অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি গণহত্যার বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশটির সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন ও ইসরায়েলি কূটনীতিকদের বহিষ্কার করার দাবিতে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের ওপর চাপ ক্রমেই তীব্র হয়ে উঠছে।

বেশ কয়েকজন অধিকারকর্মী মিডল ইস্ট আইকে বলেছেন, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা ও কূটনীতিকদের বহিষ্কারের দাবিতে তাঁরা তাঁদের আন্দোলন আরও জোরদার করেছেন।

গাজায় ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু করার পর উপত্যকাটিতে দুই লাখের বেশি ফিলিস্তিনি হতাহত হয়েছেন। উপত্যকাজুড়ে এখন দুর্ভিক্ষের অবস্থা শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার বিষয়টিকে ‘যুদ্ধে সহায়তার শামিল’ হিসেবে দেখছেন অধিকারকর্মীরা।

লেখক ও অধিকারকর্মী জুকিসওয়া ওয়ানার বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকার অনেকে ভেবেছিলেন, দেশটি ২০২৩ সালের শেষ দিকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মামলা করার ফলে এ যুদ্ধের দ্রুত অবসান হবে। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলোর পূর্ণ সমর্থন নিয়ে ইসরায়েল গাজায় যুদ্ধ চালিয়ে গেছে।

ওয়ানার বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে এ গণহত্যা বন্ধে চাপ দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। কিন্তু নাগরিক হিসেবে আমরা আমাদের সরকারের কাছে অন্তত দাবি জানাতে পারি যে দক্ষিণ আফ্রিকা একটি অস্বাভাবিক ও গণহত্যাকারী সরকারের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখতে পারে না।’

গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর শুধু বলিভিয়া ও বেলিজ ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।

বাহরাইন, চাদ, জর্ডান ও তুরস্ক—মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এ দেশগুলো বিভিন্ন সময় তাদের রাষ্ট্রদূতদের প্রত্যাহার করলেও এখনো ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে।

দক্ষিণ আফ্রিকায় ২০১৮ সালের পর থেকে কোনো ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত নেই। তবে সেখানকার অধিকারকর্মীরা বলছেন, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

২০২৩ সালের নভেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকার পার্লামেন্টে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার প্রস্তাব পাস হলেও দেশটির প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার সরকার এখনো তা কার্যকর করেনি। এ নিয়ে দেশটির জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ বিরাজ করছে।

আরও পড়ুনইসরায়েলি কূটনীতিকদের আরব আমিরাত ছাড়ার নির্দেশ৫ ঘণ্টা আগে

ওয়ানার বলেন, ‘কিছু দেশ কোনো আড়ম্বর ছাড়াই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, যা আমরা করতে পারিনি।’

চলতি সপ্তাহে দক্ষিণ আফ্রিকার প্যালেস্টাইন সলিডারিটি ক্যাম্পেইন (পিএসসি) নামের একটি সংগঠন এক পিটিশন তৈরি করেছে। এতে ইসরায়েলি দূতাবাস বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে। পিটিশনে কয়েক হাজার মানুষ স্বাক্ষর করেছেন।

পিটিশনে বলা হয়েছে, ‘আপনারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যা মামলা দায়ের করেছেন। অর্থাৎ আপনারা স্বীকার করেছেন যে ইসরায়েল গণহত্যা করছে। তবে কীভাবে আমরা সেই গণহত্যাকারী রাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বহাল রাখতে পারি?’

গাজায় ইসরায়েলি যুদ্ধ ও পশ্চিম তীরে নৃশংস দখলদারির বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকাজুড়ে ছোট ছোট প্রতিবাদ কর্মসূচি হয়েছে।

চলতি সপ্তাহে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে অধিকারকর্মীরা জড়ো হন। কারণ, খবর পাওয়া যায় যে একটি জাহাজ দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে ইসরায়েলের উদ্দেশে যাচ্ছে। জাহাজে এমন মালামাল আছে, যা হয়তো গাজা যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে।

আরও পড়ুনস্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ চলবে: হামাস১১ ঘণ্টা আগে

স্থানীয় অধিকারকর্মীরা দক্ষিণ আফ্রিকার বিডিএস (বর্জন, প্রত্যাহার ও নিষেধাজ্ঞা) জোটের মাধ্যমে আরও জানতে পারে যে ভারতীয় শহর চেন্নাই থেকে ছেড়ে যাওয়া জাহাজটি ‘বিপজ্জনক পণ্য’ বহন করছে। ভারত এর আগে ইসরায়েলে ড্রোন, বিস্ফোরক ও যন্ত্রাংশ পাঠিয়েছে। ডারবানকে আরেকটি গাজা হয়ে ওঠা প্রতিরোধে তাঁরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

খবর পেয়ে শত শত মানুষ অনলাইনে সক্রিয় হন এবং পুলিশ ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে জাহাজটিতে তল্লাশি করার দাবি জানান। পরে পুলিশ জানায়, জাহাজে মানবাধিকার লঙ্ঘনে ব্যবহৃত হওয়ার মতো কিছু পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয় লোকজন এ সাড়া ও সতর্কতার প্রশংসা করেন।

আরও পড়ুনগাজায় নৃশংসতা চালিয়ে ইসরায়েল কি পশ্চিমা বিশ্বেও একঘরে হয়ে যাচ্ছে০১ আগস্ট ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য় ইসর য় ল ক টন ত ক র কর ছ ন সরক র র গণহত য

এছাড়াও পড়ুন:

জনতার ঢল ‘দ্রোহযাত্রায়’

জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের পাশাপাশি আটক সব শিক্ষার্থী ও সাধারণ নাগরিককে ছেড়ে দিতে ২ আগস্ট ‘দ্রোহযাত্রা’ কর্মসূচিতে জড়ো হন বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ। সেদিন বিকেলে ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে ‘বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ’–এর এই কর্মসূচির পাশাপাশি আরও একাধিক সংগঠন গণগ্রেপ্তার বন্ধ ও শিক্ষার্থী-জনতা হত্যার বিচারের দাবিতে প্রেসক্লাবের সামনে জড়ো হয়েছিলেন। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের কর্মসূচির নাম ছিল ‘শিক্ষার্থী-জনতার শোকযাত্রা’।

এসব কর্মসূচি ঘিরে সেদিন (২ আগস্ট ২০২৪ সাল) দুপুরে প্রেসক্লাব এলাকায় জনতার ঢল নামে। লোকে লোকারণ্য প্রেসক্লাবের সামনে কোন সংগঠনের কী কর্মসূচি, তা আলাদা করার সুযোগ ছিল না। একপর্যায়ে পুরো প্রেসক্লাবের সামনের উপস্থিতি একক গণকর্মসূচিতে রূপ নেয়। এই কর্মসূচিতে সভাপতিত্ব করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বক্তব্যে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ দাবি করেন।

সেদিন বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে আনু মুহাম্মদ তাঁর বক্তব্য শেষ করে প্রেসক্লাবের সামনে থেকে ‘দ্রোহযাত্রা’ শুরুর ঘোষণা দেন। সেখান থেকে কদম ফোয়ারা, হাইকোর্ট মোড়, দোয়েল চত্বর ও টিএসসি ঘুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যায় দ্রোহযাত্রা। শহীদ মিনারে ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে প্রথমে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। ঠিক সেই সময় সরকারের পদত্যাগ ও হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে হাজারো জনতা স্লোগান দিতে থাকেন। স্লোগান ওঠে ‘আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’, ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাইরে’, ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’, ‘খুনি সরকারের গদিতে, আগুন জ্বালো একসাথে’।

‘দ্রোহযাত্রায়’ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, সাংস্কৃতিক কর্মী, শিল্পী, আইনজীবী, উন্নয়নকর্মী, মানবাধিকারকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন। এই কর্মসূচিতে যুক্ত ছিলেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।

দ্রোহযাত্রার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণার পাশাপাশি শহীদ মিনার থেকে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন বামপন্থী ছাত্রসংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের (একাংশ) তৎকালীন সভাপতি রাগীব নাঈম। কারফিউ প্রত্যাহার, গণগ্রেপ্তার বন্ধ, বন্দীদের মুক্তি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পাশাপাশি সরকারের পদত্যাগ দাবি করেন তিনি।

দ্রোহযাত্রা কর্মসূচির অন্যতম উদ্যোক্তা ছিল বামপন্থী ছাত্রসংগঠনের মোর্চা গণতান্ত্রিক ছাত্রজোট। সে সময় এই জোটের সমন্বয়কের দায়িত্বে ছিলেন রাগীব নাঈম। সেই কর্মসূচি সম্পর্কে তিনি গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘শেখ হাসিনা সরকারের গুলি-গণগ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে কারফিউ ভেঙে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছিল ছাত্রজোট। একপর্যায়ে সর্বস্তরের মানুষকে নিয়ে একটি কর্মসূচি আয়োজনের চিন্তা মাথায় আসে। সেই চিন্তা থেকে ২৮, ২৯ ও ৩০ জুলাই বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন, শিক্ষক নেটওয়ার্ক, সাংস্কৃতিক সংগঠন, শ্রমিক ও নারী সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমরা আলোচনা করি। মানুষকে সাহস দেওয়া এবং আরও মানুষকে যুক্ত করার জায়গা থেকে দ্রোহযাত্রার পরিকল্পনা হয়।’

শুরুতে এই কর্মসূচির নাম ‘শোকযাত্রা’ ঠিক করা হয় বলে জানান রাগীব নাঈম। তিনি বলেন, বিভিন্ন স্তরের মানুষের মতামতের ভিত্তিতে কর্মসূচি ঘোষণার এক দিনের মাথায় নাম পরিবর্তন করে ‘দ্রোহযাত্রা’ করা হয়। এক-দুই হাজার মানুষের জমায়েতের লক্ষ্য ছিল। কিন্তু দ্রোহযাত্রায় আসেন হাজার হাজার মানুষ। সেদিন শহীদ মিনারে বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা ছিলেন। সবার সম্মিলিত সিদ্ধান্তে বিপুল জনসমাবেশ থেকে তৎকালীন সরকারের পদত্যাগের দাবি ঘোষণা করা হয়।

‘দ্রোহযাত্রা’ কর্মসূচির পাশাপাশি ২ আগস্ট ঢাকার ধানমন্ডির আবাহনী মাঠের সামনে ‘গণহত্যা ও নিপীড়নবিরোধী শিল্পীসমাজ’ ব্যানারে ছাত্র-জনতার হত্যার প্রতিবাদে শামিল হন শিল্পীরা। সেদিন সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টি উপেক্ষা করেই এই সমাবেশ হয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি

২ আগস্ট সারা দেশে জুমার নামাজ শেষে দোয়া ও কবর জিয়ারতের আহ্বান জানিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। মন্দির ও গির্জাতেও প্রার্থনার আহ্বান ছিল। এ ছাড়া জুমার নামাজ শেষে ছাত্র-জনতার গণমিছিলের কর্মসূচিও ছিল সেদিন। এই কর্মসূচিকে ঘিরে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের পাঁচ জেলায় সংঘর্ষ, ভাঙচুর, সংঘাত ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

ডিবি কার্যালয় থেকে ১ আগস্ট ছাড়া পাওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মুখসারির ছয় সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও নুসরাত তাবাসসুম ২ আগস্ট গণমাধ্যমে একটি যৌথ বিবৃতি পাঠান। এতে বলা হয়, আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা-সংক্রান্ত ডিবি কার্যালয় থেকে প্রচারিত ভিডিও বিবৃতিটি তাঁরা স্বেচ্ছায় দেননি।

আজ আবারও ‘দ্রোহযাত্রা’

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় সাড়া জাগানো প্রতিবাদী কর্মসূচি ‘দ্রোহযাত্রার’ বর্ষপূর্তি আজ শনিবার। ‘ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকাঠামোর বিলোপ, চব্বিশের গণহত্যাসহ পাহাড় ও সমতলের সব গণহত্যার বিচার এবং নব্য ফ্যাসিবাদী প্রবণতা প্রতিহতের প্রতিবাদে’ আজ বেলা সাড়ে তিনটায় ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘শিক্ষার্থী–শ্রমিক–জনতার দ্রোহযাত্রা’ ডাকা হয়েছে। এতে সভাপতিত্ব করবেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, যিনি গত বছরের দ্রোহাযাত্রায়ও সভাপতিত্ব করেছিলেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জনতার ঢল ‘দ্রোহযাত্রায়’