ভরদুপুর। নদীতে টইটম্বুর জোয়ার, ঢেউ এসে ধাক্কা খাচ্ছে সিঁড়ির গায়ে। চালনা লঞ্চঘাটের পুরোনো বেঞ্চে বসে আছেন মোহাম্মদ আলী শেখ। নিপুণ হাতে শসা কাটছেন। শসার পর পেঁয়াজ, তারপর গামছা দিয়ে ঢেকে রাখলেন সবকিছু। গামছার ভেতর থেকেও ঝালমুড়ির হালকা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে। তবে চারপাশে যেন অদ্ভুত এক নীরবতা। জনা পাঁচেক যাত্রী ব্যাগপত্র নিয়ে বসে আছেন। সবার গন্তব্য কয়রা। লঞ্চ আসতে দেরি, তাই অলস অপেক্ষা।

গত কয়েক বছরে খুলনার দাকোপ উপজেলার চালনা লঞ্চঘাটের চিত্র অনেকটাই বদলে গেছে। তবে মোহাম্মদ আলী শেখ বদলাননি। আগের মতোই প্রতিদিন আসেন, বসেন, ফেরি করেন—তারপর আবার ফিরে যান বাড়িতে। ৪০ বছর ধরে এই লঞ্চঘাটের সঙ্গেই জড়িয়ে আছেন তিনি। ঘাটটাই যেন তাঁর জীবনের আরেক নাম হয়ে উঠেছে।

‘এই চালনা লঞ্চঘাটেই তো জীবন পার কইরে দেলাম’, বলেন ৫৭ বছর বয়সী মানুষটি। আলীর বাড়ি ছিল খুলনার ফুলতলার দামোদর এলাকায়। এক আত্মীয়ের মাধ্যমে ১৭-১৮ বছর বয়সে আসেন চালনায়। এরপর বিয়ে করে থিতু হন চালনাতেই।

মোহাম্মদ আলী বলছিলেন, তাঁর বয়স যখন আড়াই, তখন বাবা মারা যান। তাঁর কথা কিছু মনে নেই। মানুষের বাড়িতে কাজ করে বড় হয়েছেন। পরে চালনায় চলে আসেন। শুরুতে আত্মীয়ের বাড়িতেই থাকতেন। ঘাটে আসতেন, বসতেন। এরপরই এই ঝালমুড়ি, ছোলা মাখা, পেয়ারা-আমড়া মাখার ফেরি শুরু করেন।

মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘যখন চালনায় আসি, তখন এরশাদের আমল। তখনো মানুষ চালনাকে পোর্ট বলত। লঞ্চঘাট তখন এখানটায় ছিল না, ওই তুলসীর ঘাটের দিকটায় ছিল। পরে এখানকার এই ঘাট হয়েছে। তখন পন্টুন ছিল না, ওঠানামা চলত কাঠের পাটাতন বেয়ে। কিন্তু ঘাট জমজমাট ছিল।’

একেক দিন ১৮-২০টা লঞ্চ যেত-আসত। ঘণ্টায় ঘণ্টায় লঞ্চ। ফেরিওয়ালাই ছিল ৪০-৪৫ জন। ঝালমুড়ি, চুড়ি, বইখাতা, ছবি, খেলনা, সন্দেশ—কি না বিক্রি হতো!মোহাম্মদ আলী, ঝালমুড়ি বিক্রেতা

সেই সময় চালনা ছিল খুলনার দক্ষিণাঞ্চলের প্রবেশদ্বার। দাকোপের কালাবগী, কয়রা, পাইকগাছা, আশাশুনি, শ্যামনগর, মোংলা, রামপাল, ফকিরহাট—সব রুটেই লঞ্চ চলত।

স্মৃতির ঝাঁপি খুলে মোহাম্মদ আলী বলেন, একেক দিন ১৮-২০টা লঞ্চ যেত-আসত। ঘণ্টায় ঘণ্টায় লঞ্চ। ফেরিওয়ালাই ছিল ৪০-৪৫ জন। ঝালমুড়ি, চুড়ি, বইখাতা, ছবি, খেলনা, সন্দেশ—কি না বিক্রি হতো! ফেরিওয়ালাদের একটা সমিতিও ছিল। বছর ১০-১২ আগেও এম ভি মোহাম্মদী লঞ্চেই যাত্রী যা হতো, এক লঞ্চেই দিনের রোজগার উঠে যেত।

সময় বদলেছে, আজ আর সেই দৃশ্য নেই। একসময়ের চঞ্চল লঞ্চঘাট এখন অনেকটাই থমথমে। এখন দিনে চলে মাত্র পাঁচটি লঞ্চ। চালনা ঘাটে লঞ্চ ভেড়ে শুধু দুপুরে আর রাতে।

হিসাব কষতে কষতে মোহাম্মদ আলী বলেন, দিনের বেলা তিনটা লঞ্চ চালনায় ভেড়ে। সকাল ১০টায় খুলনা থেকে ছেড়ে একটা লঞ্চ আসে দুপুর ১২টায়, আধঘণ্টা থেমে যায় কয়রার দিকে। বেলা ১১টায় ছেড়ে আরেকটা আসে ২টার দিকে, যায় জোড়সিং। আবার কয়রার দিক থেকে একটা আসে বেলা ১টার দিকে, চালনায় থেমে খুলনার দিকে যায়। তিনি আরও বলেন, সন্ধ্যা ৬টার দিকে খুলনা থেকে একটা লঞ্চ ছাড়ে, রাত ৮টায় আসে চালনায়। রাত ১১টায় খুলনা থেকে আরেকটা ছেড়ে রাতে চালনায় আসে। কয়রার দিক থেকেও রাতে দুটো লঞ্চ আসে, চালনা হয়ে যায় খুলনায়।

কাজীবাছা, পশুর আর চুনকুড়ি নদীর মোহনায় অবস্থিত চালনা বাজারের লঞ্চঘাট খুলনা ও দক্ষিণাঞ্চলের মাঝে নৌযাত্রার অপরিহার্য সংযোগস্থল। দক্ষিণে যেতে বা খুলনায় আসতে হলে নৌপথে চালনা ছুঁয়ে যেতেই হয়। তবে এখন সড়কপথ সহজ হয়েছে। খুলনা থেকে দক্ষিণের উপজেলায় কিছু সময় পরপর বাস চলে।

এখন লঞ্চে যাত্রী কমেছে, সঙ্গে কমেছে ফেরিওয়ালাদের বিক্রি। রাতে বেশ কিছু যাত্রী থাকে বটে, কিন্তু ফেরিওয়ালা থাকে না। মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘এখন ঘাটে ফেরিওয়ালা আছেন মাত্র চারজন—আমি, পরোটা বিক্রি করে দুজন, আর চুড়ি-ফিতা বিক্রি করে একজন।’

এখন আর শুধু ঘাটে বসেই নয়, মোহাম্মদ আলী কখনো কখনো লঞ্চে চড়ে পাশের ঘাটগুলোতেও বিক্রি করেন। যেদিন বোঝেন যাত্রী বেশি, কেনাবেচা ভালো হবে, সেদিন লঞ্চে চড়ে বসেন। লঞ্চে বিক্রি করতে করতে সর্বোচ্চ জয়নগর ঘাট পর্যন্ত যান। আর যেদিন মনে হয় বেচাকেনা আর হবে না, সেদিন লঞ্চ ছেড়ে গেলে তিনিও বাড়ি চলে যান।

আগে শুধু ঘাটে সময় দিলেও এখন মৌসুমে লঞ্চের ফেরির পাশাপাশি তাল ও কতবেল নিয়ে চালনা বাজারেও বসেন মোহাম্মদ আলী। তাঁর সংসার এখন স্ত্রীকে নিয়ে। বেশ প্রশান্তি নিয়ে তিনি বলেন, ‘দুজন মিলে ভালোই চলে যায়। দিনে ৪০০-৫০০ টাকা রোজগার হয়। ছেলের একটা বেকারির দোকান আছে, মেয়ে বিয়ে হয়ে গেছে। ওরা যার যার মতো আলাদা থাকে।’

কাজীবাছা, পশুর আর চুনকুড়ি নদীর মোহনায় অবস্থিত চালনা বাজারের লঞ্চঘাট খুলনা ও দক্ষিণাঞ্চলের মাঝে নৌযাত্রার অপরিহার্য সংযোগস্থল। দক্ষিণে যেতে বা খুলনায় আসতে হলে নৌপথে চালনা ছুঁয়ে যেতেই হয়। তবে এখন সড়কপথ সহজ হয়েছে। খুলনা থেকে দক্ষিণের উপজেলায় কিছু সময় পরপর বাস চলে।

সময়ের স্রোতে লঞ্চঘাটের কোলাহল অনেকটা কমে গেছে। চালনা বন্দরের মতো এই লঞ্চঘাটও হয়তো কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে, কিন্তু মোহাম্মদ আলীর মতো মানুষদের গল্পে এই ঘাটের স্মৃতি থাকবে জীবন্ত—একটা সময়, একটা জীবন, একটা ইতিহাস।

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

আজ টিভিতে যা দেখবেন (১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫)

এশিয়া কাপে আজ মুখোমুখি শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্তান। চ্যাম্পিয়নস লিগে মাঠে নামবে ম্যানচেস্টার সিটি, নাপোলি, বার্সেলোনা।

সিপিএল: কোয়ালিফায়ার-১

গায়ানা-সেন্ট লুসিয়া
সকাল ৬টা, স্টার স্পোর্টস ২

এশিয়া কাপ ক্রিকেট

আফগানিস্তান-শ্রীলঙ্কা
রাত ৮-৩০ মি., টি স্পোর্টস ও নাগরিক

অ্যাথলেটিকস

বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ
বেলা ৩টা, স্টার স্পোর্টস সিলেক্ট ১

উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ

কোপেনহেগেন-লেভারকুসেন
রাত ১০-৪৫ মি., সনি স্পোর্টস ২

ম্যানচেস্টার সিটি-নাপোলি
রাত ১টা, সনি স্পোর্টস ১

নিউক্যাসল-বার্সেলোনা
রাত ১টা, সনি স্পোর্টস ২

ফ্রাঙ্কফুর্ট-গালাতাসারাই
রাত ১টা, সনি স্পোর্টস ৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ