যে সম্পর্কের জাল থেকে হঠাৎ মুক্ত হয়ে ভাস্কর ও আঁকিয়ে হামিদুজ্জামান খান ইহলোক ত্যাগ করে চলে গেলেন, সেই বলয়ের মানুষ হিসেবে তাঁর ওপর নিরপেক্ষ দৃষ্টি ফেলা কঠিন। সরাসরি শিক্ষক হিসেবে পরিচয়ের এক সুনির্দিষ্ট মাত্রায় তিনি হাজির ছিলেন। অনেক পরে, শিল্পীজীবনে যখন তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত, তাঁর শিশুসুলভ কোমলতা ও বদান্যতার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে তাঁর গাজীপুরের ভাস্কর্যবাগান পরিদর্শন, তাঁর কাজের ওপর লেখার অভিজ্ঞতা, সর্বোপরি বেঙ্গল গ্যালারিতে তাঁর শেষ প্রদর্শনীসহ কয়েকটি বিশেষ প্রদর্শনীর কিউরেটর হিসেবে কাজ করা—সবই তাঁকে শিল্পী ও মানুষ হিসেবে নতুন করে চিনতে সাহায্য করেছে। আন্তরিকতার যে সমুদ্রের মধ্যে তিনি আমাদের ভাসিয়ে রাখতেন, তা ছিল তুলনাহীন। তথাপি প্রশ্ন হলো—শিল্পী হামিদুজ্জামান গতায়ু হওয়ার পর কোন কোন সূত্রে এই দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত থাকবেন? তিনি ছিলেন বহুপ্রজ এক ভাস্কর ও চিত্রী। সার্বক্ষণিক শিল্প তৈরিতে ব্যস্ত এই মানুষটির ব্যস্ততা থেমে যাওয়ার পর, তাঁর সৃষ্টিশীলতার মূল্যায়নে তাঁর শেষ জীবনের দুটি বড় পরিসর নির্মাণে যে প্রতিভার প্রকাশ প্রত্যক্ষ করা গেছে, তা-ই যথেষ্ট বলে বিবেচনা করা চলে।
গত ৩১ জানুয়ারি বেঙ্গল আর্ট প্রোগ্রামের আওতায় অনুষ্ঠিত হামিদুজ্জামানের সর্বশেষ প্রদর্শনীতে শিল্পীর আকারায়ণের শক্তির নিদর্শনের অভাব ছিল না। রূপের সীমা ছাড়িয়ে আধুনিক ভাস্কর্যে গাঠনিক যে বাস্তবতার প্রজনন সম্ভব, এই শিল্পীর সারা জীবনের অর্জনে সেই স্বাক্ষর মেলে। শৈল্পিক অর্জন যেমনটা সহজেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল তাঁর এই বৃহৎ কলেবরের প্রদর্শনীতে, তেমনটা আরও কয়েকটি প্রদর্শনীতে ঘটেছে বারংবার। প্রতিবারই কোনো না কোনো নতুনতর সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার ফসল তিনি দর্শক সমীপে পেশ করতে সক্ষম হয়েছেন।
যে শিল্পী তাঁর প্রথম জীবনে কমিশনধর্মিতার মধ্য দিয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন, তাঁর ভাস্কর্যের শক্তিমত্তা বিষয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে সজাগ হয়েছি ২০০২ সালে অনুষ্ঠিত একক প্রদর্শনীতে অসংখ্য মাকেটসুলভ (ছোট মডেল) ছোট কাজের সমারোহে চোখ রেখে।
‘এন ইন্ডিজেনাস মিনিমালিস্ট’ শিরোনামের এই প্রদর্শনীতে একক দণ্ডায়মান কাজের সঙ্গে একটি বড় টেবিলে রাখা প্রায় একই মাপের ক্ষুদ্র ভাস্কর্যগুলো এক নতুন ডায়ালজিক মাত্রা বা মিথস্ক্রিয়ার জন্ম দেয়। একক মোটিফনির্ভর আধুনিকতার ওপর এটি ছিল নতুন এক মহাজনী।
এর আগে ২০১৬-তে শিল্পী ‘জীবন অন্বেষণ’ শিরোনামে একটি উন্মুক্ত ভাস্কর্য প্রদর্শনী করেন। বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের উন্মুক্ত পরিসরে হামিদুজ্জামান তাঁর ছোট-বড় ধাতব ভাস্কর্যের পাশাপাশি পাথরের ছোট ছোট ভাস্কর্য উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে বিবিধ এমন নজির হাজির করেন, যা তাঁর আপন ভাষার ক্রমবিবর্তনের একরৈখিকতা থেকে আরও অনেক দূর এগিয়ে গিয়ে নব নব আবিষ্কারের আনন্দের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ বলে ঠাহর হয়েছে।
স্পেস ও ম্যাসের ধারণার যে গাণিতিক চরিত্র মইনুদ্দিন খালেদ তাঁর কাজের ব্যাখ্যা দিতে উল্লেখ করেছেন উপরোক্ত প্রদর্শনী উপলক্ষে প্রকাশিত পুস্তকে, সেই ইউরোপীয় আধুনিকতার শিক্ষা যেন আরও নানা নির্মাণকুশলতার সূত্রে আকার বা অবয়বের সীমা ছাড়িয়ে অস্তিত্বশীল হয়ে উঠতে চেয়েছে। এ প্রদর্শনী উপলক্ষ করে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর যে উক্তি করেছেন তা ওপরের অভিজ্ঞতার আলোকে জুতসই বলে মেনে নেওয়া যায়। ‘এই (শিল্পীর) আধুনিকতা ভাস্কর্যের সীমা পেরিয়ে যায়।’ উন্মুক্ত উদ্যানে এই প্রদর্শনী ছিল করণ ও দর্শনের ক্ষেত্রকে ক্রমে উন্মুক্ত করে দেওয়ার একটি সোপান।
নিজের তৈরি ভাস্কর্যের সামনে হামিদুজ্জামান খান, ২০২০.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ভ স কর য র উন ম ক ত
এছাড়াও পড়ুন:
দুর্গাপূজা উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে হিন্দু নেতাদের সাক্ষাৎ
আসন্ন দুর্গাপূজা উপলক্ষে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিভিন্ন পূজা উদ্যাপন পরিষদের নেতারা সাক্ষাৎ করেছেন। তাঁরা এ সময় প্রধান উপদেষ্টাকে পূজামণ্ডপ পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানান।
আজ সোমবার বিকেলে হিন্দু নেতারা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় যান। এ সময় তাঁদের কাছে দুর্গাপূজার প্রস্তুতি ও সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি তাঁদের বলেন, ‘আপনাদের সঙ্গে সব সময় দেখা করার ইচ্ছা থাকলেও সুযোগ হয় না। পূজা উপলক্ষে বছরে একবার সামনাসামনি দেখা হয়, কথা বলার সুযোগ হয়।’
হিন্দুধর্মীয় নেতারা জানান, গত বছরের তুলনায় এ বছর এক হাজারের বেশি পূজামণ্ডপ বেড়েছে। সারা দেশে পূজামণ্ডপ তৈরির কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে।
নেতারা বলেন, ধর্ম উপদেষ্টা নিয়মিতভাবে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, মন্দির পরিদর্শন করেন। দুর্গাপূজা উৎসবমুখর করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা হচ্ছে। গতবারের মতো এবারও নির্বিঘ্নে পূজা উদ্যাপন হবে বলে তাঁরা আশা করছি।
এ সময় স্থায়ী দুর্গামন্দিরের জন্য রেল মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জায়গা বরাদ্দ দেওয়ায় প্রধান উপদেষ্টাকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানান মহানগর পূজা কমিটির সভাপতি জয়ন্ত কুমার দেব। তিনি বলেন, ‘এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এ জন্য আপনাকে বিশেষ ধন্যবাদ। আপনি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে নিয়মিত আমাদের খোঁজখবর রেখেছেন। গত বছরের মতো এ বছরও পূজায় আমরা দুই দিন ছুটি পেয়েছি। এ জন্যও আপনাকে বিশেষ ধন্যবাদ। গত বছর ৮ আগস্ট দেশে ফেরার পরপরই আপনি ঢাকেশ্বরী মন্দির পরিদর্শন করে বলেছিলেন, আমরা সবাই এক পরিবার। আপনার বক্তব্য আমাদের মনে গভীরভাবে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।’
বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর বলেন, ‘গত বছর দুর্গাপূজায় ঢাকেশ্বরী মন্দির পরিদর্শনে গিয়ে আপনি বলেছিলেন, নিরাপত্তা বাহিনী দিয়ে কড়া পাহারা বসিয়ে পূজা হবে এমন দেশ আমরা চাই না। আমরা প্রথমবারের মতো কোনো সরকারপ্রধানের কাছে এমন বক্তব্য শুনেছি। আমরাও আপনার বক্তব্যের সঙ্গে একমত, আমরাও চাই এ আয়োজনে সবাই সহযোগিতা করুক, দেশের সবার মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকুক।’
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান কল্যাণ ফ্রন্টের মহাসচিব এস এন তরুণ দে বলেন, ‘আপনি দায়িত্বে থাকাকালীন দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নজির স্থাপন করেছেন। আমরা লক্ষ করেছি, এক বছর ধরে, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচুর মিথ্যা কথা, ফেক নিউজ ছড়ানো হচ্ছে। আপনার নেতৃত্বে ধর্ম–বর্ণ–জাতিনির্বিশেষে বাংলাদেশের সব মানুষের কল্যাণ হবে, আমরা সেটাই কামনা করি।’
বৈঠকে ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেন, ‘ধর্ম মন্ত্রণালয় সব ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করে। কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে আমরা কল্যাণকর কর্মসূচিগুলো নিশ্চিত করি।’ এ সময় তিনি বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সহযোগিতার কথা তুলে ধরেন।
প্রধান উপদেষ্টা সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও পূজার অগ্রিম শুভেচ্ছা জানান এবং দুর্গাপূজা ঘিরে যাতে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্রের সুযোগ তৈরি না হয়, সে জন্য সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানান।
বৈঠকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার, হিন্দুধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ভাইস চেয়ারম্যান তপন চন্দ্র মজুমদার ও সচিব দেবেন্দ্র নাথ উঁরাও, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী পূর্ণানন্দ (একক), বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু সমাজসংস্কার সমিতির সভাপতি অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, শ্রীশ্রী গীতা হরি সংঘ দেব মন্দিরের সভাপতি বিমান বিহারী তালুকদার, বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন ফ্রন্টের আহ্বায়ক অপর্ণা রায় দাস, শ্রীশ্রী সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরের সাধারণ সম্পাদক নারায়ণ চন্দ্র দত্ত ও সিদ্ধেশ্বরী সর্বজনীন পূজা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রণীতা সরকার উপস্থিত ছিলেন।