আজ ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস। এ বছর বাংলাদেশে এই দিবসের প্রতিপাদ্য ‘বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি, সুন্দরবনের সমৃদ্ধি’। বাঘ বাংলাদেশের জাতীয় পশু, বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা ‘টাইগার’ নামে পরিচিত, বাঘ সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের লোগো। তাই বাংলাদেশ এ দিবসটি গুরুত্বের সঙ্গে পালন করে। বাংলাদেশে বাঘ ২০১৫–এর গণনায় ১০৬টি, ২০১৮তে ১১৪টি এবং সর্বশেষ ২০২৪–এর গণনায় ১২৫টি পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের বাঘ নানামুখী হুমকির সম্মুখীন। এরপরও বাঘের সংখ্যা যে ঊর্ধ্বমুখী, এটি আশার সঞ্চার করে। এ জন্য বন বিভাগ ও সুন্দরবনের স্থানীয় জনগণকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়।
সুন্দরবন বর্তমানে বাংলাদেশের বাঘের শেষ আশ্রয়স্থল। হরিণ বাঘের প্রধান খাদ্য। বাঘ বিজ্ঞানীরা বলেন, বাঘ শিকারের চেয়ে হরিণ শিকার বাঘের টিকে থাকার জন্য বিপজ্জনক। কারণ, পর্যাপ্ত খাবার না পেলে বাঘ দুর্বল হয়ে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা হারাবে এবং বাঘ-মানুষ সংঘাত বাড়বে।
এ মাসের ১৭ তারিখে সংবাদমাধ্যমে দেখলাম, পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের জ্ঞানপাড়া টহল ফাঁড়ির সদস্যরা একটি যাত্রীবাহী বাস থেকে ১০ কেজি হরিণের মাংসসহ দুজনকে আটক করেন। ছবিতে দেখলাম বস্তার গায়ে ঢাকার প্রাপকের নাম, ফোন নম্বর ও গন্তব্যস্থলের নাম লেখা আছে। বন বিভাগের আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও সুন্দরবনের হরিণ শিকার বন্ধ হবে না, যত দিন এর চাহিদা থাকবে অন্যত্র। অথচ সবাই মিলে বন বিভাগকেই দায়ী করবে, ভোক্তাকে নয়।
দেশে বর্তমানে অনেক হরিণের খামার হয়েছে। খামার করলে বনের হরিণের ওপর চাপ কমবে এটিই ছিল হরিণ লালন–পালনের পক্ষে মুখ্য যুক্তি। কোন বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে দেশে আজও হরিণের খামার আছে এবং বাড়ছে জানি না। সেদিন এক বন্ধু বললেন, কিছু শৌখিন মানুষ চেয়েছেন, তাই এটি হয়েছে। তবে সুন্দরবন থেকে এনে জীবন্ত হরিণ কেউ খামারে রাখবেন, এ দুঃসাহস কারও হবে না। বন্ধুকে বলতে পারিনি যে ২০১২ সারে সুন্দরবনের তিনটি বাঘের বাচ্চা তো ঢাকায় পাচার হয়েছিল। বন বিভাগের ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিটের বন্ধুরা অন্যান্য বিপন্ন প্রজাতির ভাগ্যে কী ঘটছে নিশ্চয়ই ভালো বলতে পারবেন। আমাদের সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে। ভারতে বন্য প্রাণীর খামার নিষিদ্ধ।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সুন্দরবনের চারপাশের ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ জানেন যে হরিণ শিকার এবং হরিণের মাংস ভক্ষণ আইনসম্মত নয়। এরপরও তাঁরা এ কাজটি করেন, যেহেতু হরিণের মাংস অনেক সময় অন্যান্য মাংসের চেয়ে সস্তায় পাওয়া যায়। কারণ, যিনি বিক্রি করেন, তাঁকে তো হরিণটি কিনতে হয়নি; অন্যান্য গবাদিপশু তো ক্রয় করে বিক্রয় করতে হয়। ভিয়েতনামে বন্য পশুপাখির মাংস দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করা ছিল মর্যাদার প্রতীক। ফলে ভিয়েতনাম তার শেষ বাঘটিও হারিয়েছে ২০০০ সালের দিকে।
অনেকের ধারণা, সুন্দরবনের হরিণ ব্যাপকহারে বাড়ছে এবং গুটিকয় খেলেও ওরা হারিয়ে যাবে না। তাঁদের অবগতির জন্য জানাই, উত্তর আমেরিকায় ঘুঘুর মতো দেখতে একটি কবুতর—প্যাসেঞ্জার পিজন, যার সংখ্যা ছিল ৩০০-৫০০ কোটি। এরা দল বেঁধে যখন উড়ে যেত, মনে হতো আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। আবাসস্থল নষ্ট হওয়া এবং অনিয়ন্ত্রিত শিকারের কারণে মাত্র ১০০ বছরের মধ্যে এই প্রজাতিটি পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেল।
বাঘ সুন্দরবনের জন্য একটি কিস্টোন প্রজাতি। বাঘ টিকে থাকলে সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রসহ জীববৈচিত্র্য নিজে থেকেই টিকে থাকবে, সুন্দরবন টিকে থাকবে। এলাকার জনগণ মনে করেন, ‘সুন্দরবন মায়ের মতো’—ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করে, জীবন বাঁচায়, খাদ্য জোগায়। তাঁদের মতে, বাঘ বাঁচলে সুন্দরবন বাঁচবে, সুন্দরবন বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। বন বিভাগ এবং ওয়াইল্ডটিমের সহযোগিতায় সুন্দরবনের চারপাশের গ্রামগুলোতে ৪৫০ জন স্বেচ্ছাসেবী বাঘ সংরক্ষণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এই ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিমের সদস্যরা, বাঘবন্ধুরা এবং টাইগার স্কাউটরা আমাদের সামাজিক মূলধন।
বাঘ দিবসের প্রতিপাদ্য আমাকে আশান্বিত করে। বাঘের সংখ্যা সুন্দরবনের স্বাস্থ্য নির্দেশ করে। সুন্দরবন ভালো থাকলে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে। এটি আমাদের জাতীয় সুখ সূচকের ওপরও প্রভাব বিস্তার করবে। দেশের সামগ্রিক সুখ ও মঙ্গল পরিমাপের এ ধারণাটি এসেছে ভুটান থেকে। বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধিকেও তাঁরা জাতীয় সুখ সূচকের প্রবৃদ্ধি হিসেবে দেখছেন। বাংলাদেশও সেই স্বপ্নের ‘সিল্ক রোডে’ এক পা ফেলল।
মো.
আনোয়ারুল ইসলাম, সাবেক অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ন দরবন ব স ন দরবন র বন ব ভ গ আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
সুন্দরবনের নতুন পর্যটন স্পট ‘আলী বান্দা’
পূর্ব সুন্দরবনের নিসর্গঘেরা অভয়ারণ্যে গড়ে তোলা হয়েছে নতুন পর্যটন কেন্দ্র ‘আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার’। সবুজ ম্যানগ্রোভ বনের বুক চিরে, নদীর নোনাজলে ভেসে, প্রকৃতির নীরব সৌন্দর্যে ঘেরা এই কেন্দ্রটি চলতি নভেম্বর মাস থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভ্রমণ করতে পারবেন পর্যটকরা।
পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের আওতাধীন আলী বান্দা এরইমধ্যে ভ্রমণপিপাসুদের দৃষ্টি কেড়েছে। শরণখোলা রেঞ্জ অফিস থেকে ট্রলারযোগে মাত্র ৪০ মিনিটের নৌপথ পেরিয়ে পৌঁছানো যায় সেখানে।
যাত্রাপথে চোখে পড়ে বনের গভীর সবুজ গাছগাছালি, ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাওয়া পাখি, কচুরিপানায় ঢাকা জলাশয় এবং সুন্দরী-গেওয়া গাছের সারি যা পর্যটকদের মোহিত করে।
বন বিভাগ জানিয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টারের অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হয়। এখানে তৈরি হয়েছে ছয়তলা ভবনের সমান উচ্চতার একটি ওয়াচ টাওয়ার, যেখান থেকে সুন্দরবনের বিস্তৃত সবুজাভ দৃশ্য চোখে ধরা পড়ে।
রয়েছে দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ ফুট ট্রেইল (ওয়াকওয়ে)। পথের দুই পাশে ঘন বনের মাঝে হাঁটলে দেখা যায় প্রকৃতির আসল রূপ। এছাড়া রয়েছে মিষ্টি পানির পুকুর, হরিণ রাখার সেড, জেটি, বিশ্রামাগার, সুভেনিয়ার শপ এবং পর্যটকদের নিরাপত্তায় বনরক্ষী ও স্থানীয় গাইডের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আলীবান্দা বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোর মানুষের জন্য সবচেয়ে সহজগম্য স্পট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কম সময় ও কম ঝুঁকিতে সুন্দরবনের সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে এখানে। স্থানীয় পর্যটকরা এরইমধ্যে আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা শাহিন বলেন, “আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার চালু হলে স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে স্থানীয় গাইড, নৌযানচালক, হোটেল ব্যবসায়ী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কর্মসংস্থান বাড়বে। পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব পর্যটনের মাধ্যমে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সচেতনতা বাড়বে।”
তবে পর্যটনকেন্দ্রে প্রবেশ ফি নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে। আলীবান্দায় প্রবেশের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৪৫ টাকা।
শরণখোলা ট্যুরিজম অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক রাসেল বয়াতী বলেন, ‘‘আলীবান্দায় প্রবেশ ফি ৩৪৫ টাকা, অথচ একই বনের করমজল পর্যটন পয়েন্টে ফি মাত্র ৪৬ টাকা। অনেকেই আলীবান্দায় যেতে আগ্রহী, কিন্তু ফি বেশি হওয়ায় নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।’’
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, “আলীবান্দা এখন প্রায় প্রস্তুত। চলতি মাসেই এখানে হরিণ আনা হবে। বর্তমানে পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে স্পটটি। যেহেতু এটি ২০১৭ সালে ঘোষণা করা অভয়ারণ্য এলাকার অন্তর্ভুক্ত, তাই সাধারণ বনাঞ্চলের তুলনায় কিছু বিধিনিষেধ ও প্রবেশ ফি বেশি রাখা হয়েছে। তবে পর্যটকদের দাবির বিষয়টি আমরা সরকারের কাছে জানাব।’’
ঢাকা/শহিদুল/এস