বাঘ রক্ষায় সুন্দরবনের চারপাশে হবে সুরক্ষাবলয়: পরিবেশ উপদেষ্টা
Published: 29th, July 2025 GMT
বাঘ পাচারকারী ও চোরা শিকারিদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে দাঁড়াতে হবে। বাঘ পাচারে জড়িতদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে তালিকা তৈরি করে বিকল্প জীবিকার পথ তৈরি করতে হবে। এ ছাড়া বাঘ রক্ষায় সুন্দরবনের চারপাশে একটি সুরক্ষাবলয় গড়ে তোলা হবে।
বিশ্ব বাঘ দিবস-২০২৫ উপলক্ষে আজ মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বন ভবনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ভার্চ্যুয়ালি দেওয়া বক্তব্যে এ কথা বলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘বাঘ শুধু একটি বন্য প্রাণী নয়, এটি বাংলাদেশের গর্ব ও জাতিসত্তার প্রতীক। যেমন আমরা সুন্দরবন নিয়ে গর্ব করি, তেমনি গর্ব করি রয়েল বেঙ্গল টাইগার নিয়েও। সাহস, ভালোবাসা ও বীরত্বের প্রতীক হিসেবে আমরা বাঘকে দেখি। ক্রিকেটারদের “টাইগার”নামে ডাকাও সেই আবেগের বহিঃপ্রকাশ।’
বাঘের মৃত্যু ও পাচারের মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে মন্তব্য করে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, মানুষ-বাঘ দ্বন্দ্বও বেড়েছে। এ জন্য সুন্দরবন-সংলগ্ন এলাকায় সামাজিক সুরক্ষাবলয় গড়ে তোলার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।
সুন্দরবনে অপরাধ বৃদ্ধির বিষয়টি তুলে ধরে চোরাকারবারি ও কাদের বিকল্প জীবিকা দরকার, সেটার তালিকা তৈরি করে তাদের সে পথ থেকে ফিরিয়ে আনার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন রিজওয়ানা হাসান।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ফারহিনা আহমেদ বাঘ সংরক্ষণে তাঁর মন্ত্রণালয়ের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বাঘ সংরক্ষণে নিয়োজিত সংস্থা ওয়াইল্ড টিমের প্রধান নির্বাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মো.
সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, ‘আমাদের ওয়াইল্ড টিমে ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম আছে ৪৯টি, যার সদস্যসংখ্যা ৩৪০। এ ছাড়া ফরেস্ট টাইগার রেসপন্স টিম, বাঘবন্ধু ও টাইগার স্কাউট আছে আমাদের।’ স্থানীয় জনগণকে যুক্ত করা ছাড়া বাঘ সংরক্ষণের সংকট কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বাঘ বিশেষজ্ঞ এম এ আজিজ বলেন, ‘কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও লাউস—এ তিনটি দেশ থেকে বাঘ হারিয়ে গেছে। তার বিপরীত চিত্র হচ্ছে ভারত ও নেপালে। সেখানে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে। আমাদের ২০২৪ সালের জরিপে বাঘের সংখ্যা ৮ শতাংশ বেড়েছে। এরপরও অনেক চ্যালেঞ্জ আছে।’
বাঘ সংরক্ষণে সুন্দরবনের ভেতরে ও বাইরে বাঘের ছয়টি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেন এই বিশেষজ্ঞ। হরিণ শিকার, বাঘের খাদ্য হিসেবে যেসব প্রাণী (প্রে স্পেসিস) আছে, সেগুলোর সংখ্যা কমে যাওয়া, সুন্দরবনের লবণাক্ততার প্রকোপ, উজানে পানি কমে যাওয়া ও বনজীবীদের বিকল্প জীবিকার অভাব—এগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে বিবেচনায় নিয়ে বাঘ সংরক্ষণের পরিকল্পনা নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, লোকালয়ে এসে মানুষের হাতে বাঘ মারা পড়ার ঘটনা ঘটছে। বাঘ ও মানুষের সংঘাত বন্ধ করতে লোকালয় ও বনের মাঝে যে নাইলনের ব্যারিয়ার (লোকালয়ে বাঘের প্রবেশ ঠেকাতে দেওয়া প্রতিবন্ধকতা) দেওয়া হয়েছে, সেটা এখন ভালো কাজ করছে। বাঘ ও মানুষের সহাবস্থানের সহায়ক পরিবেশ তৈরি হচ্ছে।
বন অধিপ্তরের এই শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, এটি বাঘের জন্য একটা সাইকোলজিক্যাল ব্যারিয়ার (মনস্তাস্ত্বিক বাধা) হিসেবে কাজ করছে। জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারায় এখন আগের চেয়ে বাঘ পাচারও কমে এসেছে।
অনুষ্ঠানটি যৌথভাবে সঞ্চালনা করেন বন অধিদপ্তরের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা সৈয়দ মাহমুদুর রহমান ও রাবেয়া আক্তার। সকাল ১০টার দিকে অনুষ্ঠান শুরু হয় সুন্দরবন এলাকার ঐতিহ্যবাহী গান পটুয়া সংগীত দিয়ে। এরপর সুন্দরবনের ওপর দুটি বই ‘সুন্দরবনের সংঘাতপ্রবণ বাঘ ব্যবস্থাপনা নির্দেশিকা’ ও টাইগারস অব দ্য সুন্দরবন’–এর মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
বন্য প্রাণিবিশেষজ্ঞ ও দুবাই সাফারি পার্কের সাবেক প্রিন্সিপাল ওয়াইল্ডলাইফ স্পেশালিস্ট মোহাম্মদ আলী রেজা খান; খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ; বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক মো. ছানাউল্যা পাটওয়ারী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ন দরবন র অন ষ ঠ ন পর ব শ
এছাড়াও পড়ুন:
এক দশকে ১ লাখ হেক্টর বনভূমি কমেছে
দেশে এক দশকে বনভূমি হ্রাস পেয়েছে ১ লাখ ১ হাজার হেক্টর, যা ঢাকা শহরের আয়তনের প্রায় সাড়ে তিন গুণ। গত এক দশকে দেশ থেকে হারিয়ে গেছে ৬৪ প্রজাতির গাছ।
সারা দেশে বনাঞ্চলে যে পরিমাণ গাছ আছে, গ্রামাঞ্চলে গাছের সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। তবে গ্রামে গাছের ঘনত্ব কম। আর বন উজাড় বেশি হয়েছে পার্বত্যাঞ্চলে। সেখানে একমুখী প্রজাতির ফসল চাষের প্রসার ও সড়ক সম্প্রসারণের কারণে বন উজাড় হচ্ছে।
বনের সার্বিক চিত্র জানতে ২০২৪ সালে বন অধিদপ্তরের করা জাতীয় বন জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। জরিপটি প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।
পার্বত্য অঞ্চলে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। সেটাকে মাথায় রেখে আমরা একটা পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছি। বান্দরবানের লামা অঞ্চল দিয়ে ফরেস্ট রিস্টোরেশনের (বন পুনরুদ্ধার) কাজ শুরু করব আমরা।সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, উপদেষ্টা, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়২০১৫ সালে জাতীয় বন জরিপে বন আচ্ছাদনের পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ৭৬ শতাংশ, সেটি এখন কিছুটা হ্রাস পেয়ে ১২ দশমিক ১১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক বন জরিপে দেশে বনভূমি আছে ১৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর। আগের বন জরিপে যেটির পরিমাণ ১৮ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর।
জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পার্বত্য অঞ্চলে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। সেটাকে মাথায় রেখে আমরা একটা পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছি। বান্দরবানের লামা অঞ্চল দিয়ে ফরেস্ট রিস্টোরেশনের (বন পুনরুদ্ধার) কাজ শুরু করব আমরা।’
‘জীববৈচিত্র্য রক্ষা, অবক্ষয়িত বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা’র আহ্বান জানিয়ে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ দিবস। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৭২ সালে এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক দিবসের মর্যাদা দেয়।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ফাওয়ের তথ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিকভাবে বন উজাড়ীকরণের হার ১ দশমিক ১ শতাংশ হলেও বাংলাদেশে সেটি ২ দশমিক ৬ শতাংশ।
বন অধিদপ্তরের ২০টি দল মাঠপর্যায়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ শুরু করে ২০২৪ সালের মার্চে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে তাদের তথ্য সংগ্রহ শেষ হয়। উপকূলীয় বন, শালবন, সুন্দরবন, পার্বত্যাঞ্চল ও গ্রামীণ এলাকায় মোট ১ হাজার ৮৫৮টি নমুনা প্লটের ভিত্তিতে এ জরিপের ফলাফল নির্ধারণ করা হয়েছে।
জরিপে দেশে প্রতি হেক্টরে গাছের ঘনত্ব পাওয়া গেছে ১১৭টি। সবচেয়ে বেশি গাছের ঘনত্ব আছে সুন্দরবনে। এখানে গাছের ঘনত্ব প্রতি হেক্টরে ৭০২টি। বনাঞ্চলের চেয়ে গ্রামীণ এলাকায় গাছের ঘনত্ব কম হলেও মোট গাছের পরিমাণ বেশি। গ্রামীণ এলাকায় মোট গাছের সংখ্যা প্রায় ৯০ কোটি।
২০১৫ সালের বন জরিপে গাছের সংখ্যা ছিল ১৬৯ কোটি। সাম্প্রতিক জরিপে সেটা কিছুটা কমে হয়েছে ১৫৭ কোটি। গত এক দশকে হ্রাস পাওয়া গাছের সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি। জরিপে সারা দেশে ৩২৬টি গাছের প্রজাতি শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২৪২টি প্রজাতি পাওয়া গেছে পার্বত্যাঞ্চলে। সুন্দরবনে পাওয়া গেছে ২২ প্রজাতির গাছ। এর আগে বন জরিপে (২০১৫) ৩৯০ প্রজাতির গাছ শনাক্ত করেছিল বন অধিদপ্তর। গত এক দশকে হারিয়ে গেছে ৬৪ প্রজাতির বৃক্ষ।
কেন কমছে পার্বত্যাঞ্চলের বন
২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ডারউইন ইউনিভার্সিটি পরিচালিত এক গবেষণায় পার্বত্যাঞ্চল বাংলাদেশের মোট বন আচ্ছাদনের ৪০ শতাংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে দ্রুত প্রসার ঘটছে অর্থকরি ফলের চাষ (হর্টিকালচার) ও একমুখী প্রজাতির বনায়ন (মনোকালচার), যেমন রাবারবাগান।
জানতে চাইলে জাতীয় বন জরিপের সঙ্গে যুক্ত থাকা বন অধিদপ্তরের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (সদ্য অবসরপ্রাপ্ত) জহির ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে বৈধ ও অবৈধভাবে বন উজাড় হয়ে আসছে। এখানে একদিকে বন উজাড় হচ্ছে, অন্যদিকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কারণে বনায়ন করা যায় না। যার কারণে এখানে বনভূমি হ্রাস পাওয়ার পরিমাণ বেশি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অধ্যাপক কামাল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে বন বিভাগ কিছু করতে পারে না। পাহাড়িরা কিছু গামার আর সেগুনগাছের বাগান করেন। পুরো পার্বত্য অঞ্চলে সড়ক সম্প্রসারণ হয়েছে গত কয়েক দশকে। যেমন সীমান্ত রোড হয়েছে।
কামাল হোসাইন বলেন, এ ছাড়া এখানে বিনোদনকেন্দ্র ও রিসোর্টের সংখ্যা বাড়ছে। এটা একটা দিক। অন্যদিকে অনেক প্রভাবশালী এখন ড্রাগন, কাজু ও আমের চাষ করছেন প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে। এ অঞ্চলের বনের ওপর বহুমুখী চাপের কারণে এখানে বনাঞ্চল হ্রাস পাওয়ার হার অন্যান্য অঞ্চল থেকে বেশি।
কামাল হোসাইন আক্ষেপ করে বলেন, ‘কেউ বনকে ভালোবাসে না। মানুষের লোভের শিকার হয়েছে এখানকার প্রাকৃতিক বন। এটাই আমাদের সর্বনাশ করেছে।’