মালয়েশিয়ার সুন্দরতম দ্বীপ লানকাউই। এই দ্বীপে ৯৯টি ছোট ছোট দ্বীপ রয়েছে। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে এখানে মানুষ বেড়াতে আসে। তবে এখন এই সময়ে অর্থাৎ অক্টোবরের ১২তারিখ আমরাও উপস্থিত হয়েছি বিশ্বের খুব নামকরা রেইসগুলির মধ্যে অন্যতম আয়রনম্যানের ইভেন্টে অংশগ্রহণ করবো বলে। এটি মূলত ট্রাইয়াথলন ইভেন্ট। এই রেইসে রয়েছে সাঁতার ১.

৯ কিমি, সাইকেলিং ৯০ কিমি, এরপর দৌড় ২১ কিমি। সব কিছু একের পর এক করতে হবে সাড়ে আট ঘণ্টার মধ্যে। 

বিশ্বের নানা প্রান্তের এথলেটদের সঙ্গে এবার বাংলাদেশ থেকেও অংশগ্রহণ করেছেন ১৪ জন। সাইকেল যেহেতু বাংলাদেশ থেকে আমার সঙ্গে যাচ্ছে সুতরাং লম্বা দূরত্বে সাইকেল চালিয়ে নতুন এক দেশকে কেন ঘুরে দেখবো না? নতুনকে দেখার লোভ সামলানো আমার মতো ভবঘুরের জন্য বড় কঠিন। তাই আয়রনম্যানের প্রস্তুতির সাথে সাথে এই লম্বা সাইকেল রাইডের জন্যও প্রস্তুতি চলতে থাকলো। মুনতাসীর মামুনের সঙ্গে আমার পরিকল্পনা শেয়ার করলাম। সে এবং চঞ্চল মিলে লানকাউইতে ১৪ তারিখ আসবে বলে ঠিক হলো। আমার রেস তখন শেষ হয়ে যাবে। ১৫ অক্টোবর আমরা রাইড শুরু করবো।

আয়রনম্যানের রেইস খুব ভালোভাবেই শেষ হলো। তবে রেইসের আগের দিন আমার ফোন হারিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম। চেনাং ভিউ হোটেলে আমরা উঠেছিলাম, মুনতাসীর ভাইয়েরও এই হোটেলে বুকিং দেওয়ার জন্য বলে রেখেছিলাম। সময় মিলিয়ে এয়ারপোর্টে চলে এলাম। মুনতাসীর আর চঞ্চলকে রিসিভ করে হোটেলে এসে সাইকেলগুলো রেডি করে ফেললাম।

পরদিন সকাল ৬টার দিকে আমরা তিনজন রওনা দিলাম। আলো ফুটতে তখনো ঘণ্টাখানেক বাকি। দ্বীপ পার হতে আমাদের ফেরির কাছে যেতে হবে। চেনাং ভিউ হোটেল থেকে প্রায় ২০ কিমির মতো পাহাড়ি উঁচুনিচু রাস্তা। পথে অনেক বানর আমাদের স্বাগত জানিয়েছে। সবুজের আধিক্য অনেক। তবে আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ। মাঝে মাঝে বৃষ্টিও চলে এলো বলে। সাড়ে ১১টা নাগাদ চলে এলাম ফেরির কাছে। কাউন্টারে খোঁজ খবর নিয়ে জানলাম ‘কুয়ালা কেদা’ এবং ‘কুয়ালা পেরলিস’ এই দুই জায়গায় যাওয়া যাবে। কুয়ালা কেদাতে গেলে সময় লাগবে আড়াই ঘণ্টা এবং এজন্য অনেক আগে থেকে বুকিং দিতে হবে। এ ছাড়াও কুয়ালালামপুর যাবার রাস্তার দূরত্ব অনেকটাই কমে যাবে। আর কুয়ালা পেরলিস যেতে লাগবে এক ঘণ্টা, টিকিট আছে আর ১৫মিনিট পরেই। বেশি কিছু না ভেবে আমরা কুয়ালা পেরলিসের টিকিট কেটে নিলাম। 

তবে ১৫ মিনিট যে ফেরিতে ওঠার জন্য এতো কম সময় তা জানা ছিল না। ফেরিতে ওঠা মানে বিমানে ওঠার মতো অবস্থা। এর মধ্যে আমাদের সাইকেল চালিয়ে নিয়ে যেতে দেবে না কোনোভাবেই। একটা চাকা হলেও খুলতে হবে। ট্রলি যোগাড় করো, সাইকেল খোলো। সেই তাড়াহুড়ো লেগে গেলো সব কিছু মিলিয়ে। ফেরির কাছে কাউন্টার থেকে সাইকেলের জন্য আবার আলাদা টিকিটও কাটতে হবে। এদিকে টাইম হয়ে গেছে, ফেরি আমাদের রেখে ছেড়ে দিলে টিকিটের টাকা গচ্চা যাবে।  একেকজন ২৭ রিংগিত। আর সাইকেল প্রতি নিলো ২৫ রিংগিত করে। 

এই ফেরিতে আমরাই শেষ যাত্রী ছিলাম। ফেরির একদম শেষ অংশে সাইকেলগুলো চেংদোলা করে তোলা হলো। জানা ছিল ফেরিতে যে কোন যানবাহন নিয়ে ওঠা যায়, হোক না সেটা কার, বাস, মোটরসাইকেল বা আমাদের মতো সাইকেল। তবে এই ফেরি ঠিক সেরকম নয়। যাত্রীবাহী ফেরি। তাই এত কান্ড করতে হলো। অন্য কোম্পানির ফেরি হয়তো ছিলো আমরা খুঁজে পাইনি। পুরোটা এসি কম্পার্টমেন্ট। তবে আমাদের সাইকেলগুলো রাখা হলো পেছনের খোলা জায়গায়। যাত্রীদের সেখানে যাওয়া মানা। ব্যাগপত্তর ভেতরে নিয়ে এলাম। 
বাইরের দৃশ্য বেশ মনোরম। জল কেটে জাহাজ এগিয়ে যাচ্ছে। চারপাশে যত দূর দৃষ্টি যায়, দেখা যাচ্ছে সব। আকাশের দিকে তরতরিয়ে ওঠা পাহাড়, নাবিকদের পথ দেখানোর জন্য পুরনো একটা বাতিঘর, দূরের একাকী সাদা বালির সৈকত আর হিমশীতল জলরাশি- এই হচ্ছে পরিবেশ। 

ফেরি পার হয়ে প্রথম কাজ হচ্ছে সাইকেল ফিক্স করা।  পেছনের চাকা ফিট করতে গিয়ে ব্রেক প্যাডের একটা রাবার খুলে গেলো। ঠিকঠাক লাগাতে পারবো না বলে সেই একপাশ ফাঁকা রেখেই শুধু সামনের ব্রেকের উপর ভরসা করে পুরা রাস্তা চালিয়ে গেলাম। মজার কথা হলো ঢাকা এসে এটা ঠিক করতে গিয়ে দেখি এতই সহজ যে, তখন খুলে দেখলেই ঠিক করে নিতে পারতাম। হাসি পেলো ভেবে। 

সাইকেল ফিক্স করে ব্যাগপত্তর ঠিকমত লাগিয়ে রওনা দিলাম ‘কে সাংলাং’র পথে। ১৫২ নাম্বার রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে হবে কুয়ালালামপুরের দিকে। বড় বড় করে ‘কুয়ালা পেরলিস’ লিখা অক্ষরগুলো শহরে ঢোকার মুখে ছবি তোলার জন্য বানিয়ে রাখা আছে। আমি আর চঞ্চল সেখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। কিছু দূর গিয়ে সকালের নাস্তার বিরতি দিলাম। সকালে সাইকেল চালানো শুরু করলে নাস্তাটা জরুরি। যেহেতু ২০ কিমি চালিয়ে ফেলেছি তাই ক্ষুধাও জেঁকে বসেছে। ‘নাসি গোরেং আয়াম’ মালয়েশিয়াতে বেশ জনপ্রিয় খাবার। চিকেন ফ্রাইড রাইস বা সাদা ভাত এবং ভাজা মুরগির মাংস। খেতে বেশ উপাদেয়। অর্ডার করলাম। আরেকটা হেলদি সুপ আছে ‘কয়েটাও সুপ’। ফিস বল দেয়, মুরগির মাংস, আবার ওপরে ডিম পোচও দেয়, সঙ্গে মিক্সড সবজি। এই সুপও অর্ডার করা হলো। এবং পরের দিনগুলোতেও আমরা খুঁজে খুঁজে এই সুপ খেয়েছি। 

এর মধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। অপেক্ষার পালা শেষ হলে সাইকেলে চেপে বসলাম। কিছুদূর যাবার পরে আকিকের সঙ্গে দেখা। সেও আজকে রওনা হয়েছে লানকাউই থেকে। তবে সে কুয়ালালামপুর থেকে আরো দূরে ‘জহর বাহরু’’ পর্যন্ত চালিয়ে যাবে। আমরা যাবো খুব ধীর লয়ে। তাও আকিক চাইলো আমাদের সাথে দুইদিন কাটিয়ে তারপর এগিয়ে যাবে। সমুদ্রের পাড় ধরে রাস্তায় আমরা চালানো শুরু করলাম। আবারো বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। একটা খালি দোকানের নিচে আশ্রয় নিলাম। এ দেশে বৃষ্টি বাদলের ঠিকঠিকানা নেই। যখন-তখন শুরু হয়ে যায়। আজকে বেশি দূর যাবার পরিকল্পনাও নেই। আয়রনম্যান দিয়ে আমিও তাদের সঙ্গে রিলাক্স মুডে চালাচ্ছি। তবে লম্বা সাইকেল রাইডের শুরুর দিনগুলো একটু কষ্টের যায়। পরে শরীর আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে যায়। মুনতাসীর আর চঞ্চলের জন্য প্রথম দিনটা তাই একটু সহ্য করতে হবে।

বিকাল হলে আমরা হোম স্টে খোঁজা শুরু করলাম। কিন্তু গুগলে যে বা যারা হোম স্টে দিয়ে রেখেছে আদতে তারা সেখানে নেই। দু’এক জায়গায় যাও পেলাম বেশি রিংগিত হাঁকাচ্ছে। এগিয়ে যাবার পরে খুব সুন্দর একটা কাঠের কটেজ পেলাম। মালিক নেই, প্রতিবেশী আছে। ফোনে কথা বলে দামদস্তুর হলো ১০০ রিংগিতে থাকা যাবে। বুঝিয়ে বললাম, রাতটা থেকে ভোরবেলাতেই বেরিয়ে পড়বো। তাই হয়তো তারা রাজি হলো। এই কটেজে আবার এসিও আছে, এবং খুব সুন্দর একটা এটাচড রান্নাঘর আছে। তাতে সব কিছু সাজানো- রান্নার তৈজসপত্র, চা, চিনি, মসলা। মনে হয় তারা জানে আমরা আসবো আজ রাতে। সব কিছু যেহেতু রেডি এবং হাতের কাছে তাহলে রান্নাই হোক আজকে নিজেদের মতো করে। মুনতাসীর ভাই আবার ঘরের খাবারের বেশি তৃপ্তি পায়। ভাত রান্না হলো আর, ডিম ভুজিয়া। পাকড়া নিয়ে এলাম দোকান থেকে। কাঠের ঘরে ভরপেট খেয়ে বিছানায় গেলাম। ভোরে উঠেই আবার প্যডেলে পা দিতে হবে। যাত্রা সবে শুরু হলো। আজকে ৩০ কিলোমিটার পথ এলাম। আরো ৫২০ কিলোমিটার পথ চালাতে হবে কুয়ালালামপুরের পথে। (চলবে)  
 

তারা//

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর আয়রনম য ন আম দ র স ম নত স র র জন য সব ক ছ করল ম

এছাড়াও পড়ুন:

খাগড়াছড়িতে সাংবাদিক মিলন ত্রিপুরার ওপর হামলার অভিযোগ তদন্তের আহ্বান সিপিজের

খাগড়াছড়িতে সাংবাদিক মিলন ত্রিপুরার ওপর হামলার অভিযোগ তদন্ত করতে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার বৈশ্বিক সংগঠন কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)। দোষীদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে বলে উল্লেখ করেছে সংগঠনটি।

মঙ্গলবার সিপিজের এক টুইটে এ আহ্বান জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ডিবিসি নিউজের প্রতিনিধি মিলন ত্রিপুরা ১৭ জুলাই একটি বিক্ষোভের সংবাদ সংগ্রহ করছিলেন। এ সময় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে মারধর করেন ও ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ মুছে ফেলতে বাধ্য করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ