বরিশাল বিভাগে ডেঙ্গু সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। বিশেষ করে বরগুনায় গত তিন মাস ধরে উচ্চ সংক্রমণের হার বিরাজ করায় পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন স্বাস্থ্য বিভাগ। চলতি জুলাই মাসে ধারাবাহিক বৃষ্টির পর সংক্রমণ আরও মারাত্মক রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্র বলছে, বিভাগে চলতি বছর ডেঙ্গু রোগী আট হাজার ছুঁই ছুঁই। মঙ্গলবার পর্যন্ত বিভাগে ৭ হাজার ৯০৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৪ হাজার ৬৬৩ জন বরগুনার রোগী। সরকারি হিসাবে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ছয়জন বরগুনা জেলার বাসিন্দা। এ ছাড়া হাসপাতাল থেকে বাড়িতে কিংবা অন্য হাসপাতালে নেওয়ার পথে জেলার আরও ছয়জনের মৃত্যুর তথ্য আছে, যা সরকারি নথিপত্রে নেই।

সর্বশেষ গত রোববার রাতে সেলিম মিয়া (৭০) নামের এক রোগী বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তিনি বরগুনা সদর উপজেলার বাসিন্দা। দুই দিন আগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে তিনি হাসপাতালে এসেছিলেন। এর আগে ১৫ জুলাই রাতে একজন ও ৭ জুলাই দুজন রোগীর মৃত্যু হয়েছিল।

স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, মে মাসের শুরু থেকেই বরগুনায় ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিস্তার ঘটে। এখনো জেলায় ধারাবাহিকভাবে ডেঙ্গুর উচ্চ সংক্রমণ চলছে। কিছুতেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। বিভাগে এখন পর্যন্ত সরকারি হিসাবে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর প্রায় ৫৯ শতাংশই শনাক্ত হয়েছে এ জেলায়, যার ধারাবাহিকতা এখনো অব্যাহত আছে।

বরগুনায় আগে কখনো ডেঙ্গুর এমন ধারাবাহিক ও উচ্চ সংক্রমণ দেখা যায়নি। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) জুনের মাঝামাঝি বরগুনায় এডিস মশার লার্ভা জরিপ কার্যক্রম চালায়। গত ২৬ জুন এক সংবাদ সম্মেলনে আইইডিসিআর সেই জরিপের ফলাফল প্রকাশ করে।

জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বরগুনা পৌরসভার ৩১ শতাংশ এবং গ্রামাঞ্চলের ৭৬ শতাংশ বাড়িতে ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিসের লার্ভা পাওয়া গেছে। জরিপ দল বরগুনার ১৮৪টি ঘর থেকে উপাত্ত সংগ্রহ করে। এর মধ্যে ১৩৮টি বরগুনা পৌরসভার ও বাকি ৪৬টি সদর উপজেলার গৌরীচন্না ইউনয়নের বিভিন্ন গ্রামের। এর মধ্যে পৌর এলাকার ৪৩টি বাড়িতে এবং গ্রামের ৩৫টি বাড়িতে এডিসের লার্ভা পাওয়া যায়।

এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের স্বীকৃত পদ্ধতি হলো ‘ব্রুটো ইনডেক্স (বিআই)’। যদি বিআই ২০ বা তার বেশি হয়, তবে সেখানে এডিসের লার্ভার উচ্চ উপস্থিতি আছে বলে ধরা হয়। বরগুনা পৌরসভায় ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৭ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডে বিআই যথাক্রমে ১৫৩ ও ১৩৩। আর গ্রামাঞ্চলে বিআই হলো ১৬৩। আইইডিসিআরের মেডিকেল সোশ্যাল সায়েন্স বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা রত্না দাশের নেতৃত্বে এ জরিপ চালানো হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল সোমবার সকাল আটটা থেকে আজ মঙ্গলবার সকাল আটটা পর্যন্ত বিভাগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১০১ জন। এর মধ্যে ৫৬ জনই বরগুনার ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এ ছাড়া বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৯ জন, বরিশালের অন্য হাসপাতালে ৬ জন, পটুয়াখালীতে ২৩ জন, পিরোজপুরে ৪ জন, ভোলায় ৩ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। তবে ঝালকাঠিতে কোনো রোগী শনাক্ত হয়নি। বর্তমানে বিভাগের সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন ৩১৬ জন। এর মধ্যে সর্বোচ্চ বরগুনার ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ১৪৭ জন চিকিৎসাধীন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় পরিচালক শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, বিভাগের অন্য জেলায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও বরগুনায় প্রায় তিন মাস ধরে ডেঙ্গু সংক্রমণ ভয়াবহ অবস্থায় আছে। কোনোভাবেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এ ছাড়া জুলাই মাসে বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। এতে পরিস্থিতি আরও নাজুক হওয়ার আশঙ্কা আছে। তাঁরা রোগীদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসার সব ধরনের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ডেঙ্গুবাহিত মশার বিস্তার যেভাবে ঘটছে, তাতে নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও সচেতনতার বিকল্প নেই।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পর স থ ত বরগ ন য় স ক রমণ বরগ ন র বর শ ল সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

মশা নিধনে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে

চট্টগ্রামে এডিস মশার প্রজনন ও লার্ভার ঘনত্ব গত এক বছরে দ্বিগুণ হয়েছে, আর এর সরাসরি ফল ভোগ করছেন নগরবাসী। স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মতে, এবার ডেঙ্গুর চেয়েও চিকুনগুনিয়া ঘরে ঘরে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, যা এক নতুন উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। মশা নিধনে কার্যকর ও সমন্বিত উদ্যোগের অভাবই এ রোগের দ্রুত বিস্তারের প্রধান কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। চট্টগ্রামে এভাবে জনস্বাস্থ্য ভেঙে পড়ার বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক।

রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, চট্টগ্রাম নগর এডিস মশাবাহিত রোগের জন্য এখন অতি ঝুঁকিপূর্ণ। গত বছর সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগ একই ধরনের জরিপ চালিয়েছিল। এই দুই জরিপের তুলনামূলক চিত্র আমাদের সামনে এক ভয়াবহ বাস্তবতা তুলে ধরে—এডিস মশার প্রজনন ও লার্ভার ঘনত্ব দুটিই আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।

২০২৪ সালে চট্টগ্রামে এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব (ব্রুটো ইনডেক্স) ছিল ৩৬ শতাংশ, যা এবার আইইডিসিআরের গবেষণায় পৌঁছেছে ৭৫ দশমিক ২৯ শতাংশে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান যেখানে ২০ শতাংশ, সেখানে চট্টগ্রামের এ চিত্র রীতিমতো ভয়াবহ। বাসাবাড়িতেও লার্ভার উপস্থিতি বেড়েছে। গত বছর ৩৭ শতাংশ বাড়িতে লার্ভা পাওয়া গেলেও এবার তা প্রায় ৪৮ শতাংশে পৌঁছেছে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবার ডেঙ্গুর চেয়ে চিকুনগুনিয়ার রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে। আবার অনেকের ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া দুটিই হচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জিকা ভাইরাসের উপস্থিতি, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। চলতি বছরেই ৭৬৪ জনের চিকুনগুনিয়া ও ৭৯৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে এবং ডেঙ্গুতে আটজন প্রাণ হারিয়েছেন, যার মধ্যে ছয়জনই মারা গেছেন এই জুলাই মাসে।

সিভিল সার্জন জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, আইইডিসিআরের সুপারিশগুলো সিটি করপোরেশন ও জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠানো হয়েছে এবং সে অনুযায়ী কাজ চলছে। সিটি করপোরেশনের মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম দাবি করছেন যে মশকনিধনে ক্রাশ কর্মসূচি চলছে এবং নতুন জরিপ অনুযায়ী হটস্পট ধরে কাজ করা হচ্ছে। তবে প্রশ্ন হলো এ উদ্যোগগুলো কি যথেষ্ট? লার্ভার ঘনত্ব যেখানে তিন-চার গুণ বেশি, সেখানে গতানুগতিক কর্মসূচির ওপর নির্ভর করলে চলবে না।

মশাবাহিত রোগ থেকে মুক্তি পেতে হলে মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করার কোনো বিকল্প নেই। এ কাজে সিটি করপোরেশনকে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে হবে। বাসাবাড়িতে নানা জায়গায় জমে থাকা স্বচ্ছ পানিও এডিস মশার প্রজননের জন্য যথেষ্ট। ফলে নাগরিকদের সচেতনতা এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রাম শহরকে মশাবাহিত রোগের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করতে হলে স্থানীয় প্রশাসন, নগর কর্তৃপক্ষকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে; নগরবাসীকে দ্রুত তৎপর হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • মশা নিধনে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে
  • চট্টগ্রামে এক বছরে দ্বিগুণ হয়েছে এডিস মশার লার্ভা