রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যের জন্য কে কাজ করবে
Published: 25th, July 2025 GMT
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলমত–নির্বিশেষে এক হয়ে কাজ করার যে অঙ্গীকার আমরা দেখেছিলাম, তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমরা কতটা সাফল্য পেয়েছি, তা একটি ভাবনার বিষয়। গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে আমরা যে অভাবনীয় ঐক্য গড়ে উঠতে দেখেছি, এক বছর পার হয়ে যাওয়ার পর আমরা সেই ঐক্য কি ধরে রাখতে পেরেছি? অথচ দেশ গড়ার যে ঐতিহাসিক সম্ভাবনা এই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে, তাকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানোর জন্য দলমত–নির্বিশেষে আবারও সেই ঐক্যের প্রয়োজন।
আমরা দেখতে পাচ্ছি যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংস্কারবিষয়ক নানা রকম প্রস্তাবিত বিষয়কে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য গড়ে তোলার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এর আগে কমিশনের বৈঠকগুলো মূলত রুদ্ধদ্বার বৈঠক হিসেবে পরিচালিত হয়েছে। আশার কথা হলো, চলমান সময়ে কমিশন সেই আলাপ-আলোচনাকে জনগণের সামনে নিয়ে আসছে। এর মধ্য দিয়ে দেশের সাধারণ জনগণও এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকছে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সংযোজন, যা আমরা এর আগে তেমন একটা দেখতে পাইনি। কোনো একটি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর প্রক্রিয়ায় মতবিভেদ থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। ভিন্নমত থেকে একমত ও দ্বিমত হওয়ার একটি দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমরা হয়তো একটি সহনশীল ও যৌক্তিক মতৈক্যে পৌঁছাব। কিন্তু তার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর একটি সহনশীল মানসিকতা ও রাজনৈতিক চর্চার প্রয়োজন। সেই সহনশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও চর্চার অভ্যাস করে তোলার জন্য যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা প্রয়োজন, তার উদ্যোগ কে নেবে?
আমরা বিগত সময়ে দেখেছি যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহনশীলতার অভাবের কারণে নিজেদের মধ্যে নানান দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাদের কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে সহিংসতার সংস্কৃতির মাধ্যমে। যার প্রভাব আমরা বিগত শাসনামলে হারে হারে টের পেয়েছি। যে কারণে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে যে বর্তমান বাংলাদেশে সেই পুরোনো বন্দোবস্ত ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে। যেখানে রাজনৈতিক অঙ্গনে সহনশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকবে। কিন্তু যে সহনশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং স্বতঃস্ফূর্ততা আমরা দেখেছিলাম গণ-অভ্যুত্থানের দিনগুলোতে, তা ক্রমে হারিয়ে যেতে বসেছে। হারিয়ে যেতে বসেছে সেই রাজনৈতিক ঐক্য।
রাজনৈতিক ঐক্য হারিয়ে যাওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে বলে আমরা ধারণা করতে পারি। অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক প্রস্তাবিত নানান সংস্কার বিষয়ে একমত হতে না পারা এই অনৈক্যের একটি বড় কারণ। কিন্তু আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে জাতীয় এবং দেশের উন্নয়নের স্বার্থে মৌলিক বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর একটি মতে পৌঁছানো খুব জরুরি একটি বিষয়। এর সঙ্গে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে কার অবদান বেশি আর কম ছিল, সেই দ্বিধান্বিত আলাপের মাধ্যমেও বিভাজন ও দূরত্ব তৈরি হচ্ছে, যা বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে জরুরি আলাপ নয়। কেননা, জাতীয় স্বার্থসংবলিত বিষয়ে যদি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য তৈরি না হয়, তাহলে দেশের সাধারণ মানুষই দিন শেষে বঞ্চিত হবে।
এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেকার ঐক্য নষ্ট হলে পতিত স্বৈরাচারের আসার পথ সুগম হবে বলেও অনেকে সংশয় প্রকাশ করেছেন। নিজেদের ঐক্যবদ্ধ রাখার একটি পূর্বশর্ত হলো রাজনৈতিক শিষ্টাচার বজায় রাখা। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য, অন্যান্য রাজনৈতিক দল বা তাদের নেতা সম্পর্কে নানা রকম নেতিবাচক মন্তব্য করার মাধ্যমে হেয় করার যে গতানুগতিক প্রবণতা আমরা বিগত সময়ে দেখে এসেছি, সেই চর্চা থেকে এখনো আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি। তাই রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ বর্জন করা ঐক্য গড়ে তোলার একটি অন্যতম পূর্বশর্ত। এর পাশাপাশি প্রয়োজন রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ভাষা ব্যবহারের পরিমিতিবোধ গড়ে তোলা, যা বিগত সরকারের শাসনামলে পরিপূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছিল এবং সেই অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসা। আর এটা করা গেলে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের জায়গা নিশ্চিত করা সম্ভব। বিশেষ করে তরুণদের কাছে দেশের মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। কেননা, তাদের হাত ধরেই জুলাই আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। তাই তাদের নিজেদেরও শব্দচয়নে আরও সতর্ক থাকা উচিত। এটি তাদের নিজেদের একটি শক্তিশালী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা ও তা বজায় রাখার জন্য জরুরি। তা করতে না পারলে জনমনে তাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হবে।
একটা সময় কর্তৃত্ববাদী একটি ব্যবস্থা বিলোপের জন্য আমাদের এক থাকতে হয়েছে, কিন্তু এখন সবাই নিজ নিজ রাজনৈতিক মতাদর্শকে সামনে রেখে যার যার মত ও পথ অনুযায়ী চলছে। সেটা থাকাটাও স্বাভাবিক এবং মতপার্থক্যের মধ্য দিয়েই আমরা একসময় জাতীয় স্বার্থে মৌলিক কিছু বিষয়ে এক মতে আসতে পারব। কিন্তু সেটি করতে যেন আমরা বেশি সময় না নিয়ে ফেলি, সেদিকেও সব রাজনৈতিক দলের মনযোগ দিতে হবে। বৈচিত্র্য ও মতভিন্নতার মধ্যে যে সৌন্দর্য রয়েছে, তাকে সর্বান্তকরণে গ্রহণ করতে হবে। এর মাধ্যমেই ঐক্য গড়ে উঠবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
এ পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসতে হবে এবং ঐক্য গঠনে তারা কি ভূমিকা পালন করতে পারে, সেটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আন্তদলীয় আলাপ–আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। কেননা, তাদের মধ্যে বিভেদ থাকলে সেটি আমাদের নিজেদের জন্যই হানিকর হবে, যার মধ্য দিয়ে কর্তৃত্ববাদী শক্তি তার ফায়দা তুলতে পিছপা হবে না, যা আমরা ইতিমধ্যেই সাম্প্রতিক কিছু সংকটের সময় টের পেয়েছি। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সবাই যে অসামান্য ঐক্য দেখিয়েছে, সেই ঐক্য ফিরিয়ে আনতে রাজনৈতিক দলগুলোকে আন্তদলীয় সংলাপের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে এবং নতুন দল হিসেবে এনসিপিকেও ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকেও এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে হবে, তাতে করে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের বাইরেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রক্রিয়ার চর্চা শুরু হবে, যা দেশের মানুষ ইতিবাচক উদ্যোগ হিসেবে গ্রহণ করবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, জুলাই আমাদের যা দিয়েছে, তাকে আঁকড়ে ধরে আমাদের সামনের দিনগুলোকে গড়ে তুলতে হবে। দেশকে মুক্ত করার যে প্রচেষ্টা ও একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার আমরা এক বছর আগে দেখেছিলাম, সেই শক্তিকে যেন আমরা দেশ গড়ার কাজে ব্যবহার করার অঙ্গীকার করি। আমাদের মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতা পাওয়ার চেয়ে তা রক্ষা করা আরও অনেক কঠিন। আমরা এখন ঠিক সেই কঠিন সময় পার করছি। তাই অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের প্রমাণ করতে হবে, জুলাই নিয়ে যেন আমরা চেতনার ফাঁকা আস্ফালনের সংস্কৃতি গড়ে না তুলি। আমাদের মনে রাখতে হবে, অযাচিত ও জবাবদিহিহীন ক্ষমতার চর্চা যখনই ফিরে আসবে, তখনই জনগণ তার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে। তাই ক্ষমতার আস্ফালনে জুলাইকে সাধারণ জনতার হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা যেন কারও মধ্যে না গড়ে ওঠে সেদিকে সতর্ক মনযোগ রাখতে হবে। একে ফ্লুইড ও অর্গানিক বা স্বতঃস্ফূর্তই থাকতে দিতে হবে, যেমন করে জুলাই আন্দোলনকে আমরা দেখেছিলাম একটি স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন হিসেবে, যেখানে দেশের সব নির্যাতিত মানুষের দীর্ঘ অবদান রয়েছে। জুলাইয়ের চেতনাকে সবাইকে ধারণ করতে দিলেই আমরা সবাই মিলে একতাবদ্ধ হয়ে একটি সমৃদ্ধ ও উন্নত দেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হব।
বুলবুল সিদ্দিকী নৃবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য র জন ত ক সহনশ ল আম দ র প রক র র জন য পর প র ক জ কর র একট
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই সনদের খসড়া নিয়ে ৩ দলের আপত্তি, বিএনপি মোটামুটি একমত
জুলাই জাতীয় সনদের খসড়া নিয়ে আপত্তির কথা জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের দুই বছরের মধ্যে সনদে অন্তর্ভুক্ত সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করা হবে—সনদের এ বিষয়টি নিয়েই মূলত আপত্তি। দলগুলো বলছে, জুলাই সনদকে একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে এনে তা বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা দিতে হবে। না হলে পুরো সংস্কারপ্রক্রিয়া অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাবে। তবে এ খসড়ার সঙ্গে মোটামুটি একমত বিএনপি।
গতকাল মঙ্গলবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার ফাঁকে সাংবাদিকদের কাছে সনদের খসড়া নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানায় কয়েকটি দল। আজ বুধবার দুপুরের মধ্যে দলগুলোকে এ খসড়ার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মতামত জানাতে বলেছে ঐকমত্য কমিশন।
আগামীকাল বৃহস্পতিবারের মধ্যে দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা শেষ করে জুলাই সনদ চূড়ান্ত করতে চায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তবে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের আলোচনা এখনো শেষ হয়নি। গতকাল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা, সংসদে নারী আসন, মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে আলোচনা হয়। তবে এসব বিষয়ে গতকালও ঐকমত্য হয়নি। দ্বিতীয় পর্বের আলোচ্য সূচিতে থাকা ২০টি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে এখনো ৮টি প্রস্তাবে ঐকমত্য হয়নি।
আলোচনা শেষ না হলেও গত সোমবার জাতীয় সনদের একটি খসড়া দলগুলোকে দেয় ঐকমত্য কমিশন। খসড়ায় বলা হয়েছে, জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত সংস্কার প্রস্তাবগুলো আগামী জাতীয় নির্বাচনের
মাধ্যমে সরকার গঠনের দুই বছরের মধ্যে সম্পন্ন করতে অঙ্গীকার করবে রাজনৈতিক দলগুলো। সেখানে মোট সাতটি অঙ্গীকার করার কথা বলা আছে।
রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার আনতে ছয় সংস্কার কমিশনের যেসব প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে, সেগুলো নিয়ে তৈরি হবে জাতীয় সনদ। তবে কোন কোন বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, খসড়ায় তা উল্লেখ করা হয়নি। দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা পুরোপুরি শেষ হওয়ার পর বিষয়গুলো সনদে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
খসড়া নিয়ে দলগুলোর বক্তব্যসনদের কিছু অংশ ‘বিপজ্জনক’ বলে উল্লেখ করেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। গতকাল তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তাঁরা যেকোনো একটি পদ্ধতিতে এই সনদকে আইনগত বৈধতা দেওয়ার পক্ষে। এটি আইনি কাঠামোর মধ্যে আনা না হলে দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিয়শ্চয়তার দিকে চলে যেতে পারে। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হচ্ছে, সেগুলো বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি থাকতে হবে। তাঁর মতে, সেটি দুইভাবে হতে পারে। অধ্যাদেশের মাধ্যমে একটি আইনি কাঠামো গঠন করে পরে নির্বাচিত সংসদে তা অনুমোদন অথবা গণভোটের মাধ্যমে জনগণের চূড়ান্ত অনুমোদন নেওয়া। জামায়াতে ইসলামী জুলাই সনদের একটি খসড়া ঐকমত্য কমিশনের কাছে জমা দেবে বলেও জানান তিনি।
* তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নারী আসন নিয়ে ঐকমত্য হয়নি। * আজ আবার আলোচনা। * খসড়া নিয়ে মতামত জানাতে হবে আজকের মধ্যেই।খসড়াটি দলীয়ভাবে পর্যালোচনা করা হচ্ছে জানিয়ে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই খসড়ায় আমরা মৌলিক সংস্কারের প্রতিটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত দেখতে চাই। যদি তা বাদ দেওয়া হয়, তাহলে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, সই করব কি না।’
আখতার বলেন, আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করতে তারা ‘লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার’ (আইনি আদেশ) করার প্রস্তাব দিয়েছেন। একই সঙ্গে যে সংস্কারগুলো রাজনৈতিক দলগুলো সম্মিলিতভাবে মেনে নিচ্ছে, তা যেন পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় আসা কোনো দল উপেক্ষা করতে না পারে, এ নিশ্চয়তাও চান তাঁরা।
শুরু থেকে সংবিধান পুনর্লিখনে গণপরিষদ গঠনের কথা বলে আসছে এনসিপি। এ বিষয়ে গতকাল আখতার হোসেন বলেন, গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধান পুনর্লিখন করা গেলে সঠিকভাবে সব বিষয় সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে।
সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য ছয়টি বিকল্প পদ্ধতির কথা বলেছিল ঐকমত্য কমিশন। সেগুলো নিয়ে এখনো আলোচনা হয়নি। বিষয়টি উল্লেখ করে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা এর তীব্র বিরোধিতা করছি। আলোচনার পদ্ধতি নিয়েই আলোচনা হয়নি, অথচ তারা খসড়া প্রকাশ করেছে। এটা আমরা গ্রহণ করতে পারি না।’
জুলাই সনদের খসড়াকে আইনি বাধ্যবাধকতাহীন একটি দুর্বল উপস্থাপনা বলে অভিহিত করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। দলটির মহাসচিব মাওলানা ইউনুস আহমদ গতকাল দলের নিয়মিত বৈঠকে এ প্রতিক্রিয়া জানান।
ইসলামী আন্দোলনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, খসড়ায় একবারের জন্যও পতিত ফ্যাসিবাদের মূল হোতা ও অশুভ চক্রের প্রধান শেখ হাসিনার নাম উল্লেখ করা হয়নি। জুলাই সনদের ক্ষেত্রে প্রধান চাওয়া ছিল, এর আইনি মর্যাদা ও বাধ্যবাধকতা। কিন্তু খসড়া সনদে এ সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। ফলে সনদের আদতে কোনো তাৎপর্য আছে বলে মনে হয় না।
অন্যদিকে ঐকমত্য কমিশনের খসড়ার সঙ্গে মোটামুটি একমত বিএনপি। গতকাল দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, খসড়ার সঙ্গে তাঁরা মোটামুটি একমত। অঙ্গীকারের বিষয়েও বিএনপি একমত। খসড়ায় শব্দ-বাক্য গঠন-সংক্রান্ত বিষয়ে বিএনপি তাদের পর্যবেক্ষণ আজ কমিশনকে জানাবে।
কাল সনদ চূড়ান্ত করার আশাগতকাল দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার শুরুতে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে জুলাই সনদের প্রাথমিক খসড়া পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। বুধবার পর্যন্ত দলগুলোর মন্তব্যের জন্য তাঁরা অপেক্ষা করবেন। তিনি আশা করছেন, বিভিন্ন মন্তব্য সমন্বয় করে একটি চূড়ান্ত রূপরেখা তৈরি করতে পারবেন। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে, সেসব বিষয় ও মন্তব্যগুলো নিয়ে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে সনদের চূড়ান্ত ধাপে পৌঁছাতে পারবেন বলে আশা করছেন তিনি।
গতকাল সন্ধ্যায় আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, কেউ কেউ মৌখিকভাবে সনদের খসড়ায় কিছু কিছু সংশোধনীর কথা কমিশনকে বলেছেন। বড় ধরনের আপত্তির কথা কমিশন এখনো শুনতে পায়নি। কমিশন এখনো আশাবাদী, ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ রূপ দাঁড় করানো যাবে।
গতকালের আলোচনানির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলেও এ সরকারের রূপরেখা নিয়ে ঐকমত্য হয়নি। গতকালের আলোচনায় ঐকমত্য কমিশন রূপরেখা নিয়ে একটি সংশোধিত প্রস্তাব দেয়। তবে সেটি নিয়েও ঐকমত্য হয়নি। প্রস্তাবে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের জন্য কয়েকটি ধাপে বিকল্পের কথা আছে।
আলোচনার এক পর্যায়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, প্রস্তাবের প্রথম কয়েকটি ধাপ নিয়ে ঐকমত্য আছে। এর পরের ধাপ কী হবে, সেটা ঠিক করার বিষয়টি আগামী সংসদের ওপর ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেন তিনি।
তবে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ কয়েকটি দল বিষয়টি পরবর্তী সংসদের জন্য ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। পরে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, আলোচনা থেকে বোঝা যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রস্তাবটি গ্রহণ করতে গেলে বিএনপিসহ কয়েকটি দলের ‘নোট অব ডিসেন্ট’ (ভিন্নমত) দেওয়ার সম্ভাবনা আছে। কমিশন এ বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত জানাবে।
সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০টি করা এবং সরাসরি ভোটের বিধান করার প্রস্তাব দিয়েছিল সংস্কার কমিশন। কিন্তু তাতে ঐকমত্য না হওয়ায় কমিশন নতুন প্রস্তাব দেয়। তাতে বলা হয়, ৩০০ সাধারণ আসনের মধ্যে দলগুলো এক-চতুর্থাংশ বা এক-পঞ্চমাংশ আসনে নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেবে। গতকালও এ বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি।
গতকাল এ বিষয়ের আলোচনায় জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, সরাসরি নির্বাচনে নারী প্রার্থী দিতে জামায়াতের সমস্যা হবে না। জমিয়তে ওলামা ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসব দলের ক্ষেত্রে নারী প্রার্থী দিতে ‘টেকনিক্যাল’ সমস্যা হবে। ইসলামী আন্দোলন যে সংস্কৃতির দল, তাদের পক্ষে নারী প্রার্থী দেওয়া কঠিন। তাই নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়টি বাধ্যতামূলক না করে বলা যায়, এ বিষয়ে তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। যারা পারবে, নারী প্রার্থী দেবে।
গতকালের আলোচনা শেষে আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, আলোচনায় বিভিন্ন রকম প্রস্তাব এসেছে। পর্যায়ক্রমে নারী প্রতিনিধিত্ব কীভাবে বাড়ানো যায়, তা নিয়ে ঐকমত্যের কাছাকাছি আসা গেছে। বুধবার এ বিষয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে একটি লিখিত ভাষ্য দেওয়া হবে। কমিশন আশা করছে, সেটা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
আলোচনায় অন্যদের মধ্যে ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, বিচারপতি এমদাদুল হক, সফর রাজ হোসেন, ইফতেখারুজ্জামান, আইয়ুব মিয়া ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন।