সুপারিশ কেবল জাতিকে বিভক্ত করবে, ঐক্যের বদলে অনৈক্য সৃষ্টি করবে।’’

মনগড়া যে কোনো সংস্কার প্রস্তাব গ্রহণ করলে জাতীয় জীবনে দীর্ঘ মেয়াদে অকল্যাণ ডেকে নিয়ে আসতে পারে বলেও এ সময় হুঁশিয়ার করে দেন মীর্জা ফখরুল।

নির্বাচনের আগে গণভোট অপ্রয়োজনীয় ও অযৌক্তিক :

জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবিকে অপ্রয়োজনীয় ও অযৌক্তিক আখ্যা দিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা… সেক্ষেত্রে (সংসদ) নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে প্রস্তাবিত গণভোট অনুষ্ঠান সম্ভব নয়।’’

তিনি বলেন, ‘‘সময় স্বল্পতা, নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিপুল অঙ্কের ব্যয় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ ব্যাপক লোকবল নিয়োগ এবং একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মত বিশাল আয়োজনের বিবেচনায় নির্বাচনের আগে গণভোট অনুষ্ঠান অপ্রয়োজনীয়, অযৌক্তিক এবং অবিবেচনাপ্রসূত। একই আয়োজনে এবং একই ব্যয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট অনুষ্ঠান করা বাঞ্ছনীয়।’’

‘‘আমরা আশা করি, জাতির প্রত্যাশা পূরণ এবং দীর্ঘ ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও ২০২৪ সালে ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের সকল শহীদদের রক্তের অঙ্গীকার অনুযায়ী এবং যারা দীর্ঘ এই সংগ্রামে ফ্যাসিবাদী শাসন আমলে গুম, খুন, অপহরণ, নির্যাতন, মামলা, হামলার শিকার হয়েছেন, তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পুনর্গঠন করতে পারব। প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা,’’ বলেন বিএনপির এই শীর্ষনেতা।

জাতীয় ঐক্য বজায় রাখা সকলের কাম্য জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে জাতির অভিপ্রায় অনুযায়ী সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠিত বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানতম লক্ষ্য হবে একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা। জাতীয় সংসদকে প্রকৃত অর্থে জাতীয় জীবনের সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে পরিণত করা।’’

“আমরা আন্তরিকভাবেই চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ার সাফল্য কামনা করি। কিন্তু একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে দেশ ও জনগণের প্রকৃত কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমাদের অবস্থান প্রকাশে আমরা দায়বদ্ধ,’’ যোগ করেন মির্জা ফখরুল।  

উল্লেখ্য জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়ন বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশমালা গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করা হয়। সাংবিধানিক আদেশ জারি করে গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে সেখানে।

সুপারিশে বলা হয়েছে, ওই আদেশ জারির পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যথোপযুক্ত সময়ে অথবা নির্বাচনের দিন গণভোট হবে। তবে কখন সেই ভোট হবে তা নিয়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির প্রবল মতবিরোধ রয়েছে।

ঢাকা/নঈমুদ্দীন/তারা  

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কমিশনের ‘অগ্রহণযোগ্য’ সুপারিশ জাতিকে বিভক্ত করবে: মির্জা ফখরুল