একটা শহরের প্রাণশক্তি বোঝা যায় তার হাঁটার পথ দেখে। নাগরিকদের পায়ে হেঁটে চলার কতটা সুযোগ আছে, কোথায় তারা হাঁটে, কীভাবে হাঁটে—এই ছোট ছোট বিষয় মিলিয়ে শহরের চরিত্র ধরা দেয়। সেই হিসেবে আমাদের রাজধানী ঢাকা যেন একটি হাঁপাতে থাকা শহর—যেখানে হাঁটার মতো জায়গা আছে নামমাত্র, আর হাঁটার সুযোগ আছে কেবল তাদের, যাদের সময়, সাহস আর সহ্যক্ষমতা একটু বেশি।

আমাদের শহর ঢাকা। জনসংখ্যা দুই কোটির বেশি। কিন্তু এই জনসমুদ্রের মধ্যে হাঁটার জন্য উন্মুক্ত, নিরাপদ এবং সবুজ জায়গা কতটুকু? কেউ যদি প্রশ্ন করেন, ‘এই ঢাকা শহরে সামান্য একটু হাঁটার জায়গা কোথায়?’ তাঁকে আমরা কী জবাব দেব?

অবস্থা দেখে মনে হয়, এই শহর যেন তার নাগরিকের জন্য নয়, বরং কারও প্রজেক্টের, কারও মুনাফার, কারও ক্ষমতার নিঃশব্দ এক জমিদারি। এই শহরের ফুটপাত হকারের, সড়ক জ্যামের, আর গলি ইজারাদারের দখলে।

প্রতিদিন আমরা রাস্তায় হাঁটি, কিন্তু সেটা হাঁটা না, যেন যুদ্ধ। ফুটপাতে ব্যবসা, রাজনৈতিক ব্যানার, বিলবোর্ডের খুঁটি, খাবারের ঠেলা, রিকশাওয়ালার বিশ্রাম, আর এখানে-সেখানে গর্ত—সব মিলিয়ে একজন মানুষ সোজা পথে হাঁটতেও ভয় পায়। আর নারী, শিশু, প্রবীণ কিংবা প্রতিবন্ধীদের জন্য এই শহরে হাঁটা তো একরকম নিষেধাজ্ঞার নামান্তর। বেশির ভাগ জায়গায় ফুটপাত বলে যা আছে, তা আসলে দখলের শিকার। যেটুকু আছে, সেটাও ধুলা, শব্দ আর দুর্গন্ধে ভরা।

এ শহরে আপনি হাঁটবেন কোথায়? অফিস শেষে হেঁটে বাড়ি যাবেন? নাকি সকালে ঘাম ঝরাবেন পার্কে? দুটোর কোনোটাই সহজ নয়। হাঁটার জন্য আলাদা পরিকাঠামো এখানে কোনো দিনই ছিল না। অথচ ইউরোপ-আমেরিকা তো দূরের কথা, নিকট প্রতিবেশী শহর কলকাতার সঙ্গেও ঢাকার তুলনা করলে বুঝি, আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি। সেখানে বড় বড় গাছের নিচ দিয়ে মানুষ এখনো ফুর্তি নিয়ে হেঁটে চলে।

আমরা সাধারণত হাঁটার জায়গা বললেই বুঝি পার্ক। কিন্তু হাঁটার জায়গা মানে শুধু রমনা পার্ক নয়, হাতিরঝিল নয়; হাঁটার জায়গা মানে প্রতিটি গলি, প্রতিটি ফুটপাত, প্রতিটি বাজারের পথ—যেখানে মানুষ নিরাপদে, নিশ্চিন্তে, ধাক্কা না খেয়ে হাঁটতে পারে।
কিন্তু ঢাকায় এমন কোনো এলাকা আছে কি, যেখানে আপনি নির্ভয়ে ১৫-২০ মিনিট হেঁটে ঘুরে আসতে পারবেন? অনেক খুঁজে দেখলে হয়তো দু-একটা এলাকা পাওয়া যাবে, কিন্তু সেটা শহরের সার্বিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি নয় মোটেই।

তবু ঢাকায় কয়েকটি জায়গা এখনো খানিকটা হাঁটার সুযোগ করে দেয়। সেগুলোর মধ্যেও বেশির ভাগই নির্দিষ্ট শ্রেণির নাগরিকের জন্য কিংবা নির্দিষ্ট সময় ও সুযোগসাপেক্ষ।

ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত রমনা পার্ক এখনো কিছুটা প্রশান্তির জায়গা। সকাল কিংবা ছুটির দিনে এখানে অনেকেই হাঁটতে আসেন। গাছগাছালির ছায়ায় কিছুটা হাঁটা যায় বটে, তবে সন্ধ্যার পর অনেকটা এলাকা অন্ধকার থাকে, যা নিরাপত্তার প্রশ্ন তোলে।

ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এখন ঢেলে সাজানোর পর খানিকটা হাঁটার উপযোগী হলেও কোলাহল প্রবল। মাঝেমধ্যে আড্ডার স্থান বেশি হয়ে ওঠে হাঁটার জায়গার চেয়ে। উদ্যানের নানা জায়গায় আছে গঞ্জিকাসেবীসহ মাদকাসক্তদের উৎপাত।

গাড়ি আর বাইকের শব্দ পেরিয়ে আধুনিক জলাধারপথ হাতিরঝিলে হাঁটার সুযোগ কিছুটা আছে। তবে নিরিবিলি কোনো পরিবেশ নেই। অনেকেই এখানে হাঁটেন বিনোদনের অংশ হিসেবে। নিরাপত্তাব্যবস্থা কিছুটা ভালো, তবে দুপুরের পর থেকে ট্রাফিক ও ভিড়ের কারণে হাঁটার স্বাচ্ছন্দ্য হারিয়ে যায়।

শহর যদি মানবিক না হয়, যদি সেখানে মানুষের হাঁটার জন্য জায়গা না থাকে, তাহলে সে শহর মানুষকে তাড়িয়ে দেয়। ঢাকাও কি সেই পথেই হাঁটছে? এই শহরকে এর নাগরিকদের বড় অংশটি আর ভালোবাসে না। রুটিরুজির কারণে থাকতে হয়, তাই থাকছে। আমাদের এখন প্রয়োজন নতুন করে হাঁটার জায়গা তৈরি করা নয়, বরং যা আছে—তাকে রক্ষা করা, সংরক্ষণ করা, মানুষের নাগালের মধ্যে রাখা।

গুলশান-বনানী লেক পার্ক তুলনামূলকভাবে সুপরিচালিত। সকাল-সন্ধ্যায় অনেকেই এখানে হাঁটতে আসেন। তবে এটি মূলত উচ্চবিত্ত শ্রেণির নাগরিকদের জন্য ব্যবহৃত ও নিরাপদ একটি জায়গা, ঠিক সবার জায়গা নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল, টিএসসি এলাকা—এই পথগুলোয় অনেকেই হেঁটে বেড়ান। তবে এখানে হাঁটা মানে আবার কখনো কখনো ব্যস্ত ট্রাফিকের সঙ্গে বোঝাপড়া করা।

জাতীয় সংসদ ভবন এলাকাকে বলা চলে শহরের সবচেয়ে বড় খোলা জায়গা। লুই কানের নকশায় গড়ে ওঠা এই এলাকাটি রিকশামুক্ত ও প্রশস্ত। কিন্তু প্রবেশাধিকার সীমিত। রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ হলে আবার সব বন্ধ।

এই শহরে এই নিবন্ধকারের একটি প্রিয় হাঁটার সড়ক ছিল। দোয়েল চত্বর থেকে বাংলা একাডেমি, টিএসসি হয়ে শাহবাগের সড়কটি। দোয়েল চত্বরে এসে রিকশা ছেড়ে এইটুকুন হাঁটা আনন্দের ছিল। কিন্তু মেট্রোরেল হওয়ার পর এই সড়কের অবয়ব পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন আর আগের মতো টানে না এই সড়ক।

২.

শুধু হাঁটার জায়গা নেই বলেই নয়, বরং যা ছিল, তা–ও একে একে আমরা হারিয়ে ফেলছি। গাছ কেটে রাস্তা বানানো, পার্কে কংক্রিট ঢালা, উদ্যানকে বিনোদন পার্কে রূপান্তর করা—এই সবকিছুই আমাদের হাঁটার সংস্কৃতিকে ধ্বংস করছে।
আরেকটি ভয়ংকর প্রবণতা হলো পার্কগুলোর ব্যবসায়িকীকরণ। অর্থাৎ পার্কে দোকান, ক্যাফে, কিংবা টিকিটব্যবস্থা চালু করে সাধারণ মানুষের প্রবেশ সীমিত করা হচ্ছে। হাঁটা যেন আর সবার অধিকার নয়, বরং কেবল যাঁরা টাকা দিতে পারবেন, তাঁরাই হাঁটার সুযোগ পাবেন।

হাঁটা কেবল শরীরচর্চা নয়, এটি নাগরিক জীবনের একটি মৌলিক অধিকার। একজন মানুষ চাইবেন অফিস থেকে ফেরার পথে খানিক হাঁটতে, ছুটির সকালে শিশুকে নিয়ে একটু সবুজে ঘুরতে, কিংবা মন খারাপ হলে একা একা রাস্তায় হাঁটতে। এই চাহিদা আমাদের সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, মনের ভারসাম্য—সবকিছুর সঙ্গে জড়িত।

হাঁটার গুরুত্ব মাথায় রেখে ঢাকার নগর-পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে মনে হয় না। শহরজুড়ে শুধু প্রাইভেট কার ও উড়ালসড়ককে গুরুত্ব দিয়ে হাঁটার চাহিদাকে আমরা দিন দিন বিলুপ্ত করে দিচ্ছি।

শহর যদি মানবিক না হয়, যদি সেখানে মানুষের হাঁটার জন্য জায়গা না থাকে, তাহলে সে শহর মানুষকে তাড়িয়ে দেয়। ঢাকাও কি সেই পথেই হাঁটছে? এই শহরকে এর নাগরিকদের বড় অংশটি আর ভালোবাসে না। রুটিরুজির কারণে থাকতে হয়, তাই থাকছে।

আমাদের এখন প্রয়োজন নতুন করে হাঁটার জায়গা তৈরি করা নয়, বরং যা আছে—তাকে রক্ষা করা, সংরক্ষণ করা, মানুষের নাগালের মধ্যে রাখা।

শহরের প্রতিটি এলাকায় অন্তত একটি হাঁটার পথ থাকা উচিত—যেখানে সকাল-বিকেল পরিবার, শিশু, বয়স্করা নিশ্চিন্তে হাঁটতে পারবেন। এটা কেবল স্বাস্থ্য বা বিনোদনের বিষয় নয়, বরং নাগরিক অধিকার ও মর্যাদার প্রশ্ন।

ঢাকা শহরে সামান্য একটু হাঁটার জায়গা কোথায়—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা যেন আসলে পুরো শহরের আত্মাকেই খুঁজে পাই। শহরে হাঁটা শুধু যাতায়াত নয়, বরং একটি অভিজ্ঞতা। হাঁটার পথ মানে মানুষের পথ। সেই পথ যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে শহর তো আর মানুষের থাকে না।

কাজী আলিম-উজ-জামান উপবার্তা সম্পাদক, প্রথম আলো
ই–মেইল: [email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ট র জন য এই শহর অন ক ই ফ টপ ত আম দ র ই শহর ব যবস শহর র শহর য

এছাড়াও পড়ুন:

খাগড়াছড়িতে সাংবাদিক মিলন ত্রিপুরার ওপর হামলার অভিযোগ তদন্তের আহ্বান সিপিজের

খাগড়াছড়িতে সাংবাদিক মিলন ত্রিপুরার ওপর হামলার অভিযোগ তদন্ত করতে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার বৈশ্বিক সংগঠন কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)। দোষীদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে বলে উল্লেখ করেছে সংগঠনটি।

মঙ্গলবার সিপিজের এক টুইটে এ আহ্বান জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ডিবিসি নিউজের প্রতিনিধি মিলন ত্রিপুরা ১৭ জুলাই একটি বিক্ষোভের সংবাদ সংগ্রহ করছিলেন। এ সময় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে মারধর করেন ও ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ মুছে ফেলতে বাধ্য করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ