রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যের জন্য কে কাজ করবে
Published: 25th, July 2025 GMT
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলমত–নির্বিশেষে এক হয়ে কাজ করার যে অঙ্গীকার আমরা দেখেছিলাম, তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমরা কতটা সাফল্য পেয়েছি, তা একটি ভাবনার বিষয়। গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে আমরা যে অভাবনীয় ঐক্য গড়ে উঠতে দেখেছি, এক বছর পার হয়ে যাওয়ার পর আমরা সেই ঐক্য কি ধরে রাখতে পেরেছি? অথচ দেশ গড়ার যে ঐতিহাসিক সম্ভাবনা এই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে, তাকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানোর জন্য দলমত–নির্বিশেষে আবারও সেই ঐক্যের প্রয়োজন।
আমরা দেখতে পাচ্ছি যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংস্কারবিষয়ক নানা রকম প্রস্তাবিত বিষয়কে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য গড়ে তোলার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এর আগে কমিশনের বৈঠকগুলো মূলত রুদ্ধদ্বার বৈঠক হিসেবে পরিচালিত হয়েছে। আশার কথা হলো, চলমান সময়ে কমিশন সেই আলাপ-আলোচনাকে জনগণের সামনে নিয়ে আসছে। এর মধ্য দিয়ে দেশের সাধারণ জনগণও এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকছে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সংযোজন, যা আমরা এর আগে তেমন একটা দেখতে পাইনি। কোনো একটি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর প্রক্রিয়ায় মতবিভেদ থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। ভিন্নমত থেকে একমত ও দ্বিমত হওয়ার একটি দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমরা হয়তো একটি সহনশীল ও যৌক্তিক মতৈক্যে পৌঁছাব। কিন্তু তার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর একটি সহনশীল মানসিকতা ও রাজনৈতিক চর্চার প্রয়োজন। সেই সহনশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও চর্চার অভ্যাস করে তোলার জন্য যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা প্রয়োজন, তার উদ্যোগ কে নেবে?
আমরা বিগত সময়ে দেখেছি যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহনশীলতার অভাবের কারণে নিজেদের মধ্যে নানান দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাদের কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে সহিংসতার সংস্কৃতির মাধ্যমে। যার প্রভাব আমরা বিগত শাসনামলে হারে হারে টের পেয়েছি। যে কারণে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে যে বর্তমান বাংলাদেশে সেই পুরোনো বন্দোবস্ত ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে। যেখানে রাজনৈতিক অঙ্গনে সহনশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকবে। কিন্তু যে সহনশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং স্বতঃস্ফূর্ততা আমরা দেখেছিলাম গণ-অভ্যুত্থানের দিনগুলোতে, তা ক্রমে হারিয়ে যেতে বসেছে। হারিয়ে যেতে বসেছে সেই রাজনৈতিক ঐক্য।
রাজনৈতিক ঐক্য হারিয়ে যাওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে বলে আমরা ধারণা করতে পারি। অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক প্রস্তাবিত নানান সংস্কার বিষয়ে একমত হতে না পারা এই অনৈক্যের একটি বড় কারণ। কিন্তু আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে জাতীয় এবং দেশের উন্নয়নের স্বার্থে মৌলিক বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর একটি মতে পৌঁছানো খুব জরুরি একটি বিষয়। এর সঙ্গে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে কার অবদান বেশি আর কম ছিল, সেই দ্বিধান্বিত আলাপের মাধ্যমেও বিভাজন ও দূরত্ব তৈরি হচ্ছে, যা বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে জরুরি আলাপ নয়। কেননা, জাতীয় স্বার্থসংবলিত বিষয়ে যদি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য তৈরি না হয়, তাহলে দেশের সাধারণ মানুষই দিন শেষে বঞ্চিত হবে।
এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেকার ঐক্য নষ্ট হলে পতিত স্বৈরাচারের আসার পথ সুগম হবে বলেও অনেকে সংশয় প্রকাশ করেছেন। নিজেদের ঐক্যবদ্ধ রাখার একটি পূর্বশর্ত হলো রাজনৈতিক শিষ্টাচার বজায় রাখা। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য, অন্যান্য রাজনৈতিক দল বা তাদের নেতা সম্পর্কে নানা রকম নেতিবাচক মন্তব্য করার মাধ্যমে হেয় করার যে গতানুগতিক প্রবণতা আমরা বিগত সময়ে দেখে এসেছি, সেই চর্চা থেকে এখনো আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি। তাই রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ বর্জন করা ঐক্য গড়ে তোলার একটি অন্যতম পূর্বশর্ত। এর পাশাপাশি প্রয়োজন রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ভাষা ব্যবহারের পরিমিতিবোধ গড়ে তোলা, যা বিগত সরকারের শাসনামলে পরিপূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছিল এবং সেই অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসা। আর এটা করা গেলে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের জায়গা নিশ্চিত করা সম্ভব। বিশেষ করে তরুণদের কাছে দেশের মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। কেননা, তাদের হাত ধরেই জুলাই আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। তাই তাদের নিজেদেরও শব্দচয়নে আরও সতর্ক থাকা উচিত। এটি তাদের নিজেদের একটি শক্তিশালী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা ও তা বজায় রাখার জন্য জরুরি। তা করতে না পারলে জনমনে তাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হবে।
একটা সময় কর্তৃত্ববাদী একটি ব্যবস্থা বিলোপের জন্য আমাদের এক থাকতে হয়েছে, কিন্তু এখন সবাই নিজ নিজ রাজনৈতিক মতাদর্শকে সামনে রেখে যার যার মত ও পথ অনুযায়ী চলছে। সেটা থাকাটাও স্বাভাবিক এবং মতপার্থক্যের মধ্য দিয়েই আমরা একসময় জাতীয় স্বার্থে মৌলিক কিছু বিষয়ে এক মতে আসতে পারব। কিন্তু সেটি করতে যেন আমরা বেশি সময় না নিয়ে ফেলি, সেদিকেও সব রাজনৈতিক দলের মনযোগ দিতে হবে। বৈচিত্র্য ও মতভিন্নতার মধ্যে যে সৌন্দর্য রয়েছে, তাকে সর্বান্তকরণে গ্রহণ করতে হবে। এর মাধ্যমেই ঐক্য গড়ে উঠবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
এ পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসতে হবে এবং ঐক্য গঠনে তারা কি ভূমিকা পালন করতে পারে, সেটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আন্তদলীয় আলাপ–আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। কেননা, তাদের মধ্যে বিভেদ থাকলে সেটি আমাদের নিজেদের জন্যই হানিকর হবে, যার মধ্য দিয়ে কর্তৃত্ববাদী শক্তি তার ফায়দা তুলতে পিছপা হবে না, যা আমরা ইতিমধ্যেই সাম্প্রতিক কিছু সংকটের সময় টের পেয়েছি। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সবাই যে অসামান্য ঐক্য দেখিয়েছে, সেই ঐক্য ফিরিয়ে আনতে রাজনৈতিক দলগুলোকে আন্তদলীয় সংলাপের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে এবং নতুন দল হিসেবে এনসিপিকেও ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকেও এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে হবে, তাতে করে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের বাইরেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রক্রিয়ার চর্চা শুরু হবে, যা দেশের মানুষ ইতিবাচক উদ্যোগ হিসেবে গ্রহণ করবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, জুলাই আমাদের যা দিয়েছে, তাকে আঁকড়ে ধরে আমাদের সামনের দিনগুলোকে গড়ে তুলতে হবে। দেশকে মুক্ত করার যে প্রচেষ্টা ও একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার আমরা এক বছর আগে দেখেছিলাম, সেই শক্তিকে যেন আমরা দেশ গড়ার কাজে ব্যবহার করার অঙ্গীকার করি। আমাদের মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতা পাওয়ার চেয়ে তা রক্ষা করা আরও অনেক কঠিন। আমরা এখন ঠিক সেই কঠিন সময় পার করছি। তাই অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের প্রমাণ করতে হবে, জুলাই নিয়ে যেন আমরা চেতনার ফাঁকা আস্ফালনের সংস্কৃতি গড়ে না তুলি। আমাদের মনে রাখতে হবে, অযাচিত ও জবাবদিহিহীন ক্ষমতার চর্চা যখনই ফিরে আসবে, তখনই জনগণ তার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে। তাই ক্ষমতার আস্ফালনে জুলাইকে সাধারণ জনতার হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা যেন কারও মধ্যে না গড়ে ওঠে সেদিকে সতর্ক মনযোগ রাখতে হবে। একে ফ্লুইড ও অর্গানিক বা স্বতঃস্ফূর্তই থাকতে দিতে হবে, যেমন করে জুলাই আন্দোলনকে আমরা দেখেছিলাম একটি স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন হিসেবে, যেখানে দেশের সব নির্যাতিত মানুষের দীর্ঘ অবদান রয়েছে। জুলাইয়ের চেতনাকে সবাইকে ধারণ করতে দিলেই আমরা সবাই মিলে একতাবদ্ধ হয়ে একটি সমৃদ্ধ ও উন্নত দেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হব।
বুলবুল সিদ্দিকী নৃবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য র জন ত ক সহনশ ল আম দ র প রক র র জন য পর প র ক জ কর র একট
এছাড়াও পড়ুন:
২৭০ দিন আলোচনার পর অনৈক্যে হতাশ উপদেষ্টা
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরবিরোধী অবস্থানে হতাশা প্রকাশ করেছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। ২৭০ দিন আলোচনার পরও ঐকমত্য না হওয়ায় তিনি বলেন, সরকার কীভাবে কাজ করবে, তা বোঝা কঠিন। গণভোটের সময় ও পদ্ধতি নিয়ে মতভেদ চরমে পৌঁছেছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দুটি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে গণভোট অথবা নির্বাচিত সংসদের হাতে দায়িত্ব হস্তান্তর। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য ঐকমত্যের সরকারের ধারণাকে দুর্বল করে দিচ্ছে।