আউটসোর্সিং, তুঘলকি নিয়োগ–বাণিজ্য ও সংস্কারের জাতপাত
Published: 27th, July 2025 GMT
জুলাই অভ্যুত্থানের পর আমরা বিভিন্ন ইস্যুতে হাজার হাজার মানুষকে রাস্তায় দেখছি আন্দোলন করতে। এর মধ্যে প্রায় ২০ হাজার মানুষ আন্দোলন করেছে ‘আউটসোর্সিং’ নামের এক নিয়োগপদ্ধতির বিরুদ্ধে। কারা আন্দোলন করছেন, কেন করছে, বুঝে উঠতে সময় লাগে। আউটসোর্সিং কি খারাপ? এই লোকগুলো কারা, কী চান? তাঁরা কি সরকারি চাকরিতে স্থায়ী হতে চান? রাজস্বকরণ মানে কী?
প্রথমেই মনে হবে, সরকার আর কত চাকরি দেবে? হাসিনা লুটেপুটে নিয়ে গেছে রাজকোষ, এত এত দাবিদাওয়া—একদিকে তথ্য আপারা দুই মাস ধরে বসে আছেন প্রেসক্লাবের সামনে, আরেক দিকে সচিবালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরাও আন্দোলন করছেন, সবাই চাকরি স্থায়ী করতে চান, রাজস্বকরণ চান, সরকার কি মামাবাড়ি!
জুলাই ও সরকারি চাকরি
সরকার ব্যস্ত জুলাই নিয়ে। জুলাইয়ের তোরণ, জুলাইয়ের ড্রোন, জুলাইয়ের আর্ট কালচার, জুলাইয়ের চেতনা—এত বড় সব প্রজেক্ট চলছে, সংস্কার চলছে, এর মধ্যে সরকারি চাকরি নিয়ে এসব অগুরুত্বপূর্ণ শ্রেণির লোকজনের আহাজারি-আন্দোলন কিছুটা বিরক্তিকরই!
আচ্ছা, জুলাই অভ্যুত্থানের শুরুটা যেন কী নিয়ে ছিল? কারা কিসের উদ্দেশ্যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন? সরকারি চাকরিতে নিয়োগের বৈষম্য নিয়ে কারা যেন মাটি কামড়ে আন্দোলন করছিলেন? আওয়ামী লীগ বলল, এরা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজাকারের সন্তান, আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর বিসিএস প্রজন্ম, খালি সরকারি চাকরি চায়।
আমরা বললাম, দেশে কর্মসংস্থান নেই, বিনিয়োগ নেই, ৮৬ ভাগ মানুষ ইনফরমাল খাতে কাজ করে, ব্যাংকগুলোর অবস্থা ভঙ্গুর, ২ শতাংশ হারে কর্মসংস্থান কমছে, লাখ লাখ সার্টিফিকেটধারী তরুণ বেকার বসে আছেন; বাংলাদেশের ‘জবলেস গ্রোথ’ বাস্তবতায় সরকারি চাকরি ‘ক্রেইজ’ নয়; বরং সরকারি চাকরির জন্য ছাত্ররা আন্দোলন করবেন, এটাই স্বাভাবিক।
এখন যেহেতু অভ্যুত্থান-পরবর্তী বিপ্লবী চেতনা বাস্তবায়ন চলছে, বিরাট বিরাট সংস্কার চলছে, তাহলে এখন সরকারি চাকরিতে বৈষম্য আর নিয়োগ–বাণিজ্যের আলাপটা স্রেফ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল কেন? ছাত্রদের সরকারি চাকরির আন্দোলন ঐতিহাসিক ঘটনা আর ‘চতুর্থ শ্রেণির ছোট ছোট’ লোকদের চাকরি বাঁচানোর আন্দোলন আজাইরা?
আরও পড়ুন‘জবের বন্যা’ বনাম হাজার হাজার ছাঁটাই ও বুলডোজারতন্ত্র১৮ মে ২০২৫‘আউটসোর্সিং’ নিয়োগে ঘুষ-দুর্নীতির অবাধ সুযোগ
সরকারি হাসপাতাল, সরকারি ব্যাংক, ঢাকা ওয়াসা, পল্লী বিদ্যুৎ বা ডেসকোর মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঠিকাদারি কোম্পানির মাধ্যমে সরকারি নিয়োগের এই চর্চা শুরু হয়েছিল আওয়ামী লীগ আমলে ব্যয়ভার ও ঝামেলা কমানোর নামে। ব্যয়ভার তো কমেইনি; বরং নিম্ন আয়ের মানুষকে চাকরি দেওয়ার নামে শুরু হলো শতকোটি টাকার এক ভয়াবহ নিয়োগ–বাণিজ্য। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একটু কথা বললেই খোঁজ মিলবে এক তুঘলকি কাণ্ডের।
সরকারের এই কাজগুলো মূলত স্থায়ী কাজ, অথচ নিয়োগ হয় ঠিকাদারের খেয়ালখুশি তো। চুক্তিপত্রে লেখা থাকে ১৫ হাজার টাকা আর কর্মচারী বেতন পান ৮ হাজার টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ নেওয়া হয় ৩০০ কর্মীর, অথচ নিয়োগ পান ২০০ জন। সেই ২০০ জনকে দিয়ে আবার ৩০০ জনের কাজ করানো হয় আর বাকিদের বেতন কোথায় যেন হাওয়া হয়ে যায় (দেখুন, ‘আউটসোর্সিং-কর্মীদের বেতনে পেট ভরছে ঠিকাদারের’, যুগান্তর, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫)।
সব মিলিয়ে একদিকে পাবলিকের টাকা লুট, আরেক দিকে শ্রম আইনের কী মারাত্মক লঙ্ঘন! যেহেতু ঠিকাদারি বন্দোবস্ত, তাই সরকারের কোনো দায় নেই। বর্তমানে এই মাফিয়া চক্রের খপ্পরে পড়েছেন দেশের প্রায় সাত লাখ সরকারি কর্মচারী।
একটি সরকারি হাসপাতালে পরিচ্ছন্নতাকর্মী লাগবেই, ওয়ার্ডবয় লাগবেই, আয়া লাগবেই। সরকারি ব্যাংকগুলোতে নিরাপত্তা প্রহরী লাগবেই। পল্লী বিদ্যুতে লাইনম্যান লাগবেই। ডেসকো, ডিপিডিসিতে মিটার রিডার লাগবেই। ঢাকা ওয়াসায় পাম্প অপারেটর লাগবেই।
এগুলো সরকারের স্থায়ী এবং চলমান কার্যক্রম। শুরুতে ‘অ্যাডহক’ নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে; কিন্তু একদল কর্মী চার-পাঁচ বছর ধরে ঝাড়ু দেবেন, পাহারা দেবেন, পাম্প চালাবেন, ঝুঁকি নিয়ে বিদ্যুতের খুঁটি মেরামত করবেন, রোগীর পায়খানা সাফ করবেন, অথচ কয়েক বছর পরপর পুরোনো গার্ড, পুরোনো লাইনম্যান, পুরোনো ক্লিনার, পুরোনো আয়া-বুয়াকে স্রেফ ছুড়ে ফেলে দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে নতুন লোক নিয়োগ দেওয়া হবে, এর মানে কী?
নতুন করে লোক নিতে গেলে সরকারের খালি থাকা পাঁচ লাখ পদে নিয়োগ দিন। প্রাইমারি শিক্ষক পদ খালি, জেলা–উপজেলায় নার্সের পদ খালি, রেলওয়ের অর্ধেক পদই খালি। খালি পদ খালিই থাকে; আর ভরা পদে বারবার নিয়োগ হয়! তা কোটি কোটি টাকার ভাগ কে কে পান?
আরও পড়ুন‘গরিবের দেশে’ ধনী কীভাবে আরও ধনী হয়১৮ মার্চ ২০২৪‘তথ্য আপা’দের সঙ্গে একই কাঠামোগত অন্যায়
তথ্য আপারা কারা? তাঁরা গ্রামগঞ্জের নারীদের জরুরি সেবা দেন। বাল্যবিবাহ ঠেকান, মার খাওয়া নারীকে থানায় নিয়ে যান, জিডি করেন, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে দেন, ফরম পূরণ করে দেন (নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন তাঁরা নিয়োগ পেয়েছেন।) এসব কাজ কি ‘অ্যাডহক’ কাজ? ছুটকা কাজ? এনজিওর মতো ফান্ড শেষ, চাকরিও শেষ, ১০ বছর সার্ভিস দেওয়ার পর ‘টাটা বাই বাই?’
অথচ গ্রামের নারীদের জীবনে এ ধরনের সেবার চাহিদা অপরিহার্য। আন্দোলন চলার সময়ে দেখেছি, তথ্য আপাদের কাছে গ্রামের মেয়েরা ক্রমাগত ফোন করেন—আপা, আব্বু জোর করে বিয়ে দিতে চাচ্ছেন। আপা, আমার মেয়েটাকে যৌতুকের জন্য মেরেছে; আপা আমার পরীক্ষার ফরমটা পূরণ করে দেন।
গ্রামীণ মেয়েদের সঙ্গে তথ্য আপাদের সম্পর্কটা নির্ভরতার, ভরসার। অথচ এখন মন্ত্রণালয় বলছে, এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ, নতুন ‘ফেজ’ শুরু হবে আউটসোর্সিং কোম্পানির মাধ্যমে পরীক্ষা দিয়ে নতুন করে আসতে হবে; কিন্তু ১০ বছর ধরে মাঠেঘাটে কাজ করে দক্ষ হওয়া জনবলকে নতুনদের সঙ্গে পরীক্ষা দিয়ে প্রতিযোগিতা করতে হবে কেন (তা ছাড়া চাকরির চুক্তিতেই লেখা ছিল পাঁচ বছর পর রাজস্বকরণ হবে)।
প্রকল্পের জন্য বাজেট নেই এমন তো নয়। সম্প্রতি একই ধরনের একাধিক প্রকল্প ছাড় পেয়েছে একই মন্ত্রণালয় থেকে। এই ‘তথ্য আপা’ প্রকল্পেরও তৃতীয় ধাপ শুরু হচ্ছে, খরচ ধরা হয়েছে ৭০০ কোটি টাকা। আউটসোর্সিং কোম্পানিগুলোকে নতুন ‘তথ্য আপা’ নিয়োগের জন্য সরকার মোটা অঙ্কের কমিশনও দেবে।
তথ্য আপারা ভালো করেই জানেন, এটা নিয়োগ–বাণিজ্যের কারবার। তাঁরা বলছেন, ‘আমরা ১০ বছর মাঠে কাজ করেছি, আমরা দক্ষ। আমরা লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়ে আবার নতুন করে ঢুকব কেন?’
আমরা শুরুতে ভেবেছিলাম, তথ্য আপাদের এই আন্দোলন একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। পরে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোল। দেখা গেল, সরকারের সব দপ্তরেই চলছে এই লাগামহীন নিয়োগ–বাণিজ্য।
আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, এই নিয়োগ–বাণিজ্যে রাঘববোয়াল থেকে পুঁটিমাছ সবাই জড়িত। অর্থাৎ আউটসোর্সিং কোম্পানি, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়—সবাই ভাগ পায়। গরিব মানুষের কাছ থেকে টাকা নেবে, কয়েক বছর পরপর ছাঁটাই করবে, তারপর আবার নতুন নিয়োগ, নতুন ঘুষ।
এদিকে ঢাকা ওয়াসা এবং বিদ্যুৎ বিভাগের আউটসোর্সিং কর্মীরা বলছেন, তাঁরা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ সব কাজ করেন; কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাঁদের নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা রাখে না। বাস্তবে সরকারের ‘ইমার্জেন্সি’ কাজ হলেও ঠিকাদারি কোম্পানি চুক্তি করেছে বলে মন্ত্রণালয়গুলো কোনো দায় নেয় না। আউটসোর্সিং কর্মচারী ঐক্য পরিষদ তাই দাবি করছে, সরকারি ‘স্থায়ী’ কাজের ক্ষেত্রে আউটসোর্সিং প্রথাটাই বাতিল করা হোক। মন্ত্রণালয় সরাসরি নিয়োগ দিক।
আরও পড়ুনখাওয়ার স্যালাইনের অনন্য অর্জনটি যেন হারিয়ে না যায়১৫ জানুয়ারি ২০২৫আওয়ামী ট্যাগিংয়ের রাজনীতি
ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে ঝাড়ুদার, ক্লিনার ও ওয়ার্ডবয়দের সঙ্গে কথা বলুন। তাঁরা সবাই নিয়োগ পেয়েছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। সবাই গরিব পরিবারের সন্তান। গয়না, গরু আর ফসলি জমি বেচে দু-তিন লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছেন; কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানের পর একটি বড় অংশই আওয়ামী ট্যাগিং খেয়ে চাকরিচু৵ত হয়েছে। অথচ কারও বিরুদ্ধেই সুস্পষ্ট কোনো অভিযোগ নেই। এভাবে অভ্যুত্থানের পর তৃণমূলের কর্মীদের আওয়ামী ‘ট্যাগিং’ দিয়ে চাকরিচ্যুত করা একটি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
এদিকে নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বলেছেন, ‘তথ্য আপা’ একটি আওয়ামী আবর্জনা। প্রশ্ন ওঠে, আওয়ামী আবর্জনা তো এই সম্পূর্ণ শাসনকাঠামোটাই। মাননীয় উপদেষ্টারা আওয়ামী আমলের সুবিধাপ্রাপ্ত আমলা সচিবদের সঙ্গে বসেই তো কাজ করেন, বাজেট করেন, লাঞ্চ করেন। তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ আছে, দুদকেও অভিযোগ আছে। তো এই সচিব–উপসচিবেরা আওয়ামী আবর্জনা নন?
প্রভাবশালী আওয়ামী আমলাদের সঙ্গে ওঠাবসা করা যাবে, অথচ জেলা–উপজেলায় গ্রামগঞ্জে কাজ করা হাসপাতালের ওয়ার্ডবয়, তথ্য আপা, বিদ্যুৎমিস্ত্রি, লাইনম্যান, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের আওয়ামী ট্যাগিং দিয়ে চাকরিচ্যুত করা হবে? দুর্নীতি আর শোষণের কাঠামোতে হাত না দিয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে বসে মাঠের কর্মীদের ঘন ঘন ছাঁটাই করে আওয়ামী স্টাইলের কোটি টাকার নিয়োগ–বাণিজ্যের কাঠামোকে অক্ষত রেখে তাঁরা আওয়ামী আবর্জনার বিরুদ্ধে ক্রুসেডে নেমেছেন? এভাবে সংস্কার হয়?
আউটসোর্সিং করলে কি ব্যয়ভার কমে?
সরকারি সেবার আউটসোর্সিংটা শুরু হয় মূলত আশির দশকে পশ্চিম ইউরোপে। রাষ্ট্রীয় সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন ইউনিটকে আউটসোর্সিং বা বেসরকারীকরণের মাধ্যমে তখন প্রাইভেট খাতের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছিল। শিক্ষা, স্বাস্থ৵, রেলওয়ে, কারাগারের রক্ষণাবেক্ষণ—কিছুই বাদ পড়েনি।
কিন্তু এক দশক যেতে না যেতেই সরকারি সেবার খরচ বেড়ে গেল, আর সরকারি ভর্তুকির পরিমাণও অতিরিক্ত বৃদ্ধি পেল। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিবিদেরাই তখন আউটসোর্সিং নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু করলেন।
একপর্যায়ে দেখা গেল, ব্রিটেনের রেলপথ ধাপে ধাপে আউটসোর্সিং করার পর খরচে কুলিয়ে উঠতে পারছে না প্রাইভেট কোম্পানিগুলো। শেষ পর্যন্ত রেলকার্যক্রম চালু রাখতে লোকসানি কোম্পানিগুলোকেই বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেওয়া শুরু করল ব্রিটিশ সরকার। (অ্যান্ড্রু বোম্যানের হোয়াট আ ওয়েস্ট: আউটসোর্সিং অ্যান্ড হাউ ইট গোজ রঙ প্রবন্ধে ব্রিটেনে পাবলিক খাতের আউটসোর্সিংয়ের বিপর্যয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে।)
যাহোক, পশ্চিম ইউরোপে যখন রেলপথ বেসরকারীকরণের খেসারত দিচ্ছেন জনগণ, ঠিক একই সময়ে ভারতের রেলপথের ক্ষেত্রে ঘটল উল্টো ঘটনা। বিশ্বব্যাংকের বেসরকারীকরণের চাপ এড়িয়ে তৎকালীন রেলমন্ত্রী লালুপ্রসাদ সিদ্ধান্ত নিলেন, রাষ্ট্রীয় রেল খাতের বিস্তার ঘটানো হবে। ভাড়া কমিয়ে প্যাসেঞ্জার আকর্ষণ করা হলো, নতুন বগি যুক্ত করা হলো, নতুন করে ২০ হাজার কর্মী নিয়োগ দেওয়া হলো। সুধীর কুমারের ব্যাংকক্রাপ্টসি টু বিলিয়ন: হাউ দ্য ইন্ডিয়ান রেলওয়েজ ট্রান্সফর্মড ইটসেলফ বইতে ভারতের লোকসানি রেল খাত কীভাবে লোকবল ও সেবার মান বাড়িয়ে একটি লাভজনক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো, সেই দুর্দান্ত গল্পটি আছে।
এখানে শিক্ষণীয় হলো, আউটসোর্সিং বা বেসরকারীকরণ করলেই রাষ্ট্রের ব্যয়ভার কমে, এই যুক্তির আসলে কোনো আগামাথা নেই। এটা বাজার অর্থনীতিবিদদের তৈরি করা একটি মিথ।
জনপ্রশাসনের সংস্কার কাদের জন্য
‘উন্নয়ন’–এর আমলে আমরা দেখেছি, উঁচুতলার অর্থনীতিবিদেরা মেগা প্রকল্প আর জিডিপি নিয়ে আলাপ করতেন। কয়েক কোটি চাষাভুষা, রিকশাওয়ালা, পোশাকশ্রমিক, হকার, দরজি, মিস্ত্রি বা নির্মাণশ্রমিকের জীবনমান নিয়ে তাঁদের কোনো আলাপ ছিল না।
এখন সংস্কারের (অন্তর্বর্তী সরকার) আমলেও আমরা অনেক বড় বড় বিষয় নিয়ে ব্যস্ত আছি। প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ১০ বছর না ১৫ বছর—এই সমস্যার সমাধান হলে ‘ভুখানাঙা’ বাংলাদেশের চেহারাটাই পাল্টে যাবে নিশ্চয়ই! কিন্তু হায়, সরকারি ঝাড়ুদার, মিস্ত্রি, গার্ড, পিওন, লাইনম্যান এবং আয়া-বুয়ারা যে দুইটা বছর মেয়াদও পূর্ণ করতে পারছেন না সরকারি চাকরিতে! (কোথায় প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ আর কোথায় টয়লেট পরিষ্কার করা ‘ছোটলোক’দের চাকরির মেয়াদ)।
তাহলে জনপ্রশাসন সংস্কার কি সরকারের ‘ফার্স্ট ক্লাস/সেকেন্ড ক্লাস’ নামক উঁচু শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ? এই যে ঠিকাদারি প্রথার মাধ্যমে কয়েক লাখ সরকারি আয়া, বুয়া, পিওন, মিস্ত্রি, লাইনম্যান ও বাবুর্চির নিয়োগের টাকা ভাগ করে নেওয়ার সিস্টেম—এটা কি জনপ্রশাসনের সংস্কারের আওতার মধ্যে পড়ে, নাকি পড়ে না? তাহলে ‘সংস্কার’ প্রকল্পেরও কি জাতপাত, শ্রেণিবৈষম্য আছে?
মাহা মির্জা, শিক্ষক ও গবেষক
মতামত লেখকের নিজস্ব
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব সরক র করণ ল ইনম য ন প রকল প র আউটস র স কর ম দ র সরক র র র সরক র ১০ বছর চ কর ত চ কর র ক জ কর র জন য র কর ম ক র কর আওয় ম ন করছ
এছাড়াও পড়ুন:
৪৪তম বিসিএসের ৪০০ রিপিট ক্যাডার বাদ দিচ্ছে সরকার, নতুন সিদ্ধান্ত আসছে
৪৪তম বিসিএসে পুনরাবৃত্তি হওয়া ৪০০ ক্যাডারকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। তারা ৪৩তম বিসিএসে বা আগের বিসিএসে যে ক্যাডারে আছেন ৪৪তম বিসিএসেও একই ক্যাডার পেয়েছিলেন। এই ৪০০ ক্যাডারকে নিয়ে সিদ্ধান্ত দ্রুতই হবে বলে জানিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা।
প্রথম আলোকে ওই কর্মকর্তা আজ বৃহস্পতিবার বলেন, ৪০০ ক্যাডারকে নিয়ে পিএসসির কিছু সুপারিশ আমরা পেয়েছি। এগুলো বাদ দিতে সরকার কাজ করছে। বাদ দিলে কি করা হবে তা নিয়েও কাজ করছে সরকার। এখন পিএসসিকে এ বিষয় নিয়ে একটি মতামত দিতে বলা হয়েছে। পেলেই তা পর্যালোচনা করে এ বিষয়ে প্রজ্জাপন দেওয়া হবে। এটি যাতে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয় সেজন্য আমরা কাজ করছি।
আরও পড়ুন৪৯তম বিসিএস: অনলাইন আবেদন ও ফি জমাদানে পিএসসির নতুন নির্দেশনা৩০ জুলাই ২০২৫৪৪তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল ৩০ জুন প্রকাশিত হয়। এতে বিভিন্ন ক্যাডারে ১ হাজার ৬৯০ জনকে নিয়োগের জন্য সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) সাময়িকভাবে মনোনীত করেছে।
প্রকাশিত ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১ হাজার ৬৯০ জনের মধ্যে প্রায় ৪০০ জন প্রার্থী একাধিকবার বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে একই ক্যাডারে পুনরায় সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন (রিপিট ক্যাডার)। এই ৪০০ জনের তালিকা পেয়েছে পিএসসি। এই রিপিট ক্যাডার বন্ধে বিধি সংশোধন করা হচ্ছে। এ–সংক্রান্ত চিঠি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠায় পিএসসি।
পিএসসি জনপ্রশাসনের চিঠিতে বলছে, এই রিপিট ক্যাডারের ফলে নতুন ও অপেক্ষমাণ মেধাবীরা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এটি প্রশাসনিক কাঠামো ও জনসম্পদের সদ্ব্যবহারে বাধা সৃষ্টি করছে। এখন এটি অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।
একাধিকবার বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে একই ক্যাডারে পুনরায় সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়া বন্ধ করার জন্য বিদ্যমান বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বয়স, যোগ্যতা ও সরাসরি নিয়োগের জন্য পরীক্ষা) বিধিমালা ২০১৪–এর বিধি-১৭ এর শেষে নিম্নোক্ত শর্ত যুক্ত করার প্রস্তাব করেছে পিএসসি।
আরও পড়ুনসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের ৩৪০০০ শূন্য পদ পূরণে উদ্যোগ২৯ জুলাই ২০২৫শর্তে কী আছে—পিএসসির চিঠিতে শর্ত হিসেবে বলা আছে, ‘তবে শর্ত থাকে যে এই বিধির আওতাধীন সরকারের নিকট সুপারিশ প্রেরণ করিবার প্রাক্কালে, কিংবা কোনো বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফল প্রস্তুতকালে, সংশ্লিষ্ট প্রার্থী কর্তৃক প্রদত্ত লিখিত তথ্যের ভিত্তিতে কিংবা কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত কোনো পদ্ধতির মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে যদি কমিশনের নিকট প্রতীয়মান হয় যে এই বিধির আওতাধীন মনোনয়নযোগ্য কিংবা মনোনীত কোনো প্রার্থী একই ক্যাডার পদ, সমপদ কিংবা প্রার্থীর আগ্রহ নেই এমন কোনো সার্ভিস বা ক্যাডার পদে পুনরায় মনোনীত হইবার কারণে মনোনীত সার্ভিসে বা ক্যাডার পদে যোগদান করিতে অনিচ্ছুক, এইরূপ ক্ষেত্রে কমিশন অনাগ্রহ প্রকাশকারী প্রার্থীকে এই বিধির আওতাধীন সরকারের নিকট সুপারিশ করা হইতে বিরত থাকিতে পারিবে; আরও শর্ত থাকে যে প্রথম শর্তাংশে বর্ণিত বিধান অনুযায়ী কোনো প্রার্থীকে সুপারিশ করা হইতে বিরত থাকিবার কারণে উদ্ধৃত শূন্য পদে নিয়োগের লক্ষ্যে সুপারিশ প্রেরণ করিবার জন্য উত্তীর্ণ প্রার্থিগণের মধ্য হইতে মেধাক্রম অনুযায়ী প্রার্থী নির্বাচনপূর্বক কমিশন সম্পূরক ফলাফল প্রকাশ এবং সার্ভিসে বা ক্যাডার পদে নিয়োগের জন্য সরকারের নিকট সুপারিশ প্রেরণ করিতে পারিবে;আরও অধিকতর শর্ত থাকে যে দ্বিতীয় শর্তাংশে উল্লিখিত সম্পূরক ফলাফল দ্বারা বা উহার পরিণতিতে প্রথম ঘোষিত ফলাফলে সার্ভিস বা ক্যাডার পদের জন্য মনোনীত কোনো প্রার্থীর প্রতিকূলে কোনো পরিবর্তন ঘটানো কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাইবে না।’
আরও পড়ুনবস্ত্র অধিদপ্তরে বড় নিয়োগ, চাকরির সুযোগ ১৯০ জনের২৯ জুলাই ২০২৫